আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের প্রচেষ্টা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৫-মে, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৫ই মে, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্‌ মসজিদ থেকে “আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের প্রচেষ্টা”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) পবিত্র কুরআনের সূরা হাদীদের ২১ নং আয়াত তেলাওয়াত করেন, যার বঙ্গানুবাদ হল- ‘আর তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন ক্রিড়া-কৌতুক, চাকচিক্য-সৌন্দর্য, তোমাদের পারস্পরিক আত্মশ্লাঘা এবং পরস্পরের সাথে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে অগ্রসর হওয়ার প্রতিযোগিতা মাত্র। এর দৃষ্টান্ত সেই বারিধারার ন্যায় যার দ্বারা উৎপাদিত উদ্ভিদরাজি অস্বীকারকারীদেরকে আনন্দিত করে। এরপর তা পরিপক্ক হয় এবং তুমি একে হলুদবর্ণ হতে দেখ যা অবশেষে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। আর এমন লোকদের জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে; এবং সৎকর্মশীলদের জন্য রয়েছে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি; আর এই পার্থিব জীবন সাময়িক ছলনাময়ী ভোগ্যবস্তু ব্যতিরেকে আর কিছুই নয়।’

হুযুর (আই.) বলেন, কুরআন শরীফে আল্লাহ্ তা’লা বিভিন্ন স্থানে এই বিষয়টি বর্ণনা করেছেন যে পৃথিবীর বাহ্যিক জীবন, আরাম-আয়েশ, ধন-সম্পদ এগুলো সবই সাময়িক, আর এর মূল্য ক্রিড়া-কৌতুক ও বাহ্যিক চাকচিক্যের চেয়ে একটুও বেশি নয়। যারা আল্লাহ্ সম্পর্কে উদাসীন তারাই এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে, কিন্তু একজন মুমিন এসব বিষয়ের অনেক ঊর্ধ্বে এবং সে তার পরম উদ্দেশ্য আল্লাহ্‌র ভালবাসা ও প্রেম লাভের চেষ্টা করে। হুযুর (আই.) বলেন, আমরা যারা যুগের ইমাম প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী (আ.)-কে মান্য করার ও আহমদী হবার দাবী করি, আমরা সত্যিকার আহমদী তখনই হতে পারব, যখন আমরা এই পার্থিব আশা-আকাঙ্খা ও চাকচিক্যকে নিজেদের জীবনের লক্ষ্য বানাব না এবং এসব বস্তুর প্রতি লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করব না । কারণ, এগুলো ফুলে-ফলে সুশোভিত হবার পর আবার হলুদ হয়ে যায় এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়, আর একই পরিণতি জাগতিকতার পূজারীদেরও হয়ে থাকে। আল্লাহ্ তা’লা একথা বলেন, পার্থিব জীবনকে সবকিছু মনে করো না, প্রকৃত জীবন হল মৃত্যুর পরের জীবন। তাই শুভ পরিণামের জন্য আল্লাহ্ তা’লার সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন ও তাঁর নির্দেশাবলী মেনে চলা আবশ্যক। আর মানুষ যখন আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করে ও তাঁর প্রদর্শিত পথে চলে, তখন তার পরকালই কেবল শুভ হয় না, বরং পার্থিব জীবনও সে লাভ করে। আল্লাহ্ তা’লা কখনোই দুনিয়ার নেয়ামত অর্জন করতে নিষেধ করেন না, কিন্তু এতে এতটা মগ্ন হতে নিষেধ করেন যার ফলে মানুষ তার ধর্মীয় দায়িত্বাবলী ও আল্লাহ্‌র প্রাপ্য প্রদানে উদাসীন হয়ে যায়। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, যারা খোদার পক্ষ থেকে আসেন তারা জগতকে নিজেদের পরম লক্ষ্য বানান না, আর এর ফলে জগৎ তাদের চাকরে পরিণত হয়; কিন্তু যারা জগৎ অর্জনে রত হয়, তারা শেষ পর্যন্ত এই জগতেই লাঞ্ছিত হয়। হুযুর (আই.) জগতের বাহ্যত সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ার আর লোকসানের সম্মুখিন হবার বিভিন্ন উদাহরণ উপস্থাপন করেন। হুযুর (আই.) বলেন, পার্থিব নেয়ামত অর্জনের ক্ষেত্রে সর্বদা এটি দৃষ্টিপটে রাখতে হবে যে এর ফলে অন্য কারও অধিকার যেন ক্ষুণ্ন না হয়। জাগতিক সম্পদ, তা সে ব্যক্তিরই হোক বা কোন গোষ্ঠী বা কোন সরকারেরই হোক, এর অপব্যবহার করলে আল্লাহ্‌র শাস্তিও তাদের উপর বর্ষিত হবে।

