হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সত্যতা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৪-নভেম্বর, ২০১৭

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৪শে নভেম্বর, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সত্যতা”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, গত খুতবায় আমি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বরাতে বলেছিলাম, মানুষ যদি বিদ্বেষ এবং সবরকম একগুঁয়েমি থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহ্ তা’লার কাছে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সত্যতা সম্পর্কে জানার জন্য দোয়া করে, তবে ৪০ দিন পার হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ্ তা’লা তাকে পথপ্রদর্শন করবেন। কিন্তু এজন্য হৃদয় পরিষ্কার হওয়া ও সর্বপ্রকার বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হওয়া আবশ্যক। নতুবা যারা হৃদয়ে ঘৃণা বা ক্রোধ রাখে কিংবা যাদের হৃদয় পরিষ্কার নয়, তাদের সম্পর্কে তিনি (আ.) বলেছেন যে, তারা তো একথাই বলবে আল্লাহ্ তাদেরকে স্বপ্নে পথপ্রদর্শন করেন নি বা তাঁর বিরুদ্ধে বলেছেন। যারা স্বচ্ছ্ব হৃদয়ে দোয়া করেছে তারা অবশ্যই পথনির্দেশনা পেয়েছে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যুগেও এমনটি ঘটেছে। একবার তাঁর (আ.)-এর এক বৈঠকে লাহোর থেকে আসা একটি চিঠির উল্লেখ করা হয় যার লেখক এটি বলেন, তিনি স্বপ্নে জানতে পারেন, মির্যা সাহেব সত্য। এই ব্যক্তি এক ফকিরের মুরীদ ছিলেন; যখন ফকিরের কাছে এটি বলেন তখন সেই ফকিরও বলেন, মির্যা সাহেবের এত দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমাগত উন্নতি করতে থাকা খোদা তা’লার সমর্থনের লক্ষ্মণ। সেখানে থাকা আরেক ফকির বলেন, দাঁড়াও, আমিও আল্লাহ্‌র কাছে জিজ্ঞেস করব। পরদিন সেই ফকির বলেন, আল্লাহ্ বলেছেন-মির্যা হলেন মওলা। মসীহ্ মওউদ (আ.) এটি উল্লেখ করে বলেন, অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে- আল্লাহ্ চাইছেন যেন মানুষ স্বপ্ন ইত্যাদির মাধ্যমেও হেদায়েত লাভ করে। আল্লাহ্‌র ফেরেশতারা সর্বত্র আকাশে পঙ্গপালের মত ছেয়ে আছেন এবং মানুষের হৃদয়ে এই কথা সঞ্চার করছেন- ‘মেনে নাও, মেনে নাও’। তিনি (আ.) আরেক ব্যক্তির উল্লেখ করেন যে, তাঁর (আ.) বিরুদ্ধে জবাবমূলক বই লিখতে মনস্থ করেছিল, কিন্তু স্বপ্নে দেখে যে মহানবী (সা.) এসে তাকে বলছেন, ‘তুমি তো তার বিরুদ্ধে লিখতে চাচ্ছ, কিন্তু মির্যা সাহেব সত্যবাদী।’ হুযুর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ এভাবে ভাল লোকদের পথপ্রদর্শন করেন। সেই ব্যক্তি বিরুদ্ধবাদী ছিল, কিন্তু তার কোন পুণ্য হয়তো আল্লাহ্‌র পছন্দ হয়েছিল, তাই তাকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য স্বপ্নে নির্দেশনা দান করেন।

হুযুর (আই.) বলেন, এই ধারা যা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যুগে শুরু হয়েছিল তা আজও চলমান রয়েছে। পুণ্য স্বভাবের ব্যক্তিরা ইমাম মাহদীর আগমন সম্পর্কে জানেনও না, কিন্তু আল্লাহ্ স্বপ্নে নির্দেশনা দান করেন যে ইমাম মাহদী এসে গেছেন। আবার কেউ কেউ তাঁর (আ.) দাবী সম্পর্কে জানার পর যখন আল্লাহ্‌র কাছে পথনির্দেশনা যাচনা করেন তখন তাদেরকে আল্লাহ্ পথপ্রদর্শন করেন। এরকম একটি ঘটনা পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি থেকে সেখানকার মোবাল্লেগ সাহেব লিখে পাঠিয়েছেন। মোস্তফা দিয়ালু নামের এক ভদ্রলোক একদিন স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি জান্নাতে খুব সুন্দর একটি ঘরে বসে আছেন, ঘরের একদিকে খুব সুন্দর পাগড়ি পরা শ্বেত-শুভ্র এক বুযুর্গের ছবি ছিল। কয়েকদিন পর তিনি তার এক বন্ধুর ঘরে গিয়ে সেই ব্যক্তির ছবি দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারেন- ইনি ইমাম মাহদী। পরে তিনি বন্ধুর সাথে গিয়ে জামাতের সাধারণ সভায় অংশ নেন ও সভার পরে তার আহমদীয়াত গ্রহণের ঘোষণা দেন, তবে সেদিন বয়আত না করে পরদিন নিজের সব ভাই-বোনদের সাথে নিয়ে একসাথে বয়আত করবেন বলে জানান। সেদিন বাড়িতে গিয়ে সেহরির সময় সব ভাই-বোনদের এ বিষয়ে বললে তারা ভাল-মন্দ বলতে শুরু করে এবং তাকে বয়আত করা থেকে নিরস্ত করতে চায়। দিয়ালু সাহেব নিশ্চিত করেন যে তিনি অবশ্যই বয়আত করবেন। ফজর পড়ে শোবার পর তিনি স্বপ্নে দেখেন, মসীহ্ মওউদ (আ.) এসে তাকে সূরা হিজরের ৩০/৩৫ আয়াত পড়তে বলছেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি মিশন হাউজে গিয়ে সবকিছু বললে পরে মোবাল্লেগ সাহেব তাকে সেই আয়াতগুলো খুলে দেখান যে, সেখানে ফেরেশতাদের আদম (আ.)-কে মানার ও ইবলিসের না মানার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ দিয়ালু সাহেবের বয়আত করা ফেরেশতাদের অনুরূপ কাজ হয়েছে।

