ব্যাকুলচিত্তে দোয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৯-ডিসেম্বর, ২০১৭

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৯শে ডিসেম্বর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “ব্যাকুলচিত্তে দোয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আল্লাহ্‌র কৃপায় আজ থেকে কাদিয়ানের জলসা শুরু হয়েছে; দোয়া করুন যেন জলসার এই তিনটি দিন ভালভাবে অতিক্রান্ত হয়, আর যে উদ্দেশ্যে জামাতের সদস্যরা সেখানে একত্রিত হয়েছেন তা যেন তারা অর্জন করতে পারেন। আর সেই উদ্দেশ্যটি হল আল্লাহ্ তা’লার কাছে দোয়া করা, নিজেদের জ্ঞানের পরিধি ও কর্মের মানকে উন্নত করার চেষ্টা করা, আল্লাহ্ তা’লার সাথে নিজের সম্পর্ককে দৃঢ়তর করা, আর এ উদ্দেশ্যেই জলসায় অংশ নেয়া ও জলসার অনুষ্ঠানসমূহ শোনা ও তাত্থেকে উপকৃত হওয়া, জলসার আধ্যাত্মিক পরিবেশ থেকে উপকৃত হওয়া ও উপকৃত হয়ে দোয়ার প্রতি এক বিশেষ আকর্ষণের সাথে মনোযোগী হওয়া। আর এই দোয়া কেবল নিজের ব্যক্তিসত্ত্বা পর্যন্তই যেন সীমাবদ্ধ না রেখে জামাতের উন্নতির জন্যও বিশেষভাবে দোয়া করা, পৃথিবীর যে কোন স্থানে জামাতের বিরোধীরা জামাতের ক্ষতি করার জন্য যেসব ষড়যন্ত্র করছে তা ব্যর্থ করার জন্য আল্লাহ্‌র বিশেষ সাহায্য ও সমর্থনের জন্য দোয়া করা। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে তাদের ক্ষতি থেকে আমাদের রক্ষা করুন। অনুরূপভাবে সার্বিকভাবে মুসলমানদের বিদ্যমান অবস্থা এবং আল্লাহ্ ও রসূলের নামে কতিপয় গোষ্ঠী ও সরকার যেসব অত্যাচারমূলক কাজ করছে এবং মুসলমানরা একে অন্যের রক্তপাত করে চলেছে ও ধ্বংস হচ্ছে- তাদের জন্যও দোয়া করা আজ আমাদের আবশ্যক দায়িত্ব, কেননা তারা এসব অন্যায় কর্মকান্ড আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল (সা.)-এর নামে করছে এবং এর ফলে অমুসলিম বিশ্বে ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর উপর আপত্তি উঠছে, আর এগুলোর ফলশ্রুতিতে আমাদের আহমদীদেরই হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়। তাই তাদের জন্য আমাদের দোয়া করা উচিত, বিশেষভাবে যারা এখন মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পবিত্র ভূমিতে অবস্থান করছেন তাদের উচিত ব্যক্তিগতভাবেও এবং সমবেতভাবেও এই বিষয়গুলোর জন্য দোয়া করা। একইসাথে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) যে উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছেন সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হওয়ার জন্যও দোয়া করা দরকার, আর সেই উদ্দেশ্য হল মুসলমানদের সঠিক পথ লাভ, অমুসলিমদের প্রকৃত ইসলামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, তাদের সামনে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব সাব্যস্ত করে তাদের ইসলামে দীক্ষিত করা। একইসাথে সাধারণভাবে সমগ্র পৃথিবীবাসীর জন্যও দোয়া করা যেন আল্লাহ্ তাদেরকে সুবুদ্ধি দেন এবং তারা ধ্বংসের গহ্বরে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। পৃথিবীবাসীর আজ মসীহ্ মওউদের মান্যকারীদের দোয়ার খুব প্রয়োজন। তাই কাদিয়ানে উপস্থিত আহমদীদেরকে বিশেষভাবে এবং সমগ্র জামাতকে সাধারণভাবে বলছি- দোয়া করুন যেন আল্লাহ্ তা’লা পৃথিবীবাসীকে সুবুদ্ধি দেন, মুসলমানদেরকেও সুবুদ্ধি দেন যেন তারা বুঝতে পারে যে আল্লাহ্‌র প্রেরিত মহাপুরুষকে অমান্য করে তারা উন্নতি বা মুক্তি কোনটিই লাভ করতে পারবে না; নতুন বছরে প্রবেশের সময় যেন তারা একথা বুঝতে সমর্থ হয়; আল্লাহ্ করুন তাদের যেন সুমতি হয়।

