প্রসঙ্গ: রোযা


মাহমুদ আহমদ সুমন

বর্ষ পরিক্রমায় প্রতি বছর মুসলিম উম্মাহর দরজায় আত্মসংযম, আত্মোপলব্ধি, তাক্ওয়া এবং মহান কুরবানীর শিক্ষা নিয়ে উপস্থিত হয় পবিত্র রমযান মাস। পবিত্র মাহে রমযান আধ্যাত্মিক ভূবনে বসন্তের সমারোহে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্ম-শুদ্ধির মাস, পরম করুণাময় আল্লাহকে একান্ত করে পাওয়ার মাস। এই পবিত্র মাসের পুরস্কার ঘোষণা করতে গিয়ে হযরত রসূল করীম (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন,

মানুষ যত কাজ করে তা তার নিজের জন্য আর রোযা রাখা হয় কেবল আমার জন্য। সুতরাং আমি নিজেই এর পুরস্কার বা আমি নিজে এর পুরস্কার দিব।

তাই বিষয়টা গভীর ভাবে ভাবা উচিত, যার পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহ্ নিজে। আমরা আল্লাহকে যদি পেয়ে যাই তাহলে আর কোন কিছুর কি প্রয়োজন রয়েছে? রোযার ইতিহাস তাৎপর্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

রোযার প্রাথমিক ইতিহাস

রোযার প্রাথমিক ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কোন কিছু জানা যায় না। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত দার্শনিক স্পেন্সার নিজের বই Principles of Sociology -তে কতগুলো বন্য সম্প্রদায়ের উদাহরণ এবং জীব বৃত্তান্তের ওপর গবেষণা করে লিখেছেন যে,

রোযার প্রাথমিক মানদন্ড এভাবেই হয়তো হয়ে থাকবে যে আদিম বন্য যুগের মানুষ স্বভাবতঃই ক্ষুৎ-পিপাসায় আক্রান্ত থাকতো এবং তারা মনে করতো যে, আমাদের আহার্য বস্তু আমাদের পরিবর্তে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃতদের নিকট পৌঁছে যায়। কিন্তু অনুমানসিদ্ধ উপাত্তকে যুক্তি ও বুদ্ধির আওতাভুক্ত লোকেরা কখনো স্বীকার করে নেয় নি। (ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা: ১০ম খন্ড ১৯৪ পৃষ্ঠা একাদশ সংস্করণ)

মোট কথা অংশীবাদী ধর্মমতগুলোতে রোযার প্রারম্ভ এবং হাকীকতের যে কোন কারণেই হোক না কেন ইসলামের দৃষ্টিতে এর প্রাথমিক পর্যায় ও শেষ পর্যায়কে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে নিজের অনুসারীদের ওকালতির প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করে না। ইসলামের মূল উৎস কুরআন করীমে উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে,

“হে যারা ঈমান এনেছ তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাক্ওয়া অবলম্বন করতে পার”। (সূরা বাকারা: ১৮৪)

অপর এক আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন,

“রমযান মাস হচ্ছে সেই মাস যার মাঝে কুরআন করীম নাযেল করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য পরিপূর্ণ হেদায়াত, পথ প্রদর্শনের দলিল এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে এই মাসকে পাবে তাকে অবশ্যই রোযা রাখতে হবে। আর যদি কেউ রুগ্ন হয় অথবা সফরে থাকে তাহলে সে সমপরিমাণ রোযা অন্যান্য দিনসমূহে আদায় করবে। আল্লাহ্ পাক তোমাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ চান এবং তোমাদের জন্য কাঠিন্য চান না এবং যেন তোমরা গণনা পূর্ণ কর এবং আল্লাহর মহিমা কীর্তন কর এইজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে হেদায়াত দিয়েছেন এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর”। (সূরা বাকারা: ১৮৬)

এই পবিত্র আয়াতসমূহে শুধু কেবল রোযার কতিপয় আহকাম ই বর্ণনা করা হয়নি; বরং রোযার ইতিহাস, রোযার হাকীকত, রমযানের বিশেষত্ব এবং রোযার প্রতি আরোপিত অভিযোগসমূহের প্রত্যুত্তরসমূহ বিস্তারিতভাবে এবং চিত্তাকর্ষকরূপে বিবৃত করা হয়েছে।

