ঈদুল ফিত্‌র – ২০২২

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস

০২-মে, ২০২২

মসজিদে মোবারক, টিলফোর্ড, ইসলামাবাদ

যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ২রা মে, ২০২২ ঈদুল ফিতরের খুতবা
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করেন।

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ۖ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا
(সূরা আন্ নিসা: ৩৭)
অনুবাদ: এবং তোমরা আল্লাহ্‌র ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক কোরো না আর সদয় ব্যবহার করো পিতা-মাতার সাথে, আত্মীয়-স্বজন এবং এতীম আর মিসকীন এবং আত্মীয় প্রতিবেশি এবং অনাত্মীয় প্রতিবেশির সাথে আর সঙ্গী-সহচর এবং পথচারীর সাথে আর তোমাদের ডান হাত যাদের মালিক হয়েছে (তথা অধীনস্থদের সাথে)। নিশ্চয় আল্লাহ্ অহংকারী এবং দাম্ভিকদেরকে পছন্দ করেন না।

{এরপর হুযূর (আই.) বলেন,} আল্লাহ্ তা’লা আজ আমাদেরকে ঈদ উদযাপনের সৌভাগ্য দান করেছেন। কিন্তু প্রত্যেক মু’মিনের জন্য প্রকৃত ঈদ কেবল এটিই নয় যে, ভাল কাপড় পরিধান করে নিল, ভাল খাবার খেয়ে নিল, বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দিয়ে সময় অতিবাহিত করল, ঈদের নামায পড়ে মনে করল, এখন তো ঈদের আবশ্যকীয় দায়িত্ব পালন হয়ে গেল তাই এখন আমার ছুটি, যা ইচ্ছা করা যাবে। সেদিন সময় মত যোহরের নামাযের প্রতি দৃষ্টি নেই, আসর নামাযের দিকে মনোযোগ নেই আর অন্যান্য ওয়াক্তের নামাযের প্রতিও কোন ভ্রুক্ষেপ থাকল না। আর নামাযের কথা মনে পড়লেও দ্রুততার সাথে আদায় করে নিল। বরং অনেকে তো ঈদের নামাযও পড়ে না। আর যখন ঈদের নামায পড়া হয়ে যায় তখন খুব ভাবগাম্ভীর্যের সাথে উঠে ঈদের দিন অন্যান্য যেসব ব্যস্ততা থাকে সেগুলোতে মত্ত হয়ে যায়। মনে হয় যেন, ঈদের এটিই প্রকৃত উদ্দেশ্য। এটি শুধু কথার কথা নয় বরং আমি এমন লোকদের দেখেছি যারা ঈদের নামাযও পড়ে না আর বলে যে, আমাদের ঘুম পেয়েছিল তাই আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। স্মরণ রাখা উচিত, ঈদের দিন অধিক ইবাদাত করার দিন। অন্যান্য দিনে তো পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয কিন্তু ঈদের দিন ছয় ওয়াক্ত নামায ফরয। এমনকি মহিলাদেরও যাদের গণনার কিছু দিন নামায মাফ থাকে, তাদেরকে ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। অতএব ঈদের দিনের গুরুত্ব অধিক। পাকিস্তানের আহমদীদেরও দোয়া করা আবশ্যক, অবস্থার প্রেক্ষিতে মহিলাদের ওপর সেখানে কতক বিধি-বিধান আরোপ করা হয়েছিল যেন তারা ঈদগাহে না যায়। এরপর করোনা মহামারিতে আরও কঠোরতা আরোপ করা হয়। বরং পুরুষের ওপরও রাষ্ট্রীয় বিধি-নিষেধ আরোপ করার ফলে নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়েছে। তাই দোয়া করুন বিশেষত পাকিস্তানে আর সর্বতোভাবে পৃথিবীতে এইসকল বিধি-নিষেধ থেকে আহমদীরা যেন মুক্তি লাভ করে। এখানে তো এবছর তথা দু’বছর পর ঈদ উদ্যাপনে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা তুলে নেয়া হয়েছে তথা নিজ নিজ এলাকায় ঈদ আদায়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং সকলের অংশগ্রহনের অনুমতি আছে। মোটকথা সাধারণ অবস্থায় ঈদের নামায আদায়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ বিষয়টি ভুলে যাওয়া উচিত নয়। আমি বলছিলাম, ঈদের দিন কেবল একটি উদ্দেশ্যে একত্রিত হওয়ার দিন নয় বরং এর মাঝে আল্লাহ্ তা’লা আমাদের ওপর যে দায়িত্বভার অর্পণ করেছেন, তা অন্যান্য দিনের তুলনায় অধিক পালন করা আবশ্যক। নিজেদের ইবাদাতের অধিকার আদায় করা অবশ্যক আর বান্দার অধিকার প্রদান করা যা প্রত্যেক মু’মিনের জন্য আবশ্যক তা প্রদান করতে হবে। এদিন অঙ্গীকার করা উচিত যে, আমি আল্লাহ্ তা’লার অধিকার প্রদানের জন্য সদা চেষ্টা করতে থাকব আর বান্দার অধিকার প্রদানেরও সদা চেষ্টা করতে থাকব। তবেই আমাদের ঈদ হবে প্রকৃত ঈদ। অতএব এমন ঈদ অর্জন করার চেষ্টা করা আবশ্যক। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে উক্ত অধিকারগুলো প্রদানের বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যদি আমরা আজ ঈদের দিন এই অঙ্গীকার করে উক্ত অধিকার এবং আবশ্যকীয় দায়িত্বের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করি যে, আগামীতে আমরা এগুলো আমাদের জীবনের অংশ বানিয়ে নিব, গত খুতবাতেও আমি সার্বিকভাবে উক্ত বিষয়গুলো উল্লেখ করেছিলাম, তাহলে আমরা আমাদের রমযানের উদ্দেশ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। আর ঈদ উদ্যাপনের উদ্দেশ্যও অর্জন করতে সক্ষম হব।
আমি যে আয়াত পাঠ করেছি, এর মাঝে আল্লাহ্ তা’লা কতক আবশ্যকীয় দায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আর এগুলো যারা পালন করবে না তারা অহংকারী এবং দাম্ভিক আর এমন লোকদেরকে আল্লাহ্ তা’লা পছন্দ করেন না। অতএব আল্লাহ্ যাদেরকে পছন্দ করেন না, তাদের ইহকালও গেল আর পরকালও গেল। মহানবী (সা.)ও একদা এ বিষয়ে বিশেষভাবে সাবধান করেছেন। তিনি (সা.) বলেন, যার হৃদয়ে সামান্যও অহংকার থাকবে, আল্লাহ্ তা’লা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করতে দিবেন না। এক ব্যক্তি নিবেদন করল যে, মানুষের আকাঙ্ক্ষা হলো, ভাল পোশাক পরিধান করবে, ভাল জুতা পরিধান করবে যেন তাকে দেখতে সুন্দর লাগে। তারা কাদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হবে? মহানবী (সা.) বললেন, এটি অহংকার নয়। তিনি (সা.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা নিজেই সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। তিনি (সা.) বলেন, মানুষ যখন অধিকার প্রদানে অস্বীকার করে তখন সেটি অহংকার বলে বিবেচিত হয়। মানুষকে হীনজ্ঞান করা, তাদেরকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা এবং তাদের সাথে মন্দ আচরণ করা- এসবই অহংকার।
অতএব এই ঈদের দিন উত্তম কাপড় পরিধান করা, ভালভাবে প্রস্তুতি নেয়া, সুগন্ধি লাগানো- এ সবকিছুই আল্লাহ্ তা’লার দৃষ্টিতে পছন্দনীয়। কিন্তু এগুলোকে দম্ভ এবং অহংকারের মাধ্যম বানানো, এটি আল্লাহ্ তা’লার পছন্দ নয়। উক্ত আয়াতে যে বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অবশেষে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা’লা অহংকারী এবং দাম্ভিককে পছন্দ করেন না- এ কথার মাঝে আল্লাহ্ তা’লার অধিকারের বিষয়টিও আছে আর বান্দার অধিকারের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ তা’লার অধিকার হলো, যেন তাঁর ইবাদাত করা হয়। এটি নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা’লার অধিকার তথা তাঁর ইবাদাত যেন করা হয় এবং কোন কিছুকে তাঁর শরীক যেন না করা হয় কিন্তু এর দ্বারা বান্দারই উপকার সাধিত হয়। মানুষ জানতে চায়, এর দ্বারা আল্লাহ্ তা’লার কী লাভ? এর উত্তর হলো, এতে আল্লাহ্ তা’লার কোন লাভ নেই। আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনের এক স্থলে বলেন, মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ্ তা’লার ইবাদাত করা তবে এর দ্বারা আল্লাহ্‌র কোন উপকার সাধিত হয় না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের কল্যাণের জন্য এবং আমাদেরকে পুরস্কৃত করার জন্য, আমাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহ্ তা’লা ইবাদাতের দিকে আমাদের মনোযোগ আকষণ করেছেন। আমাদেরকে মন্দ বিষয় থেকে বিরত রাখার জন্য আমাদেরকে ইবাদাতের আদেশ দিয়েছেন, নামাযের আদেশ দিয়েছেন।
এক স্থলে আল্লাহ্ তা’লা বলেন, إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ ۗ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ (সূরা আল্ আনকাবূত: ৪৬)
অর্থাৎ নিশ্চয় নামায অশ্লীলতা এবং অপছন্দীয় কাজ থেকে বাধা প্রদান করে সকল যিকিরের তুলনায় আল্লাহ্‌র যিকিরই উত্তম। অতএব নামাযের, ইবাদতের, আল্লাহ্ তা’লার যিকিরের এবং আল্লাহ্ তা’লাকে স্মরণ করার কল্যাণ আমরাই লাভ করি। আর আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এর প্রতিদান দিয়ে থাকেন।
