আদর্শ মানব (ক্রমশ:)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২২-ডিসেম্বর, ২০১৭

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২২শে ডিসেম্বর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “আদর্শ মানব (ক্রমশ:)”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, গত খুতবায় আমি সাহাবীদের (রা.) অতুলনীয় মর্যাদা, গুণাবলী ও আদর্শ বিষয়ে বর্ণনা করেছিলাম। কয়েকজন সাহাবীর জীবনালেখ্য আলোচনা করেছিলাম; আরও করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সময়ের অভাবে তা করতে পারি নি। পরবর্তীতে অনেকের চিঠির প্রেক্ষিতে আমার মনে হল অন্তত যতটুকু আমি নোট করেছিলাম তা বর্ণনা করে দিই, যেন একদিকে সাহাবীদের জীবন ও তাদের কুরবানী সম্পর্কেও জানা যায়, অন্যদিকে তাদের আদর্শ অবলম্বন করার প্রতিও আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ হয়। অর্থাৎ আজ আমি সেই প্রসঙ্গেই কথা বলব। অতঃপর হুযুর (আই.) একে একে আরও বেশ কয়েকজন সাহাবীর বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেন।

মহানবী (সা.)-এর একজন মহান সাহাবী ছিলেন আবু উবায়দা বিন জাররাহ। সাহাবী হিসেবে তো তিনি অসংখ্য গুণের অধিকারী ছিলেনই, তবে তার বিশেষ একটি গুণ স্বয়ং মহানবী (সা.) উল্লেখ করেছেন- তা হল তার আমানতদারী। মহানবী (সা.) বলেন, প্রত্যেক উম্মতেই একজন আমীন থাকে; আর হে আমার উম্মত! আমাদের আমীন হল উবায়দা বিন জাররাহ। উহুদের যুদ্ধে শত্রুর পাল্টা আক্রমণে মুসলিম বাহিনী চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় এবং মহানবী (সা.)-ও শত্রুদের ছোঁড়া পাথরের আঘাতে প্রচন্ড আহত হন। তাঁর (সা.) মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণের দু’টি কীলক গেঁথে যায়। সেসময় আবু উবায়দা (রা.) দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে একটি একটি করে কীলক বের করেন, এটি করতে গিয়ে দু’বারে তার সামনের দু’টি দাঁত পড়ে যায়। তার বিনয়, অন্যকে কাজে সহযোগিতা করার ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে কার্য সমাধা করার একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। একবার এক যুদ্ধাভিযানে আমর বিন আস (রা.)-এর নেতৃত্বে মহানবী (সা.) একটি দল প্রেরণ করেন, পরবর্তীতে তাদের সহযোগিতার জন্য আবু উবায়দা (রা.)-এর নেতৃত্বে আরেকটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন এবং বলে দেন যে উভয় নেতা যেন পরস্পর পরামর্শ ও সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করেন। এদিকে আমর বিন আস ভাবেন, এই সৈন্যদল তো তাকে সাহায্য করতে এসেছে, তাই তারাও তারই নেতৃত্বাধীন। তিনি এককভাবে নেতৃত্ব দিতে থাকেন, যদিও নতুন আসা দলের অনেকেই প্রকৃত বিষয় তার কাছে বলেছিলেন। তখন আবু উবায়দা বলেন, যদিও আমাকে মহানবী (সা.) স্বাধীন নেতা বানিয়ে পাঠিয়েছেন, কিন্তু একইসাথে তিনি (সা.) পরস্পর সহযোগিতারও নির্দেশ দিয়েছেন, তাই আমি আপনার সহযোগিতাই করব। আপনি আমার কথা না মানলেও আমি আপনার সব কথাই মানব। এটি হচ্ছে পরিস্থিতি অনুসারে মুসলমানদের বিজয়ের নিমিত্তে নেতৃত্ব পেয়েও তা কুরবানী করা। এই আদর্শ অনুসরণ করলে আজও মুসলমানরা এক বিরাট পরাশক্তিতে পরিণত হতে পারে।

