বিনয়াবনত ব্যক্তিত্ব: মির্যা খুরশেদ আহমদ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৯-জানুয়ারি, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৯শে জানুয়ারী, ২০১৮ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সদ্য প্রয়াত বিনয়াবনত ব্যক্তিত্ব মির্যা খুরশেদ আহমদ’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, দু’দিন পূর্বে জামাতের একজন একনিষ্ঠ সেবক মোহতরম সাহেবযাদা মির্যা খুরশিদ আহমদ সাহেব মৃত্যুবরণ করেছেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ্ তা’লা তাকে আধ্যাত্মিক ও শারীরিক- উভয় দিক থেকে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার সম্মান দান করেছেন। এই পৃথিবীতে যে এসেছে সে কোন একদিন চলেও যাবে- এটিই আল্লাহ্‌র নিয়ম; কিন্তু সৌভাগ্যবান তারা যারা এই ক্ষণস্থায়ী জীবনকে প্রকৃত গন্তব্যে পৌঁছাবার চেষ্টা করে এবং আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে। তারা একথা খুব ভালভাবে জানেন, কোন পুণ্যবান ব্যক্তি বা ওলীউল্লাহ্ বা নবীর বংশধর হওয়া তাদের জীবনকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেয় না বা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি পাইয়ে দেয় না, বরং মানুষের নিজের কর্ম তাকে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টিভাজন বানায়। এমনকি মহানবী (সা.)-ও হযরত ফাতেমাকে একথা বলেছেন, আমার মেয়ে বলেই তুমি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি পেয়ে যাবে না; তার জন্য নিজের জীবনকে আল্লাহ্‌র নির্দেশমত বানানোর চেষ্টা কর, আর তা ঠিকমত করার পরও এই ভয় নিজের ভেতর রাখ যে আল্লাহ্ যেন নিজ কৃপায় তা গ্রহণ করেন ও শুভ সমাপ্তি দান করেন। হুযূর বলেন, মির্যা খুরশিদ আহমদ সাহেবের সাথে আমার গভীর সম্পর্কের কারণে আমি নিজেও একথা খুব ভালভাবে জানি আর অনেকের চিঠিতেও একথা বিবৃত হয়েছে যে তিনি বিনয়ের সাথে যথাযথভাবে নিজের ওয়াকফের দায়িত্ব পূর্ণ করার চেষ্টা করেছেন। কখনোই বংশ-মর্যাদার অহংকার করেন নি। গত বছর এখানে এসে নিজের শুভ সমাপ্তির জন্য চিন্তার কথা বলেছেন, যেমনটি আল্লাহ্‌র ওলীদের বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে যে তারা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত শয়তানের আক্রমণের ভয় করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৮৫ বছর। তিনি মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রপৌত্র এবং হযরত মির্যা সুলতান আহমদ সাহেবের পৌত্র ছিলেন, তার পিতা ছিলেন মির্যা আযীয আহমদ (রা.)। তিনি ১৯৩২ সনের ১২ সেপ্টেম্বর লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২১ এপ্রিল, ১৯৪৫-এ মাত্র সাড়ে বার বছর বয়সে ওয়াকফে যিন্দেগী বা জীবনোৎসর্গের ফর্ম পূরণ করেন। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-এর নির্দেশে লাহোর সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এম.এ করেন। ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ ওয়াকেফে যিন্দেগী হিসেবে রাবওয়ার তালিমুল ইসলাম কলেজে যোগদান করেন ও ১৭ বছর সেখানে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষাদান করেন। তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমের সাথে ছাত্রদের পড়াতেন; আমি নিজেও তার কাছে পড়েছি। অধ্যাপনায় তার দক্ষতার কারণে ছাত্রদের খুব প্রিয় ছিলেন। ১৯৭৪ সালের কঠিন সময়ে খলীফা সালেস (রাহে.)