এক রেওয়ায়েতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল (সা.) আমাকে এমন কোন আমলের বিষয়ে বলুন যেটি আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে এবং আগুন থেকে আমাকে বাঁচাবে। মহানবী (সা.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লার ইবাদাত কর, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না, নামায আদায় কর, যাকাত প্রদান করো এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ। (তথা আত্মীয়স্বজনের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করো)
অতএব দেখুন! আল্লাহ্ তা’লা কীভাবে পুরস্কৃত করছেন। ইহকালেও পুরস্কৃত করছেন আর পরকালেও জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন।
অপর এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কেবলমাত্র আল্লাহ্ তা’লার খাতিরে দুই ঈদের রাতে ইবাদাত করবে, তার হৃদয় সর্বদার জন্য জীবিত করে দেয়া হবে।
কত বড় সুসংবাদ। আল্লাহ্ তা’লার খাতিরে ইবাদাত করার ফলে সর্বদার জন্য পুরস্কার লাভ হচ্ছে। অতএব কেবল আনন্দ উদ্যাপন করার নাম ঈদ নয়। বরং এই রাতগুলো ইবাদাতের মাধ্যমে জীবিত করার নাম ঈদ। আর এর ফলে সে সারা জীবনের জন্য আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করে। যারা মনে করে যে, রমযান শেষ হয়েছে, এখন আমরা আরামে ঘুমাতো পারবো। একদিকে রমযানে তো সেহেরীর জন্য জাগতো আর তখন দু’রাকাত নফলও পড়ত অথচ ঈদের দিন ফযরের নামাযে জাগার ক্ষেত্রেও অনেককে অলসতা করতে দেখা যায়। কারোনাকে বাহানা বানানো ঠিক নয়। ফজরের নামাযে মসজিদে আসবেন, ঈদের দিন যদি উপস্থিতি কম থেকে থাকে, তাহলে আগামীকাল ফযরে এটি পূর্ণ করুন। যেখানে আগামীকাল ঈদ তাদের ঈদের দিনের ফযরের বিষয়টি মাথায় রাখা আবশ্যক যেন নামাযে উপস্থিতি ভাল থাকে। অন্ততপক্ষে ঘরে ঘুম থেকে সময়মত উঠে সন্তানদের সাথে বাজামা’ত নামায আদায় করুন। যথাসম্ভব বাজামা’ত নামায পড়ার বন্দোবস্ত করুন। গত খুতবায়ও আমি যে বিষয়টি বলেছিলাম যে, ধিরেসুস্থে নামায আদায় করুন। রমযান শেষ হওয়া এবং আজ আমাদের ঈদ উদ্যাপন করা নিজেদের ইবাদাত থেকে পরিত্রাণ অথবা ঘাটতি অথবা ভালভাবে ইবাদাত না করার অনুমতি মনে করা উচিত নয়। এই ইবাদাতই আমাদের ইহকাল ও পরকালে আল্লাহ্ তা’লার কৃপার উত্তরাধিকারী বানানোর জামানত হবে।
আল্লাহ্ তা’লা ইবাদাতের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করার পর উক্ত আয়াতে হুকুকুল ইবাদ তথা বান্দার অধিকার প্রদানের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমি পূর্বেও সংক্ষিপ্তভাবে বলেছিলাম, মহানবী (সা.) আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। আল্লাহ্ তা’লা উক্ত আয়াতে বিস্তারিতভাবে কতক অধিকারের বিষয়ে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পিতা-মাতার প্রতি অনুগ্রহের আচরণ কর। আল্লাহ্ তা’রার প্রভুত্বের পর পিতা-মাতার অনুগ্রহ সবচেয়ে বেশি কেননা তারা আমাদেরকে আদর দিয়ে লালন-পালন করে বড় করেছেন। এ এমন এক অনুগ্রহ যার প্রতিদান দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। এখানে পিতা-মাতার প্রতি অনুগ্রহ বলতে বলা হয়েছে, তাদের সাথে সদা বিনম্রভাবে কথা বলবে, বিনম্র আচরণ করবে এবং তাদেরকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শণ করবে।
আল্লাহ্ তা’লা অন্য স্থানে পিতা-মাতার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছেন, “ফালা তাকুল লাহুমা উফ্” অর্থৎ তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলবে না। কোনো কিছু খারাপ লাগলে মানুষ উফ্ বলে। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, তাদের কোন বিষয় অপছন্দ হলেও উফ্ বলবে না। অন্য স্থানে বলেছেন, তাদেরকে সবধরনের সেবা কর। তাদের কথা মেনে চল তবে হ্যাঁ ধর্মের বিরুদ্ধে বা খোদা তা’লার বিরুদ্ধে তারা যদি কিছু বলে তবে তা মানা আবশ্যক নয়। এক্ষেত্রে ধর্মকে প্রাধাণ্য দিবে। এতদসত্ত্বেও তাদের সাথে কঠোরতা করবে না। কেবল এতটুকু বলা যে, আমি এ বিষয়টি মানতে পারছি না, কেননা এটি ধর্মের বিষয় বা আল্লাহ্ তা’লার বিষয়। অতএব পিতা-মাতার সাথে এক মু’মিনের আচরণ এমন হওয়া আবশ্যক।