ইয়েমেনের এক ভদ্রমহিলা জামিলা সাহেবা নিজের ঘটনা লিখেন, তিনি যখন সৌদি আরবে ছিলেন তখন কাদেরিয়া তরিকার সূফী মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তাদের কার্যবিধি অনুসারে একশ’ বার করে সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি ও সূরা ইখলাস এবং এক হাজার বার করে দরূদ ও ইস্তেগফার পড়ার পর একদিন রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন, আকাশ থেকে চাঁদের মত বড় এক তারা মাটিতে নেমে চলাফেরা করছে ও এরপর তার বাড়িতেও এসেছে। কয়েকদিন পর আরেকটি স্বপ্নে দেখেন, আগের তারার চেয়ে কিছুটা ছোট পাঁচটি তারা মাটিতে নেমে এসে এক সারিতে চলছে। অর্থাৎ প্রথম তারা মসীহ্ মওউদ (আ.) ও পরের তারাগুলো তাঁর (আ.) খলীফাগণ। পরবর্তীতে তিনি এমটিএর সন্ধান পান, এতে ইস্তেখারার নির্দেশনা শুনে সেই অনুযায়ী ইস্তেখারা করেন ও প্রথম রাতেই স্বপ্নে নির্দেশনা পেয়ে যান এবং বয়আত করেন। হুযুর (আই.) ইয়েমেনের সাম্প্রতিক করুণাবস্থার উল্লেখ করেন যে সৌদি আরব তাদেরকে সমুদ্র ও আকাশপথে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, যার ফলে তারা বহির্বিশ্ব থেকে কোনরকম সাহায্য পাচ্ছে না। হুযুর (আই.) দোয়ার আবেদন করেন যেন আল্লাহ্ তাদের উপর করুণা করেন, তাদের এই কষ্টকর অবস্থা দূর হয় ও তারা স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারে।

মিসরের এক বন্ধু মাহমুদ সাহেব লিখেন যে তিনি নয় বছর বয়স থেকে স্বপ্নে কোন একটি আওয়াজ শুনতে পেতেন যার অর্থ তিনি বুঝতেন না। ২০১০-এ এসে যখন তিনি এমটিএ-তে আলহিওয়ারুল মুবাশির অনুষ্ঠান দেখেন তার পরে তিনি বুঝতে পারেন যে এতদিন স্বপ্নে তিনি এই আওয়াজই শুনতে পেতেন। মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর লেখনী ও কবিতাসমূহ তার হৃদয় ছুঁয়ে যেত। একদিন তিনি এমটিএ দেখার সময় মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ছবির দিকে তাকিয়ে আল্লাহ্‌র কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনি নিজেই বলুন আপনার দাবী সত্য না মিথ্যা। এরপর তিনি কাজে চলে যান। সন্ধ্যায় ফিরে যখনই তিনি টিভি ছাড়েন তখন মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর একটি উদ্ধৃতি পড়া হচ্ছিল যাতে তিনি আরবীতে কসম খেয়ে দাবী করেছেন যে, তিনি আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আগত। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন যে আল্লাহ্ এভাবে তাকে জবাব পাইয়ে দিয়েছেন, অতঃপর তিনি বয়আত করেন।

হুযুর (আই.) এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা বর্ণনা করেন। এসব ঘটনার কোন কোনটি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ যেমন মালি, আইভরি কোস্ট ইত্যাদি দেশের, কোনটি সিরিয়া, জর্ডান, মিসর ইত্যাদি আরব দেশের, কোনটি বা ফ্রান্স, কানাডাসহ ইউরোপ ও আমেরিকার পশ্চিমা দেশের। মোটকথা বিশ্বের এমন কোন প্রান্ত বাকি নেই যেখানে পুণ্য প্রকৃতির লোকেরা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে সরাসরি পথনির্দেশনা লাভ করছে না। এটি যেমন একদিকে মসীহ্ মওউদ ও ইমাম মাহদী হিসেবে হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)-এর সত্যতার তাজা নিদর্শন, অন্যদিকে এরকম অজস্র ঘটনা সংঘটিত হওয়া নির্দেশ করছে যে এটিই প্রকৃতপক্ষে প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও ইমাম মাহদীর যুগ। হুযুর (আই.) বলেন, আমি গুটিকয়েক মাত্র ঘটনা উল্লেখ করলাম, এরকম অজস্র ঘটনা রয়েছে ও ঘটছে। হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা এসব নবাগতদের ঈমান ও দৃঢ়তায় উন্নতি দান করুন, তাদের নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততায় বৃদ্ধি করুন, আর আমরা যারা পুরনো আহমদী- আমাদের প্রত্যেককে নিষ্ঠা ও বিশ্বাসে উন্নতি দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন। সুম্মা আমীন।