রোযার ধর্মীয় ইতিহাস

কুরআন করীমের উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের সুস্পষ্টভাবে এই কথা তুলে ধরা হয়েছে যে, বর্তমান ইসলামের সাথেই শুধু কেবল রোযার সম্পৃক্ততা সুনির্দিষ্ট নয়, বরং কুরআন করীম অবতীর্ণ হওয়ার পূববর্তী মাযহাবগুলোতেও রোযাকে একটি ধর্মের বিশেষ অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অন্ধকার যুগের আরবদের সামনে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম উদাত্তকন্ঠে ঘোষণা করলেন, পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম বিশ্বাসের মাঝে রোযা অবশ্যই ফরজ ইবাদত হিসেবে পরিগণিত ছিল। কিন্তু তৎকালিন আরবের বিরুদ্ধবাদী সম্প্রদায় এমনকি বর্তমান যুগের কোন কোন পন্ডিত ব্যক্তিরাও মনে করে যে, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। এমতাবস্থায় রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম-এর দাবী যদি সর্বাংশে সত্য ও যথার্থ বলে প্রতিপন্ন হয় তাহলে এ কথা মেনে নিতে দ্বিধা সংকোচের অবকাশ মোটেই থাকবে না যে, তিনি উপাদানভিত্তিক জ্ঞানবত্তার উর্দ্ধ ও পরিমন্ডলে অবশ্যই অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই দাবীর সত্যতা প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে ইউরোপের অধিক প্রামাণ্য গ্রন্থের উদ্ধৃতি পেশ করছি যা অনুসন্ধানীদের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবে। ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকায় রোযার প্রবন্ধ লেখক উল্লেখ করেছেন যে,

“রোযার বিধি-বিধান ও আদায় পদ্ধতি, আবহাওয়া, সামাজিক ব্যবস্থা এবং সভ্যতা বিবর্তনের দরুন যদিও বিভিন্ন রূপ পরিদৃষ্ট হয় তথাপি আমরা অতি কষ্টে এমন কোন ধর্মের নাম উপস্থাপন করতে পারব না, যেখানে রোযাকে ধর্মীয় বিধানের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করা হয়নি বস্তুতঃ রোযা একটি ধর্মীয় প্রথা হিসেবে সকল স্থানে স্বীকৃত আছে”।

ভারতবর্ষকে ধর্ম বিকাশের সবচেয়ে পুরাতন স্থান হিসেবে দাবী করা হয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, বর্ত বা ব্রত অর্থাৎ রোযা থেকে এখানকার ধর্মগুলোও বিমুক্ত ছিল না। ভারতীয় বর্ষপঞ্জিতে প্রতিমাসের ১১ ও ১২ তারিখে ব্রাহ্মণদের ওপর একাদশীয় রোযা অপরিহার্য ছিল। এই হিসেব অনুসারে বার মাসে সর্বমোট ২৪টি রোযা পাওয়া যায়। কোন কোন ব্রাহ্মণ কার্তিক মাসে প্রত্যেক সোমবারে রোযা ব্রত পালন করে। হিন্দু যোগীরা চিল্লা পালন করে অর্থাৎ তারা চল্লিশ দিন পর্যন্ত পানাহার বর্জন করে উপোস থাকার প্রচেষ্টা চালায়। ভারতবর্ষের সকল ধর্মমতে বিশেষ করে জৈন ধর্মের মাঝে রোযা পালনের শর্তাবলী অত্যন্ত কঠিন। তাদের মতানুসারে চল্লিশ দিন পর্যন্ত একটি রোযা প্রলম্বিত হয়। গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যে প্রতি বছর জৈন ধর্মের অনুসারীরা কয়েক সপ্তাহ যাবৎ রোযা ব্রত পালন করে। প্রাচীন মিশরীয়দের মঝেও রোযাকে অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির অন্তর্ভুক্ত দেখা যায়। গ্রীক ধর্মানুসারীদের মাঝে শুধু কেবল মহিলারা ‘থাসমো ফেরিয়া-এর তৃতীয় তারিখে রোযা রাখতো। পার্শিয়ান ধর্মে যদিও সাধারণ অনুসারীদের ��পর রোযা ফরজ নয় কিন্তু তাদের ইলহামি কিতাবের একটি শ্লোক দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাদের ওপর রোযার হুকুম প্রযোজ্য ছিল। বিশেষ করে ধর্মীয় নেতাদের জন্য পাঁচ বছর রোয�� ��াখা আবশ্যক ছিল। (ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা: ১০ম খন্ড, ১৯৩-৯৪ পৃষ্ঠা, একাদাশ সংস্করণ)

