প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ ও ইমাম মাহ্‌দী (আ.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৩-মার্চ, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৩শে মার্চ, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ ও ইমাম মাহ্‌দী (আ.) প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, আজ ২৩শে মার্চ, আজকের দিনটি আহমদীয়া জামাতে মসীহ্ মওউদ দিবস হিসেবে সুপরিচিত। এদিনে এই দিবসের ইতিহাস, গুরুত্ব ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বিভিন্ন সভায় আলোচনা করা হয়।

এরপর হুযূর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনাসমগ্র থেকে তাঁর আবির্ভাবের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, আবশ্যকতা ও তাঁর পদমর্যাদা প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আবির্ভাবের পর মুসলমান আলেমগণ তাঁর বিরুদ্ধে জনসাধারণকে উত্তেজিত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছে এবং নিরন্তর করে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও আল্লাহ্‌র সাহায্য ও সমর্থনে তাঁর জামাত ক্রমাগত উন্নতি করছে।

হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি (আ.) ঐশী প্রতিশ্রুতি অনুসারে তাঁর আগমন ও প্রতিশ্রুত মসীহ্ হবার ঘোষণা করতে গিয়ে বলেন, “প্রকৃত তওহীদ, মহানবী (সা.)-এর পবিত্রতা, সম্মান ও সত্যতা এবং কুরআনের ঐশীবাণী হবার যে দাবী এরপ্রতি অন্যায় ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে আক্রমণ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ তা’লার আত্মাভিমান কি এই দাবী করে না যে, তিনি সেই ক্রুশ-ভঙ্গকারীকে প্রেরণ করেন? আল্লাহ্ কি স্বীয় প্রতিশ্রুতি ‘ইন্না নাহনু নায্যালনায্ যিকরা ওয়া ইন্না লাহু লাহাফিযুন’ ভুলে গিয়েছেন? নিশ্চিত স্মরণ রেখো, আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুতি সত্য। তিনি স্বীয় প্রতিশ্রুতি অনুসারে পৃথিবীতে এক সতর্ককারী প্রেরণ করেছেন, কিন্তু পৃথিবী তাকে গ্রহণ করে নি; তবে খোদা অবশ্যই তাঁকে গ্রহণ করবেন এবং প্রবল আক্রমণ সমূহ্ দ্বারা তাঁর সত্যতা প্রকাশিত করবেন। আমি তোমাদেরকে সত্য সত্যই বলছি, আমি খোদার প্রতিশ্রুতি অনুসারে মসীহ্ মওউদ হিসেবে এসেছি। চাইলে আমাকে গ্রহণ কর নতুবা অস্বীকার কর; তবে তোমাদের অস্বীকারে কিছুই যায় আসে না, কেননা, খোদা তা’লা যা সংকল্প করেছেন তা হবেই হবে। কেননা, পূর্বেই খোদা তা’লা বারাহীনে আহমদীয়ায় বলে দিয়েছিলেন, ‘সাদাকাল্লাহু ও রাসূলাহু ওয়া কানা ওয়াদাম মাফউলা’ অথাৎ, আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের কথা সত্য প্রতিপন্ন হয়েছে আর খোদার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়েছে।

এরপর হুযূর একে একে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনা সমগ্র হতে বিভিন্ন নির্বাচিত অংশ পাঠ করেন যার সারমর্ম হল, জগদ্বাসীকে উদ্দেশ্য করে তিনি (আ.) বলেছেন, “আমার জামাতকে নবুওয়তের মাপকাঠিতে যাচাই কর, তারপর দেখ সত্য কার সাথে আছে। যেভাবে আল্লাহ্‌র প্রেরিত নবী-রসূলগণের সত্যতা যাচাই করা হয় সেই একই পদ্ধতিতে আমার বিষয়টি যাচাই কর। যে খোলা মনে আমার কথা শুনবে ও যাচাই করবে, সে অবশ্যই উপকৃত হবে। আমি যদি মিথ্যাবাদী হতাম, তবে আল্লাহ্ তা’লা অনেক আগেই আমাকে ধ্বংস করে দিতেন”।

তিনি আরও বলেছেন, “আমাকে অস্বীকার করা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে অস্বীকারের নামান্তর। যে ব্যক্তি আমাকে অস্বীকার করে, সে মৌখিকভাবে না হলেও নিজ কর্মকাণ্ড দ্বারা আল্লাহ্ ও রসূল (সা.)-কে অস্বীকার করে। কারণ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্‌র এই প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, ‘ইন্না নাহনু নায্যালনায্ যিকরা ওয়া ইন্না লাহু লাহাফিযুন’ অর্থাৎ ‘আমরাই এই যিকর অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই এর সুরক্ষাকারী’- এই দাবী অনুসারে ইসলামের ওপর বিভিন্ন ধর্মের সম্মিলিত আক্রমণের এই ভয়াল যুগে ইসলামের প্রতিরক্ষায় কারো আগমন আবশ্যক ছিল।

