আহমদীয়াতের সত্যতার প্রমাণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৭-জুলাই, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৭ই জুলাই, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্‌ মসজিদ থেকে “আহমদীয়াতের সত্যতার প্রমাণ”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, নবীদের ইতিহাসে আমরা এটি দেখতে পাই যে যখন তাদের জামা’ত প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তাদের অনেক বিরোধিতাও হয়, আর জামা’ত যত বিস্তৃতি লাভ করে বিরোধিতাও ততই বৃদ্ধি পায়। বিরোধিরা যতদূর তাদের সাধ্যে কুলায় বিরোধিতা করতে থাকে; কিন্তু দাবীকারী যেহেতু আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে হয়ে থাকেন এবং আল্লাহ্‌র কাছ থেকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি পেয়ে থাকেন, তাই বিরোধীদের শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র তাদের উন্নতির পথে কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না আর পারবেও না। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে আল্লাহ্ তা’লা প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী হিসেবে পাঠিয়েছেন, তাই তাঁর ক্ষেত্রেও নবীদের মত বিরোধিতা হবার এই রীতি অনুসৃত হওয়ার ছিল এবং আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে সাহায্য ও সমর্থন লাভের কথা ছিল; বাস্তবে তা-ই হয়েছে। একইভাবে তাঁর (আ.) জামা’তের সাথেও আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি সেভাবেই পরিপূর্ণ হচ্ছে। বিরুদ্ধবাদীদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’লা পূর্বেই সংবাদ দিয়ে রেখেছেন যে তাদের পরিণাম অশুভ হবে এবং মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রতি আল্লাহ্‌র সাহায্য ও সমর্থন থাকবে। এ সংক্রান্ত অনেকগুলো ইলহাম হুযুর (আই.) উদ্ধৃত করেন। তার মধ্যে একটি হল, ‘তোমার প্রতি যারা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা রাখে আমি তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করব’। আরেকটি হল ‘এমন লোকেরা তোমার সাহায্য করবে যাদের হৃদয়ে আমরা আকাশ থেকে ইলহাম করব’। একটি ইলহামে আল্লাহ্ বলেন, ‘আমি তোমাকে সম্মান দান করব ও তা বৃদ্ধি করব’। একটি ইলহাম হল, ‘ইয়ানসুরুকাল্লাহু মিন ইনদিহি’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ্ নিজের পক্ষ থেকে তোমাকে সাহায্য করবেন’। মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বাণীর প্রচার সম্পর্কে আল্লাহ্‌র ইলহাম, ‘আমি তোমার প্রচারকে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছাব’। এই ইলহামও হয়েছে যে ‘কাতাবাল্লাহু লাআগলিবান্না আনা ওয়া রুসুলি’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ্ এটি নির্ধারণ করে রেখেছেন যে আমি ও আমার রসূলগণ অবশ্যই বিজয়ী হব’। সাহায্য ও সমর্থন লাভের এরকম আরও অজস্র ইলহাম রয়েছে। এমনটি নয় যে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এসব কথা (না’ঊযুবিল্লাহ্) আল্লাহ্‌র প্রতি মিথ্যারূপে আরোপ করেছেন, বরঞ্চ আল্লাহ্ তা’লা প্রত্যেক যুগে এগুলোকে বাস্তবে পরিণত করেছেন এবং বিরোধিদের ষড়যন্ত্র উল্টো তাদের উপরই আপতিত হয়েছে। অনেক ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা’লা স্বয়ং আহমদীয়াতের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন, বিরোধীদের আক্রমণের প্রেক্ষিতে তাঁর (আ.) মান্যকারীদের সাহায্য করেছেন এবং স্বীয় প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন।

