নামায, জুমুআ ও রমযান

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৩-জুন, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৩শে জুন, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্‌ মসজিদ থেকে “নামায, জুমুআ ও রমযান”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, রমযানের কল্যাণময় মাস এসেছিল এবং খুব দ্রুততার সাথে শেষও হয়ে গিয়েছে। দিন অনেক দীর্ঘ হওয়া সত্ত্বেও এবং তীব্র গরম হওয়া সত্ত্বেও আমার সাথে যারা সাক্ষাৎ করেছেন তাদের অধিকাংশই এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে এ বছর রোযার কষ্ট বলতে গেলে টেরই পাই নি, বা কঠিন পরিবেশের তুলনায় কষ্ট হয় নি বললেই চলে। হুযুর (আই.) বলেন, কিন্তু রমযান আসা এবং কোন রকম কষ্ট টের পাওয়া ছাড়াই পার হয়ে যাওয়া আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়; যদি এমনটি হয়েও থাকে তবে তা আল্লাহ্ তা’লার কৃপা যে বিশেষ কোন কষ্ট ছাড়াই রমযান অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। বরং আমাদের নিজেদের হিসাব নেয়া প্রয়োজন যে আমরা আল্লাহ্ তা’লার এই বরকতপূর্ণ দিনগুলোতে কী করেছি, আমাদের অর্জনের খাতায় কী কী রয়েছে, আল্লাহ্‌র কৃপা ও দয়া লাভের জন্য কী করেছি বা কী কী প্রতিজ্ঞা করেছি এবং কতটুকু পরিবর্তন নিজেদের মাঝে এনেছি। যদি এই আত্মবিশ্লেষণ এবং সে অনুযায়ী নিজেদেরকে পরিবর্তনের জন্য অবিচল প্রতিজ্ঞা আমরা করে থাকি এবং পরিবর্তন সাধন করে থাকি, তাহলে আমরা আল্লাহ্ তা’লার স্থায়ী কৃপার অধিকারী হতে পারব। যদি আমরা রমযানে নিয়মিত নামায পড়ি, জুমআয় উপস্থিত হই, কুরআন তেলাওয়াত করি, দরূদ পাঠ ও যিকরে এলাহীতে রত থাকি, উন্নত চরিত্র ও নৈতিকতা প্রদর্শন করি এবং রমযান শেষে এসব কাজে অনিয়মিত হয়ে যাই বা ছেড়ে দেই, তবে তা আল্লাহ্‌র নির্দেশমত চলার নাম নয়। আল্লাহ্ তা’লা এটি চান না যে আমরা রমযানে বাধ্য হয়ে পুণ্যকাজ করি এবং পরে তা ছেড়ে দিয়ে যেমন ছিলাম তেমনই হয়ে যাই; বরং রমযান একটি ট্রেনিং ক্যাম্পের মত হয়ে থাকে যাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে মানুষ সারা বছর এসব পুণ্যকাজ সম্পাদন করবে, এগুলোতে আরও উন্নতি করবে এবং অবিচলতার সাথে পুণ্যের সুউচ্চ মানে অধিষ্ঠিত হবে।

হুযুর (আই.) বলেন, নামাযের ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশ হল ‘আকিমুস্ সালাত’ অর্থাৎ নিয়মিতভাবে, যথাসময়ে, সুন্দরভাবে নামায পড়। আরও বলেছেন, ‘হাফিজু আলাস্ সালাওয়াতে ওয়াস্ সালাতিল উসতা’ অর্থাৎ সকল নামায, বিশেষভাবে মধ্যবর্তী নামাযের ব্যাপারে যত্নবান হও। সালাতুল উসতা অর্থ হচ্ছে মধ্যবর্তী নামায বা গুরুত্বপূর্ণ নামায; অনেক নামাযের সময় মানুষ ব্যক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থ বা ইচ্ছা-আকাঙ্খাকে অগ্রাধিকার দেয়, যেমন ফজরের নামাযের উপর ঘুম বা আরামকে প্রাধান্য দেয় বা যোহরের নামাযের চেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেয়, এগুলোই সালাতুল উসতার অন্তর্ভুক্ত যার ব্যাপারে আল্লাহ্ যত্নবান হতে বলেছেন। আল্লাহ্‌র নির্দেশ কেবল রমযানের নামাযের ব্যাপারে নয়, বরং সব সময়ের নামাযের জন্য প্রযোজ্য। রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর হাদীস থেকেও জানা যায় যে একজন বান্দার এক বেলার নামায থেকে পরবর্তী নামায, এক জুমুআ থেকে পরবর্তী জুমুআ এবং এক রমযান থেকে পরবর্তী রমযান পর্যন্ত মধ্যবর্তী পাপসমূহ আল্লাহ্ তা’লা ক্ষমা করে দেন, যদি সে বড় বড় পাপ থেকে বিরত থাকে। এই হাদীস থেকে প্রতি বেলার নামায এবং প্রতি সপ্তাহের জুমুআর গুরুত্ব প্রকাশ পায়। আর হাদীস থেকে এ-ও জানা যায় যে দৈনিক পাঁচ বেলার নামায যথাযথভাবে পড়লে মানুষ অশ্লীলতা ও মন্দকাজ থেকেও রক্ষা পায়। এত্থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে প্রতি বেলার নামাযই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রসূলুল্লাহ্ (সা.) একথাও বলেছেন যে কেউ যদি যথোপযুক্ত কারণ ছাড়া পরপর তিন জুমুআয় উপস্থিত না হয় তবে আল্লাহ্ তা’লা তার হৃদয়ে মোহর মেরে দেন এবং তার হৃদয় কালো হয়ে পড়ে। হুযুর (আই.) বলেন, আজকে রমযানের শেষ জুমুআ হওয়ার কারণে অনেক বেশি লোক উপস্থিত হয়েছে; হয়তো তাদের মনে এই ধারণা রয়েছে যে এই জুমুআয় উপস্থিত হওয়া খুবই জরুরি। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা কুরআন শরীফে সূরা জুমুআয় যে নির্দেশ দিয়েছেন তাতে প্রত্যেক জুমুআতেই উপস্থিত হবার এবং সেসময় নিজেদের জাগতিক কাজ-কর্ম বন্ধ রাখার কড়া নির্দেশ রয়েছে। হাদীসে একথাও বর্ণিত হয়েছে যে কেয়ামতের দিন লোকদেরকে সেই ক্রমধারা অনুসারে আল্লাহ্‌র সমীপে উপস্থিত করা হবে যে অনুসারে তারা জুমুআয় উপস্থিত হতো। তাই প্রত্যেক জুমুআয় উপস্থিত হওয়া এবং যথাসময়ে ও দ্রুত উপস্থিত হওয়া আবশ্যক।