হুযুর (আই.) বলেন, দোয়ার বিষয়টি এত ব্যাপক ও বিস্তৃত যে মসীহ্ মওউদ (আ.) বিভিন্ন স্থানে তাঁর বক্তব্য ও লেখনীর মাধ্যমে এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন; দোয়া কী, এর জন্য কেমন অবস্থা হওয়া উচিত, দোয়া কীভাবে গৃহীত হতে পারে, দোয়াই সকল সমস্যার সমাধান ইত্যাদি বিষয়ে তিনি (আ.) অনেক বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন এবং দোয়ায় গভীরভাবে মনোযোগ প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। হুযুর (আই.) মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বিভিন্ন উদ্ধৃতিও তুলে ধরেন। দোয়া গৃহীত হবার ব্যাপারে একটি মৌলিক বিষয় হল অন্তর বা হৃদয় পরিষ্কার হওয়া। যদি পার্থিব কোন বিষয় নিয়ে কোন ব্যক্তির প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণা থাকে তবে এমন ব্যক্তির দোয়া গৃহীত হয় না, তাই সর্বপ্রকার ব্যক্তিগত ঘৃণা ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতে হবে। দ্বিতীয়ত, দোয়া গৃহীত হবার জন্য হৃদয়ে এক উদ্বেলতা ও উদ্বিগ্ন অবস্থা সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক। কেননা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা’লা দোয়া গৃহীত হবার জন্য এই বিষয়টির উল্লেখ করেছেন যে তিনি উদ্বিগ্ন ও ব্যাকুল হৃদয়ের দোয়া শুনেন এবং তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। মুখে শুধু বকবক করে বুলি আওড়ানো কোনো দোয়া নয়, বরং প্রকৃত দোয়া তো এক মৃত্যুতুল্য অবস্থার নাম যার পরে এক নতুন জীবন লাভ হয়। তাই দোয়া করার সময় এমন উদ্বেগের সাথে তা করতে হবে যেন একেবারে মৃত্যুর মত অবস্থায় রয়েছে। এর সাথে সাথে নফল ইবাদতও জরুরী। মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, আমাদের জামাতের উচিত তারা যেন তাহাজ্জুদ নামাযকে আবশ্যক বানিয়ে নেয়; যদি বেশি না পারে তবে অন্তত দু’রাকাতই পড়ুক। এমনটি করলে অবশ্যই তার দোয়া করার সৌভাগ্য লাভ হবে, কারণ তাহাজ্জুদের নামাযের দোয়ায় এক বিশেষ বেদনাঘন অবস্থা সৃষ্টি হয়। তাহাজ্জুদে তো সেই ব্যক্তিই উঠতে পারে যার হৃদয়ে এক ব্যাকুলতা ও উদ্বেগ রয়েছে; নিশ্চিন্ত ব্যক্তি তো আর আরামের ঘুম ভেঙে তাহাজ্জুদে উঠতে পারে না। দোয়া গৃহীত হওয়ার জন্য অযথা কথা বলা থেকে নিজের জিহ্বাকে পবিত্র রাখাও জরুরী। ব্যক্তিগত কারণে যে অন্যকে কষ্ট দেয়, অন্যের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করে কথা বলে- সেই ব্যক্তির দোয়া গৃহীত হয় না। অতএব এসব বিষয় দৃষ্টিপটে রেখে দোয়া করতে হবে।

মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, মানুষ দুই ধরনের দোয়া করে থাকে। এক তো হল সাধারণভাবে যে দোয়া মানুষ করে, আরেকটি হল দোয়াকে একেবারে চরম পর্যায়ে পৌঁছানো, চূড়ান্ত পর্যায়ের উদ্বেগ ও আবেগ দিয়ে হৃদয়-নিংড়ানো দোয়া। সাধারণতঃ মানুষ বিপদে পড়লে দোয়া করে; কিন্তু উচিত হল বিপদে পড়ার আগেই দোয়া করা, কেননা কে জানে কখন কোন বিপদ এসে হাজির হবে আর সে দোয়া করার আদৌ কোন সুযোগ পাবে কি-না? আগে থেকে দোয়া করলে বিপদের সময় তা কাজে আসে। মানুষ এতটাই তুচ্ছ ও দুর্বল যে আল্লাহ্‌র সাহায্য ছাড়া সে পবিত্র হতে পারেই না আর দোয়াও করতে পারে না। কিন্তু এই সাহায্য পাওয়ার জন্যও তো ব্যাকুলচিত্তে দোয়া করা দরকার, কেননা আল্লাহ্‌র সাহায্যও দোয়ার ফলেই লাভ হয়। দোয়া গৃহীত হবার জন্য এটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে মানুষ যেন পুণ্যের ক্ষেত্রে ক্রমাগত উন্নতি করতে থাকে, সে যেন ক্রমাগত সামনে অগ্রসর হয় ও কখনো পশ্চাদপদ না হয়।

মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, এ যুগে বিজয়ের জন্য মসীহ্ মওউদকে কেবল একটি অস্ত্রই দেয়া হয়েছে- তা হল দোয়া। আমাদের সকল সাফল্য ও বিজয় কেবল ও কেবলমাত্র দোয়ার মাধ্যমেই হবে। আর দোয়ার মাঝে এমন অসাধারণ শক্তি রয়েছে, যা জগতের বড় বড় পরাশক্তিকেও নিমিষে পরাভূত করে দেয়। আর যে অস্ত্র আল্লাহ্ তা’লা মুহাম্মদী মসীহ্‌কে তার মিশনে বিজয়ের জন্য দিয়েছেন, সেই একই অস্ত্রের মাধ্যমে এই মিশনকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে হবে তার জামাতের সদস্যদেরকে, অন্য কোন অস্ত্র এখানে বেকার। হুযুর (আই.) সাধারণ মুসলমানদের জন্য হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর একটি দীর্ঘ আবেগঘন ও ব্যাকুল দোয়া পড়ে শোনান। হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা মুসলিম উম্মতের চোখ খুলে দিন, আর তারা আল্লাহ্‌র প্রেরিত ব্যক্তির বিরোধিতা পরিত্যাগ করে তাঁর (আ.) সাহায্যকারী ও সহযোগীতে পরিণত হোক; আর আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকেও দোয়ার দাবী পূর্ণকারী বানান, বিশেষভাবে কাদিয়ানে জলসায় অংশগ্রহণকারীরা দোয়ার প্রতি গভীর মনোযোগ দিন, আর এই জলসায় অংশগ্রহণ নিজেদের ভেতর এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের কারণ বানান- আল্লাহ্ তা’লা সকলকে এর তৌফিক দান করুন। আমীন।