আলেকজান্ডার ডুই-এর সঙ্গে মোবাহালা

ইলহামের মাধ্যমে প্রাপ্ত আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আঃ) হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর মোজাদ্দেদ এবং প্রতিশ্রুত মসীহ ও ‘ইমাম মাহদী’ হওয়ার দাবী করেন। একই সময়ে ‘পাদ্রী আলেকজান্ডার ডুই’ নামক আমেরিকার একজন বিখ্যাত খৃষ্ট ধর্মযাজক নিজেকে ‘এলিয়’ তথা ইলিয়াস পয়গম্বর বল দাবী করেন এবং নিজের প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশ্বব্যাপী জোরালো প্রপাগন্ডা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

বস্তুতঃ উনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে পশ্চিম গোলার্ধে এলিয় নবী হওয়ার দাবীকারক মিষ্টার আলেকজান্ডার ডুই এবং পূর্ব গোলার্ধে অন্তর্ভুক্ত ভারতবর্ষের প্রতিশ্রুত মসীহ (মুহাম্মদী মসীহ) হওয়ার দাবীকারক মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী প্রসঙ্গদয় সারা বিশ্বে তখন এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

প্রখ্যাত পাদ্রী আলেকজান্ডার ভুইয়ের সঙ্গে ইসলাম ধর্ম সত্য নাকি খৃষ্টধর্ম সত্য’ তা যাচাই করে দেখার জন্য আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)-এর এক মোবাহালা হয়েছিল। এই ‘ঐহিতাসিক মোবাহালার’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তদানীন্তন প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক পত্র পত্রিকাগুলোতে বহু চিত্তাকর্ষক খবর এবং নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, যার ফলে খৃষ্টধর্মের উপর ইসলামের সত্যতা বা সাদাকাত সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েছিল।

ইলিয়াস নবী হওয়ার দাবীকারক পাদ্রী ডুই সাহেব মূলতঃ অষ্ট্রেলিয়ার অধিবাসী ছিলেন। দেশ ত্যাগ করে আমেরিকা এসে তিনি ধর্মযাজক হিসেবে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৯২ সালে তিনি আমেরিকায় খৃষ্টধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন এবং নিজে শিষ্যগণকে নিয়ে একটি শহর স্থাপন করেন। যার নাম দেন “জিয়ন শহর’। যেহেতু ঐ জামানাতে পৃথিবীতে মসীহের তথা ঈসা নবীর দ্বিতীয় আগমনের নানাবিধ লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছিল, সেহেতু সারা পৃথিবীর জনসাধারণের মধ্যে এতদ্বিষয়ে কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছিল যে কখন, কোথায়, কীভাবে কোন দেশে বা কোন মহাদেশে অথবা পৃথিবীর কোন শহরে মসীহ আকাশ হতে অবতরণ করবেন? যদিও আকাশ হতে অবতরণের বিশ্বাসটা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবতা বিরোধী এবং অলীক ধারণাপ্রসূত, তথাপি কোটি কোটি মানুষের জন্য এ ছিল একটি প্রধান আলোচ্য বিষয় এবং তদানীন্তন সুধী মহলের জন্যও ছিল একটা আকর্ষণীয় প্রসঙ্গ। একদিকে হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আঃ) দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘বনী ইস্রাঈলী মসীহ স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুলাভ করেছেন এবং শ্রীনগর (কাশ্মীর) শহরে তাঁর সমাধি বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং, আকাশ হতে মসীহ অবতরণের আকিদাটি সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা।

অপর দিকে এলিয় পয়গম্বর হওয়ার দাবীকারক পাদ্রী আলেকজান্ডার ডুইও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন, “বনী ইস্রাঈলী মসীহ আমার প্রতিষ্ঠিত পবিত্র নগর আমেরিকার জিয়ন শহরে অবশ্যই আকাশ থেকে অবতরণ করবেন।” এরূপ ব্যতিক্রমধর্মী ঘোষণাসমূহের প্রচারের প্রেক্ষিতে উভয় গোলার্ধেই বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হতে লাগল। বিশেষতঃ এতে করে খৃষ্টজগতে এক অভূতপূর্ব উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছিল। আলেকজান্ডার ডুই সাহেব তার অসাধারণ বাকশক্তির মদে মত্ত হয়ে যুক্তি প্রদর্শন করলেন, যেহেতু এ পৃথিবীতে খৃষ্টের আগমনের পূর্বে ‘এলিয় নবীর পুনরাগমনের নির্দেশ ছিল এবং বর্তমানে মসীহের দ্বিতীয় আগমনের সময় অত্যাসন্ন। অতএব, তার আকাশ থেকে অবতরণের পূর্বে তিনিই (ডুই সাহেব) স্বয়ং ‘এলিয়’ পয়গম্বর হিসেবে আগমন করেছেন। পাদ্রী ডুই সাহেব নিজের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার এরূপ দাবীও জনসমক্ষে পেশ করলেন যে, মসীহের ন্যায় তিনিও প্রার্থনার বলে স্পর্শ দ্বারা ব্যধিগ্রস্তদের আরোগ্য দান করতে সক্ষম। 