অনুরূপভাবে আয়াতে ইস্তেখলাফের প্রতিশ্রুতি অনুসারে উম্মতে মুহাম্মদীয়াতেও মূসায়ী উম্মতের ন্যায় কোন খলীফার আগমন হওয়ার কথা। আবার পবিত্র কুরআনে মুহাম্মদ (সা.)-কে মূসার সদৃশ আখ্যা দেয়া হয়েছে, তাই সাদৃশ্যের দাবী অনুসারে যেভাবে মূসা (আ.)-এর পর চতুর্দশ শতাব্দীতে মরিয়ম পুত্র মসীহ্ (আ.) এসেছিলেন, তেমনিভাবে এই উম্মতেও চতুর্দশ শতাব্দীতে এক মসীহ্‌র আগমন অপরিহার্য ছিল।

এছাড়া সূরা জুমুআর আয়াত ‘আখারিনা মিনহুম’ অনুসারেও একজন পারস্য বংশীয় ব্যক্তির ঈমান পুনরুদ্ধারের জন্য আগমন করা আবশ্যক। কাজেই, আমাকে অস্বীকার করলে প্রকারান্তরে আগাগোড়া পবিত্র কুরআন অস্বীকার করতে হবে। অনুরূপভাবে হাদীসে মহানবী (সা.) যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যেমন প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে একজন মুজাদ্দিদের আগমন কিংবা ‘ইমামুকুম মিনকুম’ হাদীসটি অথবা ক্রুশীয় নৈরাজ্যের যুগে এক মসীহ্র আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে- এগুলোকেও মিথ্যা সাব্যস্ত করতে হবে। অতএব, প্রণিধাণ কর, আমাকে অস্বীকার করা চাট্টিখানি বিষয় নয়? আমাকে অস্বীকার করলে আল্লাহ্ ও রসূল (সা.)-কেই অস্বীকার করা হবে। কেননা যাবতীয় লক্ষণ পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই যুগে প্রতিশ্রুত মসীহ্ না আসলে আল্লাহ্ ও রসূল (সা.) প্রদত্ত সকল প্রতিশ্রুতি মিথ্যা সাব্যস্ত হবে, নাউযুবিল্লাহ্”।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে চটজলদি করতে বারণ করেছেন এবং স্বচ্ছমনা ব্যক্তিদের জন্য একটি উদাহরণ প্রদান করেন। তিনি বলেন, “মালাকী নবীর পুস্তকে একথা লেখা ছিল যে, মসীহ্‌র আগমনের পূর্বে এলিয়া নবী স্বশরীরে আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। যখন ইহুদী আলেমরা হযরত মসীহ্ (আ.)-কে এই দলিলের আলোকে তার সত্যতার ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করে, তখন ঈসা (আ.) ইয়াহইয়া (আ.)-কে দেখিয়ে বলেন, ইনিই এলিয়া। স্বাভাবিক যুক্তি অনুসারে এটি একটি অগ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ছিল, কিন্তু আমরা সবাই জানি, হযরত ঈসা (আ.) স্বীয় দাবীতে সত্য ছিলেন এবং ইহুদীরা ভ্রান্ত ছিল”।

এবার সেই একই ঘটনা উম্মতে মুহাম্মদীয়ার ক্ষেত্রেও ঘটছে এবং এই উম্মতের আলেমরাও সেই ইহুদী আলেমদের মতই মসীহ্ মওউদকে অস্বীকার করছে; অথচ তাদের কাছে কুরআন রয়েছে, যাতে প্রকৃত ঘটনা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আগের ঈসা মৃত্যুবরণ করেছেন। আর আল্লাহ্ তা’লা নিজ সাহায্য ও সমর্থন দ্বারা মসীহ্ মওউদের সত্যতার প্রমাণ স্বয়ং প্রদান করে যাচ্ছেন, এবং আজ পৃথিবীর ২১০টি দেশে আহমদীয়া জামাত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) নিজ সত্যতার পক্ষে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত, বিভিন্ন হাদীস এবং ঐশী নিদর্শনাবলীকে উপস্থাপন করেছেন এবং বিবেকবানদের এই মানদণ্ডে তাঁর সত্যতা যাচাই করা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

এরপর হুযূর (আই.) ২০১২ সালে আফ্রিকার দেশ বেনিনের একজন আহমদী ইব্রাহীম সাহেবের একটি ঘটনা উল্লেখ করেন যে, কীভাবে তিনি খাঁটি ইসলাম তথা আহমদীয়াতের প্রচার করেন এবং তার বিরোধিতাকারীদের আল্লাহ্ ধ্বংস করে দেন।

অতঃপর হুযূর বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর অনুকূলে আল্লাহ্‌র অগণিত নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে এবং সুদূর ভবিষ্যতেও হতে থাকবে; আফ্রিকার সাম্প্রতিক ঘটনাটি সেই প্রতিশ্রুতিরই একটি বাস্তব রূপায়ন মাত্র।