ইহুদীদের মাঝেও রোযা ছিল আল্লাহ্‌র আরোপিত ফরজ ইবাদত। হযরত মূসা (আ.) কুহে তুরে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ক্ষুৎ-পিপাসার ভিতর দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। (নির্গ: ৩৪-৩৮)

সুতরাং সাধারণভাবে হযরত মূসা (আ.)-এর অনুসারীদের মাঝে চল্লিশ রোযা রাখাকে উত্তম বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু তাদের ওপর চল্লিশতম দিনে রোযা রাখা ফরজ বা তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ পড়ত। (তৌরাত: সফরুল আহবার: ১৬-২৯-৩৪: ২৩-২৭) এজন্য এই দশম দিনকে আশুরা বলা হতো। আর আশুরার এই দিনটি ছিল ঐ দিন যেদিন হযরত মূসা (আ.)কে তৌরাতের ১০ আহকাম দান করা হয়েছিল। এইজন্য তৌরাত কিতাবে এই দিনের রোযাকে পালন করার প্রতি জোর তাগিদ করা হয়েছে।

বস্তুতঃ উপরোল্লিখিত দিক-নির্দেশনা ছাড়া ইহুদীদের অন্যান্য ছহীফাসমূহের মাঝে অন্যান্য দিনের রোযার হুকুম-আহকামও বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায়। (প্রথম শামুয়েল ৭-৬ এবং ইয়ারমিয়া ৩৬-৬) খৃষ্টান ধর্মে বর্তমান কালেও রোযার প্রভাব বিদ্যমান।

হযরত ঈসা (আ.)ও চল্লিশ দিন পর্যন্ত জঙ্গলে অবস্থান করে রোযা রেখেছেন। (মথি: ৪-২)

হযরত ইয়াহইয়া (আ.) যিনি হযরত ঈসা (আ.)-এর সমসাময়িক ছিলেন তিনিও রোযা রাখতেন এবং তার উম্মতগণের মাঝেও রোযা রাখার রীতির প্রচলন ছিল। (মার্কস: ২-১৮)

ইহুদীরা বিভিন্নকালে অসংখ্য ঘটনাবলীর স্মৃতিস্বরূপও এর সাথে অনেকগুলো রোযা সংযোজন করেছিল। এর অধিকাংশই ছিল বেদনাময় স্মৃতির স্মরণিকা। এই সকল রোযার মাধ্যমে তারা নিজেদের অতীত বেদনাময় স্মৃতিগুলোকে উজ্জীবিত করে তুলতো। এমন কি দেহ-মনের মাঝেও বেদনা ছাপ ফুটিয়ে তুলতো। (কোযাত: ২০-২৬, প্রথম শামুয়েল: ৭-৬ ও ৩১-১৩ এবং লুক: ৬-১৬) হযরত ঈসা (আ.) স্বীয় আমলে কিছু সংখ্যক রোযা রাখার অনুমতি বা অবকাশও ছিল। একবার কতিপয় ইহুদী সমবেত হয়ে হযরত ঈসা (আ.)-এর নিকট এই আপত্তি উত্থাপন করলো যে, তোমার অনুসারীরা কেন রোযা রাখছে না। হযরত ঈসা (আ.)-এর জবাবে বলেন,

“তবে কি বরযাত্রীগণ যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে অবস্থান করে তারা ততক্ষণ পর্যন্ত রোযা রাখতে পারে না। সুতরাং এমন এক সময় আসবে যখন দুলা তাদের সাথে থাকবে না তখন তারা রোযা রাখবে।” (মার্কস: ২-১৮)

