আল্লাহ্ তাআলার গুণাবলী


ওয়ালিল্লাহিল আসমাউল হুসনা ফাদউবিহা অর্থাৎ, আর সব সুন্দর সুন্দর নাম তাঁরই। অতএব এগুলোর মাধ্যমে তাঁকে ডাক (সূরাতুল আ’রাফঃ ১৮১ আয়াতাংশ)

আল্লাহ্ তাআলার সিফাত বা গুণাবলী বলতে বুঝায় তাঁর ‘আসমাউল হুসনা’ বা সুন্দরতম নামগুলো। তিনি নিরাকার। অনাদি ও অনন্ত। তাঁর গুণাবলী তথা নামগুলোর মাধ্যমেই তিনি প্রকাশিত হন। আর এগুলোর জ্যোতির্বিকাশের মাধ্যমে তাঁকে চেনা ও জানা যায়। আল্লাহকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না। তিনি তাঁর প্রিয় ও মনোনীত ব্যক্তির কাছে দেখা দেন। যেভাবে আল্লাহর পবিত্র কালাম কুরআন মজীদে বলা হয়েছে, লাতুদরিকুহুল আবসারু ওয়াহুয়াইউদরিকুল আবসারা-ওয়া হুয়াল লাত্বীফুল খবীর অর্থাৎ দৃষ্টি তীরনগাল পেতে পারে না কিন্তু তিনি দৃষ্টির নাগাল পেয়ে থাকেন। আসলে তিনি অতি সূক্ষ্ম (ও) সম্যক অবহিত (সূরা আল্ আন’আম : ১০৪)।

কোন কোন লোক বলে থাকেন, ‘যা দেখি না নয়নে তা বিশ্বাস করি না গুরুর বচন।’ কথাটা আপাতদৃষ্টিতে পান্ডিত্যপূর্ণ বলেই মনে হয়। এ দিয়ে তারা বুঝাতে চান, আল্লাহকে চর্ম চক্ষে না দেখলে তারা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু তারা কি ভেবে দেখছেন, সব কিছুই চর্মচক্ষে দেখা যায় না? স্বপ্ন কি তারা চোখ দিয়ে দেখেন? তরকারীর লবণ কি চোখ ডুবিয়ে দেখেন না জিহ্বা দিয়ে দেখেন? তাহলে বুঝা গেল, সব কিছুই চর্মচক্ষে দেখা যায় না। এক একটি জিনিষ দেখার জন্যে এক একটি ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার হয়ে থাকে। এমন কি কোন কোন জিনিষ ইন্দ্রীয়াতীতও। তা দেখার জন্যে ভিন্ন ধরনের চোখের প্রয়োজন। যেমন ক্ষুদ্র বস্তু দেখতে অনুবীক্ষণ যন্ত্র এবং দূরের বস্তু দেখতে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। আল্লাহকেও তাই দেখার জন্যে আধ্যাত্মিক চোখের প্রয়োজন। তবে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর লীলা ও কর্মকান্ড উপলব্ধি করা যায়। আল্লাহকে চর্ম চক্ষে দেখা কক্ষনও সম্ভব নয়। হযরত মূসা (আঃ)-এর জাতি আল্লাহকে চর্মচক্ষে দেখতে চেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল। যুগ ইমাম হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আঃ) আল্লাহ্ তাআলা সম্বন্ধে বলেন,

“…………তার গুণাবলী অনাদি অনন্ত এবং অপরিবর্তনীয়…………। তিনি এরূপ এক সত্তা যে, দূরে থেকেও তিনি নিকটে এবং নিকটে থেকেও দূরে। তিনি এক হলেও তাঁর জ্যোতির্বিকাশ বিভিন্ন মানুষ যখন নিজের মাঝে এক অভিনব পরিবর্তন সৃষ্টি করে তখন তার জন্যে তিনি এক নতুন খোদা হয়ে যান এবং নতুন রূপে তার সাথে আচরণ করেন। মানুষ নিজের আত্মার সংশোধনের পরিমাণ অনুসারে খোদা তাআলার মাঝে এক পরিবর্তন দেখতে পায়। কিন্তু খোদার মাঝে কোন পরিবর্তন সাধিত হয় এমনটি নয়। তিনি অনাদিকাল থেকে অপরিবর্তনীয় এবং পরম গুণের অধিকারী। কিন্তু মানুষ নিজ জীবনের পরিবর্তন আনতে গিয়ে সৎকর্মের প্রতি যখন ধাবিত হয় তখন খোদাও তার কাছে এক নতুন জ্যোতিতে প্রকাশিত হন। মানুষের প্রত্যেক উন্নতিপ্রাপ্ত অবস্থার সাথে সাথে খোদা তাআলার শক্তি ও জ্যোতি তার কাছে নতুন উন্নততর আকারে প্রকাশিত হয়। যেখানে অসাধারণ পরিবর্তন সাধিত হয় তিনিও সেখানে তাঁর অসাধারণ নিদর্শনগুলো প্রদর্শন
করেন। আর মু’জিযা বা অলৌকিক লীলার মূল এটাই” (কিশতিয়ে নূহ)।