হুযুর (আই.) হযরত আব্বাস (রা.)-এরও উল্লেখ করেন; মহানবী (সা.) স্বয়ং বলেছেন, আব্বাস (রা.) কুরায়শদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদার ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী। এটি শুনে হযরত আব্বাস (রা.) সাথে সাথে ৭০ জন দাসকে মুক্ত করে দেন। হযরত জাফর (রা.)-ও একজন মহান সাহাবী ছিলেন, মহানবী (সা.)-এর চাচাতো ভাই এবং হযরত আলী (রা.)-এর আপন ভাই ছিলেন। তিনিও ইসলামের প্রারম্ভিক যুগেই ইসলাম গ্রহণ করেন, মক্কার লোকদের অত্যাচার সয়েছেন, পরবর্তীতে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। মক্কার কাফেররা যখন ষড়যন্ত্র করে দু’জনকে আবিসিনিয়ায় পাঠায় সেখানকার সম্রাটকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে এদেরকে ফেরত আনানর জন্য, তখন সম্রাট নাজ্জাশী মুসলমানদেরকে ডেকে প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। সেসময় হযরত জাফর (রা.) মুসলমানদের পক্ষে জবাব দেন। তার বাগ্মিতাপূর্ণ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উত্তরে কাফেরদের সব ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায় এবং বাদশাহ নাজ্জাশীও মুসলমানদের ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানান।

আরেকজন সাহাবী ছিলেন হযরত মাসআব (রা.)। তিনি অনেক বিলাসীতার মাঝে বড় হয়েছিলেন, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর পরিবারের লোকদের বিরোধিতা ও অত্যাচারের শিকার হন এবং হতদরিদ্রভাবে দিনাতিপাত করেন। কেবলমাত্র আল্লাহ্ ও রসূলের খাতিরে তিনি চরম কষ্টকর জীবন হাসিমুখে বরণ করে নেন। তার বিশেষ গুণ ছিল তিনি খুব সুন্দরভাবে তবলীগ করতে পারতেন। মদীনার অনেকেই তার তবলীগে মুসলিম হন।

এমনিভাবে একজন সাহাবী ছিলেন সাদ বিন রাবী আনসারি (রা.)। মহানবী (সা.) আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন প্রতিষ্ঠা করে দিলে পরে তিনি তার নতুন ভাই আবদুর রহমান বিন আওফকে অর্ধেক সম্পত্তি এমনকি একজন স্ত্রীও দিয়ে দিতে চান; যদি হযরত আবদুর রহমান তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। এই সাহাবী উহুদ যুদ্ধে শহীদ হন; মৃত্যুর পূর্বে তিনি আনসারদের শেষ যে ওসীয়্যত করে যান তা ছিল- রসূলুল্লাহ্ (সা.) আনসারদের জন্য সবচেয়ে মহান ও মূল্যবান আমানত, তারা যেন নিজেদের জীবন দিয়েও এই আমানতের নিরাপত্তা বিধান করে। হুযুর (আই.) হযরত উসায়দ (রা.) ও আবি বিন কাব (রা.)-এরও উল্লেখ করেন। হযরত উসায়দ (রা.)-এর খোদাভীতি, ইবাদত ও নামাযের প্রতি গভীর ভালবাসার নমুনাস্বরূপ দু’টি ঘটনা হুযুর (আই.) উল্লেখ করেন। হযরত আবি বিন কাব (রা.)-এর আমানতদারী ও দরূদপাঠের ক্ষেত্রে অতুলনীয় আদর্শের ঘটনা হুযুর (আই.) বর্ণনা করেন।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) সাহাবীদের গুণগান করে যেসব কথা বিভিন্ন বৈঠকে বা বইয়ে উল্লেখ করেছেন তার কয়েকটি উদ্ধৃত করেন। অতঃপর হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এসকল উজ্জ্বল নক্ষত্রের আদর্শ অনুসরণ করে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল (সা.)-এর প্রেমিক হবার তৌফিক দান করুন, আর আমাদেরও প্রত্যেকটি কর্ম যেন আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হয় সেই তৌফিক দান করুন। আমীন।

খুতবার শেষে হুযুর হল্যান্ডের বয়আতকারী আহমদী মোকাররমা আরিশা ডেফেন্থলার সাহেবার, যিনি ফাহিম ডেফেন্থলার সাহেবের স্ত্রী ছিলেন এবং গত ১১ ডিসেম্বর বেনিনে ৬২ বছর বয়সে অকস্মাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তার গায়েবানা জানাযার উল্লেখ করে তার যিকরে খায়ের করেন ও তার আত্মার মাগফিরাত ও ক্রমাগত উন্নতির জন্য দোয়া করেন।