ডুই সাহেব ছিলেন একজন প্রতিভাশালী, কর্মদক্ষ এবং সাংগঠনিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি | ব্যক্তিগত প্রভাব-প্রতিপত্তির বলে একটি সমৃদ্ধশালী এলাকাতে ১১ বর্গমাইলব্যাপী বিস্তৃত ছয় সহস্র একর জমি খরিদ করে স্বীয় মিশনের কেন্দ্র হিসেবে ‘জিয়ন’ নামে একটি নতুন শহরের পত্তন করে তিনি ঘোষণা করলেনঃ “যীশু যখন আকাশ থেকে অবতরণ করবেন তখন তিনি নবগঠিত এ পবিত্র নগর জিয়ন সিটিতেই অবতরণ করবেন।” তার এরূপ আস্ফালন শুনে জনগণের মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিল যে, ডুই সাহেবের সঙ্গে খোদাতা’লার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এবং খোদার নির্দেশেই যীশুর অবতরণের স্থান হিসেবে তিনি এ পবিত্র নগর জিয়ন সিটির গোড়াপত্তন করেছেন। এ নিয়ে চতুর্দিকে এমন কি দেশ-বিদেশে সর্বত্র একটা চিত্তাকর্ষক খবরে মুগ্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ধনিক সম্প্রদায়ের লোকেরা জিয়ন সিটিতে বাড়ী নির্মাণ করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন। যে পবিত্র নগরীতে যীশু স্বয়ং আকাশ থেকে অবতরণ করবেন, সেখানে কে কার পূর্বে বাড়ী তৈরী করবেন সেই চিন্তা-ভাবনায় তারা অধীর হয়ে গেলেন। ফলে দেখতে দেখতে স্বল্পকালের মধ্যেই শহরটিতে গগণচুম্বী অট্টালিকাসমূহ নির্মিত হয়ে গেল। লক্ষ-লক্ষ সঙ্গতিসম্পন্ন আমেরিকান তার উপর ঈমান আনতে লাগলেন। চতুর্দিকে পাদ্রী ডুই সাহেবের নাম-যশ ছড়িয়ে পড়ল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে পশ্চিম গোলার্ধের অন্তর্ভুক্ত বিশাল উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকেরাও দলে দলে এসে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে শুরু করে দিল। এমন কি বিশাল আটলান্টিক মহাসাগরের পরপারে অবস্থিত ইউরোপ মহাদেশের যাবতীয় এলাকায় এবং সুদূর প্রাচ্যের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসমূহেও পাদ্রী ডুই সাহেবের মিশন বিস্তার লাভ করতে লাগল। তার মতবাদ প্রচারের সুবিধার্থে লিভস অব হিলিং নামক একটি পূর্ণাঙ্গ পত্রিকাও প্রকাশ করা হত। এমন কি বহির্দেশে ফ্রান্স ও জার্মান ভাষায় এতদুদ্দেশ্যে পত্রিকা প্রকাশ হতে লাগল।

আমেরিকার একজন সুবিখ্যাত লেখক পার্লন সাহেব রচিত ‘ভয়েস অব জিয়ন সিটি’ নামক পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে যে, ডুই সাহেব তাঁর শিষ্যদেরকে সম্বোধন করে বলেছিলেনঃ “আমি যা-ই বলব, তোমাদেরকে অবশ্যই তা পালন করতে হবে। কেননা, খোদার ওয়াদা অনুযায়ী আমি একজন পয়গম্বর । পয়গম্বরী দাবীর সঙ্গে গর্বের সাথে তিনি ইহাও ঘোষণা করেছিলেনঃ “সারা বিশ্ব মানবের কেন্দ্র হিসেবেই পবিত্র জিয়ন শহরের অভূদয় হয়েছে। এ পবিত্র জিয়ন সিটির বাদশাহাত স্বর্গীয় বাদশাহাত, যাকে কেউই টলাতে পারবে না।” -(‘LEAVES OF HEALING VOL 18, No, 26 Page 458)

ফলতঃ পাদ্রী আলেকজান্ডার ডুই সাহেব একজন প্রতাপান্বিত বাদশাহের মতই অতীব উন্নতমানের জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন। তার ভক্তগণের ভক্তির আতিশয্যে তাকে ‘ডুই দি ডক্টর’ কেউ তাকে ‘দি ওভারসিয়ার দি ফাস্ট এ্যাপোসেল’ খেতাবে সম্বোধন করতে লাগলেন। লক্ষ-লক্ষ শিষ্যের সমন্বয়ে গঠিত তার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান “দি জেনারেল ওভারসিয়ারের সর্বাধিনায়ক হিসেবে অসাধারণ প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। তা ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন শিল্পপতি । তিনি কতিপয় শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বড় বড় কল-কারখানারও স্বত্ত্বাধিকারী ছিলেন। তার ব্যক্তিগত অর্থসম্পদ তখন ৬ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। -(আলকাস পারলান প্রণীত ‘ডুই এন্ড দি খৃষ্টান ক্যাথলিক এপষ্টলিক চার্চ ইন জিয়ন’) 

মুদ্দাকথা এই যে, অগাধ ধন-সম্পদ, শিষ্যদের সংখ্যাধিক্য এবং প্রগতিশীল ও সঙ্গতিসম্পন্ন শিষ্যদের উপর তার আধিপত্য ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের উপরে তার একচেটিয়া স্বত্ত্বাধিকার এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ইত্যাদির গর্বে পাদ্রী আলেকজান্ডার ডুই সারা দুনিয়ায় অন্য কাউকে নিজের সমকক্ষ বলে মনে করতেন না।  

উল্লেখ্য যে, ১৮৯৬ সনের ২২ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে পাদ্রী ডুই সাহেব খৃষ্টান ক্যাথলিক এপষ্টলিক চার্চের নাম দিয়ে জেনারেল ওভারসিয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে জিয়ন সিটি চার্চের অধীন একটি নতুন স্বতন্ত্র ফেরকা সৃষ্টি করেছিলেন। ঐ ফেরকা সৃষ্টি করেই তিনি ঘোষণা করেছিলেনঃ অতঃপর চার্চ অব ইংল্যান্ড, ডিফেন্ডার অব ফেইথ, চার্চ অব রোম, ভেটিকান ইত্যাদি যাবতীয় চার্চ সংস্থাই বাতেল বলে গণ্য করা হবে। 