আল্লাহ্ তাআলা যেমন অনন্ত অসীম তেমনি তাঁর সিফাত বা গুণাবলীও অনন্ত অসীম। এ পর্যন্ত কুরআন ও হাদীস থেকে তাঁর যেসব গুণ সম্বন্ধে জানা গেছে তা দু’ভাবে ভাগ করা যেতে পারে। একটি হলো ইসমে জাত আর অপরগুলো হলো ইসমে সিফাত

(ক) ইসমে জাত—আল্লাহ্ তাআলার ‘আল্লাহ্’ নামটি ইসমে জাত বা মৌলিক নাম। আল্লাহ্ অর্থ এমন এক সত্তা যা সব গুণের আধার, যাঁর  গুণের প্রতি সবাই আকৃষ্ট হয় এবং আরাধ্য মা’বুদ বা উপাস্য হিসেবে যাকে গ্রহণ করে নেয়। এ নামটি সব রকমের ত্রুটিমুক্ত। “আল্লাহ্ তাঁর সত্তার মৌলিক নাম বিধায়
একে গুণবাচক নামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

(খ) ইসমে সিফাত—গুণবাচক নাম। হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী আল মুসলেহুল মাওউদ (রাঃ) কুরআনের আলোকে দিবাচা কুরআন মজীদ’ (Introduction to the study of the Holy Quran)-এ সংখ্যা ১০৪ বলে সংকলন করেছেন। সূরা ফাতিহার ৪টি সহ এ গুণবাচক নামগুলো অর্থসহ সংকলন করা হলো-(প্রবন্ধকার)

