শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৬-মার্চ, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৬ই মার্চ, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত আবু দাজানা আনসারী (রা.), হযরত মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.), হযরত আবু আইয়্যুব আনসারী (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা.), হযরত মু’আয বিন হারেস (রা.), হযরত মুআওয়ায বিন হারেস (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, হযরত আকদাস মসীহ্ মওউদ (আ.) একস্থানে মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের পদমর্যাদা সম্পর্কে বলেন, সাহাবা কেরাম (রা.) মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জীবনীর উজ্জ্বল সাক্ষী ছিলেন। এখন কোন ব্যক্তি যদি এই সাক্ষীদের নষ্ট করে, তবে সে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়তকে নষ্ট করতে চায়। সেই ব্যক্তিই মহানবী (সা.)-এর প্রকৃতরূপে মূল্যায়ন করে যে সাহাবাদেরকে মূল্যায়ন করে; যে সাহাবাদের কদর করে না, সে কক্ষনোই মহানবী (সা.)-এর কদর করে না। মহানবী (সা.)-এর আনুগত্যে তারা এভাবে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন যে তাঁর (সা.) খাতিরে তারা যে কোন কষ্ট সহ্য করতে সদা প্রস্তুত থাকতেন। হুযূর (আই.) বলেন, এটি হল সাহাবাদের সেই পদমর্যাদা যা প্রত্যেক আহমদীর সর্বদা দৃষ্টিপটে রাখা উচিত। অতঃপর হুযূর আজও কতিপয় সাহাবীর কিছু ঘটনাবলী বর্ণনা করেন।

হুযূর প্রথমে হযরত আবু দাজানা আনসারী (রা.)-এর উল্লেখ করেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর মদীনায় হিজরতের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর সাথে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। উহুদ যুদ্ধেও তিনি অংশ নেন এবং প্রাথমিক বিজয়ের পর যখন যুদ্ধের ছক উল্টে যায় ও রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর উপর ক্রমাগত আক্রমণ হতে থাকে, তখন যে সাহাবীরা তাঁর (সা.) নিকটে থেকে তাঁকে আড়াল করে রাখেন তাদের মধ্যে আবু দাজানাও ছিলেন এবং চরমভাবে আহত হওয়া সত্ত্বেও পিছু হটেন নি। ইয়ামামার যুদ্ধে শত্রু যখন দুর্গের ভেতর লুকিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছিল, তখন তিনি (রা.) প্রস্তাব করেন যে তাকে যেন পাঁচিলের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে মারা হয়। পাঁচিল অনেক উঁচু ছিল, যার ফলে ওপাশে পড়ে তার পা ভেঙে যায়, কিন্তু তিনি তা সত্ত্বেও বীরত্বের সাথে লড়তে লড়তে ভেতর থেকে দুর্গের দরজা খুলে দেন এবং মুসলমানরা তাতে প্রবেশ করে। এ যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। একবার অসুখের সময় তিনি তার সঙ্গীকে বলেন, হয়তো আল্লাহ্ আমার দু’টি কর্মকে গ্রহণ করবেন। একটি হল আমি কখনো বৃথা কথা বলি নি বা কারও পশ্চাতে তার গীবত করি নি, আরেকটি হল আমি কখনো কোন মুসলমানের জন্য মনে ঘৃণা বা বিদ্বেষ রাখি নি।

এরপর হুযূর (আই.) হযরত মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.)-এর উল্লেখ করেন। তিনি (রা.) একেবারে শুরুর দিকের আনসারী সাহাবী। অত্যন্ত বীর ও নির্ভীক ব্যক্তি ছিলেন, উহুদ যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর পাশে বীরদর্পে লড়ে গিয়েছেন। রসূলুল্লাহ্ (সা.) একবার তাকে নিজের তরবারি দিয়ে বলেন, যতদিন মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ হয় ততদিন এটি দিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। আর যখন এমন সময় আসবে যে মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করবে, তখন এটি ভেঙে ফেলবে এবং নিজের ঘরে বসে পড়বে। তিনি (রা.) কার্যত তা-ই করেছেন, হযরত উসমান (রা.)-এর মৃত্যুর পর তিনি সেই তরবারি ভেঙে ফেলেন ও লোকালয় ছেড়ে দিয়ে নির্জন স্থানে বসবাস শুরু করেন। হুযূর (আই.) বলেন, এটি ছিল মহানবী (সা.)-এর সাহাবাদের বৈশিষ্ট্য- যতদিন পর্যন্ত ধর্মের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন যুদ্ধ করেছেন, আর যখন নিজেদের ভেতর অন্তর্কোন্দল ও যুদ্ধ সৃষ্টি হয়েছে তখন যুদ্ধ ছেড়ে দিয়েছেন, বর্তমান যুগে আমরা যার পুরো বিপরীত চিত্র দেখতে পাই।