জেনারেল ওভারসিয়ার সংস্থাটিই হবে খৃষ্টধর্মের একমাত্র প্রতিনিধি।” তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে এ নির্দেশ কার্যকরী হতে লাগল এবং অন্যান্য সংস্থার অন্তর্গত সমুদয় চার্চসমূহে লোক সমাগম ক্রমান্বয়েই হ্রাস পেতে .লাগল । আর এদিকে জেনারেল ওভারসিয়ার মতবাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত চার্চ অব জিয়ন সিটি’ লোকে লোকারণ্য হতে লাগল। ২/৩ বৎসরের মধ্যেই দেখা গেল যে, অন্যান্য সমস্ত গীর্জসমূহ অনাবাদী এবং অকেজো হয়ে পড়ছে। 

পাদ্রী ডুই সাহেবের নব প্রতিষ্ঠিত ‘চার্চ অব জিয়ন সিটিতে এক বিশালকায় ঘন্টা সংস্থাপিত হয়েছিল এবং আদেশ করা হয়েছিল যে,সকাল ৯ ঘটিকা এবং সন্ধ্যার পরে ৯ ঘটিকার সময়ে গীজায় উপস্থিতির সংকেত স্বরূপ ঘন্টাধ্বনি করা হবে। কড়া আদেশ জারী করা হয়েছিল যে,ঘন্টাধ্বনি হওয়ামাত্র পদমর্যাদা নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাইকে গীর্জায় হাজিরা দিতে হবে।

বস্তুতঃ চার্চ অব জিয়ন সিটিতে প্রার্থনার সময়ে এরূপ আশ্চর্য দৃশ্য এবং অভূতপূর্ব ধর্মীয় পরিবেশ অবলোকন করে সমসাময়িক সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ এবং জার্নালিষ্টগণ ইহাই প্রচার করতেছিলেন যে, এসব কর্মকান্ড ডুই সাহেবের মোজেযা বা অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ড ব্যতিরেকে আর কিছুই নহে। শুধু তাই নয়, স্বীয় ভৌতিক চিকিৎসা দ্বারা রোগ নিরাময়ের জন্য পবিত্র জিয়ন নগরে প্রকান্ড হাসপাতাল নির্মাণ করা হল। হাসপাতালটির আয়তন বৃদ্ধি হতে হতে ক্রমিক নম্বর ১ হতে ৭ নম্বর হাসাপাতাল পর্যন্ত নির্মিত হয়ে গেল। বহুসংখ্যক রোগী আসতে লাগল। ফী বাবদ প্রতি রোগী হতে সে যুগের মুদ্রায় ২০ ডলার হারে আদায় করা হত।

প্রচারের সুবিধার্থে জিয়ন প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং হাউজ’ নামকরণ করে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রেসও স্থাপন করা হয়েছিল। অর্থ-সম্পদের সুষ্ঠু তদারকির জন্য জিয়ন সিটিতে ডুই সাহেবের নিজস্ব ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হল । বিভিন্নমুখী বিরাট সম্পদের সুষ্ঠু ংরক্ষণের জন্য “জিয়ন গার্ড’ নামে এক বিরাট স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। নির্মাণ কার্যে শহরটিকে স্বনির্ভর করে তোলবার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারের মতই ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনষ্ট্রাকশান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল । বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃথক পৃথক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিয়োজিত ছিল। ডুই সাহেবের একজন অতীব প্রিয় শিষ্য উইলভার গ্লিভেন ওয়ালীথ নামীয় একজন পাদ্রী ছিলেন জেনারেল ম্যানেজার । তিনি ডুই সাহেবের দক্ষিণহস্তস্বরূপ ছিলেন। 

জিয়ন সিটির ঐসব বিভিন্নমুখী কর্মতৎপরতা ছাড়াও বহির্দেশে তার আরও ৩২টি মিশন কার্যরত ছিল। নিউ ইয়র্ক গীর্জার ভক্তগণকে জিয়ন সিটি গীর্জার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একবার তিনি ৬/৭টি স্পেশিয়াল ট্রেনের ব্যবস্থা করে তিন সহস্র অনুচরবর্গ নিউ ইয়র্ক ভ্রমণে বের হলেন। জিয়ন সিটি হতে ৯০০ মাইল দূরবর্তী নিউ ইয়র্ক শহরে দলে দলে উপস্থিত হওয়ামাত্র খুব হৈ-চৈ পড়ে গেল। বহুল প্রচারিত ‘এলিয় পয়গম্বরকে’ এক নজর দেখবার জন্য নিউ ইয়র্ক শহরের রাস্তাঘাট, রেলওয়ে স্টেশনসহ সর্বত্র লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল।

তথাকথিত এলিয় নবী ডুই সাহেবের জীবনে এরূপ আন্তর্জাতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করা এবং ধর্ম প্রচারের এমন অভিনব পদ্ধতি সূচনা করার মূখ্য উদ্দেশ্যই ছিল ইসলামকে করতলগত করে ত্রিত্ববাদের দ্বারা জগতকে ছেয়ে ফেলা। তার নিজস্ব পত্রিকা লিভস অব হিলিং’-এর ১৯০২ সনের ৭ই জুন সংখ্যাতে ভুই সাহেব বলেছিলেনঃ “যেভাবে জিয়ন সিটি তৈরী করেছি তদনুরূপ একাদিক্রমে আরও ৭টি জিয়ন সিটি তৈরী করতে আমরা সক্ষম এবং এরূপে জিয়ন সিটির সংখ্যা বৃদ্ধি করলে আমাদের আয়ও বৃদ্ধি হয়ে ১০ লক্ষ ডলারে উন্নীত হবে। সে অবস্থাতে আমরা মুসলিম তুরস্ককে কিনতে পারব এবং জেরুজালেমকে তথা বায়তুল মুকাদ্দাসকেও আমরা পুনর্দখল করতে পারব। *(টিকা: তখনকার দিনেও বিশ্ব মোসলেমের খেলাফত বিরাজিত ছিল তুরস্কে তুরস্ক ছিল দারুল খেলাফত’। জেরুজালেম নগরে অবস্থিত কেবলায়ে আওয়াল বায়তুল মোকাদ্দাস তখনও মুসলমানদের অধিকারে ছিল।) তদনুরূপ সমগ্র ইহুদীগোষ্ঠি এবং মূর্তিপূজক মোশরেক জাতিগুলোকেও খরিদ করা যাবে।”