এই দিক নির্দেশনায় দুলা বলতে নির্দেশ করা হয়েছে হযরত ঈসা (আ.)-এর পবিত্র সত্তাকে এবং বরযাত্রী বলা হয়েছে তার অনুসারী হাওয়ারীদেরকে। একথা সুস্পষ্ট যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন স্বীয় উম্মতের মাঝে অবস্থান করেন ততক্ষণ উম্মতদের শোক পালনের কোন প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় না। সুতরাং উপরোল্লিখিত বর্ণনার দ্বারা বুঝা যায় যে, হযরত ঈসা (আ.) হযরত মূসা (আ.) এর আমলে প্রবর্তিত ফরজ এবং মোস্তাহাব রোযাসমূহকে নয়; বরং শোক পালনার্থে প্রচলিত নব্য রোযার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন এবং তিনি স্বীয় অনুসারীদেরকে পূর্ণ আন্তরিকতা ও বিশুদ্ধচিত্ততার সাথে রোযা রাখার উপদেশ প্রদান করতেন। যেমন,

‘অতঃপর তোমরা যখন রোযা রাখবে তখন লোক দেখানো মনোবৃত্তি সম্পন্ন মানুষের মত নিজেদের মুখমন্ডলকে উদাস করে রাখবে না। কেননা, এই শ্রেণীর লোক নিজেদের মুখমন্ডলের আসল রূপ বিকৃত করে ফেলে যেন মানুষ মনে করে যে তারা রোযাদার। আমি তোমাদের কাছে সত্য কথাই বলছি। এ শ্রেণীর লোকেরা তাদের বিনিময় পেয়ে গেছে। সুতরাং তোমরা যখন রোযা রাখবে তখন মাথায় তেল ব্যবহার করবে, মুখমন্ডল ধৌত করবে। এতে করে তোমরা মানুষের নিকট নয়; বরং তোমাদের পিতার নিকট গোপনীয় ভাবে অবস্থান করবে। তোমরা যারা রোযাদার তা সুস্পষ্ট এবং তোমাদের পিতার নিকট যা প্রচ্ছন্ন ও গোপনীয় তিনি তার সরাসরি প্রতিফল ও বিনিময় অবশ্যই প্রদান করবেন’। (মথি: ৬- ৬-৭)

অপর এক স্থানে হযরত ঈসা (আ.)-এর নিকট তার অনুসারীরা জিজ্ঞেস করলো যে আমরা আমাদের অপবিত্র অন্তর সমূহকে কিভাবে দূর করে দিতে সক্ষম হবো? প্রত্যুত্তরে হযরত ঈসা (আ.) বললেন,

“অন্তর সমূহের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে দোয়া এবং রোযা ছাড়া দূর করার কোন ব্যবস্থা নেই”। (মথি: ১৭-২১)

আরববাসীরাও ইসলামের পূর্বে রোযা সম্পর্কে কমবেশী ওয়াকিফহাল ছিল। মক্কার কুরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ মুহররম) দিনে এ জন্য রোযা রাখতো যে, এই দিনে খানা কাবার ওপর নতুন গেলাফ চড়ানো হতো। (মুসনাদে ইবনে হাম্বল: ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ: ২৪৪)

মদীনায় বসবাসকারী ইহুদীরাও পৃথকভাবে আশুরা উৎসব পালন করতো। (সহীহ বুখারী: কিতাবুস সওম, ১ম খন্ড, পৃ: ১৬২) অর্থাৎ ইহুদীরা নিজেদের গণনানুসারে সপ্তম মাসের ১০ম দিনে রোযা রাখতো।

উপরোক্ত বিশ্লেষণের দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, কুরআন করীমের নির্দেশ “তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল” আয়াতটি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। একমাত্র ইসলাম ধর্মেই এই উপবাস ব্রতের মধ্যে নবরূপ ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য তুলে ধরেছে। ইসলাম পরিপূর্ণ ধর্ম। তাই ইসলামেই রোযাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ণ করে একে পালনের জন্য ফরজ করা হয়েছে এবং এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