(১) রহমান – পরম করুণাময় অযাচিত-অসীম দানকারী।

(২) আর রহীম – বার বার কৃপকারী।

(৩) রব্বুল ‘আলামীন – গোটা বিশ্বজগতের প্রভু-প্রতিপালক।

(৪) মালিকিইয়াওমিদ্দীন – বিচার দিনের মালিক বা কর্তা।

(৫) আল্ মলিকু – তিনি বাদশাহ্ বা শাসনকর্তা।

(৬) আল্ কুদ্দুসু – অতি পবিত্র সত্তা।

(৭) আস্-সালা-মু – শান্তিদাতা।

(৮) আল মু’মিনু – নিরাপত্তাদাতা।

(৯) আল্ মুহায়মিনু – আশ্রয়দাতা।

(১০) আল্ ‘আযীযু – মহাপরাক্রমশালী।

(১১) আল্ জাব্বারু – শক্তিমান, অগোছালো অবস্থাকে গুছিয়ে দেন যিনি।

(১২) আল্ মুতাকাব্বিরু – গর্ব করার অধিকারী।

(১৩) আল্ খালিকু -সৃষ্টিকর্তা।

(১৪) আল্ বারী – নির্মাণকর্তা।

(১৫) আল্ মুসাব্বিরু – আকৃতিদাতা।

(১৬) আল্ গফফারু -পরম ক্ষমাশীল।

(১৭) আল্ কুহুহরু -প্রভাবশালী, শক্তিশালী।

(১৮) আল ওয়াহ্হাবু – পরমদাতা।

(১৯) আর্‌ রয্‌যকু -পরম রিয্‌ক (জীবনোপকরণ) দাতা।

(২০) আল্ ফাত্তা-হু – যিনি বারবার খুলেন বা উন্মুক্তকারী।

(২১) আল্ ‘আলীমু-সর্বজ্ঞ।

(২২) আল্ ক্বাবিযু – প্রত্যেক বস্তুকে নিয়ন্ত্রণকারী।

(২৩) আল্-বা-সিতু – স্বচ্ছলতা দানকারী।

(২৪) আল খাফিযু – সংকীর্ণতাদানকারী।

(২৫) আর্ রফি’উ – উন্নীতকারী।

(২৬) আল্ মু’ইয্‌যু – সম্মানদানকারী।

(২৭) আল মুযিল্লু – লঞ্ছনাদানকারী।

(২৮) আস্ সামী’উ – সর্বশ্রোতা।

(২৯) আল্ বাসীরু – সর্বদ্রষ্টা।

(৩০) আল্ হাকামু – সঠিক ফয়সালা ও আদেশদানকারী।

(৩১) আল্ আদলু – ন্যায়বিচারকারী।

(৩২) আল্ লাত্বীফু -অতি সূক্ষ্ম যিনি।

(৩৩) আল্ খবীরু – সর্ববিদিত।
(৩৪) আল্ হালীমু -অতিসহিষ্ণু।

(৩৫) আল্ ‘আযীমু– অতি মহান।

(৩৬) আল্ গফুরু – অতি ক্ষমাশীল।

(৩৭) আশ্ শাকুরু -অতি গুণগ্রাহী।

(৩৮) আল্ ‘আলিয়্যু – অতি উচ্চ।
(৩৯) আল্ কাবীরু – অতি বড়।

(৪০) আল্ হাফীযু– সুরক্ষাকারী।

(৪১) আল্ মুক্বীতু – সর্বসক্ষম।

(৪২) আল্ হাসীবু – হিসাব গ্রহণকারী।

(৪৩) আল্ কারীমু – অতি সম্মানিত।

(৪৪) আল জালীলু – মহিমার অধিকারী।

(৪৫) আর্ রক্বীবু – রক্ষক।

(৪৬) আল্ মুজীবু – দেয়া গ্রহণকারী।

(৪৭) আল্ ওয়াসি’উ – প্রাচুর্যদাতা।

(৪৮) আল্ হাকীমু –  পরম প্রজ্ঞাময়।

(৪৯) আল্ ওয়াদুদু – অতি মমতাময়।

(৫০) আল্ মাজীদু – মহামর্যাদাবান।

(৫১) আল্ বা’ইসু – পুনরুত্থানকারী।

(৫২) আশ্ শাহীদু — সব স্থানে বিরাজমান।

(৫৩) আল্ হাক্কু – তাঁর সত্তা স্বয়ং তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষ্যদানকারী এবং সব সত্যের ভিত্তি।

(৫৪) আল্ ওয়াকীলু – প্রকৃত তত্ত্বাবধায়ক।

(৫৫) আল কাবিয়্যু – খুবই শক্তিশালী।

(৫৬) আল্ মাতীনু – খুবই ক্ষমতাধর।

(৫৭) আল্ ওয়ালিয়্যু – অভিভাবক, বন্ধু।

(৫৮) আল্ হামীদু — সব প্রশংসার অধিকারী, প্রশংসাময়।

(৫৯) আল্ মুহসিয়্যু – প্রত্যেক বস্তুকে গণনাকারী।

(৬০) আল্ মুবদিয়্যূ – সূচনকারী।

(৬১) আল্ মু’ঈদু – দ্বিতীয়বার সৃষ্টিকারী।

(৬২) আল্ মুহ্ঈ‌ –  জীবনদানকারী।

(৬৩) আল্ মুমিতু –  মৃত্যুদনকারী।

(৬৪) আল্ হাইয়্যু – চিরঞ্জীব জীবনদাতা

(৬৫) আল্ ক্বাইয়্যূমু – চিরস্থায়ী স্থিতিদাতা।

(৬৬) আল্ ওয়া-জিদু – প্রত্যেক বস্তুকে ধারণ ও নিয়ন্ত্রণকারী।

(৬৭) আল্ মাজিদু – অতি সন্ত্রস্ত সত্তা।

(৬৮) আল্ ক্বদীরু – কুদরত বা শক্তি ও মহিমার অধিকারী।
(৬৯) আল্ মুক্‌ তাদিরু — সব কুদরত ও মহিম তার কব্জায়।

(৭০) আল মুক্বদ্দিমু – যিনি সামনে এগিয়ে দেন।

(৭১) আল্ মুয়াখখিরু – যিনি পিছনে হটিয়ে দেন।

(৭২) আল্ আওওয়ালু – সর্বপ্রথম, আদি।

(৭৩) আল্ আখিরু — সর্বশেষ, অন্ত।

(৭৪) আবূ যাহিরু – তিনি অতি প্রকাশ ও সব কিছু পরিশেষে তাঁর অস্তিত্ব প্রকাশ করে।

(৭৫) আল্ বাত্বিনু – তিনি অতি গুপ্ত এবং প্রত্যেক বস্তুর গুঢ়-তত্ত্ব তাঁর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
(৭৬) আল্ ওয়ালী – শাসনকর্তা।

(৭৭) আল্ মুতা’আলী – পবিত্রগুণের অধিকারী।

(৭৮) আল্ বার্‌রু – উচ্চস্তরের সদাচরণকারী।

(৭৯) আত্ তাওয়াবু – সদয় তওবা গ্রহণকারী।
(৮০) আল্ মুন’ইম – পুরস্কার দাতা।

(৮১) আল্ মুনতাক্বিম — যথোচিত শাস্তিদাতা।
(৮২) আল্ আফ্‌উ – পাপ উপেক্ষাকারী, পাপ মোচনকারী।