পাদ্রী ডুই সাহেব একজন কট্টর ইসলাম বিরোধী ছিলেন। ইসলামের সঙ্গে সর্বদাই তিনি বৈরী মনোভাব পোষণ করতেন এবং ইসলাম ও ইসলামের নবী করীম (সাঃ) সম্পর্কে কুবাক্য ও কঠোর ভাষা ব্যবহার করতেন। 

১৯০২ সনে জিয়ন সিটি হতে প্রকাশিত ‘লিভস অব হিলিং-এর মাধ্যমে পাদ্রী ডুই সাহেব এক ঘোষণা প্রকাশ করেছিলঃ “যদি মুসলমানেরা খৃষ্টধর্ম গ্রহণ না করে তবে তারা এ ধরাপৃষ্ঠ হতে নির্মূল হয়ে যাবে।” পাদ্রী ডুই যেহেতু একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ধর্মগুরু হিসেবে বিবেচিত হতেন তাই মুসলমানদের সম্পর্কে এ মারাত্মক ঘোষণাটি পত্রিকা হতে পত্রিকান্তরে প্রচারিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত কাদিয়ানে হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)-এর গোচরীভূত হয়।

১৯০২ সনের সেপ্টেম্বর মাসে হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ) ইসলাম ধর্মের গুণাবলী এবং ইসলামের সৌন্দর্য বর্ণনা করে এক ইশতেহার প্রকাশ করে আলেকজান্ডার ডুই-এর কাছে এই বলে প্রেরণ করলেনঃ “খোদাতালার তরফ থেকে আমি এ জামানার প্রতিশ্রুত মসীহ। খৃষ্টধর্ম গ্রহণ না করলে সব মুসলমান নির্মুল হয়ে যাবে বলে আপনি যে ঘোষণা করেছেন, তার উত্তরে আপনাকে অবহিত করছিঃ ধর্মের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আপনার ঘোষণা মোতাবেক কোটি কোটি মানুষের (মুসলমানদের)ঞ্চংস কামনা না করে আপনি বরং একটা সহজ পন্থা অবলম্বন করুন। সে পন্থাটি হচ্ছে যে, ইসলাম সত্য, নাকি আপনার ত্রিত্ববাদ সত্য, তা যাচাই করে দেখার জন্য আমার সঙ্গে *মোবাহালায়” অগ্রসর হউন। এ ধরনের মোবাহালার ফলশ্রুতিতে যদি আমি একব্যক্তি হালাক হয়ে যাই তবে খৃষ্টধর্ম সত্য বলে প্রমাণিত হবে এবং কেবলমাত্র এক ব্যক্তিকে ধ্বংস করেই অতি সহজে আপনার উদ্দেশ্য হাসেল হয়ে যাবে । আর মোবাহালার ফলে যদি আপনি হালাক হয়ে যান, তবে ইসলামের সত্যতা প্রমাণিত হয়ে যাবে। 

একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ)-এর উপরোক্ত চ্যালেঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন প্রখ্যাত পত্রিকাসমূহে ব্যাপকভাবে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। যে সকল পত্রিকাতে এ ঐতিহাসিক চাঞ্চল্যকর চ্যালঞ্জটি প্রচারিত হল তার সংখ্যা এক শতের কম হবে না । এসব পত্রিকার মধ্যে হযরত মির্যা সাহেবের নিকট প্রায় ৪০টি পত্রিকার কপি পৌঁছেছিল। তন্মধ্যে নিম্নে কয়েকটি প্রখ্যাত পত্রিকার নাম উল্লেখ করা হলঃ 

১ | চিকাগো ইন্টারভিশন- ২৮শে জুন, ১৯০৩

২। ওয়ালিংটন প্রেস- ২৭শে জুন, ১৯০৩ 

৩ । নিউ ইয়র্ক মেইল- ২৫শে জুন, ১৯০৩ 

৪ | বালটিমোর আমেরিকান- ২৫শে জুন, ১৯০৩ 

৫ । বোষ্টন রেকর্ড- ২৭শে জুন, ১৯০৩ 

৬ | রিচম্যান নিউজ- ১লা জুলাই, ১৯০৩ 

৭ | গ্লাসগো হ্যারলড্- ২৭শে জুন, ১৯০৩ 

৮ | হিউষ্টন ক্রনিক্যাল- ৩রা জুলাই, ১৯০৩ 

৯। নিউ ইয়র্ক কমর্শিয়াল এডভার্টাইজার- ২৬শে অক্টোবর, ১৯০৩ 

১০ | দি মর্নিং টেলিগ্রাফ, নিউ ইয়র্ক- ২৮শে অক্টোবর, ১৯০৩ 

১১ । পাথ-ফাইন্ডার, ওয়াশিংটন- ২৭শে জুন, ১৯০৩

অতঃপর ১৯০৩ সনের ডিসেম্বর নাগাদ আমেরিকার বিভিন্ন পত্রিকায় হযরত মির্যা সাহেবের এ মোবাহালার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে এবং রিভিউ ও সম্পাদকীয় মন্তব্যসমূহ পত্রিকা হতে পত্রিকান্তরে প্রকাশ হতে থাকে। অত্র পুস্তকের কলেবর সীমাবদ্ধ রাখার মানসে যাবতীয় পত্রিকার বিবৃতি উদ্ধৃত করা হতে বিরত রইলাম । তবে একটিমাত্র পত্রিকার রিপোর্ট প্রকাশ করছি। 