আরেকজন সাহাবী ছিলেন হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা.)। তার এই সৌভাগ্য হয়েছিল যে মহানবী (সা.) মদীনায় এলে তিনিই হুযূর (সা.)-এর আতিথেয়তা করার সুযোগ লাভ করেন। খায়বারের যুদ্ধের পর ইহুদী নেতার মেয়ে হযরত সাফিয়া (রা.)-এর সাথে মহানবী (সা.)-এর বিবাহ হয়। বিবাহের পরদিন যখন মহানবী (সা.) নামাযের জন্য বাইরে আসেন, তখন দেখতে পান আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) পাহারায় দাঁড়িয়ে আছেন। রসূলুল্লাহ্ (সা.) প্রশ্ন করেন, তুমি কেন পাহারা দিচ্ছ? তিনি (রা.) জবাব দেন, যেহেতু সাফিয়া (রা.)-এর অনেক নিকটাত্মীয় আমাদের হাতে নিহত হয়েছে, তাই আমার শঙ্কা হল কেউ না আবার আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করে, তাই আমি পাহারা দিতে চলে এলাম। এতে মহানবী (সা.) দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ্! আবু আইয়ুবকে সর্বদা তোমার নিরাপত্তার আশ্রয়ে রেখো, যেভাবে সে রাতভর জেগে আমাকে পাহারা দিয়েছে।’ এর ফলাফল এই হয়েছিল যে তিনি অনেক যুদ্ধে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও শত্রুর হাতে নিহত হন নি, রোমীয় যুদ্ধের সময় বৃদ্ধাবস্থায় অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

আরেকজন সাহাবী ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা.)। তিনি অনেক বিখ্যাত কবি ছিলেন। একবার মহানবী (সা.) মদীনার সর্দারদের একটি সভায় তবলীগ করতে গেলে মুনাফিকদের নেতা আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই তাঁকে (সা.) এরূপ করতে নিষেধ করে। তখন আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা সাথে সাথে এর বিপরীতে বলেন, আপনি অবশ্যই আসবেন, আমরা আপনার এসব কথা শুনতে চাই। তিনি (রা.) সমাজের সেসব নেতাদের বিন্দুমাত্রও পরোয়া করেন নি। মূতার যুদ্ধে মহানবী (সা.) যায়েদ বিন হারসা (রা.) ও তার মৃত্যুর পর জাফর বিন আবু তালিব (রা.) ও তারপর আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহাকে নেতা বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে তারা তিনজনই শহীদ হবেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ও জানতেন যে তিনি শহীদ হতে যাচ্ছেন, আর এ নিয়ে তিনি কিছু পংক্তিও রচনা করেছিলেন। মূতা পৌঁছে বোঝা যায় যে সেখানকার লোকজন রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে সাহায্য চেয়েছে এবং তিনি দুই লক্ষ সৈন্য পাঠিয়েছেন। সেসময় হযরত আব্দুল্লাহ্‌র অনুপ্রেরণামূলক কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিন হাজার মুসলিম সৈন্যই দুই লক্ষের সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। হযরত আব্দুল্লাহ্ শাহাদাতের আগমুহূর্ত পর্যন্ত বীরত্বের সাথে মুসলিম বাহিনীকে উৎসাহ দিতে দিতে যুদ্ধ করেছেন ও নেতৃত্ব দিয়েছেন।

ইসলামের ইতিহাসে হযরত মু’আয বিন হারেস ও মুআওয়ায বিন হারেস (রা.) নামক দুই কম বয়সী ভাইয়ের উল্লেখ রয়েছে, যারা বদর যুদ্ধে অসম-সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন। বয়সে নিতান্ত ছোট এই দুই ভাই বদরের যুদ্ধের সময় একেবারে নির্ভিকচিত্তে দুঃসাহসিকভাবে ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু আবু জাহলের উপর হামলা করে বসে, যা আব্দুর রহমান বিন আওফ (রা.)-এর মত বীর যোদ্ধারাও কল্পনা করতে পারেন নি। মূলত তাদের হামলার ফলেই পরবর্তীতে আবু জাহল নিহত হয়, আর এই দুই ভাই শহীদ হন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, “সাহাবাদের এই আদর্শই আমি আমার জামাতের মাঝে দেখতে চাই যে তারা আল্লাহ্ তা’লাকে অগ্রগণ্য করুক, আর কোন বিষয় যেন এপথে বাধ না সাধে; এ পথে তারা নিজেদের জীবন ও সম্পদকে তুচ্ছ মনে করুক।…আমাদের যাবতীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টা আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হওয়া উচিত, তা সে কষ্ট-কাঠিন্য ও বিপদাপদের মধ্য দিয়েই হোক। আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি পৃথিবী ও এর যাবতীয় আনন্দ থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ”। হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এই দায়িত্ব পালনের তৌফিক দান করুন। আমীন।

খুতবার শেষদিকে হুযূর জামাতের এক বিশিষ্ট সেবকের মৃত্যুতে গায়েবানা জানাযার ঘোষণা দেন। তিনি হলেন ঘানার মোকাররম আলহাজ্জ ইসমাঈল বিকে আডু সাহেব, গত ৮ মার্চ ৮৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। হুযূর মরহুমের যিকরে খায়ের করেন এবং তার পদমর্যাদার উন্নতির জন্য দোয়া করেন।