(৮৩) আর্ রউফু – পরম স্নেহ মমতাশীল।

(৮৪) মা-লিকুল মুলকি – রাজ্যের মালিক।

(৮৫) যুল জালালি ওয়াল ইকরম – প্রবল প্রতাপান্বিত এবং দান ও সম্মানের অধিকারী।

(৮৬) আল্ মুকসিতু – ন্যায়বিচারক।

(৮৭) আল্ জা-মি’উ– সমবেতকারী।

(৮৮) আল্ গনী’উ – অভাবহীন, প্রাচুর্যশালী, বেপরওয়া।

(৮৯) আল্ মুগনী – অভাব দূর করেন যিনি, প্রাচুর্যদাতা।

(৯০) আল্ মা-নিউ – বাধাদানকারী।

(৯১) আয্‌ যার্‌রু — দুষ্টকে শাস্তিদাতা।

(৯২) আল্ না-ফি’উ – উপকার করেন যিনি।

(৯৩) আল্ নূর – জ্যোতি, জ্যোতি দানকারী।

(৯৪) আল্ হা-দীউ হেদায়াতদাতা।

(৯৫) আল্ বাদী’উ – নতুন সৃষ্টিকর্তা।

(৯৬) আল্ বা-ক্বীউ – সবশেষে যিনি থাকেন।

(৯৭) আল্ ওয়া-রিসু – সবার উত্তরাধিকারী।

(৯৮) আর্ রশীদু – পুণ্যপথ দেখান যিনি।

(৯৯) আস্ সবুর – পরম ধৈর্যশীল।

(১০০) যুল ‘আরশ – আরশের অধিকারী।

(১০১) যুলওয়া ক্বা-র – প্রত্যেক কাজ যুক্তিপ্রমাণ ও প্রয়োজন অনুযায়ী করেন যিনি।

(১০২) আল্ মুতাকাল্লিমু – কথা বলেন যিনি

(১০৩) আশ্ শা-ফী -আরোগ্যদাতা।

(১০৪) আল্ কা-ফী – সব প্রয়োজন দূর করেন যিনি।

(১০৫) আল্ আহাদু – এক-অদ্বিতীয়।

(১০৬) আল্ ওয়াহিদু – সম্পূর্ণ এক বা একাকী।

(১০৭) আস্ সামাদু — স্বনির্ভর, সর্বনির্ভর স্থল।

(১০৮) আর্ রফীকু – অতি কোমল, বন্ধু। (এটি হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর কাছে ইলহামের মাধ্যমে প্রকাশিত)।

আল্লাহ্ তাআলা তাঁর প্রতি সদা বিনয়াবনত বান্দাদেরকে তার পূর্ণ মা’রেফত বা তত্ত্বজ্ঞান দান করার জন্যে কুরআন মজীদে নিজ গুণাবলী দু’ভাবে প্রকাশিত করেছেন। এগুলো হলো:

(১) সিফাতে তানযিহিয়্যাহ্ (অনতিক্রম্য বা Non Transcendental)
(২) সিফাতে তাশবিহিয়্যাহ (সাদৃশ্যসূচক, অতিক্রম্য বা Immanent)।

উদাহরণস্বরূপ সূরা ইখলাসে আল্লাহ্ তাআলার ৪টি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো সিফাতে তানযিহিয়্যাহ্। এগুলো চিরস্থায়ী, অতুলনীয় ও আল্লাহ্ তাআলার অনন্য গুণ। মানুষ বা কোন সৃষ্ট জীব কোন ভাবেই এগুলো ধারণ বা অবলম্বন করতে পারে না। এগুলো হলো:
(১) আল্ আহাদ অর্থাৎ এক অদ্বিতীয়। সৃষ্টির সব কিছুই জোড়া জোড়া কেবল মাত্র আল্লাহ্ই এক-অদ্বিতীয়। আর কোনকিছু অদ্বিতীয় হতে পারেনা।

(২) আস্ সামাদ অর্থাৎ স্বনির্ভর, সর্বনির্ভরস্থল। কোন সৃষ্টির মাঝেই এগুণটি পরিলক্ষিত হয় না বা হতে পারে না

(৩) লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইউলাদ অর্থাৎ আল্লাহ্ই একমাত্র সত্তা যিনি কাউকে জন্ম দেননি বা তিনি কারও মাধ্যমে জন্মও নেন নি। যা কিছু জন্ম দেয় বা জন্ম
নেয় তা আল্লাহ্ হতে পারে না এবং

(৪) কুফুওওয়ান আহাদ অর্থাৎ তার সমতুল্য এবং সমকক্ষ কেউ নেই। কোন দিক দিয়েই কোন সত্তা আল্লাহর সমতুল্য এবং সমকক্ষ হতে পারে না। এদিক থেকেও তিনিই এক অদ্বিতীয়।

এমনিভাবে সূরা ফাতিহাতে ৪টি গুণের বর্ণনা এসেছে। এগুলো মানবের মাঝ থেকে নিজ নিজ ক্ষমতা ও পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী বিকশিত হতে পারে। এসব গুণ সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছিল বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে। তিনি (সাঃ) ছিলেন ঐশী গুণাবলীর
পূর্ণ বিকাশম্ভুল। এগুলো হলোঃ

(১) রববুল ‘আলামীন অর্থাৎ গোটা বিশ্ব জগতের প্রভু প্রতিপালক।

(২) আর রহমান অর্থাৎ পরম করুণাময় অযাচিত-অসীম দানকারী।

(৩) আর রহীম অর্থাৎ কর্মের প্রতিদানদাতা, বার বার কৃপকারী এবং
(৪) মা-লিকিইয়াওমিদ্দীন অর্থাৎ বিচার দিনের মালিক বা কর্তা।

 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বলা হয়ে থাকে ৮ জন ফিরিশ্‌তা আল্লাহ্‌ তাআলার ‘আরশ’ বহন করে থাকে। উপরোক্ত আটটি গুণই হলো সেই ফিরিশ্তাদের প্রতিভূ। আল্লাহ্ তাআলার অন্য যেসব নাম বা গুণ রয়েছে সেগুলো এ আটটি গুণের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত।
আস্ সাত্তার অর্থাৎ যিনি ঢেকে রাখেন বলেও আল্লাহর একটি নাম আছে বলে জানা যায় কিন্তু কুরআনে এর উল্লেখ নেই। এভাবে অনন্ত অসীম আল্লাহ্ তাআলার আরও অনেক নাম থাকতে পারে।