উওয়াশিংটন হতে প্রকাশিত “পাথ-ফাইন্ডার’ নামক পত্রিকার ১৯০৩ সনের ২৭শে জুন সংখ্যার নিম্নরূপ মন্তব্য করা হয়েছিলঃ

“মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ভারতের একজন মুসলমান, যিনি প্রতিশ্রুত মসীহ হওয়ার দাবী করেছেন। তার অনুসরণকারী দ্রুতগতিতে প্রসার লাভ করছে। কিন্তু চিকাগো এলাকায় অবস্থিত জিয়ন সিটির ডক্টর ডুই সাহেবের সঙ্গে তার বৈরিতা চলছে। কেননা, তিনি (ডুই সাহেব) একই প্রকারের এলিয় নবী হওয়ার দাবীকারক। মির্যা সাহেব তাকে এরূপ মোবাহালা অর্থাৎ প্রার্থনা প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন যেন স্পষ্টতঃ ইহা প্রমাণিত হয়ে যায় যে,তাদের উভয়ের মধ্যে আপন আপন দাবীতে কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যাবাদী, এতদুভয়ের মধ্যে প্রকৃতই কে আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট সত্য পয়গম্বর।”

এতদসত্ত্বেও পাদ্রী ডুই সাহেব হযরত আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)-এর এ ঐতিহাসিক । চ্যালেঞ্জের সরাসরি কোন উত্তর দেননি। তবে ‘লিভস্ অব হিলিং’ পত্রিকার ১৯০৩ সনের ১৪ই ফেব্রুয়ারী সংখ্যাতে পাদ্রী ডুই সাহেব ইসলামের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত ‘বদদোয়াটি’ প্রকাশ করেছিলেনঃ

“আমি (পাত্রী আলেকজান্ডার ডুই) খোদার নিকট দোয়া করছি যেন সেদিন সন্নিকট হয়, যখন ইসলাম ধরাপৃষ্ঠ হতে নাবুদ হয়ে যায়। হে খোদা! তুমি আমার এ দোয়া কবুল কর, হে খোদা! তুমি ইসলামকে ধ্বংস কর।” 

অতঃপর উপরোক্ত পত্রিকার ৫ই আগষ্ট সংখ্যায় ইসলামের বিরুদ্ধে তিনি পুনঃ ঘোষণা করলেনঃ

“মানবতার উপর এ কলঙ্কময় চিহ্নকে অর্থাৎ ইসলামকে জিয়ন শহর ধ্বংস করে ছাড়বে।”

হযরত আহমদ কাদিয়ানী (আঃ) যখন বিশেষভাবে লক্ষ্য করলেন যে,বারংবার চ্যালেঞ্জ করা সত্ত্বেও পাদ্রী ডুই সাহেব কোন পরওয়াই করছেন না, অথচ ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হতেও বিরত হচ্ছেন না, তখন ১৯০৩ সনের ২৩শে আগষ্ট তারিখে তিনিও একটি ইশতেহার প্রকাশ করলেন যার শিরোনামা দেওয়া হলঃ

“এ জামানাতে আল্লাহ্ আমাকে এ জন্যই পাঠিয়েছেন, যেন তার ‘তৌহীদকে” আমি জগতে প্রতিষ্ঠিত করি এবং শির্‌ককে  মিটিয়ে দেই।” 

অতঃপর ২৩শে আগষ্ট তারিখের ঐ ইশতেহারটিতে একথাও তিনি ঘোষণা করলেনঃ ‘আমেরিকার জন্য খোদাতা’লা আমাকে এক নিশান প্রদান করেছেন যে, পাদ্রী ডুই সাহেব যদি আমার সঙ্গে মোবাহালাতে অগ্রসর হয়ে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে আমার মোকাবেলাতে এসে যান তাহলেঃ 

“দেখতে দেখতে এই ব্যক্তি (পাদ্রী ডুই সাহেব) অত্যধিক যন্ত্রণাদায়ক দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হয়ে ইহলীলা ত্যাগ করবে।” 

উক্ত ইশতেহারটিতে হযরত আকদস ইহাও লিখলেনঃ “পদ্র ডুই সাহেবকে প্রথম কিন্তু অদ্যাবধি তিনি আমাকে উহার কোন উত্তর প্রদান করেন নি। সুতরাং পুনরায় আমি ঘোষণা করছি যে, এখন হতে আমার চ্যালেঞ্জের জওয়াব দেওয়ার জন্য পাদ্রী ডুই সাহেবকে ৭ মাস সময়ের অবকাশ দেওয়া হল । ”

অতঃপর হযরত আকদস (আঃ) এ-ও ঘোষণা করলেনঃ “পাছ একিন রাখ্যো কে উছকে সাইহুন (জিয়ন সিটি) পার জল্দ আওর এক আফত্ আনে ওয়ালী হ্যা।” অর্থাৎ 

‘তোমরা দৃঢ় বিশ্বাস রাখ যে, শীঘ্রই তার (পাদ্রী ডুই সাহেবের) জিয়ন সিটিতে আরেকটি বিপদ অবর্তীর্ণ হবে।” 

