তাকওয়া অর্জন

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৯-জুন, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৯ই জুন, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্‌ মসজিদ থেকে “তাকওয়া অর্জন”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশ- ‘রমযান ও রোযার উদ্দেশ্য হল হৃদয়ে তাকওয়া সৃষ্টি করা’ এবং তাকওয়া অর্জনের উপায় সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর লেখনীর আলোকে গত খুতবায় উপস্থাপন করেছিলাম। হুযুর (আই.) বলেন, যদি তাকওয়া না থাকে তাহলে কোন পুণ্যই প্রকৃতপক্ষে পুণ্য হতে পারে না। মানুষ সাময়িক আবেগের বশে কোন কোন পুণ্য করে, কিন্তু পুণ্যের উপর স্থায়িত্ব তখনই সৃষ্টি হয়, যখন হৃদয়ে প্রকৃত তাকওয়া সৃষ্টি হয়। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, মুত্তাকী হবার জন্য কেবল ইবাদতকারী বা আল্লাহ্‌র হক আদায়কারী হলেই চলবে না, বরং চারিত্রিক মানও উন্নত হতে হবে, অর্থাৎ তার চরিত্রের মাধ্যমে তাকওয়ার যে উন্নত প্রভাব রয়েছে তা অন্যদের উপরও প্রকাশ করবে। তিনি (আ.) বলেন, চরিত্র মানুষের পুণ্যবান হবার লক্ষণ হয়ে থাকে। একজন মুমিনের জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সর্বদা ইসলামের শিক্ষার সৌন্দর্য প্রকাশ করা, আর এটি তখন সম্ভব যদি কেউ তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে উন্নত চরিত্র প্রদর্শন করে। আল্লাহ্ তা’লা বলেন, ইদফা’ বিল্লাতি হিয়া আহসান- এখানে আল্লাহ্ শিক্ষা দিচ্ছেন যে, কোন বিরোধী যদি গালিও দেয় তবুও তার উত্তর গালির মাধ্যমে দেবে না, বরং ধৈর্য প্রদর্শন করবে। এতে সেই বিরোধী তোমার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে নিজেই তার গালির জন্য অনুতপ্ত হবে, আর এটি সেই শাস্তি থেকে উত্তম হবে যা তুমি তার গালির জন্য তাকে দিতে পারতে। তাকওয়া হল সেই জিনিস যার প্রভাবে দুষ্ট লোকেরাও প্রভাবিত হয়।

আখলাক বা উত্তম চরিত্র প্রদর্শনের উদ্দেশ্য কী তা বলতে গিয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, খুলক ও খালক শব্দ দুটি ভিন্ন ভিন্ন সৃজনকে নির্দেশ করে। খালক দ্বারা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন নাক-কান, হাত-পা ইত্যাদি বোঝায়, আর খুলক হল আভ্যন্তরীন শক্তি ও বৈশিষ্ট্য যা মানুষে মানুষে পার্থক্য তৈরি করে যেমন চরিত্র, চিন্তাশক্তি, মেধাশক্তি ইত্যাদি। খুলকের মাধ্যমে যদি একজনের মানুষ পরিচয় ফুটে না ওঠে তবে এটি চিন্তার বিষয় যে সে মানুষ না গরু-গাধা ইত্যাদি। খুলক না থাকলে মনুষ্যত্ব থাকে না। আর খুলকের প্রেক্ষিতে আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’লা স্বয়ং ঘোষণা দিচ্ছেন যে ‘ইন্নাকা লাআ’লা খুলুকিন আযীম’ অর্থাৎ নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। মসীহ্ মওউদ (আ.) আরও বলেন, অধিকাংশ মানুষ এমন হয় যে তাদের মাঝে কোন একটি গুণ থাকলেও অন্যদিক থেকে একটি ত্রুটি থেকে যায়; কেউ হয়তো দানশীল কিন্তু রাগী, আবার কেউ নম্র কিন্তু কৃপণ, কিংবা হয়তো দানশীলও আর নম্রও, কিন্তু তার মাঝে ভীরুতা রয়েছে। মোটকথা সর্বপ্রকার উত্তম গুণে গুণান্বীত হয় না। অথচ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এমন ছিলেন যে, এক পর্যায়ে যখন বাগ্মিতা প্রদর্শন করেছেন তো সেক্ষেত্রেও সর্বোত্তম প্রমাণিত হয়েছেন, যখন যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন তখন সর্বোচ্চ সাহসিকতা প্রদর্শন করেছেন, যখন দানশীলতার সুযোগ এসেছে তখন পাহাড়সম সম্পদও দান করে দিয়েছেন, আবার ক্ষমার বেলায় তিনি প্রাণের শত্রুদেরও ক্ষমা করে দিয়েছেন। এক কথায় এমন কোন চারিত্রিক গুণ নেই যা তাঁর (সা.) মাঝে ছিল না; এবং পরিপূর্ণ ও চরম মাত্রায় ছিল না! এজন্যই আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে (সা.) অনুসরণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে চারিত্রিক সংশোধন সাধন প্রসঙ্গে বলেন যে, মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং দোয়া ছাড়া এটি অর্জন সম্ভব নয়, এই দুটি জিনিসেরই আবশ্যকতা রয়েছে। চেষ্টা প্রসঙ্গে তো স্বয়ং আল্লাহ্ তা’লাই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন- ‘ইন্নাল্লাহা লা ইয়ুগাইয়িরু মা বিকাওমিন হাত্তা ইয়ুগাইয়িরু মা বিআনফুসিহিম’; অর্থাৎ আল্লাহ্ ততক্ষণ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা না করে, আর এটি আল্লাহ্ তা’লার সুন্নত বা চিরন্তন রীতি। যদি অলস না হও, যদি চেষ্টা কর, তাহলে পরিবর্তন আসবে। হুযূর (আই.) বলেন, রমযান মাস আলস্য দূর করার ও চারিত্রিক পরিবর্তন সাধনের এক মহা সুযোগ, একে কাজে না লাগালে তা অত্যন্ত আক্ষেপের কারণ হবে।

