নামাযের কতিপয় নিয়মাবলী

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৭-জানুয়ারি, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৭শে জানুয়ারী, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “নামাযের কতিপয় নিয়মাবলী”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,

গত সপ্তাহে নামাযের গুরুত্ব ও নামায পড়ার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে খুতবার পর বিভিন্ন ব্যক্তি ও জামাত চিঠি লিখে বলেছেন যে আসলেই এক্ষেত্রে তাদের আলস্য ছিল, এজন্য তারা লজ্জাও প্রকাশ করেছেন এবং ভবিষ্যতে তারা এদিকে মনোযোগী হবেন বলে জানিয়েছেন। অনেকে এটিও জানিয়েছেন যে তারা প্রোগ্রাম তৈরি করছেন এবং এক্ষেত্রে তারা পূর্ণ প্রচেষ্টা চালাবেন। আল্লাহ তা’আলা যেন তাদেরকে তৌফিক দান করেন এবং আমাদের মসজিদ যেন প্রকৃত অর্থে আবাদ হয়, আমীন। কিন্তু একইসাথে হুযুর (আই.) একথাও স্মরণ করান যে, যেকোন কাজে উত্তম ফলাফল লাভের জন্য অধ্যবসায় প্রয়োজন হয়ে থাকে। অনেকেই কাজ শুরু করার সময় খুব উদ্যম ও উৎসাহের সাথে শুরু করেন, কিন্তু আলস্যের শিকার হয়ে পড়েন। হুযুর (আই.) বলেন, ব্যক্তির ক্ষেত্রে এমন আলস্য তৈরি হওয়া যদিও চিন্তার বিষয়, কিন্তু তবুও তা এত ভয়ংকর পরিণতি সৃষ্টি করে না; কিন্তু যদি ব্যবস্থাপনার মধ্যে অলসতা তৈরি হয় তবে তা চরম ভয়ের কারণ। কেননা, ব্যক্তির আলস্য দূর করবে ব্যবস্থাপনা, কিন্তু ব্যবস্থাপনা যদি নিজেই অলস হয়ে যায় তবে ব্যক্তির সংশোধন করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই জামা’তী ব্যবস্থাপনা এবং অঙ্গ-সংগঠন উভয়েরই মৌলিক ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এমন পরিকল্পনা করা প্রয়োজন যেন সময়ের সাথে সাথে অলসতার পরিবর্তে আমরা প্রতিদিন উন্নতির দিকে অগ্রসর হই। লাজনা ইমাইল্লাহকেও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। নিজেদের সংশোধনের সাথে সাথে সন্তানদেরও প্রশিক্ষিণ দিতে হবে, আবার বাড়ির পুরুষদেরকেও বাজামা’ত নামাযের জন্য মসজিদে পাঠানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। হুযুর বলেন, কখনো কখনো অভিযোগ আসে যে স্ত্রী যদি স্বামীকে নামাযের জন্য স্মরণ করায় তবে স্বামী ক্ষেপে যায় আর বলে যে ‘এটি আমার ও আমার খোদার মধ্যেকার ব্যাপার’। হুযুর (আই.) বলেন, একথা ঠিক, কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরকে নামাযের জন্য স্মরণ করানো ও তাগাদা দেয়ার নির্দেশ রসূলুল্লাহ (সা.) দিয়েছেন। একইভাবে জামা’তের ব্যবস্থাপনারও এ ব্যাপারে স্মরণ করানোর দায়িত্ব রয়েছে। তাই এতে ক্ষেপে যাওয়া চলবে না। এই ধারণা ভুল যে এই ব্যাপারে আমরা স্বাধীনভাবে চলতে পারি।

এরপর হুযুর (আই.) হযরত মসীহ মাওউদ (আ.)-এর লেখনী ও বিভিন্ন ঘটনাবলীর আলোকে নামায প্রসঙ্গে বিভিন্ন ফিকাহ সংক্রান্ত বিষয়াবলী তুলে ধরেন। যেহেতু হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) এই যুগের হাকাম ও আদাল বা ন্যায়বিচারক ও মীমাংসাকারী, তাই বিভিন্ন মুসলিম ফির্কার মাঝে ফিকাহ সংক্রান্ত মতবিরোধের সমাধান করা তাঁর দায়িত্ব ছিল এবং তিনি তা করেছেন। আর এক্ষেত্রে তিনি (আ.) কোন নতুন নিয়ম জারী করেন নি, বরং যা রসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবাগণ (রা.) কর্তৃক প্রমাণিত, তা-ই তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন।

এমনই একটি বিতর্কিত বিষয় হল নামাযে ‘রাফা ইয়াদাইন’ বা নামাযে প্রত্যেক তাকবীরের পর হাত উঠানো। এটিকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে এমন ঝগড়া ছিল যে কুফরি ফতোয়া বা বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ফতোয়া দিয়ে দেয় হতো। মসীহ মাওউদ (আ.) এ বিষয়ে যা বলেন তা হল- এটি করলেও সমস্যা নেই, না করলেও অসুবিধা নেই। কারণ রসূলুল্লাহ (সা.) কখনো এটি করেছেন, আবার কখনো করেন নি। তবে যেহেতু রসূলুল্লাহ (সা.) শেষদিকে এটি করেন নি, তাই আমরাও এটি করি না।

ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সূরা ফাতেহা পাঠের আবশ্যকতা সম্পর্কে তিনি (আ.) বলেন যে, সূরা ফাতেহা অবশ্যই পড়া উচিত। কিন্তু না পড়লে নামাযই হবে না- তা নয়। হাদীসে এসেছে যে সূরা ফাতেহা ছাড়া নামায হয় না। তাই ইমামের পিছনে থাকলেও এবং ইমাম সশব্দে ফাতেহা পড়লেও মুক্তাদীর সূরা ফাতেহা পড়তে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে ইমামের দায়িত্ব হল প্রতি আয়াত পড়ার পর কিছুটা বিরতি দেয়া যেন মুক্তাদী সেই আয়াত নিজেও পড়ে নিতে পারে। হানাফী ফির্কার মুসলমানরা ইমামের পিছনে সূরা ফাতেহা পড়েন না। মসীহ মাওউদ (আ.)-এর মতে তাদের সূরা ফাতেহা না পড়লেও নামায অতি অবশ্যই হয়েছে। কেননা এই ফির্কার নেতা ইমাম আবু হানীফাসহ আরও অনেক বুযুর্গ ব্যক্তি এ ফির্কায় গত হয়েছেন। যদি নামায না-ই হতো, তবে তারা খোদাপ্রাপ্ত সত্তায় পরিণত হতে পারতেন না।

শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পড়ার সময় তর্জনী উঠানো উচিত কি-না এ প্রসঙ্গে তিনি (আ.) বলেন যে আরবদের মাঝে তর্জনী তুলে গালি দেয়ার রীতি ছিল, এজন্য এ আঙুল তুলে আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয়ার নিয়ম করা হয়েছে। একইভাবে, আরবদের মাঝে দিনে পাঁচবার মদ্যপানের অভ্যাস ছিল, এর বিপরীতে আল্লাহ তা’আলা পাঁচ বেলা নামাযের ব্যবস্থা করেছেন।

রুকু ও সিজদায় কুরআনী দোয়া পড়ার ক্ষেত্রে তিনি (আ.) যে নির্দেশনা দেন তা হল- এই দুটি অবস্থা বিনয় ও নিচু হওয়ার অবস্থা, আর কুরআন মানুষকে উঁচু করে। এছাড়া রসূলুল্লাহ (সা.)-ও কখনো এমনটি করেন নি। তাই এ দুটি অবস্থায় কুরআনী দোয়া পড়া উচিত নয়।

কোন অবস্থায় এসে নামায ধরলে নামাযের সেই রাকাত গণ্য হবে এ প্রসঙ্গে তিনি (আ.) সিদ্ধান্ত দেন যে, যে ব্যক্তি চেষ্টা সত্ত্বেও কিয়াম অবস্থায় নামায ধরতে পারে না, তার জন্য রুকু পর্যন্ত এসে নামায ধরতে পারলেও সেই রাকাত পড়া হয়েছে বলে গণ্য হবে।

মুসল্লি মসজিদে এসে জামা’ত চলছে এমন দেখতে পেলে কী করবে সে সম্পর্কে মসীহ মাওউদ (আ.) বলেন, যদি মুসল্লি এসে বুঝতে পারে যে আসর বা এশার নামায চলছে আর তার যোহর বা মাগরিব বাকি থেকে থাকে, তবে সে জামা’তে শামিল না হয়ে আগের নামায পড়বে। আর যদি না জানে যে কোন নামায চলছে, তবে জামা’তে শামিল হয়ে যাবে; আর যদি দেখতে পায় যে এর ফলে তার আগের বেলার নামায বাদ রয়ে গেছে তবে জামা’তের পর সে আগের নামায পড়ে নেবে।

ইমামতীকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা যাবে কি-না? এ প্রশ্নের উত্তরে মসীহ মাওউদ (আ.) বলেন, যদি কেউ ইমাম হওয়ার আকাক্সক্ষা রাখে তবে সেই ইমামের পিছনে নামায হবে কি-না তাতে আমার সন্দেহ আছে। যারা একে পেশা হিসেবে নেয় তারা আসলে নামায পড়ে না, বরং এটি তাদের এক প্রকার ব্যবসা যা তাদের রুটি-রুজির মাধ্যম। একইভাবে অ-আহমদী ইমামের পিছনে নামায পড়াকেও তিনি (আ.) যুক্তির মাধ্যমে কঠোরভাবে মানা করেছেন, তা সে কুফরি ফতোয়া প্রদান করুক বা না করুক। হুযুর (আই.) দোয়া করেন যে আল্লাহ তা’আলা যেন আমাদেরকে বিশুদ্ধরূপে জামাতের সদস্য হবার তৌফিক দান করেন, যেমনটি মসীহ মাওউদ (আ.) ইচ্ছা পোষণ করেছেন।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) আলজেরিয়ার আহমদীদের জন্য দোয়ার আবেদন করেন। সেখানে সরকারিভাবে আহমদীদের উপর ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ভয়াবহ সব আক্রমণ চালানো হচ্ছে, তাদেরকে কারাগারে আবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে এবং সর্বপ্রকারে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আল্লাহ তা’আলা যেন তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করেন এবং তাদেরকে দৃঢ়তাও দান করেন এবং ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র যেন তাদের উপরই বর্তায় সেজন্য হুযুর দোয়া করেন। আল্লাহুম্মা আমীন।