হযরত মুসলেহ্ মাওউদ (রাঃ) ‘দিবাচা কুরআন মজীদে’ বলেন, ‘এসব নামের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিলে আধ্যত্মিক জগতের পরিকল্পনা সম্বন্ধে ভালভাবে অবহিত হওয়া যেতে পারে যা কুরআন উপস্থাপন করেছে। এসব নাম মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ

প্রথমত সেসব গুণ যা কেবল আল্লাহর সত্তার সাথেই সম্পর্ক রাখে। এদের সাথে সৃষ্টির কোন সম্পর্ক নেই। যেমন আল্ হায়্যু অর্থাৎ চিরঞ্জীব-জীবনদাতা। আল্ ক্বদরু অর্থাৎ শক্তিও মহিমার অধিকারী। আল্ মা-জিদু অর্থাৎ অতি সম্ভ্রান্ত সত্তা ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ত রয়েছে সেসব গুণ, যা সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত। এগুলো খোদা তাআলা এবং তাঁর সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক নির্দেশ করে এবং এদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গীও নির্দেশ করে। যেমন আল্ খালিকু, আল্ মালিকু ইত্যাদি।

তৃতীয়ত রয়েছে সেসব গুণ খোদার সৃষ্টির স্বেচ্ছাপূর্বক ভাল মন্দ কর্মের দরুন আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে যা প্রকাশিত হয়। যেমন রহীম, মা-লিকিইয়াওমিদ্দীন, আফু, রউফ প্রভৃতি।

‘কোন কোন গুণ বাহ্যিকভাবে সমার্থবোধক বা পুনরাবৃত্তিমূলক বলে মনে হয়। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে জানা যায়, এদের মাঝে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। সৃষ্টি করার ব্যাপারে আল্লাহ্‌র কয়েকটি গুণ বর্ণিত হয়েছে।
যেমন সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, আল্ বদিউ, আল্ ফাতিরু, আলু খালিকু, আলু বা-দী, আল্ মুঈদু, আল্ মুসাব্বিরু, আর্ রব্ব। 

এসব গুণ আপাতদৃষ্টিতে পুনরুক্তি বলে দৃশ্যমান হলেও আসলে এসব গুণ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অর্থে প্রয়োগ হয়ে থাকে। সবকিছুর সৃষ্টি কর্তা দিয়ে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তাআলা আত্মা ও পদার্থকে (Matter)-ও সৃষ্টি করেছেন। কেননা কোন কোন জাতি খোদাকে কেবল সংযোজনকারী (Assembler) বলে মনে করে থাকে। সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মনে করে না।

কোন কোন লোক এসব গুণ দেখে ধোকায় পড়ে যায় যে এসব গুণ পরস্পর অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়। যেমন, খোদা তাআলা পরম দয়ালু এবং তিনি শাস্তিও দিয়ে থাকেন। খোদা তাআলা অভাবমুক্ত এবং প্রাচুর্যশীলও আবার সৃষ্টিও তিনি করে থাকেন। আর মানবমন্ডলীর জন্যে হেদায়াতদাতাও প্রেরণ করে থাকেন।

এর অর্থ দাঁড়ায়, এসব বস্তুসত্তা লাভ করুক এ ব্যাপারে তাঁর আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এসব প্রশ্ন সাধারণত সেসব মস্তিষ্কে সৃষ্টি হয় যারা গভীরভাবে চিন্তা করে না। ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে দেখে। তারা এর তাৎপর্য বুঝে না। বিশ্বের প্রকৃত সৌন্দর্যের অনেকাংশই এর বিভিন্নমুখিতার কারণে পরিদৃষ্ট হয়। এসব লোক এটা চিন্তা করে না যে, প্রত্যেক বস্তুই নিজস্ব পৃথক পৃথক সীমার বাঁধনে আবদ্ধ অথবা শিকলের কড়ার ন্যায় একটি কড়া শেষ হলে অন্যটি আরম্ভ হয়। নিঃসন্দেহে খোদা তাআলা শাস্তিও দিয়ে থাকেন। কিন্তু শাস্তি দেয়ার জন্যে তাঁর কিছু নিয়ম কানুন নির্ধারিত রয়েছে। সেই নিয়ম কানুনের চাহিদা অনুযায়ী তিনি শাস্তি দেন। আবার সেই  নিয়মকানুনের বিপরীতে যখন নিজের মার্জনা গুণ কার্যকরী করার যে নিয়মকানুন তিনি নির্ধারিত করেছেন এর চাহিদা বেড়ে যায় তখন মার্জনাও করেন। কোন মানুষের জন্যে তাঁর সৃষ্টি করার গুণ কার্যকর হয়ে থাকে এবং কোন মানুষের জন্যে তার মৃত্যু দেয়ার গুণ কার্যকরী হয়ে থাকে। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলার গুণাবলীর মাঝে কোন বিরোধ নেই বরং কোন গুণ কোন গুণের সহায়ক হিসেবেও বিকশিত হয়ে থাকে।

