মুসলেহ্ মওউদ (রা.) সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী ও আমাদের করণীয়

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৯-ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৯শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “মুসলেহ্ মওউদ (রা.) সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী ও আমাদের করণীয়”- বিষয়ে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, ২০শে ফেব্রুয়ারির দিনটিকে বিশ্ব জামাতে আহমদীয়া মুসলেহ্ মওউদ দিবস হিসেবে উদযাপন করে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে একজন প্রতিশ্রুতি পুত্রের সংবাদ দেয়া হয়েছিল, যিনি ধর্মসেবক হবেন, দীর্ঘায়ু লাভ করবেন এবং আরো অন্যান্য গুণাবলীর অধিকারী হবেন। এই ভবিষ্যদ্বাণীর গুরুত্ব সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, এটি শুধুমাত্র একটি ভবিষ্যদ্বাণীই নয় বরং এক সুমহান ঐশী নিদর্শন। যাকে মহা সম্মানিত ও পরাক্রমশালী খোদা আমাদের সম্মানিত ও দয়ালু নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য প্রদর্শন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এই নিদর্শন একজন মৃতকে জীবিত করার নিদর্শনের চেয়ে মর্যাদার নিরিখে শত-শত গুণ উন্নত, উত্তম, পরিপূর্ণ, শ্রেষ্ঠ এবং উৎকর্ষ। কেননা, মৃতকে জীবিত করার তাৎপর্য হলো, খোদার দরবারে দোয়া করে একটি প্রাণকে ফিরিয়ে আনা, যা প্রমাণের ক্ষেত্রে আপত্তিকারীদের অনেক অভিমত রয়েছে। কিন্তু এখানে আল্লাহ্‌র কৃপা ও অপার অনুগ্রহ এবং হযরত খাতামুল আম্বিয়া (সা.)-এর কল্যাণে খোদার দরবারে এই অধমের দোয়া গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে এমন এক আশিসপূর্ণ সত্তাকে প্রেরণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যে, যার বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ কল্যাণরাজি জগমতময় বিস্তৃতি লাভ করবে। অতএব এই নিদর্শন মৃতকে জীবিত করার মত মনে হলেও অভিনিবেশ করলে বুঝা যায়, এই নিদর্শন মৃতকে জীবিত করার চেয়ে শত শত গুণ শ্রেয়। মৃতদের আত্মাও দোয়ার মাধ্যমেই ফিরে আসে আর এস্থলে দোয়ার মাধ্যমেই এক সত্তার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে কিন্তু সেসব আত্মা এবং এই সত্তার মধ্যে লক্ষ লক্ষ ক্রোশ দূরত্ব রয়েছে।

হুযূর বলেন, এরপর আপন-পর সবাই হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর এই ভবিষ্যদ্বাণী অত্যন্ত মহিমার সাথে পূর্ণ হতে দেখেছে। এই ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূরণস্থল ছিলেন হযরত মির্যা বশীর উদ্দীন মাহমুদ আহমদ, খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রা.)। জামাতের আলেমগণ এবং সাধারণ সদস্যরা বিশ্বাস রাখতেন, এই ভবিষ্যদ্বাণী হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানীর জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু খিলাফতের ৩০বছর পার হলেও তিনি কখনো আকার-ইঙ্গিতেও একথা বলেন নি যে, এটি আমার সম্পর্কে আর আমিই মুসলেহ্ মওউদ (রা.) সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূরণস্থল। এরপর আল্লাহ্‌র নির্দেশে তিনি ১৯৪৪ সনে নিজেকে মুসলেহ্ মওউদ হিসেবে ঘোষণা দেন।

এরপর হুযূর এই ভবিষ্যদ্বাণী এবং এর পূর্ণতা সম্পর্কে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-এর ভাষায় বর্ণনা করেন। তিনি ২৮শে জানুয়ারী, ১৯৪৪ সনের খুতবায় বলেন, আজ আমি এমন একটি কথা বলবো যা বর্ণনা করা আমার স্বভাব পরিপন্থী। কিন্তু যেহেতু কতিপয় ঐশী বিষয় এর সাথে সম্পর্কযুক্ত তাই মন না চাইলেও একথা বর্ণনা করা থেকে আমি বিরত থাকতে পারছি না। এরপর তিনি তাঁর একটি দীর্ঘ স্বপ্ন বর্ণনা করেন এবং এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, মুসলেহ্ মওউদ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী আল্লাহ্ তা’লা আমার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। মানুষ বার বার এই ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চেয়েছে কিন্তু আমি কখনো মনোযোগ দিয়ে এসব ভবিষ্যদ্বাণী পড়েও দেখিনি। কারণ আমার প্রবৃত্তি যেন আমাকে প্রতারিত না করে আর আমি আমার সম্পর্কে এমন ধারণা করতে আরম্ভ না করে বসি যা বাস্তবতার পরিপন্থী।