এরপর আত্মীয়ের সাথে উত্তম আচরণের আদেশ দেয়া হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি রিযিকে বরকত চায় অথবা যে ব্যক্তি দীর্ঘায়ূ লাভ করতে চায় এবং যে জনমুখে নিজের প্রশংসা চায় তার উচিত আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার স্বভাবসম্বলিত হওয়া। নিজের আত্মীয় বা শ্বশুর বাড়ীর আত্মীয়- সবার প্রতি দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। যারা স্বাচ্ছন্দে আছেন, বাইরের দেশে আসার ফলে আল্লাহ্ তা’লার তাদের অবস্থায় উন্নতি দান করেছেন, তাদের ঈদের আনন্দে নিজ এমন আত্মীয়স্বজনকেও শামিল করা উচিত যারা দরিদ্র। এর জন্য এই শর্ত প্রযোজ্য নয় যে, যদি তারা জবাবে উত্তম আচরণ করে তাহলে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করা হবে। বরং তারা যদি পজিটিভ আচরণ না-ও করে, তবুও তাদের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে।
এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর সমীপে নিবেদন করল, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমি আমার আত্মীয়দের সাথে উত্তম আচরণ করি, তবুও তারা সম্পর্ক ছিন্ন করে, কথার সঠিক জবাব দেয় না, তারা উত্তম আচরণ করে না। এমতবস্থায় আমি কী করতে পারি? মহানবী (সা.) বলেন, তুমি যা বলছ তা যদি সত্য হয় তবুও তুমি তাদের সাথে উত্তম আচরণ কর, তাদের প্রতি এ তোমার পক্ষ থেকে এক অনুগ্রহ আর যতদিন তুমি তাদের সাথে এমন উত্তম আচরণ করতে থাকবে, আল্লাহ্ তা’লা তোমাকে সাহায্য করতে থাকবেন। অতএব পুণ্যকর্ম করা আমাদের দায়িত্ব। আর ঈদের প্রকৃত আনন্দ আমরা তখনই লাভ করতে সক্ষম হব, যখন এই উত্তম আচরণ কোন প্রতিদান ছাড়াই মানুষ করতে থাকবে। আর তা এই কারণে যে, আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূল (সা.) এই আদেশ প্রদান করেছেন। এবং এর প্রতিদান দেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা’লা। এখানে এ বিষয়টিও স্পষ্ট করে দিতে চাই যে, আনেক স্বামী নিজ স্ত্রীকে স্ত্রীর আত্মীয়স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ করতে বাধা দেয় এমনকি স্ত্রীর পিতা-মাতার সাথেও দেখা করতে দেয় না। (অর্থাৎ স্ত্রীর আত্মীয়স্বজন এবং পিতা-মাতার সাথে)। এটি চরম অজ্ঞতা। তুচ্ছ তুচ্ছ কথা এবং হৃদয়ে বিদ্বেষ পোষণ করে যে, স্ত্রীর ভাই অমুক সময় একথা বলেছিল, তার বোন এমন কথা বলেছে, তার বাপ-মা আমার সাথে এবং আমার বাবা-মায়ের সাথে এমন আচরণ করেছে। অমুকের চাচা বা মামা এভাবে কথা বলেছে। এসব অজ্ঞতাসূলভ কথা। এধরনের চিন্তাধারা লালন করা একজন মু’মিনের শোভা পায় না। আর এ বিষয়গুলো প্রায়শ সামনে আসতে থাকে। অতএব আল্লাহ্ তা’লাকে যদি সন্তুষ্ট করতে হয়, আল্লাহ্ তা’লার সাহায্য যদি লাভ করতে হয়, তাহলে এই বাজে বিষয়গুলো পরিত্যাগ করতে হবে। যারা আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বাহ্যত কুর্ণিশ করে অন্যদেরকে সালামও প্রদান করে, সন্ধির ক্ষেত্রে প্রথমে এগিয়ে যায়, তারা আল্লাহ্ তা’লার কৃপাভাজন হয়। অতএব এদিকেও প্রত্যেক আহমদীর বিশেষ মনোযোগ দেয়া আবশ্যক।
এমনই স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি রয়েছে। ঘরগুলোতে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঠোকাঠুকি লাগে। সেগুলোও দূর করার চেষ্টা করা আবশ্যক। স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ করার আদেশ যদি পুরুষকে দেয়া হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে স্ত্রীদের জন্যও একই আদেশ তথা নিজেদের মাঝে স্বল্পেতুষ্টি সৃষ্টি করুন এবং নিজ পরিবারের দেখাশুনা করুন।