ডুই সাহেব হতে কোন প্রকারের উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই হযরত আকদস (আঃ) আরও ঘোষণা করলেনঃ

“আয় খোদা ইয়ে ফয়সলা জলদ কার কে পিগট আওর ভুই কা ঝুট লোগো পর যাহের কার দে।” 

অর্থাৎ “হে খোদা! অতি শীঘ্রই তুমি পিগট সাহেব এবং পাদ্রী ডুই সাহেবের মিথ্যাকে জনসমক্ষে প্রকাশিত করে দাও ।”

হযরত আকদসের ইশতেহার মারফত এসব ঘোষণাসমূহ সারা পশ্চিম গোলার্ধে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে লাগল । এমন কি এশিয়া এবং ইউরোপের প্রখ্যাত পত্রিকাসময়ূহেও মির্যা সাহেব (আঃ)-এর এসব চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যদ্বাণী সম্বলিত খবরসমূহ পরিবেশিত হতে লাগল । এসব পত্রিকার মধ্যেঃ (১) গ্লাসগো হ্যারল্ড, ইংল্যান্ড, (২) নিউ ইয়র্ক কমার্শিয়াল এডভার্টাইজার, আমেরিকা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে হযরত আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)-এর এ ধরনের উপর্যুপরি চ্যালেঞ্জসমূহ এবং ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ সমগ্র আমেরিকায় এবং ইউরোপের আন্তর্জাতিক পত্রিকাসমূহের মারফত বহুল প্রচারের ফলে সারা বিশ্বের বিশেষ করে আমেরিকান খৃষ্টান জনসাধারণের মধ্যে এরূপ একটা সন্দেহের সৃষ্টি হল যে, পাদ্রী ডুই সাহেবের অলৌকিকতা তথা দাবীটা হয়ত বা ভন্ডামি বা ভাওতাবাজীরই নামান্তর। এমনকি ডুই সাহেবের নিজস্ব জিয়ন চার্চের ভক্তবৃন্দও বলতে লাগলেন যে, তাদের মহান গুরু যিনি খোদার ওয়াদা অনুযায়ী একজন পয়গম্বর, তিনি হিন্দস্থানের অধিবাসী একজন মুসলমানের (যিনি প্রতিশ্রুত মসীহ হওয়ার দাবীকারক) ঘোষণাগুলোর প্রেক্ষিতে কোন জওয়াব দিচ্ছেন না কেন, তা তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। এর জওয়াব দেওয়ার জন্য অনেকেই ডুই সাহেবের উপর চাপ সৃষ্টি করতে লাগলেন। 

যা হোক,এসব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ভক্তবৃন্দের সন্দেহ নিরসনের জন্য পাত্রী আলেকজান্ডার ভুই সাহেব তার লিভস্ অব হিলিং’ পত্রিকার মাধ্যমে সর্বপ্রথম হযরত আকদসের ১৯০২ সনের এবং ১৯০৩ সনের চ্যালেঞ্জসমূহের কথা উল্লেখ করলেন এবং খুবই ঘৃণা ও অহঙ্কারের সঙ্গে হযরত আহমদ কাদিয়ানীকে ‘হিন্দুস্থানের এক বেকুফ মুহাম্মদী মসীহ’ নামে আখ্যায়িত করলেন এবং ভক্তদের সান্ত্বনার জন্য লিখলেনঃ “তোমরা কি এরূপ ধারণা কর যে, এ ধরনের মশা-মাছির আস্ফালনের কোন প্রকার জবাব দেব আমি? তাদের উপর যদি আমার পা রাখি তবে পদদলিত ও নিষ্পেষিত করে দিতে পারি। কিন্তু এখন আমি তাকে সময় দিতেছি যেন আমার দৃষ্টির বহির্ভূত অবস্থায় অন্ততঃ আরও কিছুদিন সে বেঁচে থাকতে পারে।”

হযরত আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)-এর চ্যালেঞ্জকে অগ্রাহ্য করা বা পরওয়া না করা’ প্রদর্শন করতে যেয়ে পাদ্রী ডুই সাহেব উপরোক্ত মন্তব্যের মাধ্যমে প্রকারান্তরে হযরত আকদসের সঙ্গে মোবাহালাতে দন্ডায়মানই হয়ে গেলেন । এখানে ইহাও প্রণিধানযোগ্য যে, হযরত আকদস তার ইশতেহারে স্পষ্টরূপেই এ কথাটি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে, “যদি এ ব্যক্তি ইশারাতান অন্ততঃ ইশারা বা আকার-ইঙ্গিতেও আমার মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে যায়, তবে আমার জীবদ্দশায়ই সে অত্যধিক দুঃখ-যাতনার ভিতর দিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে।”

তথাকথিত পয়গম্বর ডুই সাহেবের অহঙ্কার ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলল। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি এ কথাও প্রচার করলেনঃ “খোদার ভূপৃষ্ঠে যদি আমি পয়গম্বর না হয়ে থাকি, তবে আর কেউই পয়গম্বর নহে।” এতদসঙ্গে তিনি ইহাও বললেনঃ “ এক ফেরেশতা এ খবরও আমাকে দিয়েছেন যে, আমি আমার দুষমনদের উপর জয়যুক্ত হব “উপরন্ত স্বীয় অহঙ্কারে স্ফীত হয়ে ডুই সাহেব হযরত আহমদ (আঃ)-কে কীট বা মশা-মাছির সঙ্গে তুলনা দিয়ে এবং পদদলিত করে নিষ্পেষিত করার মত তা প্রদর্শন করে পরোক্ষভাবে হযরত আকদসের সঙ্গে মোবাহালাতে’ জড়িত হয়ে গিয়েছিলেন। পাদ্রী ডুইয়ের এসব হঠকারিতার পর হযরত আহমদ কাদিয়ানী (আঃ) ডুই সম্বন্ধে লেখালেখি কিছুকালের জন্য স্থগিত রাখলেন।