তিনি (রা.) আরো বলেন, যার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় তার স্বয়ং দাবী করা আবশ্যক নয়। উদাহরণ স্বরূপ মহানবী (সা.) রেল গাড়ি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তাঁর অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, এটি পূর্ণ হবে, তাই রেল গাড়ির দাবী করা আবশ্যক নয় যে, আমি মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূরণস্থল।

তিনি (রা.) বলেন, আমাদের জামাতের বন্ধুরা এই ভবিষ্যদ্বাণী এবং এই ধরনের অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণী বারবার আমার সামনে উপস্থাপন করেন আর একথার ওপর জোর দেন যে, সেগুলো আমার ক্ষেত্রে পূর্ণ হয়েছে- এ মর্মে আমি যেন ঘোষণা দেই। কিন্তু আমি তাদেরকে সর্বদা একথাই বলেছি, ভবিষ্যদ্বাণী নিজের পরিপূরণস্থলকে নিজেই প্রকাশ করে। যদি এসব ভবিষ্যদ্বাণী আমার সম্পর্কে হয়ে থাকে তাহলে যুগ নিজেই স্বাক্ষ্য দিবে, এসব ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যায়নস্থল আমি। আর যদি তা আমার সম্পর্কে না হয়ে থাকে তাহলে যুগের স্বাক্ষ্য আমার বিপরীতে যাবে। উভয় ক্ষেত্রে আমার বলার কোন প্রয়োজন নেই। যদি এসব ভবিষ্যদ্বাণী আমার সম্পর্কে না হয় তাহলে আমি একথা বলে কেন গুনাহ্‌গার হব যে, এগুলো আমার সম্পর্কে করা হয়েছে। আর যদি সত্যিই আমার সম্পর্কে করা হয়ে থাকে তাহলে আমার ত্বরাপরায়ণ হওয়ার প্রয়োজন কী? সময় নিজেই তা প্রকাশ করবে। মোটকথা যেভাবে ঐশী ইলহামে বলা হয়েছিল, তারা বলে আগমনকারী ব্যক্তি কী ইনিই নাকি আমরা অন্য কারো জন্য পথ চেয়ে থাকব? পৃথিবীর মানুষ এই প্রশ্নের এতবার পুনরাবৃত্তি করেছে যে, প্রশ্ন করতে করতে এক দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। এই দীর্ঘ সময় সম্পর্কেও হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বিভিন্ন ইলহামে সংবাদ রয়েছে। উদাহারণ স্বরূপ হযরত ইয়াকূব (আ.) সম্পর্কে হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ভাইগণ বলেছিল, ইউসুফের কথা বলতে বলতে তুমি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে বা তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর হুবহু একই ইলহাম হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রতিও হয়েছে। একইভাবে এই ইলহাম হওয়া, আমি ইউসুফের সুগন্ধ পাচ্ছি, এটি একথার প্রতি ইঙ্গিত ছিল যে, খোদা তা’লার ইচ্ছার অধীনে এই বিষয়টি দীর্ঘদিন পরে প্রকাশ পাবে। এখনও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে এসব ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে মৃত্যুর নিকটবর্তী সময় পর্যন্তও যদি আমাকে এই জ্ঞান না দেয়া হত যে, এগুলো আমার সম্পর্কে বরং যদি মৃত্যুকাল পর্যন্তও আমাকে এই জ্ঞান না দেয়া হত এতে কোন সমস্যা ছিল না। ঘটনাক্রম নিজেই প্রকাশ করত যে, এসব ভবিষ্যদ্বাণী আমার যুগে এবং আমার হাতে পূর্ণ হয়েছে তাই আমিই এর পরিপূরণস্থল। সমর্থনসূচক কোন কাশ্‌ফ এবং ইলহাম নাযিল হওয়া একটি অতিরিক্ত বিষয়। কিন্তু খোদা তা’লা নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী এ বিষয়টি যেহেতু প্রকাশ করে দেন আর আমাকে তাঁর পক্ষ থেকে জ্ঞানও দান করেন যে, মুসলেহ্ মওউদ সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ আমার জন্যই করা হয়েছে।

এরপর তিনি (রা.) এই ভবিষ্যদ্বাণীতে বর্ণিত মুসলেহ্ মওউদ এর বিভিন্ন গুণ ও বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন এবং সেগুলো তাঁর মাধ্যমে কীভাবে পূর্ণতা পেয়েছে তা বর্ণনা করেন।

