রোযা ও আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১০-মে, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১০ই মে, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় রোযা ও আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য বিষয়ে আলোকপাত করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর সূরা বাকারার ১৮৪-১৮৭ নং আয়াত তেলাওয়াত করেন ও এগুলোর অনুবাদ উপস্থাপন করেন। এই আয়াতগুলোতে রোযা ফরয হওয়া, এর গুরুত্ব, রমযান মাসে মুমিনদের দায়িত্বাবলী এবং দোয়া গৃহীত হওয়ার পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এমন একটি মাস দান করেছেন, যে মাসে তিনি বান্দাদের সবচেয়ে নিকটে চলে আসেন এবং শয়তানকেও শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেন। তাই আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে যখন এমন অবারিত কল্যাণ ও অনুগ্রহের দ্বার উন্মুক্ত করা হচ্ছে, তখন আমাদের কতটা সাগ্রহে রোযার হক আদায়ে সচেষ্ট হওয়া উচিত! মহানবী (সা.) একবার প্রসঙ্গক্রমে বলেন, ‘যদি তোমরা জানতে রমযানের কী কী কল্যাণ রয়েছে এবং আল্লাহ্ তা’লা এই মাসে কতটা করুণাময় ও দয়াপরবশ হন, তাহলে তোমরা চাইতে যেন সারা বছরই রমযান হয়।’ হুযূর বলেন, এখন তো অ-মুসলিম ডাক্তাররাও একথা স্বীকার করতে শুরু করেছে যে রোযার ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর অনেক সুপ্রভাব পড়ে; এমনকি এ-ও বলছে যে রোযা মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা আনে। এসব জাগতিক লোক ঘোষণা দিক বা না দিক, একজন খাঁটি মুমিন অভিজ্ঞতা দিয়ে জানে যে রোযা একদিকে যেমন তাকে শারীরিকভাবে উন্নতি দান করে, অন্যদিকে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি আধ্যাত্মিকভাবে উপকার বয়ে আনে। তাই আমাদের আল্লাহ্ তা’লার এই নির্দেশ পালনের মাধ্যমে রমযান মাসে নিজেদের আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য পূর্ণ চেষ্টা-প্রচেষ্টা করা উচিত। উল্লেখিত আয়াতগুলো থেকে প্রতিভাত হয়, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অভুক্ত ও পিপাসার্ত থাকাটা রোযার মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং খোদা তা’লার এই নির্দেশের উদ্দেশ্য হল- এক প্রকার খাদ্য কমিয়ে আরেক প্রকার খাদ্য বৃদ্ধি কর; যে খাদ্য দেহের লালন-পালন করে সেই খাদ্য কমিয়ে আত্মার খোরাক বৃদ্ধি কর, যা আত্মাকে তৃপ্ত ও প্রশান্ত করে অর্থাৎ যিকরে ইলাহী বা খোদা তা’লার স্মরণ বৃদ্ধি কর যেন খোদার প্রতি ভালবাসা ও জগদ্বিমুখতা সৃষ্টি হয়।

প্রথম আয়াতটিতে আল্লাহ্ তা’লা রোযা ফরয হওয়ার ঘোষণা দিয়ে এর কারণ হিসেবে বলেছেন, এজন্য রোযা ফরয করা হয়েছে যেন তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। তাকওয়া কী? তাকওয়া হল আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক ত্রুটি থেকে আত্মরক্ষা করা। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাকওয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, মুত্তাকী হতে হলে স্থূল প্রকৃতির পাপ থেকে আত্মরক্ষা করার সাথে সাথে এর বিপরীতে উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করা আবশ্যক। মানুষের সেবা ও উপকারে এতটা সহজাত হতে হবে যেন প্রতীয়মান হয় যে সে আল্লাহ্ তা’লার খাতিরে এসব করছে, এর মাঝে তার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ নেই। আর আল্লাহ্ স্বয়ং এমন ব্যক্তিদের অভিভাবক হয়ে যান, যেমনটি তিনি ঘোষণা দিয়েছেন- ওয়া হুয়া ইয়াতাওয়াল্লাস্ সালিহিন (আর তিনি পুণ্যবানদের অভিভাবক হয়ে যান)। যখন তাকওয়ার এই মান অর্জিত হয়, তখন তা এক রোযাদার মুমিনকে আল্লাহ্ তা’লার ঢালের আড়ালে আশ্রয় দান করে।

হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে, মানুষের সব কর্ম তার নিজের জন্য হয়ে থাকে, একমাত্র ব্যতিক্রম হল রোযা; রোযা আমার খাতিরে রাখা হয়, আর যে ব্যক্তি আমার খাতিরে রোযা রাখে, আমি স্বয়ং এর প্রতিদান হয়ে থাকি বা আমি স্বয়ং এর প্রতিদান দেই। রোযা হল ঢাল; তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রোযা রাখে তবে সে যেন কোন অশ্লীল কথা বা গালিগালাজ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা তার সাথে ঝগড়া করে, তবে তার বলা উচিত- আমি রোযাদার, (আমি কোন বাজে কথা বা কাজ করতে পারি না)। সুতরাং একজন প্রকৃত রোযাদারকে তাকওয়ার এই মান অর্জন করতে হবে। কেবল এতেই খুশি হয়ে গেলে চলবে না যে ‘আমি রোযা রেখেছি’। পৃথিবীতে এমন অনেক রোযাদার আছে যারা বাহ্যত রোযা তো রাখে, কিন্তু তাদের নামায বা চরিত্রের মাঝে সেই মান দেখা যায় না যা এক রোযাদারের হওয়ার কথা। তাই আমাদের শুধুমাত্র রমযান আসায় খুশি হওয়া ও মোবারকবাদ দেয়াই যথেষ্ট নয়; বরং আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত যে আমরা আল্লাহ্ তা’লা রমযানের রোযার যে উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন তা অর্জনের চেষ্টা করছি কি-না। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে তা অর্জনের তৌফিক দান করুন এবং আমাদেরকে নিজ রহমত ও মাগফিরাতের চাদরে আবৃত রাখুন। (আমীন)

অতঃপর হুযূর পরবর্তী আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে থাকেন। যেহেতু রোযার অশেষ কল্যাণ ও মর্যাদা রয়েছে, তাই কেউ যেন আবার রোযা রেখে ভেবে না বসে- আমরা বিশাল কিছু করে ফেলেছি। কিছু মানুষ রোযা রেখে খুব গর্বের সাথে বলে, ‘আমরা রোযা রেখেছি’, অথচ কার্যত সাহরিতেও পেটপুরে খাওয়া হয় আর ইফতারেও চলে ভুরিভোজ। সুতরাং রোযা রেখে সে আল্লাহ্‌র উপর বিরাট কোন অনুগ্রহ করে ফেলেনি, আর অভুক্ত থাকার যে কষ্টটাও সে করছে, তা হাতে গোনা কয়েকটি দিন মাত্র- এটিই আল্লাহ্ তা’লা পরের আয়াতে বলেছেন। প্রকৃত মুমিন তো অনেক বড় বড় কুরবানী করেও ভয়ে থাকে যে কিভাবে আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করবে, গর্ব করা তো দূরে থাক। আবার এর পরপরই ছাড়ও দিয়েছেন, যারা অসুস্থ বা ভ্রমণরত থাকে, তারা রোযা ছেড়ে দিয়ে পরবর্তীতে সেই গণনা পূর্ণ করবে। একইসাথে ফিদিয়ারও উল্লেখ করেছেন। হুযূর ফিদিয়ার দর্শনও তুলে ধরেন। ফিদিয়ার বিধান রাখা হয়েছে যেন মানুষ রোযা রাখার সামর্থ্য লাভ করে। ফিদিয়া দিলে রোযা মাফ হয়ে যায় না, বরং সুস্থতা অর্জনের পর তা রাখা আবশ্যক। হ্যাঁ, যারা স্থায়ীভাবে অসুস্থ কিংবা গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মা- তাদের জন্য ফিদিয়াই যথেষ্ট সাব্যস্ত হবে। কিন্তু এই ধারণা ভ্রান্ত যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও রোযা না রেখে ফিদিয়া দিয়ে দিলেই চলবে, কিংবা একবার যেহেতু ফিদিয়া দেয়া হয়ে গেছে, তাই এখন সামর্থ্য সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও আর রোযা রাখা লাগবে না।