এরপর বান্দার অধিকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে আল্লাহ্ তা’লা বলেন, এতিম এবং মিসকিনের প্রতিও খেয়াল রাখবে। এ এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এদিকে প্রত্যেক আহমদীর দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক। যদি কোনো এতিমের খোঁজ জানা না থাকে তাহলে জামা’তে ইয়াতামা ফান্ড আছে। এখানে অধিকহারে অংশগ্রহণ করা আবশ্যক। ঈদের আনন্দের এতিমদের শামিল করুন। এই খাতে চাঁদা দেয়া আবশ্যক।
মহানবী (সা.) এতিমের লালন-পালনের বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমি এবং এতিমের লালন-পালনকারী জান্নাতে এমনভাবে একত্রে থাকব যেভাবে হাতের এই দুই আঙুল একত্রে থাকে, তিনি (সা.) হাতের আঙুল একত্রিত করে দেখিয়েছিলেন। অতএব এই পুণ্যে আমাদের অংশগ্রহণ করা উচিত। এছাড়া জামা’তে আরও সাহায্য ফান্ড আছে। মরিয়ম শাদী ফান্ড, অসুস্থদের ফান্ড, ছাত্রদের ফান্ড, যাদের সূযোগ আছে তাদের এর মাঝে অংশগ্রহণ করা উচিত।
এরপর আল্লাহ্ তা’লা মিসকিনের লালন-পালনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আল্লাহ্ তা’লা বলেন, মু’মিন আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টির জন্য এতিম এবং মিসকিনদের খাবার খাইয়ে থাকে।
মহানবী (সা.)ও বলেছেন, তুমি যদি চাও যে, তোমার হৃদয় কোমল হোক তাহলে মিসকিনদের খাবার খাওয়াও এবং এতিমের মাথায় হাত রাখো। অতএব পুণ্যের সৌভাগ্য লাভ করতে আর আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি লাভ করার জন্য সৃষ্টি সেবার এই কাজ প্রত্যেক মু’মিনের নিজের ওপর আবশ্যক করে নেয়া উচিত। আর বিশেষভাবে ঈদের সময় এ দিকে দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। আর কেবল ঈদের দিনে এই সাহায্য করলে চলবে না বরং যাদের সামথ্য আছে, তাদের স্থায়ীভাবে এ কাজ করতে থাকা উচিত।
এরপর প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণের বিষয়টি রয়েছে। যদি প্রতিবেশীর বিষয়টি উপলব্ধি করে মানুষ তার প্রতিবেশীর অধিকার প্রদান করার চেষ্টা করে তাহলে জগৎ থেকে নৈরাজ্যই শেষ হয়ে যায়। একজন মু’মিনের প্রকৃত ঈদ তখন লাভ হবে যখন জগত থেকে নৈরাজ্য শেষ হয়ে যাবে।
প্রতিবেশীর সংজ্ঞা কী? হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) একবার বলেন, শত ক্রোশ পর্যন্ত তোমাদের প্রতিবেশী। অর্থাৎ তোমাদের আশেপাশের একশত মাইল পর্যন্ত যেসব লোক বাস করে তারা তোমাদের প্রতিবেশী। এই সংজ্ঞা অনুসারে তো কেউই প্রতিবেশীর বাইরে থাকে না। মহানবী (সা.) বলেন, তোমাদের প্রতিবেশী যদি তোমাদের প্রশংসা করে তবেই তোমরা উত্তম প্রতিবেশী।
অতএব এই হলো উত্তম প্রতিবেশীর মান আর এই মানে উপনীত হলে সমাজে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। এতে কোন পার্থক্য করার সুযোগ নেই যে, তারা স্বধর্মীয় নাকি বিধর্মী লোক। বরং অনেককে আমি দেখেছি তারা এখানে তাদের বিধর্মী প্রতিবেশীর সাথে অধিক উত্তম আচরণ করে অথচ আহমদীদের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো না। ঈদ উপলক্ষ্যে আমাদেরকে এসব মনোমালিন্যও দূর করতে হবে।
এরপর সঙ্গীসাথির সাথেও উত্তম আচরণের নির্দেশ রয়েছে। সহকর্মীদের সাথে উত্তম আচরণ করার নিদের্শ রয়েছে। এসব নির্দেশ অনুসারে সবাই যদি কাজ করতে আরম্ভ করে তাহলে তবলীগেরও নতুন নতুন পথ খুলবে। আর যখন এই তবলীগের পথ উম্মোচিত হবে তখন সেই ঈদ-ই প্রকৃত ঈদ হবে।
এখানে পশ্চিমা দেশগুলোতে আজকাল বিভিন্ন সময় ইসলামের বিরুদ্ধে বিরেধিতা মাথাচাড়া দেয়। এখানে আমাদের চারিত্রিক গুণাবলী প্রদর্শনের মাধ্যমেই লোকদের কাছে ইসলামের সঠিক শিক্ষা তুলে ধরতে হবে।
এরপর নিজ অধীনস্থ এবং দুর্বলদের প্রতি উত্তম আচরণের নির্দেশ রয়েছে। আপন-পর উভয়ে সাথেই। ইসলাম কোথাও এ কথা বলে না যে, তোমাদের আত্মীয় বা তোমাদের স্বধর্মীদের সাথেই তোমরা উত্তম আচরণ কর, বরং ইসলাম মানুষের অধিকারের কথা বলে। আত্মীয়ের অধিকারের কথাও বলে আর অনাত্মীয়ের অধিকারের বিষয়েও বলে। প্রতিবেশীর অধিকারের বিষয়েও কথা বলে, পাশের প্রতিবেশী এবং দূরের প্রতিবেশীর অধিকারের কথাও বলে। এমনকি কখনো তোমাদের সফরসঙ্গী ছিল এমন প্রতিবেশীর অধিকারের কথাও ইসলাম বলে। এরপর বঞ্চিত এবং দুর্বলদের অধিকারের কথাও বলে। তোমাদের অধীনস্থদের অধিকারের বিষয়েও কথা বলে। এমন কোন্ অধিকার আছে যে বিষয়ে ইসলাম ধর্ম কথা বলে নি? এসব অধিকার- সংক্রান্ত অন্য আয়াতেও এর উল্লেখ রয়েছে।