চারিত্রিক পরিবর্তনের জন্য তওবাও অত্যন্ত উপকারী ও আবশ্যক একটি জিনিস। তবে প্রকৃত তওবা, যা তাওবাতুন নাসূহা নামে আখ্যায়িত হয়, তার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে। প্রথমত, যেসব চিন্তাধারা অন্যায়ের বা বাজে কাজের প্ররোচনা সৃষ্টি করে সেসব চিন্তাধারা ও নোংরা ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করা। দ্বিতীয়ত, নিজের বিবেককে জাগ্রত করা এবং নিজের মাঝে প্রকৃত অনুশোচনা সৃষ্টি করা। তৃতীয়ত, ভবিষ্যতের জন্য এই দৃঢ় সংকল্প করা যে আমি আর কখনও এই পাপের দিকে ফিরেও তাকাব না। আর এগুলোর সাথে আল্লাহ্ তা’লার সাহায্যও চাইতে হবে, কারণ এই সংকল্পকে বাস্তবায়িত করতে যে শক্তির প্রয়োজন তা আল্লাহ্ দান করতে পারেন। কুরআনে আছে ‘ইন্নাল কুউওয়াতা লিল্লাহি জামিয়া’ অর্থাৎ সব শক্তি প্রকৃত অর্থে আল্লাহ্‌রই। অতএব, যে এভাবে চেষ্টা করবে এবং আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য ও শক্তি চাইবে, তার পক্ষে চারিত্রিক সংশোধন সম্ভব।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, প্রকৃত বীর বা পালোয়ান সেই ব্যক্তি নয় যে কি-না পাহাড়কে টলিয়ে দিতে পারে, প্রকৃত বীর হল সেই ব্যক্তি যে নিজের চরিত্রকে পরিবর্তন করতে পারে। মহানবী (সা.)-কে সবচেয়ে বড় যে নিদর্শন দান করা হয়েছিল তা ছিল চরিত্রের নিদর্শন। তাঁর (সা.) আদর্শে প্রভাবান্বিত হয়ে কৃপণরা দানশীল হয়েছে, হিংস্ররা নম্র হয়েছে। আর সাহাবাদের এই পরিবর্তন ছিল এক মহা মোজেযা ও কেরামত। তলোয়ারের মাধ্যমে ইসলাম ভিন জাতির মাঝে বিস্তৃত হয় নি, বরং সাহাবাদের এই উন্নত চরিত্র ও আদর্শ যা তারা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মাধ্যমে লাভ করেছিলেন সেটিই ভিন জাতির লোকদেরকেও ইসলামের ছায়াতলে একত্রিত করেছিল। তাই অহংকার ও বিদ্বেষমুক্ত হয়ে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও দোয়া করা প্রয়োজন যেন আল্লাহ্ তা’লা আমাদের মাধ্যমেও এই নিদর্শন প্রদর্শন করেন।

হুযুর (আই.) দোয়া করেন যে, আল্লাহ্ তা’লা যেন আমাদেরকে তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজেদের চরিত্রে পবিত্র পরিবর্তন সাধনের তৌফিক দান করেন, মহানবী (সা.)-এর উত্তম আদর্শকে আত্মস্থ করার তৌফিক দান করেন, সবসময় উন্নত নৈতিক গুণাবলী প্রদর্শনের তৌফিক দান করেন এবং হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদের কাছ থেকে যে প্রত্যাশা করেছেন সে অনুযায়ী জীবন যাপনের সৌভাগ্য দান করেন। আমীন, সুম্মা আমীন।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) দুটি গায়েবানা জানাযার উল্লেখ করেন। প্রথমটি মিয়াঁ আতাউর রহমান সাহেবের পুত্র আমেরিকা নিবাসী মোকাররম লুৎফর রহমান মাহমুদ সাহেবের, যিনি গত ২৭শে মে ইন্তেকাল করেন। দ্বিতীয় জানাযা মোকাররম মির্যা উমর আহমদ সাহেবের, যিনি ডা. মির্যা মুনাওয়ার আহমদ সাহেবের পুত্র ও হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রপৌত্র ছিলেন। তিনি গত ৫ই মে রাবওয়ার তাহের হার্ট ফাউন্ডেশনে চিকিৎসারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। হুযুর (আই.) উভয়ের যিকরে খায়ের করেন এবং তাদের পদমর্যাদায় উন্নীত হবার জন্য দোয়া করেন।