রমযানের সাথে কুরআনের এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যেমনটি আল্লাহ্ তা’লা স্বয়ং বলেছেন। তাই এই মাসে কুরআন বেশি বেশি পড়া ও তাতে গভীর অভিনিবেশ করা আবশ্যক। কোনমতে পড়ে নেয়াই যথেষ্ট নয়, বরং বুঝে বুঝে ও এর মর্মার্থ অনুধাবন করে পড়া উচিত; যেখানে কোন দোয়া আসে, সেখানে থেমে নিজের জন্যও সেই দোয়া করা উচিত; যখন কোন সতর্কবাণী আসে তখনও থেমে দোয়া করা উচিত যেন আমরা তার শিকার না হয়ে যাই। আর বিশেষভাবে জামাতের ব্যবস্থাপনায় যে দরসের আয়োজন করা হয়, তাতে উপস্থিত হয়ে কুরআনের গভীর জ্ঞান অর্জনের সাধ্যানুসারে চেষ্টা করা প্রয়োজন। এমটিএ-তে খলীফা রাবে (রাহে.)-এর কুরআনের দরস প্রচারিত হয়, তা শুনেও নিজেদের জ্ঞান বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা আবশ্যক। তেমনিভাবে দোয়ার দর্শনও এই আয়াতগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। বান্দা জানতে চায় আল্লাহ্ কোথায় আছেন, আল্লাহ্ তা’লা জবাব দেয়াচ্ছেন- আমি নিকটেই আছি, আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা শুনি, বিশুদ্ধচিত্তে তারা যে দোয়া করে তা কবুলও করি। কিন্তু দোয়া কবুল করানোর জন্য দোয়াকারীদেরও উচিত তারা যেন আমার কথা মানে, আমার নির্দেশ পালন করে, আমার উপর বিশ্বাস দৃঢ় করে। আমরা যদি আল্লাহ্‌র নিদের্শাবলী না মানি, আল্লাহ্‌র সাথে প্রকৃত ভালবাসা সৃষ্টির জন্য সচেষ্ট না হই, তাঁর প্রকৃত বান্দায় পরিণত না হই, কেবল বিপদে পড়লেই তাঁকে ডাকি- তাহলে এই অভিযোগ কেন করি যে ‘আমরা অনেক দোয়া করেছি, কিন্তু দোয়া কবুল হয় নি’! হুযূর (আই.) দোয়া কবুল হওয়ার দর্শন বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।

খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে তাঁর প্রকৃত বান্দায় পরিণত করে তাঁর রহমত ও মাগফিরাতের চাদরে আবৃত করে নিন, আমরা যেন এই মাসে তাঁর অনুগ্রহ অর্জনকারী হই। হুযূর আরও বলেন, এই দিনগুলোতে জামাতের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করুন, আল্লাহ্ তা’লা যেন আহমদীয়াতের শত্রুদের ষড়যন্ত্র তাদের উপরই আপতিত করেন; যেখানে যেখানে আহমদীয়াতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, আল্লাহ্ তা’লা যেন সেসব স্থানে তাদের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র উল্টো তাদের উপরেই বর্তান। মুসলিম উম্মাহ্‌র জন্য দোয়া করুন, আল্লাহ্ তা’লা যেন তাদেরকে অত্যাচার করা থেকে ও একে অপরকে হত্যা করা থেকে বিরত করেন এবং তাদেরকে খাঁটি মুসলমানে পরিণত করেন; তারা যেন যুগের ইমামকে মান্যকারী হয়। পৃথিবীর অবস্থার জন্য সার্বিকভাবে দোয়া করুন, পৃথিবী প্রবল বেগে অনেক বড় ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে; আল্লাহ্ তা’লা তাদের বুদ্ধি দান করুন, আর তারা যেন আল্লাহ্ তা’লাকে চিনতে পারে ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। (আমীন)

খুতবার শেষাংশে হুযূর মোকাররম ডা. তাহের আযীয আহমদ সাহেব ও ডা. ইফতেখার আহমদ সাহেবের গায়েবানা জানাযার ঘোষণা দেন, যাদেরকে গত ১৩ মার্চ তাদেরই একজনের কর্মচারী নৃশংসভাবে খুন করে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বাহ্যত এই ঘটনায় আহমদীয়াত সম্পৃক্ত নয়; কিন্তু যেহেতু সেই দেশে সাধারণভাবে এটিই প্রচলিত যে আহমদীদের হত্যা কর, তাহলে পুণ্যও লাভ হবে, আর সরকারও কোন বিচার করবে না- তাই এই দৃষ্টিকোণ থেকে এটি আহমদীয়াতের সাথে সম্পৃক্ত, আর মরহুমদ্বয়ও সেই অর্থে শহীদ বলে সাব্যস্ত হন। হুযূর তাদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন ও তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন। (আমীন)