-এর সহকারী হিসেবে সেবা করেছেন ও একটানা দু’তিন মাস কাসরে খেলাফতেই অবস্থান করেছেন। মুসলেহ্ মওউদের নির্দেশে এতিমদের দেখাশোনা ও তরবিয়তের জন্য ১৯৬২ সালে স্থাপিত প্রতিষ্ঠান ‘দারুল ইকামাতুন্ নুসরাত’-এর ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৮ থেকে ৮৩-এর জুলাই পর্যন্ত। বিভিন্ন সময়ে নাযের খেদমতে দরবেশান, এডিশনাল নাযেরে আলা, নাযের উমুরে আম্মা, নাযের উমুরে খারেজা, নাযেরে আলা, সদর আনসারুল্লাহ্, মজলিসে ইফতা ও কাযা বোর্ডের সদস্য হিসেবে সেবা করেছেন। ৭৩ সালে হজ্জ করার সৌভাগ্য পান। ১৯৫৫ সালে তার বিয়ে হয় যা মুসলেহ্ মওউদ (রা.) পড়ান। তার ৬ জন ছেলে, ৪ জনই ওয়াকেফে যিন্দেগী। খলীফাতুল মসীহ্ সানীকে খুব ভালবাসতেন, প্রায়ই বলতেন যে তাঁর (রা.) প্রতি বিরোধীদের বিদ্বেষ অনেক বেশি, এমনকি মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর চেয়েও বেশি। খলীফা সালেসের ব্যাপারে বলতেন যে ৭৪-এর সংকটময় সময়ে হুযূরকে সারারাত জেগে থাকতে দেখেছেন। খলীফা রাবের ব্যাপারেও বলতেন যে চরম বিপদের সময়ও তিনি হুযূরকে শান্ত থাকতে দেখেছেন। ২০১০-এ লাহোরের মর্মান্তিক ঘটনার সময়ও খুব সাহসিকতার সাথে সব বিপদের মোকাবেলা করেছেন, আর তীব্র গরমের মাঝেও প্রত্যেক শহীদের জানাযা পড়িয়েছেন, দাফন-কাফনে উপস্থিত হয়েছেন। কোন একবার কেন্দ্রীয় রিপোর্টে ভুলবশত মহানবী (সা.)-এর নামের সাথে দরূদ সংক্ষেপে লেখা হয় ও মসীহ্ মওউদ-এর নামের সাথে ‘আলাইহিস সালাম’ পুরো লেখা হয়, তখন তিনি তাদের কঠোরভাবে সতর্ক করেন যে এমন ভুল যেন না হয় এবং মহানবী (সা.)-এর নামের সাথে দরূদ পুরো লেখা হয়। নামাযের ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলেন, হাসপাতালেও চরম অসুস্থতার মাঝে নামায জমা করেন নি। নাযেরে আলা হিসেবে খলীফার প্রতিনিধি হওয়ায় ব্যস্ততা সত্ত্বেও বিয়ে-শাদি বা কারো মৃত্যুতে তাদের বাড়ি যেতেন। খলীফা সালেসের মৃত্যুর পর তাঁর জানাযা পড়ানোর ও গোসল করানোর সৌভাগ্য পান। বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ তার যেসব যিকরে খায়ের করেছেন হুযূর সেগুলোর মধ্যে থেকেও কয়েকটি উল্লেখ করেন। ডা. নূরী সাহেবের কাছে একবার কথা প্রসঙ্গে বলেন, আমি প্রত্যহ এই দোয়া করি আল্লাহ্ যেন হুযুরের সকল দোয়া গ্রহণ করেন। তার স্বাস্থ্যের রিপোর্ট দৈনিক হুযুরের কাছে পাঠানো হতো, একদিন তিনি ডা. নূরী সাহেবের হাত ধরে খুব আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বলেন, হুযূরকে কেবল অসুখ আর কষ্টের রিপোর্ট ছাড়া শোনানোর জন্য ভাল কোন কথা কি নেই? খেলাফতের প্রতি গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা রাখতেন। নসীহত করার বেলায় কেবল অন্যদেরকে করা আর নিজ পরিবারকে এর উর্ধ্বে ভাবা- এ বিষয়টি একেবারেই তার মাঝে ছিল না। হুযূর (আই.) কয়েক বছর পূর্বে খানদানে মসীহ্ মওউদ-এর সদস্যদের প্রতি একটি চিঠি লিখে পাঠান ও তাদের সকলকে একত্র করে এটি পড়ে শোনানোর নির্দেশ দেন। যখন মরহুম সবাইকে এই চিঠি পড়ে শোনান তখন খুব আবেগের সাথে বলেন, আমি স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি, যে ভুলগুলো হুযূর উল্লেখ করেছেন আমার নিজের সন্তানরাও তাতে অন্তর্ভুক্ত, আমাদের সবাইকে হুযুরের আশানুযায়ী নিজেদের সংশোধন করতে হবে। এটি ছিল তার সত্যবাদীতা ও খোদাভীতির মান। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা তার সন্তানদেরকে তার পুণ্যসমূহ প্রতিষ্ঠিত রাখার তৌফিক দিন; আল্লাহ্ তা’লা খেলাফতে আহমদীয়াকে এমন বিশ্বস্ত, নিষ্ঠাবান ও খোদাভীরু সাহায্যকারী দান করতে থাকুন। আমীন।