হুযুর (আই.) বলেন, ক্ষমালাভ সংক্রান্ত হাদীসে ক্রমধারার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দৈনিক পাঁচ বেলার নামাযকে, এরপর জুমুআকে এবং তারপরে রমযানকে। সুতরাং দৈনিক পাঁচ বেলার নামাযকে যে গুরুত্ব দিবে, এরপর জুমুআতেও উপস্থিত হবে এবং জুমুআর দিনের সেই বিশেষ মুহূর্তের সন্ধানী হবে যে মুহূর্তে যে কোন দোয়া গৃহীত হয়, অতঃপর রমযান পালন করবে এবং রমযানের প্রতিটি দশক ও বিশেষভাবে শেষ দশক যা জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভের সুযোগ- তার সন্ধানী হবে- এমন ব্যক্তির পক্ষেই প্রকৃত ক্ষমা ও মুক্তি লাভ করা সম্ভব।

হুযুর (আই.) বলেন, রমযানে অনেকেই কুরআন পাঠের প্রতি মনোযোগী হয় এবং মহানবী (সা.)-এর সুন্নত অনুসারে রমযানে পুরো কুরআন একবার পড়ে শেষ করে; তাদের এই সংকল্প করা জরুরি যে এখন থেকে সারা বছরই দৈনিক কুরআন পড়ব। কেননা আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশ ‘ওয়া কুরআনাল ফাজ্‌র’ প্রত্যহ কুরআন পাঠের প্রতি নির্দেশ করে। একইভাবে রমযানে বেশি বেশি যিকরে এলাহীর প্রতি যে মনোযোগ নিবদ্ধ হয়, সেটিকেও সারা বছর জুড়ে নিজের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। অন্যান্য পুণ্যকাজ, উন্নত চরিত্র ও নৈতিক গুণাবলী অর্জন- এই সবগুলোকেই নিজের স্থায়ী আমল বা কার্য্যে পরিণত করতে হবে।

এরপর হুযুর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আতকারীদের কাছে তিনি (আ.) কী আশা করেন বা তাদেরকে কোন মানে দেখতে চান তা তাঁর (আ.) উদ্ধৃতির আলোকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। এরপর হুযুর (আই.) বলেন, অতএব আমাদের প্রত্যেকের এই অঙ্গীকারের সাথে রমযান শেষ করা উচিত যে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল (সা.) যেসব কথা বলেছেন, আর যেসব কথা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদের জন্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, সেগুলো দৃষ্টিপটে রেখে সেই অনুযায়ী যেন আমরা জীবন অতিবাহিত করি। আর যদি আমরা এমনটি করি, তবেই আমরা বলতে পারব যে আমরা আল্লাহ্ ও রসূল (সা.)-এর শিক্ষানুসারে রমযান অতিবাহিত করার চেষ্টা করেছি। হুযুর (আই.) দোয়াও করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করেন। আমীন।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) দুটি গায়েবানা জানাযার উল্লেখ করেন। প্রথম জানাযা মোকাররমা মুশতাক জহুরা সাহেবার, যিনি জহুর আহমদ সাহেবের সহধর্মিনী ছিলেন, গত ১২ জুন ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। দ্বিতীয় জানাযা জামাতের ওয়াকেফে যিন্দেগী মিসরের অধিবাসী মোকাররম আবদুল বকর সাহেবের, যিনি গত ১২ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৪১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। হুযুর (আই.) উভয়ের যিকরে খায়ের করেন এবং তাদের পদমর্যাদায় উন্নীত হবার জন্য দোয়া করেন।