মুরব্বী ও জামাতী কর্ম-কর্তাদের কর্মপরিধি

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১০-মার্চ, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১০ই মার্চ, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “মুরব্বী ও জামাতী কর্ম-কর্তাদের কর্মপরিধি”- বর্ণনা করে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,

আল্লাহ্ তা’লার ফযলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জামেয়া আহমদীয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখান থেকে মুরব্বীগণ নিজেদের শিক্ষালাভ করে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেছেন বা করতে যাচ্ছেন। একসময় কেবল রাবওয়া ও কাদিয়ানেই জামেয়া ছিল, কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন দেশে জামেয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ও কানাডা জামেয়ার শাহেদ পাসকৃতদের যৌথভাবে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এদের প্রায় সবাই-ই ওয়াকেফীনে নও। তারা পাশ্চাত্যের চাকচিক্যপূর্ণ পরিবেশে বড় হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের এভাবে জীবন উৎসর্গ করা অবশ্যই তাদের সৌভাগ্য এবং ধর্মকে জাগতিকতার উপর প্রাধান্য প্রদানের একটি চিত্র। কিন্তু তাদের স্মরণ রাখতে হবে যে এটি আল্লাহ্ তা’লার ফযল ছাড়া সম্ভব নয়, তাই তাদেরকে আন্তরিক বিনয় ও নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্ তা’লার দরবারে সমর্পিত হয়ে তাঁর কৃপা ও অনুগ্রহ সন্ধান করা উচিত। হুযুর (আই.) বলেন, সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম যে জামাতের প্রচুর মুরব্বীয়ান ও মোবাল্লেগীন প্রয়োজন রয়েছে, এজন্য ওয়াকফে নওদের অনেক বেশি সংখ্যায় জামেয়াতে আসা প্রয়োজন। যেহেতু রাবওয়া ও কাদিয়ান ছাড়া কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ঘানা, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশেও জামেয়া প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তাই সব জামেয়াতে যেন পূর্ণসংখ্যক ছাত্র ভর্তি হয়- সেজন্য ওয়াকফে নওদেরকে শৈশব থেকেই পিতা-মাতার এদিকে পূর্ণ মনোযোগ আকর্ষণ করা উচিত ও এজন্য প্রস্তুত করা উচিত।

এরপর হুযুর (আই.) কর্মক্ষেত্রে যোগদানকারী মুরব্বীদের কিছু প্রশ্ন, যা তারা বিভিন্ন সময় করে থাকেন, সেগুলোর উত্তর প্রদান করেন এবং বলেন যে, খুতবায় এটি বলার কারণ হল যেন জামাতের পদাধিকারীরাও যেন তারা বুঝতে পারেন যে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কিভাবে তাদের কাজ করতে হবে; কারণ অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির কারণে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো মুরব্বীরা প্রশ্ন করে, তাদের কাজে স্থানীয় প্রেসিডেন্ট কতটুকু হস্তক্ষেপ করতে পারে? আমাদের ও তাদের কাজের সীমা কতটুকু? কখনো দেখা যায় মুরব্বী একটি বিষয়কে জামাতের তরবিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরী মনে করে তা প্রচলন করতে চান, কিন্তু প্রেসিডেন্ট দ্বিমত পোষণ করেন বা কখনো দীর্ঘদিন প্রেসিডেন্ট পদে থাকার কারণে মনে করেন যে, তিনি যা বলেন তা-ই সঠিক। কখনো প্রেসিডেন্ট অনেকের সামনে মুরব্বীর সাথে এমন ভাষায় কৈফিয়ত চান বা কথা বলেন যা অনুচিত, আর যারা যুবক মুরব্বী তারা এটিকে খারাপ মনে করে, হয়তো বা কেউ এর জবাবও দিয়ে বসতে পারে। হুযুর (আই.) বলেন, প্রথমত মুরব্বীদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ব্যবস্থপনার দিক থেকে তাদের যার অধীনে দেয় হয়েছে তার আনুগত্য করতে হবে, পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন আনুগত্যের সর্বোত্তম আদর্শ প্রদর্শন করতে হবে যেন জামাতের উপর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। যদি কোন প্রেসিডেন্ট বেশি বাড়াবাড়ি করেন তবে ন্যাশনাল আমীরের কাছে বা হুযুর (আই.)-এর কাছে তারা লিখতে পারে। অনুরূপভাবে হুযুর (আই.) প্রেসিডেন্টদের উদ্দেশ্যে বলেন, মুরব্বীদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা তাদের দায়িত্ব, মুরব্বীদের সম্মান করা ও তাদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করার ক্ষেত্রে তাদেরকে সর্বাগ্রে থাকতে হবে। হুযুর (আই.) বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন; তা হল জামাতের সদস্যদের তালিম-তরবিয়ত, ব্যবস্থাপনার সম্মান প্রতিষ্ঠা, খেলাফতের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করা, তৌহীদ প্রতিষ্ঠা করা ও ইসলামের সত্যিকার শিক্ষা সারা বিশ্ব প্রচার করা- এই কাজের মধ্যে সীমারেখার প্রশ্ন কেন আসবে? এটি তো পরস্পর সম্মিলিতভাবে করা উচিত। আর একাজে আল্লাহ্ তা’লার মৌলিক নির্দেশ হল: ‘তাআ’ওয়ানু আলাল বির্‌রে ওয়াত্তাকওয়া’ অর্থাৎ ‘পুণ্য ও মঙ্গলের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর’। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এর ব্যাখ্যায় বলেন, এর অর্থ হল দুর্বল ভাইদের বোঝা বহন কর- কর্মের ক্ষেত্রেও, ঈমানের ক্ষেত্রেও এবং আর্থিক ব্যাপারেও। এটি তখনই সম্ভব যখন মুরব্বী ও কর্মকর্তা পরস্পর সম্মিলিতভাবে জামাতের সদস্যদের সমব্যথী ও হিতাকাঙ্খী হবে। কর্মকর্তারা প্রশাসনিক দিক থেকে আর মুরব্বীরা ধর্মীয় জ্ঞানের ও তরবিয়তের দিক থেকে তাদের এই দায়িত্ব পালন করবে।