এসব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চমৎকার যে শিক্ষা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে তা হলো সাম্য ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা আর এত বিস্তারিতভাবে তা বর্ণনা করা হয়েছে যা অতুলনীয় এবং কয়েক জায়গায় এটি বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- এক জায়গায় বলা হয়েছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সত্য সাক্ষ্য দাও যদিও তা নিজের বিরুদ্ধে অথবা নিজের পিতামাতার বিরুদ্ধে কিংবা নিকটাত্মীয়ের বিরুদ্ধেই দিতে হয়। যেমন- আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَىٰ أَنفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ
(সূরা আন্ নিসা: ১৩৬)
অর্থ: হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা ন্যায়পরায়ণতার ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং আল্লাহ্‌র জন্য সাক্ষী হয়ে যাও, যদিও তোমাদের সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের বা পিতামাতার কিংবা স্বজনের বিরুদ্ধেই দিতে হোক।

এগুলো এমন শিক্ষা যা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত রাখে এবং সুন্দর সমাজের জন্ম দেয়। এগুলো এমন বিষয় যা আমরা আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি লাভের জন্য পালন করি, ফলে এগুলো পৃথিবীকেই জান্নাতে পরিণত করে। এটিই হলো প্রকৃত ঈদ যার ফলে এ জগতেই আমরা জান্নাত লাভ করি। অর্থাৎ আল্লাহ্ এবং তাঁর বান্দার অধিকার প্রদানের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীকেই জান্নাতপ্রতীম বানাতে পারি। ইসলাম আমাদেরকে প্রকৃত যে পুণ্যের শিক্ষা দেয় তা হলো নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিবর্তে অন্যের অধিকারের প্রতি দৃষ্টি রাখাতে হবে। এটিই একজন মু’মিনের শান/মান হওয়া উচিত। অর্থাৎ তারা এমন চেষ্টা করবে যাতে তাদের ওপর অন্য কারো অধিকার প্রদানের দায়িত্ব অবশিষ্ট না থাকে। আত্মবিশ্লেষণ করে দেখুন যে, আমার ওপর তো কারো অধিকার প্রদানের দায়িত্ব নেই? অন্যের অধিকার অন্বেষণ করুন। কারো ঋণ পরিশোধ করাই অধিকার নয়। বরং নিজের যতটা শক্তি, সামর্থ্য ও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে তা দিয়ে অন্যের সাথে উত্তম ব্যবহার করাই হলো অধিকার। অন্যের দুঃখকষ্ট অনুভব করুন আর এ বিষয়টিই আমাদের ঈদকে প্রকৃত ঈদ বানাতে পারবে। কেবল এক দিনের ঈদ নয়, বরং এমন ঈদ যা আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি লাভ করে সর্বদার ঈদ হবে।
এছাড়া ঈদের সময় পৃথিবীর সার্বিক বিষয় নিয়েও আমাদের চিন্তিত হওয়া উচিত, এর জন্য দোয়াও করা দরকার। কেবল নিজেরা আনন্দিত হয়েই সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন না, কেননা বর্তমানে পৃথিবী ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা এ নিয়ে চিন্তিত এবং চিন্তিত হওয়া উচিতও বটে। কেননা মানবতাকে রক্ষা করারও আমাদের দায়িত্ব। এসব কিছু হওয়ার কারণ হলো ন্যায়পরায়ণতার দাবি পূরণ করা হচ্ছে না। অন্যের অধিকারের প্রতি দৃষ্টি রাখা হয় না। অঙ্গীকার পালনে যদি বাধ্যবাধকতা থাকত, যদি সর্বস্তরে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার এবং অধিকার প্রদানের চেষ্টা করা হত, সঠিক অর্থে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা হত আর যদি যথাযথভাবে অধিকার প্রদান করা হত তাহলে আমাদেরকে ইরাকের ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে হত না, সিরিয়ার ধ্বংসযজ্ঞও দেখতে হত না, লিবিয়ার ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে হত না, ইয়েমেনের ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে হত না আর আফগানিস্তানের ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে হত না, বর্তমনে যে অবস্থা তাদের হয়েছে তা দেখতে হত না এবং ইদানিং ইউক্রেনে যা কিছু হচ্ছে তাও দেখতে হত না। অতএব যেভাবে আমি বলেছি, এসব অধিকার প্রদানের বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভ করা আর জগতকে ইসলামের সঠিক শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করা এবং পরিচয় করিয়ে দেয়া আর নিজেরা সে অনুসারে আমল করা তবলীগের নতুন পথ উম্মোচিত করবে এবং জগতকে রক্ষা করারও মাধ্যম হবে। এদিকে আমাদের বিশেষ মনোযোগ নিবদ্ধ করা উচিত। জগদ্বাসী নিজদের ধ্বংসের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, এদিকে কেউই ভ্রুক্ষেপ করছে না। তাদের দৃষ্টিতে জাগতিক শক্তি এবং এর বহিঃপ্রকাশ আর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করাই তাদের জীবন ও স্থায়ীত্বের জামানত। কিন্তু তারা জানে না, এটি তাদের স্থায়িত্ব নয় বরং তাদের ধ্বংসকে সুনিশ্চিত করছে। এটিও বৃথা আশাই মনে হচ্ছে যে, পারমানবিক বোমা ব্যবহৃত হবে না বা এর সম্ভাবনা কম। এ সম্পর্কে তো একে অপরকে হুমকি দিচ্ছে কিন্তু তা ব্যবহার হবে কি হবে না তা আল্লাহ্ই ভালো জানেন। কিন্তু এটি সুনিশ্চিত মনে হচ্ছে যে, তারা ধ্বংসের দিকে খুব দ্রুত ধাবিত হচ্ছে এবং এর শেষ পরিণতি বিনাশ ছাড়া আর কিছু নয়। এমতবস্থায় একটি জিনিসই আছে যা পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে আর তা হলো, নিজেদের সৃষ্টিকর্তার পরিচিতি লাভ এবং তাঁর দিকে অগ্রসর হওয়া। জগদ্বাসী এ বিষয়টি জানেও না আর এ বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞানও নেই। তাদেরকে এ পথের দিশা দেখানো এখন আহমদীদের দায়িত্ব। আল্লাহ্‌র প্রাপ্য এবং বান্দার অধিকারের বিষয়টি তাদেরকে বলুন। অর্থাৎ এই উভয় অধিকার প্রদানই তোমাদের স্থায়িত্বের জামানত, তোমাদের শক্তিমত্তা নয়। জনসাধারণকে একথা বলতে হবে যে, তোমাদের নেতারা তোমাদেরকে কোন্ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অতএব পরিস্থিতি সাপেক্ষে আমাদেরকে নতুনভাবে তবলীগের পথ খুলতে হবে। নিজ নিজ এলাকায় লোকদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে তাদেরকে পথ দেখাতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে এদিক-সেদিকের কথা বলে সময় নষ্ট না করে গঠনমূলক কথা বলুন। বাজে কথায় সময় ব্যয় করার পরিবর্তে আল্লাহ্ তা’লার দিকে ধাবিত হওয়ার দিকে পথ প্রদর্শন করুন। একথা বলুন যে, এটিই হলো প্রকৃত বিষয়, অর্থাৎ যদি আল্লাহ্‌র দিকে ধাবিত হও তাহলে তোমরা স্থায়ীত্ব লাভ করবে। আমরা যদি এ দায়িত্ব পালন করতে সমর্থ হই এবং জগদ্বাসীকে এ কথাগুলো বলি তাহলে একদিকে আমরা আমাদের বাড়িঘর, শহর এবং দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছি বলে সাব্যস্ত হব আর জগতকেও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে আনন্দ প্রদানকারী হব। জগতকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার এই একটিই পথ আছে আর তা হলো জগদ্বাসীকে খোদা তা’লার সাথে পরিচিত করানোর মাধ্যমে তাঁর প্রাপ্য প্রদানকারী বানানো। আর এ জন্য আমাদের নিজেদের অবস্থাও সর্বোচ্চ মানে উপনীত করতে হবে। তবেই তা হবে প্রকৃত ঈদ। এই ঈদ উদ্যাপনের জন্য আল্লাহ্ তা’লা মহানবী (সা.)-এর নিবেদীতপ্রাণ দাসকে যুগের সংশোধনকল্পে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি (আ.) এ বিষয়ে জগতকে বার বার সাবধান করেছেন।