রোযার হাকীকত

মানুষের সকল প্রকার আত্মিক অবনতি ও দুর্ভাগ্যসমূহকে এবং তার অসফলতার কার্যকারণসমূহ যদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে সর্বশেষ পরিণাম ফল এই দাঁড়াবে যে, পৃথিবীর বুকে মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজন সমূহের প্রতি মুখাপেক্ষী এবং তারা বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসরণ করে চলে। তাদের অন্তরের যে কোন অনুকম্পন এবং তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সন্তুত যাবতীয় চেষ্টা ও তদ্বীর কোন প্রয়োজন এবং উদ্দেশ্য থেকে খালি নয়। নৈতিক অবস্থা যা সার্বিক সম্পর্ক আত্মিক অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। যদি এর তাহকীক করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, এর ভিত্তিও সাধারণত কোন না কোন প্রয়োজন অথবা গরজে নফসানীর উপর অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত। এ জন্য আমাদের সকল প্রকার দূর্ভাগ্য, অপবিত্রতা এ সকল কারণেরই ফলশ্রুতি মাত্র। সুতরাং প্রয়োজন এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যদি মানুষের সংস্পর্শে থেকে বহু দুরে চলে যায় এমনকি এগুলোর ছোঁয়াচ হতে মানুষ যদি সম্পূর্ণরূপে অমুখাপেক্ষী ও বিমুক্ত হয়ে যায় তাহলে সে আর মানুষ রূপে বিবেচিত হবে না, বরং তাকে ফেরেশতা বলাই সমীচীন হবে।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, মানুষের প্রয়োজন সমূহ এবং তাদের বিভিন্নমুখী আশা-আকাংক্ষা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা একটি বৃহত্তর পরিসরে সীমাহীনরূপে পরিদৃষ্ট হয় এগুলোর আসল হাকীকত কি? আমাদের অন্তরে রয়েছে আশা-আকাংক্ষার একটি খনি এবং ইচ্ছা ও অভিব্যক্তির সুবিশাল প্রান্তর এবং সেখানে অবস্থান করছে স্বঃপ্রণোদিতভাবে অসংখ্য প্রয়োজনীয়তার অগণিত সম্ভার। এইসব অগণিত আশা আকাংক্ষাকে ত্যাগ করে খোদার সন্তুষ্টির জন্য তাঁর কথা মত চলাই আমাদের জন্মের উদ্দেশ্য। আমরা যদি খোদা তাআলার হুকুম মতে চলি তাহলেই তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারবো আর রোযা হচ্ছে খোদাকে পাবার সবচেয়ে বড় মাধ্যম।

হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) রোযার হাকীকত সম্বন্ধে বলেন,

“অল্প আহার এবং ক্ষুধা সহ্য করাও আত্মশুদ্ধির জন্য আবশ্যক। এতে দিব্য-দর্শন শক্তি (কাশ্ফী তাকত) বৃদ্ধি পায়। মানুষ শুধু খাদ্য গ্রহণ করে বাঁচে না যে অনন্ত জীবনের প্রতি লক্ষ করা একেবারেই পরিত্যাগ করে, সে নিজের ওপর “ঐশীকোপ” (কহরে ইলাহী) আনয়ন করে। কিন্তু রোযাদারকে লক্ষ রাখতে হবে যে, রোযার অর্থ শুধু এটা নয় যে, মানুষ অনাহারে থাকবে; বরং খোদার যিকর অর্থাৎ তাঁর স্মরণে মশগুল থাকা উচিত। আঁ হযরত (সা.) রমযান শরীফে অনেক বেশি ইবাদত করতেন। এদিনগুলোতে পানাহারের চিন্তা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহ্ তাআলার প্রতি মনোনিবেশ (তাবাত্তুল ইলাল্লাহ্) করা চাই। দুর্ভাগ্য সেই ব্যক্তির, যে দৈহিক প্রয়োজনে খাদ্য গ্রহণ করে কিন্তু আধ্যাত্মিক খাদ্যের জন্য পরওয়া করে না। বাহ্যিক খাদ্য দৈহিক শক্তি লাভ হয়, একই ভাবে আধ্যাত্মিক খাদ্য আত্মাকে কায়েম রাখে এবং এতে আত্মার শক্তিগুলো সতেজ হয়। খোদার নিকট সাফল্য চাও। কারণ, তিনি সামর্থ্য দিলেই সকল দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে”।

হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) আরও বলেন,

“কেবল অভুক্ত ও পিপাসার্ত থাকাই রোযার উদ্দেশ্য নয় বরং এর একটি তাৎপর্য এবং প্রভাব আছে যা অভিজ্ঞতায় বুঝা যায়। মানুষের প্রকৃতির মাঝেই এটা নিহিত আছে যে, মানুষ যত কম খায় ততই তার আত্মশুদ্ধি এবং কাশফী তাকত বা দিব্য-দর্শন শক্তি বৃদ্ধি পায়। খোদার অভিপ্রায় এটাই যে, একটি খাদ্যকে কম করে অপর একটি খাদ্যকে বর্ধিত করা। রোযাদারের সর্বদাই এর প্রতি দৃষ্টি দেয়া কর্তব্য। খোদা তাআলার যিকর বা স্মরণেই সময় কাটানো উচিত যেন সংসারের মোহ দূর হয় এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ মনোনিবেশ করা যায়। অতএব, রোযার উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন এক খাদ্য ত্যাগ করে অন্য খাদ্য গ্রহণ করে। এটা আত্মার প্রশান্তির এবং তৃপ্তির কারণ হয়। যে লোক শুধু খোদার জন্যই রোযা রাখে এবং আচার-অনুষ্ঠানের রোযা রাখে না তার উচিত, যে সর্বদা হামদ (প্রশংসা কীর্তন), তসবীহ্ (আল্লাহর পবিত্রতা ও মাহাত্ম ঘোষণা) এবং তাহলীলের (আল্লাহর তৌহীদ ঘোষণা) মাঝে নিজেকে নিয়োজিত রাখে, যাতে তার দ্বিতীয় খাদ্যের (আধ্যাত্মিক খাদ্যের) সৌভাগ্য লাভ হয়”। (আল হাকাম: ১৭-০১-১৯০৭)

রোযার গুরুত্ব সম্পর্কে রেওয়ায়েত আছে, আঁ হযরত (সা.) বলেছেন,

প্রত্যেক জিনিষের জন্য নির্দিষ্ট দরজা থাকে, ইবাদতের দরজা রোযা। (জামেউস সাগীর)

তারপর হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, আঁ হযরত (সা.) বলেছেন,

রোযা ঢালস্বরূপ এবং আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি নিরাপদ দূর্গ। (মুসনাদ আহমদ)

হযরত হুযায়ফা (রা.) বলেছেন,

আমরা হযরত ওমর (রা.) নিকট বসেছিলাম, হযরত ওমর জিজ্ঞাসা করলেন, ফেৎনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্পর্কে তোমাদের কাছে আঁ হযরত (সা.)-এর দেয়া কোন বক্তব্য আছে? আমি বললাম, আঁ হযরত (সা.) যা বলেছিলেন আমার তা হুবহু মনে আছে। হযরত ওমর বললেন, ‘তুমি কথা বলার ব্যাপারে খুব সাহস রাখ। আমি বললাম, মানুষ তার ঘর-সংসার, ধন-সম্পদ, সন্তানাদী অথবা প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে যেসব ফেৎনার সম্মুখীন হয়, নামায, রোযা, সদকা, ভাল কাজের আদেশ, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার নির্দেশ পালনের মাধ্যমে ঐসব ফেৎনার প্রায়শ্চিত্ব হয়ে যায়’। (বুখারী)

হযরত আলী (রা.) বলেছেন, আঁ হযরত (সা.) বলেছেন:

“নিশ্চয় জান্নাতে বালাখানা থাকবে, যার ভেতরের সবকিছু বাইরে থেকে দেখা যাবে। একজন বেদুঈন দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ঐ বালাখানা কাদের জন্য হবে? আঁ হযরত (সা.) বললেন, যারা মিষ্টভাষী হবে, অভাবীদের আহার করাবে, রাতের গভীরে যখন মানুষ নিদ্রামগ্ন থাকে তখন যারা নামায পড়ে”। (তিরমিযী)

হযরত আবু মাসুদ গাফফারী (রা.) বর্ণনা করেছেন,

আমি একদিন আঁ হযরত (সা.) কে বলতে শুনেছি তখন রমযান মাস ছিল, হুযূর (সা.) বলেছিলেন, যদি মানুষ রমযানের মর্যাদা, ফযিলত সম্পর্কে জানত তাহলে আমার উম্মতের সবাই আকাংক্ষা করতো যে, সারা বছরটাই যেন রমযান হয়ে থাকে। একথা শুনে বনী খুজাআ গোত্রের এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর নবী! আপনি রমযানের ফযিলত সম্পর্কে বলুন। আঁ হযরত (সা.) বললেন, নিশ্চয় জান্নাতকে বছরের আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত রমযানের জন্য প্রস্তুত করা হয়। রমযানের প্রথম দিন আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর আরশের নিচে বায়ু প্রবাহ শুরু হয়ে যায়।

