রমযানের প্রেক্ষাপটে একজন মু’মিনের বৈশিষ্ট্য

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৪-জুন, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৪শে জুন, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “রমযানের প্রেক্ষাপটে একজন মু’মিনের বৈশিষ্ট্য”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর বলেন, গত শুক্রবার আমি বলেছিলাম দোয়া গৃহীত হওয়ার এবং খোদার নৈকট্য লাভের জন্য তাঁর নির্দেশ পালন, তাঁর ইবাদত এবং তাঁর বিধি-বিধান মেনে চলা আবশ্যক। তবেই আল্লাহ্ বান্দার দোয়া গ্রহণ করেন এবং বান্দাকে স্বীয় নৈকট্যের সম্মানে ভূষিত করেন।

হুযূর বলেন, ইবাদত এবং খোদার নির্দেশ মেনে চলা কি শুধুমাত্র রমযান মাসেই আবশ্যক? না এমনটি নয় বরং এ মাস যেহেতু প্রশিক্ষণ এবং সংগ্রাম-সাধানার মাস। এ মাসে এমনিতেই নামাযের প্রতি এবং অন্যান্য ইবাদতের প্রতি মানুষের মনোযোগ বেশি নিবদ্ধ থাকে তাই এ মাসের বরাতে খোদার নৈকট্য লাভ সহজতর। আর এ মাসের প্রশিক্ষণ ও সংগ্রামের চেতনা যাতে জীবনের স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে রূপ নেয় সেজন্য মু’মিনদের আরো যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।

হুযূর বলেন, খোদার নৈকট্য লাভের জন্য তাঁর বিধি-নিষেধ মেনে চলা আবশ্যক আর এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে রয়েছে খোদার ইবাদত বা নামায। পবিত্র কুরআনে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, আমি জ্বিন ও ইনসানকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছি।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) নামায বা ইবাদতের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে তাঁর অনুসারীদের বিভিন্ন স্থানে নসীহত করেছেন।

হুযূর বলেন, রমযানে ফরয নামায ছাড়াও তারাবীহ্ ও নফল পড়ার প্রতিও মানুষ মনোযোগী থাকে অথচ অন্যান্য দিনে মানুষ আলস্য দেখায়। এর মূল কারণ হল, সংকল্প। মানুষ যদি সংকল্প করে তাহলে সে যে কোন দুরূহ কাজও করতে সক্ষম। তাই যদি একমাস প্রশিক্ষণের পর আবার আমাদের জীবন আলস্যে ভরে উঠে তাহলে এই মাসের প্রশিক্ষণের কোন মূল্যই থাকে না।

হুযূর বলেন, জামাতের অনেক ওয়াকেফে যিন্দেগী এবং কর্মকর্তাদের মধ্যেও নামাযের ব্যাপারে আলস্য পরিলক্ষিত হয়। তারা এর অপরীসীম গুরুত্ব সম্পর্কে অনবহিত নয় ঠিকই কিন্তু এরপরও বাস্তবে তাদের আলস্য চোখে পড়ার মত। অতএব, আপনারা আলস্য ঝেড়ে ফেলে এখন থেকেই নামাযের বিষয়ে যত্নবান হওয়ার চেষ্টা করুন।

হুযূর বলেন, ইবাদত ছাড়া মানুষকে নিজের নফসের প্রাপ্য প্রদান করাও আবশ্যক কিন্তু সেক্ষেত্রেও ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন। সর্বদা মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে অগ্রগণ্য করতে হবে। আর সৃষ্টির মূল লক্ষ্যই হল, স্রষ্টাকে চেনা এবং তাঁর আনুগত্য করা। নফসের প্রাপ্য দিলে স্বাস্থ্য ভালো থাকবে আর সুন্দরভাবে ইবাদতও করতে পারবে। অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে বৈধ জিনিষও অবৈধ হয়ে যায়। তাই ইবাদত হোক বা পার্থিব কাজকর্ম উভয়ক্ষেত্রে ভারসাম্য আবশ্যক।