আল্লাহতা’লা শাস্তি প্রদানে মন্থর কিন্তু যখন কাউকেও পাকড়াও করেন তখন সে গযব হতে কেউই রক্ষা পেতে পারে না। সুতরাং, আল্লাহ্তা’লার এরশাদ “ফানতাযিরু ইন্নি মায়াকুম মিনাল মুনতাযেরীন” আয়াতে করীমার মর্ম মোতাবেক হযরত আকদস খোদায়ী ফয়সালার অপেক্ষায় থাকলেন।

অতঃপর আল্লাহ্তা’লার নিদর্শন লক্ষ্য করুন। যে হস্ত দ্বারা ডুই সাহেব খোদা প্রেরিত প্রতিশ্রুতি মসীহের বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষায় লিখেছিলেন, যে পদযুগল দ্বারা দলিত করে মুহাম্মদী মসীহকে নিষ্পেষিত করার ঘোষণা করেছিলেন, কিছুকাল অতিবাহিত হতে না হতেই ১৯০৫ সনের সেপ্টেম্বর মাস শেলেটবার নিকেল গীর্জার হলে মহাসমারোহের সাথে যীশুর মৃত্যু উপলক্ষে এক জনাকীর্ণ অধিবেশনের সমাপ্তি ভাষণ দানের সময় সেই হস্তদ্বয় এবং পদদ্বয় সহসা বাত ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে প্যারালাইজড় (পক্ষাঘাতগ্রস্ত) হয়ে গেল। ক্রমান্বয়ে তার হাত-পা একেবারে অকেজো হয়ে গেল। তাকে কাঁধে বহন করে এখানে-সেখানে আনা-নেওয়ার জন্য দু’জন নিগ্রো ভূত্যু নিয়োজিত হল। এমতাবস্থায় সমুদয় কাজকর্মের পরিচালনার ভার অন্যান্য কর্মকর্তাদের হাতে ন্যস্ত করে তিনি দ্বীপাঞ্চলে বসবাস করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু দ্বীপ-দ্বীপান্তরে বসবাস করার পরেও তার রোগ অবনতির দিকে ধাবিত হল এবং ক্রমান্বেয়ে সমস্ত শরীর আক্রান্ত হয়ে গেল। পূর্ণাঙ্গ পক্ষাঘাতের ফলে তার শরীরের স্বাভাবিক গঠন বিকৃত হয়ে বাকা গঠনের একটি কীটের আকার ধারণ করল। আল্লাহর প্রেরিত প্রতিশ্রুতি মসীহকে যিনি মশা-মাছিরূপ কীটসদৃশ বলে বিদ্রুপ করেছিলেন আজ তিনি স্বয়ং কীটই হয়ে গেলেন যেন।

এতেই ইতি নয়, শিষ্যদেরকে ডুই সাহেব সর্বদাই মাদকদ্রব্য সেবন হারাম বলে উপদেশ দিতেন, অথচ তদন্ত করে তারই খাস কামরাতে ও প্রাইভেট ষ্টোর রুমে বহু মদের বোতল ও মদ্যভান্ডার আবিস্কৃত হল। তার প্রথমা স্ত্রী ও ছেলে সাক্ষ্য প্রদান করলেন যে, পাদ্রী ডুই সাহেব চুপিসারে মদ্যপান করতেন। শিষ্যদের কাছে তিনি এরূপ প্রচারমুখরও ছিলেন যে, মুসলমানের মত একাধিক বিবাহ হারাম অথচ শেষ বয়সে প্রেমাসক্ত হয়ে এক যুবতীর সঙ্গে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়ে একজন প্রিয় শিষ্য দ্বারা উল্টো প্রচারণা আরম্ভ করিয়ে দিলেন যে, বিশেষ প্রয়োজনে একাধিক বিবাহ শুধু বৈধই নয় বরং পুণ্যকর্ম। এসব প্রবঞ্চনা ও হঠকারিতা সর্বত্র প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ শিষ্যই প্রকাশ্যে তাকে বর্জন করলেন এবং জিয়ন সিটি গীর্জাতে ভক্তদের উপস্থিতি শোচনীয়ভাবে ভাটা পড়ে গেল। গীর্জার সে বিশালকায় ঘন্টাটির বিকট ধ্বনি যথাসময়েই বেজে উঠত বটে, কিন্তু এদিকে কেহ আর তেমন কর্ণপাত করতেন না। তার স্ত্রী-পুত্র এমনকি তার পিতাও তাকে ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করতে লাগলেন।