এরপর হুযুর (আই.) সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। ভারতের একজন মোয়াল্লেম ইসহাক সাহেব রমযানের প্রারম্ভে কোন গ্রামে তরবিয়তি কাজে গেলে ইকবাল নামক এক বিরুদ্ধবাদী যুবক তার সাথে চরম অশিষ্ট আচরণ করে ও তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, শেষমেশ তাকে এই বলে শাসায় যে ভবিষ্যতে তিনি সেই গ্রামে গেলে তাকে কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে। মোয়াল্লেম সাহেবও তাকে বলে দেন যে, তার এরূপ আচরণের কারণে তার ভয়াবহ পরিণতি হবে। ঈদের ছুটি শেষে এসেই মোয়াল্লেম সাহেব জানতে পারেন যে সেই যুবক হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছে। তার এহেন পরিণতিতে গ্রামবাসীও অত্যন্ত প্রভাবান্বিত হয়। ইয়েমেনের এক আহমদী রানা সাহেবের ক্ষেত্রেও প্রায় অনুরূপ ঘটনা ঘটে। তিনি যেহেতু তবলীগ করতেন তাই যুবকদের একটি দল নিয়মিত তাকে হুমকি দিয়ে আসছিল, একবার এক মৌলভীর সাথে তাকে তর্ক করতেও বাধ্য করে ও মোবাহালার চ্যালেঞ্জ দেয়। এরা তাকে হত্যার পরিকল্পনায় লিপ্ত ছিল, অথচ তার দোয়ার পরিণতিতে এরা নিজেরাই মারামারিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং সংগঠন ভেঙ্গে গিয়ে তাদের পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়। বেনিনে এক স্থানে জামা’ত কায়েম হবার পর মোল্লারা অনেক বিরোধিতা করেও যখন আহমদীদের নিরস্ত করতে বিফল হয়, তখন তারা গ্রামের রাজার কাছে গিয়ে বিভিন্ন মিথ্যা কথা বলে তাদেরকে আহমদীয়াত থেকে বিচ্যুত করতে বলে। গ্রামের রাজা প্রেসিডেন্ট সাহেবকে ডেকে বিভিন্নভাবে আহমদীয়াত ছাড়তে বলে, শেষমেশ গ্রামছাড়া করার হুমকি দেয়। কিন্তু আহমদীরা এতদসত্ত্বেও ঈমানে অটল থাকায় রাজা খুবই আশ্চর্য হয় এবং তাদেরকে শান্তিতে ধর্ম পালনের অনুমতি দেয়। বেনিনেই একস্থানে রেডিওতে প্রতি বুধবার ৩০ মিনিটের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে তবলীগের কাজ চলতো। কিন্তু রেডিও স্টেশনের ডাইরেক্টর জামা’তের বিরোধী ছিল এবং সেই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার পাঁয়তারা করছিল। আল্লাহ্‌র আশ্চর্য লীলা এই যে কয়েকদিন পরই সেই ডাইরেক্টর দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হয়, আর নতুন ডাইরেক্টর সেসব অনুষ্ঠান শুনে এতই প্রভাবিত হয় যে জামা’তকে অতিরিক্ত কোন ফি ছাড়াই আরও অনুষ্ঠান সম্প্রচারের অনুমতি দিয়ে দেয়। সিরিয়া, মিসর, মরক্কো, ইয়েমেন ইত্যাদি দেশে বসবাসকারী কয়েকজন ব্যক্তির ঘটনা হুযুর (আই.) উল্লেখ করেন যাদের কেউ কেউ আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে স্বপ্নে দিকনির্দেশনা লাভ করে আহমদীয়াত গ্রহণ করেন, কেউ আবার জামা’তের অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ ও দলিল দেখে সেই সৌভাগ্য লাভ করেন, কেউ কেউ এম.টি.এ দেখে সত্য বোঝার ও মানার তৌফিক পান। আহমদীয়াতের কল্যাণে তাদের ঈমানে প্রভূত উন্নতি হয়েছে, তাদের কেউ কেউ সরকারবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হবার পর তা থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। মোটকথা আহমদীয়াতের উন্নতির ও ঐশী সাহায্য লাভের যেসব প্রতিশ্রুতিই আল্লাহ্ তা’লা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে প্রদান করেছিলেন তা তিনি পূর্ণ করে চলেছেন এবং বিরোধিতার মাঝেও তাঁর জামা’তকে বৃদ্ধি করে চলেছেন।

হুযুর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আরও কয়েকটি ইলহাম উদ্ধৃত করেন যেগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে তাঁর (আ.) মৃত্যুর পরও এই জামা’ত ঐশী সাহায্য-সমর্থন লাভ করতে থাকবে এবং কেয়ামত পর্যন্ত আহমদীয়া জামাত অন্যদের উপর বিজয়ী থাকবে। এর মাঝে একথা প্রচ্ছন্ন যে অন্যান্য মুসলমান দলও কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে যারা হঠকারিতা দেখিয়ে আহমদীয়াত গ্রহণ করবে না, কিন্তু তাদের করুণ অস্তিত্বই সাক্ষ্য দিবে যে আহমদীয়াত সত্য ও বিজয়ী। হুযুর (আই.) বলেন, দলিল-প্রমাণের দিক থেকে তো আমরা বিজয়ী রয়েছিই, সংখ্যাধিক্যের দিক থেকেও আমরা বিজয়ী হব, ইনশাআল্লাহ্। কিন্তু আমাদের জন্য আবশ্যক হল আল্লাহ্ তা’লার এই করুণা লাভের জন্য নিজেদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় উন্নত হওয়া, হুযুর (আই.) দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন আমাদের সেই তৌফিক দান করেন (আমীন)। সবশেষে হুযুর (আই.) জামা’তের বিজয়ের ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’লার অমোঘ প্রতিশ্রুতি সম্বলিত হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর দ্ব্যর্থহীন একটি ঘোষণা উদ্ধৃত করেন।