হুযুর (আই.) বলেন, একজন প্রকৃত মুসলমানের সর্বদা এটি দৃষ্টিতে রাখা উচিত যে আল্লাহ্‌র ইবাদত ও তাঁর নির্দেশাবলী পালনের ক্ষেত্রে কেবল বাহ্যিকতার অনুসরণ নয়, বরং এক বেদনা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার সাথে তা আদায় করা আবশ্যক। কেউ বলতে পারে যে ‘আমরা তো ইবাদত করিই, এর পরে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত নেয়ামত অর্জনের চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?’। হুযুর (আই.) বলেন, প্রথমত ইবাদতের ক্ষেত্রে এটি আবশ্যক যেন তা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতাপূর্ণ হয়, দ্বিতীয়ত আল্লাহ্‌র দেওয়া নেয়ামত থেকে তাঁর সৃষ্ট জীবের হক আদায় করাও আবশ্যক। একদিকে আল্লাহ্‌র নাম নেয়া আর অন্যদিকে সৃষ্ট জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শনের খোদায়ী নির্দেশের বিপরীত কাজ করা- এটি খোদার শাস্তিকে আমন্ত্রণ জানায়। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-ও এটি বলেছেন যে আল্লাহ্‌র প্রাপ্য প্রদানের সাথে সাথে তাঁর বান্দাদের প্রাপ্যও এভাবে প্রদান করতে হবে যেন তাদের জন্য হৃদয়ে এক বেদনা থাকে, কারো প্রতি অনুগ্রহ করছি- এই মনোভাব যেন না হয়; এমনটি করলে তা আল্লাহ্‌র কৃপাকে আকর্ষণ করে। হুযুর (আই.) বলেন, জাগতিক ধন-সম্পদ বা নেয়ামত অর্জন নিষেধ নয়, কিন্তু এর জন্য শর্ত হল তা যেন হালাল বা বৈধ উপায়ে করা হয় এবং তা যেন বান্দার প্রাপ্য আদায়ের পথে বাধ না সাধে।

হুযুর (আই.) এরপর এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.)-এর বিভিন্ন হাদীস এবং সাহাবীদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন যে কিভাবে তারা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ও পরকাল অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন। এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে জানতে চান যে কী করলে আল্লাহ্ও আমাকে ভালবাসবেন আর মানুষও আমাকে ভালবাসবে। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ইহকালের প্রতি নির্মোহ হও এবং মানুষের সম্পদের প্রতি লোভাতুর দৃষ্টি প্রদান থেকে বিরত থাক। হুযুর (আই.) ব্যাখ্যা করেন, জগতের প্রতি নির্মোহ হওয়ার অর্থ এটি নয় যে সংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাও; এর অর্থ হল ইহজগৎ যেন আল্লাহ্‌র নির্দেশ পালনের পথে প্রতিবন্ধক না হয়; তাহলে আল্লাহ্‌র ভালবাসা অর্জন করা যাবে। আর অন্যের সম্পদের প্রতি লোভাতুর দৃষ্টিই পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টির কারণ, এটি না করলে মানুষও তোমাকে ভালবাসবে। হুযুর (আই.) এই বিষয়টিকে হাদীস ও হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর লেখনীর আলোকে আরও ব্যাখ্যা করেন। ইসলাম সন্ন্যাসব্রতকে নিষেধ করে, জাগতিক ব্যবসা-বাণিজ্য অবলম্বন করতে বলে; কিন্তু এতে একটি সীমারেখা থাকা চাই। জাগতিক কাজকর্মের উদ্দেশ্যও ধর্ম ও ধার্মিকতা হওয়া উচিত। আল্লাহ্ তা’লা যে দোয়া কুরআন শরীফে শিখিয়েছেন তাতে ‘ফিদ্দুনিয়া হাসানাহ্’ বা দুনিয়ার কল্যাণ প্রথমে রেখেছেন, এতে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে পৃথিবীতে সেই জিনিসই কল্যাণকর যা পরকালের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। আর পার্থিব লোভ-লালসার আগুনও এক জাহান্নাম; যা মানুষকে কখনো পরিতৃপ্ত করে না, বরং ক্রমশ বেড়েই চলে। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য যেকোন বস্তুর ভালবাসাই হৃদয়কে জাহান্নামে পরিণত করে, একমাত্র আল্লাহ্‌ ভালবাসাই মানুষের হৃদয়ে জান্নাত সৃষ্টি করে। হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের অবস্থা যেন আল্লাহ্‌ স্মরণ ও তাঁর অধিকার আদায় করা থেকে বা আমাদের দুর্বল ভাইদের অধিকার আদায় করা থেকে আমাদের উদাসীন না করে, একইসাথে ইসলামের প্রচারের দায়িত্বও যেন আমরা পালন করতে পারি এবং হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আতের কারণে ধর্মকে জাগতিকতার উপর প্রাধান্য দেয়ার যে দায়িত্ব আমাদের উপর অর্পিত হয়েছে তা যেন আমরা পালনকারী হই; আল্লাহ্ যেন আমাদের এই তৌফিক দান করেন। আমীন।

হুযুর (আই.) খুতবার শেষদিকে দুটি গায়েবানা জানাযার উল্লেখ করেন। প্রথমটি মোকাররম বাশারত আহমদ সাহেবের, যাকে গত ৩ মে বাড়ি ফেরার পথে গুলি করে শহীদ করা হয়েছে। দ্বিতীয় জানাযা মোকাররমা প্রফেসর তাহেরা মালেক সাহেবার, তাকে গত ১৭ এপ্রিল ছুরিকাঘাতে শহীদ করা হয়। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। হুযুর (আই.) উভয়ের সংক্ষিপ্ত যিকরে খায়ের করেন এবং তাদের পদমর্যাদার উন্নতির জন্য দোয়া করেন।