উদাহরণস্বরূপ, তিনি তিনকে চার করবেন, সোমবার শুভ সোমবার, তাঁকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পরিপূর্ণ করা হবে, ইত্যাদি। এসব কথা অক্ষরে অক্ষরে নির্ধারিত সময়ে পূর্ণ হয়েছে।

এরপর হুযূর হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) তাঁর সেই বিখ্যাত স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেন, কীভাবে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রা.)-এর সত্তায় পূর্ণ হয়, এ সংক্রান্ত নিজের একটি রুইয়্যা বা সত্য স্বপ্নের উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, আমি সেসব সাদৃশ্য বর্ণনা করছি যা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে আমার স্বপ্নের রয়েছে। তিনি (রা.) বলেন, আমি স্বপ্নে দেখি, আমার মুখ থেকে এই বাক্য নিসৃত হচ্ছে যে, আনাল মসীহুল মওউদু, মসীলুহু ওয়া খলীফাতুহু। এই শব্দগুলো আমার মুখ থেকে নিঃসৃত হওয়া আমার জন্য এতটাই বিষ্ময়কর ছিল যে, আতঙ্কে আমি প্রায় জেগেই উঠেছিলাম, আমার মুখ থেকে এ কেমন শব্দ বের হলো; বাস্তবে তো এটি হতেই পারে, কিন্তু স্বপ্নেও আমার অবস্থা এমনই হয়। পরবর্তীতে কোন কোন বন্ধু মনোযোগ আকর্ষণ করেন, মসীহী নফস হওয়ার উল্লেখ হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৬ সনের বিজ্ঞাপনেও রয়েছে। যদিও সেদিন আমি এই বিজ্ঞাপনটি পড়ে এসেছিলাম কিন্তু আমি যখন খুতবা দিচ্ছিলাম তখন বিজ্ঞাপনের এই শব্দগুচ্ছ আমার স্মরণ ছিল না। খুতবার পর সম্ভবত দ্বিতীয় দিন মৌলভী সৈয়্যদ সরোয়ার শাহ্ সাহেব আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বিজ্ঞাপনেও লেখা আছে, সে পৃথিবীতে আসবে আর নিজের মসীহি সত্তা ও পবিত্র আত্মার প্রসাদে বহুজনকে ব্যধিমুক্ত করবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীতেও মসীহ্ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয়ত আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি প্রতিমা ভাঙ্গছি। এর ইঙ্গিতও হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর এই ভবিষ্যদ্বাণীর দ্বিতীয় অংশে পাওয়া যায়, সে রূহুল হক বা পবিত্র আত্মার কল্যাণে বা প্রসাদে বহু মানুষকে ব্যধিমুক্ত করবে। তিনি (রা.) বলেন, রূহুল হক মূলতঃ তৌহীদের রূহকে বলা হয় আর আসল কথা হলো, খোদা তা’লার সত্তাই হলো আসল আর বাকি সবকিছুই ছায়া বা প্রতিবিম্ব। অতএব রূহুল হক বা পবিত্র আত্মার অর্থ হচ্ছে তৌহীদের প্রাণ যা সম্পর্কে বলা হয়েছিল, সে এর কল্যাণে অনেক মানুষকে ব্যধিমুক্ত করবে। তৃতীয়তঃ আমি (স্বপ্নে) এটিও দেখেছি যে, আমি দৌড়াচ্ছি। স্বপ্নে আমি শুধু এটিই দেখিনি যে, আমি দ্রুত হাঁটছি বরং আমি দৌড়াচ্ছি আর আমার পদতলে ভূমি সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে। প্রতিশ্রুত সন্তান সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীতেও এই শব্দগুলো রয়েছে, সে দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। একইভাবে আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি কতিপয় ভিন দেশে গিয়েছি আর সেখানেও আমি নিজের কর্মকান্ড সমাপ্ত করিনি বরং আমি আরো সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার সংকল্প করছি। যেন আমি বলছি, হে আব্দুশ্ শকূর! এখন আমি সম্মুখে এগিয়ে যাব আর যখন এই সফর থেকে ফিরে আসব তখন দেখব, এই সময়ের মধ্যে তুমি কি তৌহীদকে প্রতিষ্ঠিত করেছ? র্শিককে নির্মূল করেছ? আর ইসলাম এবং হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর শিক্ষাকে মানুষের হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছ? আল্লাহ্ তা’লা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ওপর যে কালাম বা বাণী অবতীর্ণ করেছেন তাতেও এদিকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যেমন লেখা আছে, সে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে সুখ্যাতি লাভ করবে। এই শব্দগুচ্ছও তার দূর-দুরান্তে গমন এবং অগ্রসর হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।

হুযূর বলেন, হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) জামাতের কাছে জ্ঞানের যে ভান্ডার রেখে গেছেন তা আমাদের পাঠ করা উচিত এবং এত্থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।