এখন আমি হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-এর একটি সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি উপস্থাপন করতে চাই যা কেউ একজন আল্‌-ফযলকে প্রেরণ করেছিল এবং হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-এর ঈদের খুতবার অংশবিশেষ আর এটি মুদ্রণও হয়ে গেছে। আর দৈবক্রমে ঈদুল ফিতরের দিন ছিল ২রা মে ১৯৫৭ সালে। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) সংক্ষিপ্ত খুতবা দিয়েছিলেন যার সারসংক্ষেপ আমি উল্লেখ করছি। এটি তবলীগ বিষয়ক খুতবা ছিল তথা আমাদের হৃদয়ে তবলীগের জন্য কেমন ব্যাকুলতা থাকা প্রয়োজন? আমাদের কীভাবে জগতকে সাবধান করা উচিত? আর কীভাবে আমরা সঠিক অর্থে আহমদী মুসলমান হতে পারি? তিনি (রা.) বলেন, আমাদের ঈদ প্রকৃতপক্ষে সেটিই হতে পারে যা হবে মহানবী (সা.)-এর ঈদ। যদি আমরা ঈদ উদ্যাপন করি আর মহানবী (সা.) যদি উদ্যাপন না করেন তাহলে আমাদের ঈদকে তো ঈদ বলা যায় না। যদিও মহানবী (সা.)-এর ওফাতের ১৩০০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে তবুও এক মু’মিনের ঈদের মহানবী (সা.) অন্তর্ভুক্ত না হন আর যদি সে এই বাহ্যিক ঈদে সন্তুষ্ট হয়ে যায় তাহলে তার ঈদ কোনো কাজের নয়। সেমাই খেলে মহানবী (সা.)-এর ঈদ আসে না এবং মিষ্টি বা খোরমা খেলেও আসে না বরং তাঁর ঈদ কুরআন এবং ইসলাম ব্যাপৃত হলেই আসে। যদি কুরআন এবং ইসলাম বিস্তার লাভ করে তাহলে আমাদের ঈদে মহানবী (সা.)ও অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। তিনি (সা.) আনন্দিত হবেন এই ভেবে যে, যে মিশন নিয়ে আমি আগমন করেছিলাম, আমার উম্মত এখনও তা প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। তাই চেষ্টা করো- ইসলাম যেন প্রসার পায়। কুরআন যেন প্রসার লাভ করে। যেন আমাদের ঈদে মুহাম্মদ (সা.) শামিল হন। আমরা নিঃসন্দেহে তবলীগ করি কিন্তু তবলীগের সঠিক অধিকার প্রদানের জন্য আমাদেরকে পূর্বের তুলনায় অধিক তবলীগ করতে হবে। আমরা বলতে পারি না, যেভাবে তবলীগ করা উচিত, আমাদের সন্তানদের মাঝেও কি সেই আবেগ আছে যা পূর্ববর্তীতের মাঝে ছিল? অথবা আমাদের মাঝেও কি তবলীগের সেই আবেগ আছে যা পূর্ববর্তীতের মাঝে ছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত তবলীগের এই আবেগ আমরা আমাদের নিজেদের মাঝে এবং আমাদের সন্তানদের মাঝে সৃষ্টি করতে সক্ষম না হব, ততক্ষণ আমরা প্রকৃত ঈদ যা মহানবী (সা.)-এর ঈদ- তা উদ্যাপন করতে সক্ষম হবো না।
অতএব এই বাণী আমাদের সদা দৃষ্টিপটে রাখা আবশ্যক। অর্থাৎ এই আবেগ আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝেও সঞ্চারিত করব। নিজেদের মাঝেও পবিত্র পরিবর্তণ সৃষ্টি করার দিকেও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। আল্লাহ্ তা’লার ইবাদাতের অধিকারও প্রদান করতে হবে এবং তাদেরকেও তথা নিজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বলতে হবে, তারাও যেন এ অধিকার প্রদান করে। তারা যেন বান্দার অধিকারও প্রদানকারী হয়। আর কুরআন ও ইসলামের শিক্ষা জগতে বিস্তারের জন্য তারা যেন যথাসাধ্য চেষ্টা করে এবং এই আবেগ যেন পরবর্তী বংশধরদের মাঝে সঞ্চারকারী হয়। আর আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষ্যান্ত হব না যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত জগতে ইসলাম এবং মহানবী (সা.)-এর পতাকা উড়তে না থাকে। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এর সৌভাগ্য দিন, আমরা যেন এমন ঈদের দৃশ্য দেখতে পারি। এমন ঈদ দেখার জন্য আমাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে পারি।
এখন দোয়া হবে। দোয়াতে আসীরানে রাহে মওলাদের স্মরণ রাখবেন, শহীদদের পরিবারবর্গকে স্মরণ রাখবেন, আল্লাহ্ তাদের হাফেয ও নাসের হোন। জামা’তের জন্য যারা আর্থিক কুরবানী করছে তাদের জন্য দোয়া করুন। আল্লাহ্ তা’লা তাদের ধন-সম্পদ ও জনবলে প্রভূত বরকত দিন। ওয়াক্‌ফে যিন্দেগীদের জন্য দোয়া করুন। আল্লাহ্ তা’লা তাদেরকে ওয়াক্‌ফের চেতনা প্রতিষ্ঠিত রাখার সৌভাগ্য দিয়ে গভীর আবেগসহ কাজ করার সৌভাগ্য দিন আর তাদের মাঝে একটাই আবেগ কাজ করুক তথা কর্মক্ষেত্রে যেসব মুবাল্লিগ কাজ করছেন। আমরা মহানবী (সা.)-এর পতাকা জগতে উড়াবো এবং জগতকে তৌহীদের পতাকাতলে নিয়ে আসব। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের এই তুচ্ছ প্রচেষ্টায় অশেষ বরকত দিন আর আমরা মহানবী (সা.) এবং ইসলামের বিজয়কে যেন অচিরেই জগতে দেখতে পাই, আমীন।