নামায ও ইবাদতের বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে নির্দেশ রয়েছে। ইবাদতও করতে হবে আবার জাগতিক কাজকর্মও করতে হবে। কেননা, ইসলামে বৈরাগ্যের কোন বিধান নেই। ব্যবসায়ী এবং চাকরীজীবি নিজ দায়িত্ব পালনের পাশপাশি যেভাবে স্ত্রী-সন্তানের অধিকার প্রদান করে ঠিক একই ভাবে তাকে ইবাদতের দায়িত্বও সুচারুররূপে পালন করতে হবে। কিন্তু ধর্মকে অগ্রগণ্য করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পবিত্র কুরআন নামাযের সুরক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে, বিশেষকরে মধ্যবর্তী নামাযের। তাই যথাসময় এবং যথাযথভাবে নামায পড়া আবশ্যক।

এছাড়া পবিত্র কুরআনের আলোকে আরো কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবতারণা করে হুযূর বলেন, উন্নত নৈতিক গুণাবলী অর্জনের লক্ষ্যে একজন মানুষের এগুলো অবলম্বন করা বা মেনে চলা প্রয়োজন। যেমন অঙ্গীকার রক্ষা করা। ধর্মকে পার্থিবতার ওপর অগ্রাধিকার দেয়া এবং বয়আতের অঙ্গীকার মেনে চলা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। বান্দার প্রাপ্য অধিকার প্রদান এবং পারষ্পরিক অধিকার প্রদানের অঙ্গীকার রক্ষা করাও মু’মিনের জন্য আবশ্যক। অঙ্গীকার রক্ষার মাধ্যমেই পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাদির সমাধান হতে পারে।

হুযূর বলেন, এরপর রয়েছে মিথ্যা। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, প্রতীমার নোংরামী বর্জন কর আর মিথ্যা হতে বিরত থাক। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, অন্যায়ের প্রতি নাছোড় মনোবৃত্তি পোষণ করে সত্যকে হত্যা করো না। ছোটরা সত্য বললে তা মেনে নাও। বিরোধীরা সত্য বললে তাও মেনে নাও কেননা, এরফলে বিবাদ-বিসম্বাদ থেকে রক্ষা পাবে। যারা মনে করে, মিথ্যার ওপরই মানুষের জীবনের ভিত্তি তাদের জন্য এরচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে? মানুষ সত্য বললে যদি শাস্তি পায় তাহলে কেউ আর সত্য বলার সাহস দেখাবে না আর আল্লাহ্‌র ওপরও মানুষের আর আস্থা থাকবে না। সত্য বলার কারণে কেউ ধৃত হয় না আসলে প্রচ্ছন্ন কোন পাপের কারণেই মানুষ ধরা পরে।

হুযূর বলেন, এরপর মু’মিনের বৈশিষ্ট্য হল, রাগ বা ক্রোধ সংবরণ করা। কুধারণা, ছিদ্রান্বেষণ এবং পরচর্চা বা কুৎসা না করা। কুধারণা এমন এক ব্যাধি যা মানুষকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে। এরফলেই সব ধরনের পাপের জন্ম হয়। কুধারণা বা রাগ যখন চরমে পৌঁছে তখন মানুষ উম্মাদ হয়ে যায়। রাগ ও বিবেক এর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। রাগ সংবরণ করলে হৃদয় আলোকিত হয় আর রাগ করলে হৃদয় তমাসচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং এরফলে অন্ধকারের জন্ম হয়, চিন্তাশক্তি লোপ পায় আর মানুষ ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যায়। এরফলে প্রজ্ঞার প্রস্রবণ থেকে মানুষ দূরে সরে যায় । অতএব রাগ ও ক্রোধ সংবরণ করা উন্নত নৈতিক গুণ অর্জনের জন্য আবশ্যক। এরফলে বিবেক-বুদ্ধি আলোকিত হয় এবং মানুষ খোদার নৈকট্য লাভ করে।

অতএব, রমযান মাসের প্রশিক্ষণ থেকে আল্লাহ্ আমাদের পুরোপুরি লাভবান হওয়ার এবং একে জীবনের স্থায়ী অংশে রূপ দেওয়ার তৌফিক দান করুন, আমীন।