শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১২-জানুয়ারি, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১২ই জানুয়ারী, ২০১৮ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত খাব্বাব বিন-আরত (রা.), হযরত মাআয বিন জালাল (রা.), হযরত শাম্মাস বিন উসমান (রা.), হযরত সাইদ বিন যায়েদ (রা.), হযরত সুহায়ব বিন সিনান রূমী (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) মহানবী (সা.)-এর পবিত্রকরণ শক্তির উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস হল তাঁর (সা.) পবিত্রকরণ শক্তি এমন ছিল যা পৃথিবীর আর কোন নবী অর্জন করতে পারেন নি। ইসলামের উন্নতির রহস্যের আসল কারণ হল নবী করীম (সা.)-এর আকর্ষণী শক্তি অসাধারণ ছিল। আর তাঁর (সা.) কথায়ও সেই প্রভাব ছিল যে যে-ই তা শুনত সে বিমোহিত হয়ে যেত। যাদেরকে তিনি (সা.) আকর্ষণ করেছেন, তাদেরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ছেড়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, যখন সাহাবীদের দিকে আমরা তাকাই, তাদের মাঝে কোন মিথ্যাবাদী দেখতে পাই না; অথচ যখন এর পূর্বে আরবের অবস্থার দিকে তাকাই, তাদেরকে নিকৃষ্টতম অবস্থায় পতিত দেখতে পাই। মূর্তিপূজায় রত, এতিমদের সম্পদ গ্রাস করা এবং সর্বপ্রকার মন্দকাজে বেপরোয়া ও দুঃসাহসী ছিল, ডাকাতদের মত জীবিকা নির্বাহ করত- যেন আপাদমস্তক পাপ ও নোংরামিতে ডুবে ছিল। কিন্তু তিনি (সা.) তাদের মধ্যে এমন বিপ্লব সৃষ্টি করেন যার কোন নজির অন্য কোন জাতির মাঝে দেখা যায় না। আর তাঁর (সা.) এই ক্রিয়া এমন এক মোজেযা বা অলৌকিক ক্রিয়া ছিল যা পৃথিবীর চোখ খোলার জন্য যথেষ্ট। একজন ব্যক্তির সংশোধন করাই প্রায় দুঃসাধ্য এক কাজ, সেখানে পুরো একটি জাতিকে এমনভাবে বদলে দেয়া এবং বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সেই পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া যে সত্যের জন্য তারা গরু-ছাগলের মত নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। এটিই ইসলামের সেই উপমা যা আমরা পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করি। এই সংশোধন ও হেদায়েত বা পথপ্রদর্শনের কারণেই আল্লাহ্ তা’লা ভবিষ্যদ্বাণীরূপে তাঁর (সা.) নাম ‘মুহাম্মদ’ রেখেছিলেন অর্থাৎ তিনি (সা.) পৃথিবীতে প্রশংসিত হবেন, কেননা তিনি (সা.) পৃথিবীকে নিরাপত্তা, শান্তি, উত্তম চারিত্র্য ও সৎকর্মশীলতায় ভরে দিয়েছেন। হুযূর (আই.) বলেন, আজও আমরা দেখি, যারা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি রাখে তারা এই কথা স্বীকার না করে পারে না যে রসূলে করীম (সা.) চরম মাত্রায় অধঃপতিত, মূর্খ ও নোংরা লোকদেরকে শিক্ষিত ও খোদাপ্রাপ্ত লোকে পরিণত করেছিলেন। কয়েক বছর পূর্বে এক ইহুদী পন্ডিত আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিল, সে মসজিদুল আকসায় তার পরিদর্শনের ঘটনা বলছিল। লম্বা বর্ণনার মাঝে একটি বিষয় সে বলেছিল, সেখানকার ব্যবস্থাপক সন্দেহ করছিল যে সে মুসলমান নয়। সেই ইহুদী তার কথাবার্তায় এটি প্রকাশ করার চেষ্টা করছিল যে সে মুসলিম, এমনকি সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’ কলেমাও পড়ে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থাপক এই সন্দেহই করেন যে সে মুসলিম না। এতে সেই ইহুদী স্বীকার করে যে সে মুসলিম না, তবে কলেমা সে সত্যিই বলেছে। ইহুদী হিসেবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’তে তো সে বিশ্বাস করেই; আর মুহাম্মদ (সা.)