হাদীসে আরো বর্ণিত আছে, হযরত ওমর (রা.) রেওয়ায়াত করেন,

হযরত রসূল করীম (সা.) বলেছেন, “রমযান মাসে আল্লাহর যিকর যারা করেন তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়, এ মাসে আল্লাহর কাছে চেয়ে কেউ বঞ্চিত থাকে না”। আঁ হযরত (সা.) এ কথাও বলেছেন, “রোযাদার ব্যক্তি ইফতারী করার সময় যা দোয়া করে তা কখনোই না মঞ্জুর হয় না”। (ইবনে মাজাহ)

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আওয়াল (রা.) বলেছেন:

“যদি মানুষ জিজ্ঞেস করে যে, রোযার দ্বারা কিভাবে নৈকট্য লাভ হয়! তুমি বল, আমি খুব নিকটে এবং এ মাসে যারা দোয়া করে তাদের দোয়া শুনে থাকি। তাদের উচিত তারা যেন আগের থেকে আমার আদেশ নিশেধ মেনে চলে যা আমি আদেশ দিয়ে রেখেছি। আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে যেন সে উদ্দেশ্য লাভে সফল হতে পারে এবং এভাবে সে অনেক উন্নতি করবে”। (আল হাকাম, ১৭ নভেম্বর, ১৯০৭)

তিনি (রা.) আরো বলেন,

“রোযা যেমন তাক্ওয়া লাভের মাধ্যম তেমনই আল্লাহর নৈকট্য লাভেরও মাধ্যম। তাইতো রমযানের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন: (সূরা বাকারা: ১৮৭) এ আয়াতে রমযানের বরকত সম্পর্কে নাযেল হয়েছে। এখান থেকে রমযান মাসের সম্মান এবং আল্লাহ্ সম্পর্কে জানা যায় যে, যদি কেউ এ মাসে দোয়া করে তাহলে আমি কবুল করবো। কিন্তু তার উচিত আমার কথা মেনে চলা এবং মান্য করা। মানুষ যত বেশি আল্লাহর আদেশ পালনে শক্তি ব্যয় করে আল্লাহ্ ও তত বেশি তার দোয়া কবুল করেন। তারপর আয়াত শেষে যে বলা হয়েছে, “যেন তারা হেদায়াত পায়” এর থেকে জানা যায় যে, হেদায়ত লাভ করাও এ মাসের বরকত। এ মাসে আল্লাহর প্রতি ঈমান, তাঁর নির্দেশাবলীর আনুগত্য এবং দোয়ার মাধ্যমে হেদায়াত লাভ হয় এবং এর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়”। (আল হাকাম, ২৪ জানুয়ারী ১৯০৪)

আল্লাহ্ তাআলা রোযাদারের মুখের গন্ধকে এজন্য পছন্দ করেন যে তাঁর বান্দা তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে রোযা রাখতে বাধ্য করেছে এবং ইবাদতে রত হয়েছে। ফলে আল্লাহ্ তাঁর এমন বান্দাকে খুব পছন্দ করেন। এমন বান্দাদের জন্য বিশেষ রহমত ও ফযলের বাতাস প্রবাহিত করেন। ইহজগতেও তাকে নিজের আশ্রয়ে রাখেন এবং পরকালেও জান্নাতের উত্তরাধিকারী করেন।

আল্লাহ্ তাআলা আমাদের সকলকে সেই তৌফিক দান করুন, আমরা যেন সঠিকভাবে এই পবিত্র রমযান ইবাদতগুজারে অতিবাহিত করতে পারি। হে আল্লাহ্! আমাদেরকে এ রমযানের সীমাহীন কল্যাণ প্রদান কর। প্রত্যেক অনিষ্ট, মন্দ থেকে বাঁচাও, তোমার রহমতের ও ফযলের আবরণের মধ্যে চিরদিন আবৃত করে রাখ। (আমীন)

প্রাপ্ত সুত্রঃ পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে আগস্ট, ২০০৮ইং