হুযুর (আই.) বলেন, কখনো কখনো দেখা যায় যে প্রেসিডেন্ট ও মুরব্বীর সম্পর্কে মধ্যে কোন সমস্যা দেখা দেয়। তখন জামাতের মধ্যে দুটো পক্ষ সৃষ্টি হয়, একদল মুরব্বীর কাছে বলে যে, প্রেসিডেন্ট অন্যায় আচরণ করেছেন, আরেকদল প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে বলে, মুরব্বীর এমন ব্যবহার করা সাজে না। হুযুর (আই.) বলেন, এভাবে যাদের সংশোধন করা মুরব্বী ও প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছিল, তারাই মুরব্বী ও প্রেসিডেন্টের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। অথচ মসীহ্ মওউদ (আ.) এটি স্পষ্টভাবে বলে গিয়েছেন, এমনটি কখনো হওয়া উচিত নয়, যখন তোমরা একত্রিত হও তখন তোমাদের মাঝে ঐক্য ও শক্তি সৃষ্টি হওয়া উচিত যেন ভালবাসা ও কল্যাণ সৃষ্টি হয়। এটি কেবল তখনই সম্ভব যখন সহানুভূতি, ভালবাসা, মার্জনা এবং পারস্পরিক সম্মান, অন্যের দুর্বলতা গোপন করা, তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে কঠোরভাবে না ধরা ইত্যাদি থাকবে।

হুযুর (আই.) বলেন, আমার এমনটি বলার কারণ এটি নয় যে এরকমটি প্রায়ই ঘটে, বরং কালে-ভদ্রে এমনটি ঘটে। কিন্তু যেহেতু আমাদের এক মহান লক্ষ্য রয়েছে, আর শয়তান পারস্পরিক মতভেদের সুযোগে অনেক বড় ক্ষতি করে বসে, তাই এমনটি যেন কখনোই না হয় সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাই উদ্দেশ্য।

হুযুর (আই.) বলেন, মুরব্বীদের ধর্মীয় জ্ঞান ও তাকওয়ার মান সবচেয়ে উন্নত হওয়া উচিত, এমনটি হলে জামাতের কাছেও তাদের এক মর্যাদাপূর্ণ স্থান সৃষ্টি হবে। আমীর-প্রেসিডেন্ট ও মুরব্বীদের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা থাকা উচিত। আর কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হল ওয়াকেফীনে যিন্দেগীদের প্রতি বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল হওয়া, জামাতের সদস্যদেরকেও তাদের সম্মান করতে শেখানো- যেন বেশি বেশি সংখ্যায় যুবকরা জীবন উৎসর্গ করতে এগিয়ে আসে। হুযুর (আই.) বলেন, যদিও এদিকে এগিয়ে আসা ওয়াকেফীনে নওদের দায়িত্ব, কিন্তু বাহ্যিকভাবে এদিকে আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য কর্মকর্তাদের কাজ করতে হবে। অন্যদিকে মুরব্বীদের হুযুর (আই.) বলেন, কেউ সম্মান করুক বা না করুক, আপনারা আল্লাহ্‌র সাথে যে ওয়াদা করেছেন সেটিকে সর্বাবস্থায় পূর্ণ করবেন; সর্বক্ষেত্রে খোদার সামনেই ঝুঁকবেন, মানুষ কী করল না করল সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করবেন না। হুযুর (আই.) বলেন, মুরব্বী তো পুরো জীবনই এ পথে উৎসর্গ করেছেন, অন্যদিকে কর্মকর্তাররা সাময়িক দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। তাই তাদের জন্য দোয়া করা উচিত যেন আল্লাহ্‌ তাদের শুধরে দেন, কিংবা কর্মকর্তা যদি জামাতের ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে তবে যেন আল্লাহ্‌ তাকে অপসারণের ব্যবস্থা করেন। একইসাথে এটিও মুরব্বীর দায়িত্ব যে কোনভাবেই যেন ঘরে কর্মকর্তাদের নিয়ে সমালোচনা না করা হয়।

হুযুর (আই.) কর্মকর্তাদেরকেও স্মরণ করান, তাদের পদ যেন তাদেরকে অহংকারী না করে, বরং সর্বদা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে হাসিমুখে সবার সাথে সাক্ষাত করেন। একইসাথে হুযুর (আই.) জামাতের সাধারণ সদস্যদেরকেও স্মরণ করান যে তারা যেন নিজেদের তাকওয়া ও আনুগত্যের মানকে উন্নত করেন, কখনোই যেন বিদ্রোহমূলক কোন আচরণ না করেন, কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি থাকলে তা কেন্দ্রে লিখতে পারেন, কিন্তু কখনোই আনুগত্যকে বিসর্জন দেয়া চলবে না। আনুগত্যের ফলে তাদের নিজেদেরও জামাতের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হবে, আর তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মও আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত হবে।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা করুন আমাদের প্রতিটি কাজ যেন তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী হয়, আমরা যেন যুগ-ইমামের জামাতের সদস্য হবার দায়িত্ব পালনকারী হই, এবং মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রত্যাশানুযায়ী যেন আমরা কার্য করতে পারি। আল্লাহুম্মা আমীন।