-কে না মানলেও তিনি (সা.) যে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আগত একজন সত্য রসূল ছিলেন, এটিও সে বিশ্বাস করে। সে বলে, আমি ভালভাবে আরবদের ইতিহাস জানি, তাদের যে অবস্থা ছিল তা একজন নবীর পক্ষেই ঠিক করা সম্ভব ছিল, কোন জাগতিক নেতার পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তাই মুহাম্মদ (সা.)-কে আমি মানি বা না-ই মানি, তাঁকে অবশ্যই আল্লাহ্‌র নবী বলে বিশ্বাস করি। হুযূর (আই.) বলেন, আজও যদি কেউ ন্যায়পরায়ণতার সাথে দেখে, তবে মহানবী (সা.)-এর পবিত্রকরণ শক্তির প্রভাবে সাহাবীদের মাঝে সৃষ্ট অসাধারণ পরিবর্তন দেখে এটি স্বীকার না করে পারবে না যে তিনি (সা.) প্রকৃতই আল্লাহ্‌র রসূল ছিলেন। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) সাহাবীদের অতুলনীয় মর্যাদা, তাদের মাঝে অসাধারণ পরিবর্তন ইত্যাদি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, সাহাবীদের দৃষ্টান্ত দেখ! প্রকৃতপক্ষে তাদের উপমা সকল নবীদের উপমার মত। তারা গরু-ছাগলের মত নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আর নবুওয়তের এক চেহারা যা আদম (আ.) থেকে শুরু হয়েছিল, কিন্তু তার স্বরূপ বোঝা সম্ভব ছিল না, অথচ সাহাবীগণ তা সমুজ্জ্বল করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা কাকে বলে। যে কষ্টের জীবন তারা বরণ করে নিয়েছেন, তা-ও নজিরবিহীন। তাদের হৃদয় একীন বা দৃঢ় বিশ্বাসে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, যখন হৃদয়ে একীন থাকে তখন প্রথম দিকে মানুষ ধন-সম্পদ বিলিয়ে দেয়, আর যখন একীন বৃদ্ধি পায় তখন মানুষ আল্লাহ্‌র পথে নিজের প্রাণও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। সাহাবীদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’লা বলেন- ‘লা তুলহীহিম তিজারাতুন ওয়ালা বাইউন আন যিকরিল্লাহ্’ অর্থাৎ কোন ব্যবসা-বাণিজ্য বা ক্রয়-বিক্রয় তাদেরকে আল্লাহ্‌র স্মরণ ভুলিয়ে দেয় না- এই একটি আয়াতই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব জানার জন্য যথেষ্ট। যখন হৃদয় আল্লাহ্‌র সাথে প্রকৃত প্রেম ও সম্বন্ধ জুড়ে নেয়, তখন সে তার থেকে আর বিচ্ছিন্ন হয় না। যারা খোদার সাথে এরূপ সম্পর্ক সৃষ্টি করে ফেলে তারা কখনোই খোদাকে ভুলে যায় না আর তাঁর পথে সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকারেও কোন কুণ্ঠাবোধ করে না।

এরপর হুযূর (আই.) কয়েকজন সাহাবীর (রা.) উপমা তুলে ধরেন। হযরত খুবাব বিন আরদ (রা.) এমন একজন সাহাবী ছিলেন যিনি ইসলামের প্রাথমিক যুগে চরম কষ্ট-নির্যাতন সয়েছেন, পরবর্তীতে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন; কিন্তু নিজ সম্পদ বা কর্মের ব্যাপারে অহংকার তো দূরে থাক, সবসময় এই বিনয় ও ভয়ে থাকতেন যে আল্লাহ্ হয়তো তাকে এই পৃথিবীতেই সব প্রতিদান দিয়ে দিচ্ছেন আর তিনি হয়তো অন্য সাহাবীদের সমতুল্য নন। তার মৃত্যুর পর হযরত আলী (রা.) খলীফা হিসেবে তার জানাযা পড়ান ও ভূয়সী প্রসংশা করেন। হযরত মুআয বিন জাবাল (রা.) আরেকজন সাহাবী ছিলেন যিনি ইবাদতে অনেক অগ্রসর ছিলেন, দীর্ঘ তাহাজ্জুদ নামায পড়তেন এবং দোয়া করতেন, আল্লাহ্‌র পথে প্রচুর খরচ করতেন, করতে করতে ঋণগ্রস্ত হয়ে যেতেন আর আল্লাহ্ সেই ঋণ দূর করার ব্যবস্থা করে দিতেন। হযরত শামাস বিন উসমান (রা.) আরেকজন ছিলেন, যিনি মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালবাসার ও ইসলামের জন্য আত্মত্যাগের নমুনায় পরিণত হয়েছিলেন। উহুদের যুদ্ধে হযরত তালহার মত হযরত শামাসও রসূল (সা.)-এর সামনে ঢালের মত দাঁড়িয়ে ছিলেন, যা স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন। যখন মহানবী (সা.) শত্রুর আক্রমণে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন, তখনও শামাস (রা.) তাঁর ঢাল হয়ে ছিলেন এবং তাঁকে (সা.) রক্ষা করতে গিয়ে নিজে চরমভাবে আহত হন। এই আঘাতের ফলেই যুদ্ধের দেড়-দু’দিন পর তিনি মারা যান, মহানবী (সা.) তাকে শহীদ আখ্যা দেন ও শহীদদের মত তাকে দাফন করান। হযরত সাঈদ বিন যায়েদ (রা.), যিনি হযরত উমর (রা.)-এর বোন-জামাই ছিলেন, যাদের মুসলমান হবার খবর শুনে উমর (রা.) তাদের শায়েস্তা করতে গিয়ে নিজেই পরে ইসলাম গ্রহণ করেন, তারও হুযূর উল্লেখ করেন। তার খোদাভীতির অসাধারণ কিছু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সাহাবীদের একটি অসাধারণ গুণ ছিল তারা সত্য বলতে তিনি কাউকে ভয় পেতেন না, যার অনুপম দৃষ্টান্ত হযরত সাঈদের রয়েছে। তিনি বলতেন, সবচেয়ে বড় অন্যায় হল একজন মুসলমানের সম্মানের উপর অন্যায় আক্রমণ। হযরত সুহায়েব রূমী (রা.)-এর ইসলামের জন্য অসাধারণ আর্থিক ত্যাগের হুযূর উল্লেখ করেন। হযরত উমর (রা.)-এর ওসীয়্যত অনুসারে তিনি-ই উমর (রা.)-এর জানাযা পড়ান ও পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ইমামতি করেন। হযরত উসামা বিন যায়েদ (রা.) সেই ব্যক্তি যাকে ইমাম হাসান (রা.)-এর সাথে মহানবী (সা.) কোলে নিয়ে দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ্! আমি এদেরকে ভালবাসি, তাই তুমিও তাদের ভালবাস। অথচ এই উসামাই যখন কোন এক যুদ্ধে এক কাফেরের কলেমা পড়া সত্ত্বেও তাকে হত্যা করেন, তখন মহানবী (সা.) তার এই কাজে চরমভাবে রুষ্ট হন। সেই কাফের তো প্রাণ বাঁচাবার জন্য কলেমা পড়েছিল- উসামা এই কথা বললে তিনি (সা.) তাকে প্রশ্ন করেন, তুমি কি তার হৃদয় চিরে দেখেছিলে? উসামা বলেন, সেদিন থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করি যে কোনোদিন কোনো কলেমা পাঠকারীকে হত্যা করব না। অথচ আজ মুসলমানরা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে অন্য মুসলমানদের রক্তপাত করছে। হুযূর (আই.) মুসলমানদের বর্তমান দুর্দশার কারণ হিসেবে সাহাবীদের আদর্শ অনুসরণ না করার কথা তুলে ধরেন। শেষে হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল (সা.)-এর প্রকৃত অনুসারী ও নির্দেশাবলী মান্যকারী হবার তৌফিক দিন। আমীন।

খুতবার শেষদিকে হুযূর মোহতরমা আমাতুল মজিদ সাহেবার জানাযার উল্লেখ করেন, যিনি যুক্তরাজ্যের নায়েব আমীর চৌধুরী নাসের আহমদ সাহেবের স্ত্রী ও মৌলভী আব্দুল্লাহ্ সানৌরী সাহেবের প্রপৌত্রি ছিলেন, গত ৯ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হুযূর তার সংক্ষিপ্ত যিকরে খায়ের করেন ও তার জন্য দোয়া করেন।