তিনি (আ.) একস্থানে বলেছেন, “আমি ও আমার জামাত যদি এখন ঘরেও বসে থাকি, তবুও দাজ্জালের পতন ঘটবেই ঘটবে; কেননা এটিই দাজ্জালের ধ্বংস হবার যুগ। কুরআনের প্রতিশ্রুতি অনুসারেই এখন দাজ্জালের পতন ঘটবে এবং ক্রুশীয় মতবাদ ধ্বংস হবে”।

তিনি (আ.) বলেন, “কোন কোন বিরোধী একথা বলে সাধারণ মুসলমানদের ধোঁকা দিতে চায় যে ‘আমরা কি নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত ইত্যাদি পালন করি না? তাহলে এই নতুন জামাত ও নতুন নৈরাজ্যের দরকার কী?” তিনি বলেন, “মনে রেখ, এটি নির্বোধদের কথা। কেননা এই জামাত আমি প্রতিষ্ঠা করি নি, বরং আল্লাহ্ করেছেন। আল্লাহ্ যদি প্রকৃত ঈমানের অভাব না দেখতেন, তবে তিনি কেন এমনটি করলেন? যদি তোমরা প্রকৃতই সৎকর্মশীল হয়ে থাক, তবে তোমাদের সেই কাজের সুপ্রভাব বা উত্তম ফলাফল কেন প্রকাশ পায় না? কেন মুসলমানরা এসব পুণ্যকর্ম করা সত্ত্বেও ক্রমাগত জগতমুখী হয়ে পড়ছে এবং তাদের মাঝে অন্যায় ও অপকর্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে?”

এমন এক যুগে মসীহ্ মওউদ (আ.) আবির্ভুত হয়েছেন যখন ইসলাম চতুর্মুখী আক্রমনের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ কোন্দল ইসলামের জন্য দুর্নামের কারণ হয়েছে অপর দিকে বাইরের শত্রুরা ইসলাম, পবিত্র কুরআন ও মহানবী (সা.)-এর পবিত্র সত্তার ওপর চরম আক্রমন করেছে। ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে।

মোটকথা, বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দেখেই এর সংশোধনকল্পে আল্লাহ্ তা’লা মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে প্রেরণ করেছেন।

হুযূর বলেন, এখন আমাদের আহমদীদের একথা ভেবে দেখতে হবে, তিনি (আ.) অন্যান্য মুসলমানের ঈমানের যে চিত্র অংকন করেছেন, আমাদের মাঝেও সেই একই অবস্থা বিরাজ করছে না তো? বয়আত করার পরও যদি আমাদের মাঝে সেই পবিত্র পরিবর্তন সৃষ্টি না হয়, তবে আমরাও আল্লাহ্‌র ক্রোধভাজন হব। অন্যরা তো অস্বীকার করার কারণে আল্লাহ্‌র ক্রোধভাজন হচ্ছে, আর আমরা ইমাম মাহ্‌দীকে মানার পর, নিজেদের মাঝে আমূল পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার করার পরও যদি তা ভঙ্গ করি তাহলে আল্লাহ্‌র ক্রোধভাজন হব।

হুযূর বিশেষভাবে এ যুগে হযরত আদম (আ.)-এর দোয়া ‘রাব্বানা যালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা ওয়াতার হামনা লানাকুনান্না মিনাফ খাসিরিন’ এবং হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ইলহামী দোয়া ‘রাব্বি কুল্লু শাইয়্যিন খাদিমুকা রাব্বি ফাহ্‌ফাযনী ওয়ানসুরনী ওয়ারহামনী’ পড়ার জন্য আহমদীদের নির্দেশনা প্রদান করেন।

হুযূর বলেন, আল্লাহ্ করুন আমরা যেন কেবল প্রথাগতভাবে মসীহ্ মওউদ দিবস পালনকারী না হই, বরং মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মানার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করি। আর সকল প্রকার বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা থেকে আত্মরক্ষাকার চেষ্টা করি; আল্লাহ্ তা’লা যেন সর্বদা আমাদেরকে স্বীয় নিরাপত্তাবেষ্টনীতে আবদ্ধ রাখেন ও সর্বপ্রকার বিপদাপদ থেকে আমাদের রক্ষা করেন। (আমীন)

খুতবার শেষদিকে হুযূর জামাতকে একটি সুসংবাদ প্রদান করে বলেন, আল্ হাকাম পত্রিকা, যা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যুগে জামাতের প্রথম পত্রিকা ছিল ও কাদিয়ান থেকে প্রকাশিত হতো, পরবর্তীতে তা কোন কারণে বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৯৩৪ সনে পুনর্প্রকাশ আরম্ভ হয় আবার তা-ও একসময় বন্ধ হয়ে যায়। আজ থেকে পুনরায় এর ইংরেজি সংস্করণ লন্ডন থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। মুদ্রিত সংস্করণ ছাড়াও অনলাইনে এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে প্রতি শুক্রবার এটি প্রকাশিত হবে, ইনশাআল্লাহ্। এর ওয়েবসাইট এড্রেস হল, www.alhakam.org । হুযূর সবাইকে এবং বিশেষভাবে ইংরেজি ভাষাভাষীদেরকে এদ্বারা উপকৃত হবার আহ্বান জানান।