‘আসল কথা এই, আল্লাহ্ তাআলার গুণাবলী দৃটি নিয়মের অধীন কার্যকর হয়ে থাকে। যেসব গুণ মানবমন্ডলীর সাথে সম্পর্ক রাখে এদের পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য আল্লাহ্ তাআলা কুরআন শরীফে দু’টি বিধান উপস্থাপন করেছেন। একটির উল্লেখ রহমাতী ওয়াসিআত কুল্লা শায়ইন (সূরা আ’রাফ : ১৫৭)-এ এসেছে। এর অর্থ হলো, আমার কৃপা সব কিছুর ওপর প্রাধান্য লাভ করেছে।

দ্বিতীয় বিধান কুরআন করীমে এভাবে বলা হয়েছে মা লাকুম লা তরজুনালিল্লাহি ওক্বরা (সূরা নূহ :১৪)। অর্থাৎ তোমাদের কি হয়েছে, তোমরা খোদাতাআলার ব্যাপারে এটা চিন্তা কর না যে, তিনি তাঁর কাজকর্মে প্রজ্ঞাকে দৃষ্টিপটে রাখেন? সুতরাং আল্লাহ্ তাআলার গুণাবলীর বিকাশ তাঁর প্রজ্ঞার মাধ্যমে সময় ও চাহিদা
অনুযায়ী বিকশিত হয়। এতে বৈপরিত্য লক্ষ্য করার কোন হেতু নেই’।

আল্লাহ্ তাআলার গুণাবলীর কোন কোনটি কোনটির সম্পূরক হিসেবেও কাজ করে এর মাহাত্ম্য ও মর্যাদা অতি উচ্চে তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আল্লাহ্ তাআলা আহকামুল হাকেমীন (সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক) বা মা-লিকিইয়াওমিদ্দীন (বিচার দিনের মালিক)। এ কেবল সেই সত্তাই হতে পারেন যিনি আলীমুল গায়েব (অদৃশ্যের জ্ঞাতা)ও বটেন। আবার রহমান (পরম করুণাময় অযাচিত-অসীম দানকারী) তিনিই হতে পারেন যিনি গনি(প্রাচুর্যশালী, অভাবমুক্ত)ও। এভাবে আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

আল্লাহর সিফাত বা গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্যে তথা আল্লাহ্ ইবাদত ও উপাসনা করার জন্যে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সিবগাতাল্লাহি ওয়া মােন আহসানু মিনাল্লাহি সিবগাহ্ আল কুরআনের আয়াত (২: ১৩৯) এবং তাখাল্লাকুবি আখলাকিল্লাহ্ হাদীসেও এ কথার সমর্থন পাওয়া যায়। এ মানুষই যখন আল্লাহ্‌র গুণে গুণান্বিত হয়ে আল্লাহ্‌র মত রং ধারণ করে যেভাবে লোহা আগুনে পুড়ে আগুনের রং ধারণ করে তখন কোন কোন মানুষ ভুল করে তাকেই আবার আরাধ্য বলে ভুল করে বসে। ইসলামের পূর্ববর্তী কোন কোন ধর্মে ভুলবশত মানুষকেই ‘ভগবান’ ‘খোদাবন্দ খোদা’ এর স্থান দিয়েছে বা এখনও অনেক ফিরকা বা দল তাদের পীর মুর্শেদকে খোদার অনুরূপ স্থান দিয়ে বলে থাকে মুর্শিদ খোদা সে জুদা নেহি।” (পথের দিশারী খোদা থেকে আলাদা নয় অর্থাৎ তিনিই আরাধ্য) ইত্যাদি। এসবই ভুল ধ্যান ধারণাপ্রসূত। সত্যের সাথে এর সামান্যতম সম্পর্ক নেই। অথচ এ প্রসঙ্গে কুরআন আমাদের আগেই শিক্ষা দিয়েছে- লায়সা কা মিসলিহী শায়উন অর্থাৎ কোন কিছুই তাঁর মত হতে পারে না (৪২:১২)।

এ প্রসঙ্গে যুগ ইমাম হযরত ইমাম মাহদী ও মসীহ্ মাওউদ (আঃ) একটা উদাহরণ দিয়ে বলেন:

এসব গুণ তার সত্তার সাথে যথোপযোগী। এগুলো মানুষের গুণের মত নয়। তার চোখ কোন দেহ বা দৈহিক নয়। তাঁর গুণ মানুষের গুণের মত নয়। যেমন মানুষ তাঁর রাগের সময় প্রথমে নিজেই রাগজনিত কষ্ট পায়। উত্তেজনা ও রাগের দরুন তখন তখনই তার অন্তরের প্রশান্তি দূর হয়ে জ্বলন সৃষ্টি হয় এবং তার মাথায় চাপ সৃষ্টি হয় এবং তার সবটা অবস্থার মাঝে এক প্রকার পরিবর্তন দেখা দেয়। কিন্তু খোদা এসব পরিবর্তন থেকে মুক্ত। তাঁর রাগের অর্থ এটাই, যে-ব্যক্তি অসৎ কাজ থেকে বিরত হয় না, তার ওপর থেকে তিনি তাঁর সাহায্যের ছায়া সরিয়ে নেন এবং তাঁর আদি প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী তার সাথে ঠিক তেমনই আচরণ করেন যেমন আচরণ করে কোন রাগান্বিত ব্যক্তি। এ কারণেই রূপকভাবে খোদার এ আচরণকে বলা হয় তার রাগ বা গযব। তেমনি তাঁর ভালবাসা মানুষের ভালবাসার মত নয়। কেননা, মানুষ ভালবাসার কারণেও কষ্ট পায়। তার ভালবাসার পাত্র পৃথক বা আলাদা হয়ে গেলে তার মনে কষ্ট লাগে। কিন্তু খোদা এসব কষ্ট থেকে পবিত্র। এভাবেই তাঁর নৈকট্য মানুষের নৈকট্যের মত নয়। কেননা, মানুষ যখন একজনের নিকটস্থ হয় সে তখন তার আগের অবস্থা পরিহার করে।কিন্তু খোদা নিকট হওয়া সত্ত্বেও দূর এবং দূর হওয়া সত্ত্বেও নিকট। সংক্ষেপে খোদা তাআলার প্রত্যেকটি গুণ মানুষের গুণ থেকে আলাদা। এতে সাদৃশ্য শুধু শব্দের বা কথার। এর বেশি নয়। তাই আল্লাহ্ তাআলা কুরআন করীমে বলেছেন—লায়সাকা মিসলিহী শায়উন অর্থাৎ কোন কিছুই নিজ সত্তা বা গুণাবলীতে খোদার মত নয়” (চশমা মা’রেফত, পৃষ্ঠা ২৬০-২৬৪)।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে আল্লাহর গুণাবলী সম্বন্ধে আমরা কেন আলোচনা করবো? প্রবন্ধের প্রারম্ভে যে আয়াতে করীমার উল্লেখ করেছি সেখানে এর জবাব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে-সুন্দর সুন্দর নাম তাঁরই। অতএব এগুলোর মাধ্যমে তাঁকে ডাক। হাদীস থেকেও এ প্রসঙ্গে জানা যায়। একটি হাদীসে এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ

একবার হযরত রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা (রাঃ) কে বলতে লাগলেন, আল্লাহ্ তাআলার এমন একটি সিফত বা গুণের নাম আমি জানি যে নামের দোহাই দিয়ে দোয়া করলে তা অবশ্যই কবুল হয়। হযরত আয়েশা অতি উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, হুযূর! তাহলে আমাকেও সে গুণটি বলুন না? হুযুর (সাঃ) বল্লেন, আমার ধারণায় এটা বলা সমীচীন নয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) রাগ করে অন্য দিকে গিয়ে বসলেন যে, এখন হুযুর (সাঃ) নিজেই বলবেন। কিন্তু আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম কিছু সময় পার হওয়ার পরও যখন বল্লেন না তখন আশ্চর্য এক উৎসাহের ভঙ্গীতে নিজেই উঠলেন এবং রসূলে করীম (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর কপালে চুমু খেলেন এবং আকুতি-মিনতি করে নিবেদন করলেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল (সাঃ)! আমাকে সেই গুণটি অবশ্যই বলুন। আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম বল্লেন, হে আয়েশা! আসল কথা এই, সেই গুণের দোহাই দিয়ে পার্থিব কোন জিনিষ বৈধ নয়। এজন্যে আমি বলতে চাই না। তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) অসন্তুষ্ট হয়ে সেখান থেকে উঠে পড়লেন। ওযু করলেন, নামাযের বিছানা বিছালেন এবং আঁ হুযূর (সাঃ)-কে শুনিয়ে শুনিয়ে উচু শব্দে দোয়া করতে লাগলেনঃ

হে আমার প্রভু, তোমার সব পবিত্র নাম ও উত্তম গুণাবলীর দোহাই দিয়ে সেসব গুণ যা আমার জানা আছে আর যা আমার জানা নেই তুমি তোমার এ বাঁদীর সাথে ক্ষমার আচরণ কর। আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম পাশে বসে হাসছিলেন এবং বলছিলেন, হে আয়েশা! নিঃসন্দেহে সেই গুণটি যেসব সিফতের অন্যতম যা তুমি গুণে এসেছে (ইবনে মাজাহ, কিতাবুদ দোয়া)।

অতএব দোয়ার কবুলিয়তের সাথে ঐশী গুণাবলীর এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

ইনসান অর্থ মানুষ। ইনসান বলতে এমন সত্তাকে বুঝায় যার মাঝে দু’টি “উনস’ অর্থাৎ দু’টি ভালবাসা নিহিত। একটি স্রষ্টার প্রতি অপরটি সৃষ্টির প্রতি। তাই স্রষ্টা বা আল্লাহ্‌র প্রতি ভালবাসার বৈশিষ্ট্য মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতিতে নিহিত করে রাখা হয়েছে। ভালবাসার পাত্র বা প্রেমাস্পদের স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কে না জানলে তাকে সঠিকভাবে ভালবাসা যায় না। আর মানুষ যাকে ভালবাসে তার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। প্রেমিকার কপোলের কালো তিলটি নিয়ে ফাসী সাহিত্যের কবিরা যে কত পংক্তি রচনা করেছেন তা সাহিত্যিক মাত্রেই অবহিত।
ভালবাসার পাত্রের সর্বৈব অনুসরণ অনুকরণ করারও যে চেষ্টা করা হয় এটাও সর্বজনবিদিত। তাই আল্লাহ্‌র সাথে ভালবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হলে তাঁর স্বভাব প্রকৃতি তথা গুণাবলী সম্বন্ধে অবশ্যই ওয়াকেবহাল থাকতে হবে। তা না হলে ভালবাসা সঠিক ও গভীর হবে না। এ প্রসঙ্গে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) কয়েকটি পংক্তি স্মর্তব্যঃ

বিন দেখে কিস তারাহ্ কেসি মাহবুব পে আয়ে দিল

কিঁউকার কোই কিসি খেয়ালি সনম সে লাগায়ে দিল।

অর্থাৎ চোখে না দেখে কোন চন্দ্রমুখীকেও কিভাবে কে ভালবাসতে পারে?

কল্পিত প্রেমাস্পদকে কিরূপে কেউ মন দিতে পারে?

আগেই আলোচনা করেছি, আল্লাহকে চর্ম বা বাহ্যিক চোখে দেখা যায় না। তাকে তাঁর গুণাবলীর মাধ্যমেই দেখা যেতে পারে। আর তাঁর গুণাবলী সম্বন্ধে এ কারণেও অবহিত হওয়া আবশ্যক যেন প্রয়োজনের সময় তাঁর সঠিক নামটি ধরে তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় বিষয়ের জন্যে আবেদন ও দোয়া করা যায় যেভাবে উল্লেখিত আয়াতে করীমায় আল্লাহ্ তাবারক তাআলা আদেশ দিয়েছেন।

আল্লাহ্ তাআলার গুণাবলী উপলব্ধি করার বিষয়টি যে অতি গুরুত্বপূর্ণ তা আমাদের প্রিয় খলীফা (আইঃ) কর্তৃক ইদানিং কালে প্রদত্ত আল্লাহ্ তাআলার গুণাবলীর ওপর খুতবা প্রদান থেকেও বোধগম্য হয়। দোয়ার কবুলিয়ত সম্পর্কে হযরত ইমাম মাহদী ও মসীহ্ মাওউদ (আঃ) অনেক আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেনঃ

“এ ধারণা করো না আমরা পাপী আমাদের দোয়া কি করে কবুল হবে? মানুষ ত্রুটিবিচ্যুতি করে ফেলে। কিন্তু দোয়ার কল্যাণেই অবশেষে কু-প্রবৃত্তির ওপর বিজয়ী হয়ে থাকে এবং কুপ্রবৃত্তি পদদলিত করে দেয়। কেননা, খোদা তাআলা মানুষের মাঝে এ শক্তিও স্বাভাবিকভাবে নিহিত রেখেছেন যেন সে কুপ্রত্তির ওপর বিজয় লাভ করে। দেখ, পানির স্বভাবে আগুন নিবিয়ে দেয়ার শক্তি নিহিত। সুতরাং পানি যতই গরম কর না কেন এ যখন আগুনে পড়বে তখন অবশ্যই আগুন নিবিয়ে দেবে। যেভাবে পানির প্রকৃতিতে পবিত্রতা নিহিত রয়েছে প্রত্যেক ব্যক্তির মাঝে আল্লাহ্‌ তাআলা পবিত্রতার উপকরণ নিহিত রেখেছেন। আমরা পাপে ডুবে আছি বলে ভয় পেও না। পাপ সেই ময়লার মত যা কাপড়ে থাকে এবং দূর করা যায়। তোমাদের প্রকৃতিতে কুপ্রবৃত্তির আবেগ যতই ভরপুর থাকুক খোদা তাআলার
কাছে কেঁদে কেঁদে দোয়া করতে থাকো। তিনি তোমাদের বিফল করবেন না। তিনি পরম সহিষ্ণু। তিনি পরম ক্ষমাশীল ও বার বার কৃপকারী (বদর ১৭ এপ্রিল, ১৯০৭ জলসা সালানার বক্তৃতা)।

আল্লাহ্ তাআলা আমাদের সবাকে এ গুঢ়তত্ত্ব উপলব্ধি করার এবং তদনুযায়ী আল্লাহ্ তাআলার বিনীত বান্দা হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন।

প্রবন্ধ: আল্লাহ্ তাআলার গুণাবলী – আলহাজ্জ মোহাম্মাদ মুতিউর রহমান

পাক্ষিক আহ্‌মদী – নব পর্যায় ৭০ বর্ষ | ১তম সংখ্যা | ১৫ই জুলাই ২০০৭ইং | পৃষ্ঠা ১৫ -১৯