এখানেও তার দুঃখের শেষ হল না। এদিকে পক্ষাঘাত রোগাক্রান্ত অবস্থায় দ্বীপ দ্বীপান্তরের সেনাটারিয়মে থাকাকালীন জিয়ন সিটিতে গড়ে উঠা যাবতীয় শিল্প, বাণিজ্য, ব্যবসা ও কল-কারখানাসমূহের কেন্দ্রীয় গভর্নিং বডির সদস্যবৃন্দের ৬ই এপ্রিল, ১৯০৬ সনের সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট রেকর্ড স্কুটনী তথা খতিয়ে লক্ষ্য করা গেল যে, পাদ্রী ডুই সাহেবের কর্মতৎপরতা দুর্নীতিতে ভরপুর । জিয়ন ইন্ডাষ্ট্রির শেযার বিক্রীর তহবিল হতে বিশ লক্ষ ডলার আত্মসাৎ করা হয়েছে এবং মিষ্টি তৈরীর কারখানার শেয়ার বিক্রী বাবদ আমদানীকৃত দেড় লক্ষ ডলারের মধ্যে ১৭,০০০, (সত্তর হাজার) ডলার ব্যতীত অবশিষ্ট সমুদয় অর্থ লাপাত্তা হয়ে গেছে। সুতরাং, এরূপ মারাত্মক দুর্নীতি ও ধাপ্পাবাজীর দায়ে অভিযুক্ত করে গভর্নিং বডি সর্বসম্মতিক্রমে পাদ্রী ডুই সাহেবকে সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব হতে অপসারণ করেন। ডুই সাহেব কর্তৃক বরখাস্তকৃত প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার মিষ্টার ওয়ালিওকে যাবতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য সর্বেসর্বা পরিচালক নিযুক্ত করা হল। এতেও ডুই সাহেবের অপমান ও যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি হল না । টেলিগ্রামে খবর পেয়ে পাদ্রী ডুই সাহেব পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায়ই চিকাগো কোর্টের জজ মিষ্টার লেনসিস সাহেবের আদালতে ওয়ালিও সাহেবের বিরুদ্ধে এক মামলা দায়ের করলেন। ১৯০৬ সনের ২৭শে জুন তারিখে মহামান্য জজ লেনসিস সাহেব পাদ্রী ডুইয়ের বিরুদ্ধে এবং ওয়ালিও সাহেবের পক্ষে রায় ঘোষণা করলেন। রায়ে ইহাও ঘোষিত হল যে, জিয়ন সিটির জিয়ন ফান্ড, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবহৃত স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পদে পাদ্রী ভুই সাহেবের ব্যক্তিগত মালিকানা বাতিল বলে গণ্য হল এবং জাতীয় সম্পত্তি হিসেবে গভর্নমেন্ট রিসিভারের নিকট হস্তান্তর করা হল। (*টীকাঃ এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণের জন্য এনসাইক্লোপেডিয়া বৃটানিকা ১৯৫১ এডিশন দ্রষ্টব্য।)

হযরত আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে খোদার গযবে নিপতিত হযে আজ তিনি সর্বহারা। তার এ শোচনীয় পরিণতি মৃত্যুর চেয়েও অধিকতর লাঞ্ছনাকর। 

ইসলাম সত্য না খৃষ্টধর্ম সত্য খোদার নিকট সে ব্যাপারে প্রতিযোগিতামূলক প্রার্থনা দ্বারা যাচাই করে নির্ণয় করার জন্য পাদ্রী ডুই সাহেবের প্রতি হযরত আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)- এর চ্যালেঞ্জ ঘোষণার কিছুকাল পরেই পাদ্রী ডুই সাহেবের কিছুটা বুদ্ধি বিপর্যয় ও অপ্রকৃতস্থ হওয়ার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, নিউ ইয়র্কের মহান গীর্জার ভক্তগণকে জিয়ন সিটির গীর্জার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এক মহাসম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় এরূপ ঘটল যে, ভুই সাহেবের কথাবার্তা আগে-পাছে গরমিল ও এলোপাতাড়ি হতে লাগল। আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন, অস্পষ্ট ও শ্রুতিকটু ভাষায় কিছু বলছিলেন এবং এক পর্যায়ে তদানীন্তন ইংল্যান্ডের রাজা তথা ভারতসম্রাটের বিরুদ্ধে অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্যও করে বসলেন। শ্রোতৃবৃন্দের কাছে এসব অসহনীয় এবং অপ্রিয় হওয়াতে ক্রমান্বয়ে সম্মেলনের হল ছেড়ে তারা চলে যেতে লাগলেন।

বিবিধ পত্রিকার ভাষ্যকারগণ বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন যে, এক সময়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখ্যাত বক্তা ডুই সাহেবের মুখনিঃসৃত অদ্যকার কর্কশ কথাবার্তা ও অপ্রাসঙ্গিক আস্ফালনগুলো এতই শ্রুতিকটু ছিল যে,তা যেন একটি গো বৎসের ‘হাম্বা’ শব্দসদৃশই শুনাচ্ছিল। 

(১) পাদ্রী ডুই সাহেবের নিজস্ব ঐতিহাসিক মিষ্টার আর্থার নিউকম সাহেবের লিখিত পুস্তকের ২৫৪ পৃঃ।

(২) নিউ ইয়র্ক আমেরিকান মেগাজিনের ১৯০৩ সনের ১৯শে অক্টোবর সংখ্যা। অতঃপর তথাকথিত এলিয় পয়গম্বর’ পাদ্রী আলেকজান্ডার ভুই সাহেব পক্ষাঘাত রোগাক্রান্ত অবস্থায় একটি নগণ্য কীটসদৃশ শরীরটা নিয়েই তার পয়গম্বর হওয়া, খৃষ্টধর্ম গ্রহন না করলে বিশ্বের সারা মুসলমানই হালাক হয়ে যাওয়ার ঘোষণা প্রকাশ, আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত প্রতিশ্রুত মসীহ আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)-এর সম্পর্কে তার অবজ্ঞা ও অহঙ্কারসূচক আস্ফালনের ফলাফল কি দাঁড়ায় তা স্বচক্ষে অবলোকন করতে করতে ১৯০৭ সনের ৯ই মার্চ ইহলীলা ত্যাগ করেন। 

অপরদিকে ঐ তারিখেই হযরত আহমদ কাদিয়ানী মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর নিকট ইলহাম হলঃ 

অর্থাৎ “হাজার হাজার লোক তোমার পাখার নীচে আশ্রয় নিতেছে।” 

(১) আমেরিকার চিকাগো ট্রিবিউন’ ১৯০৭ সনের ১০ই মার্চ সংখ্যায় লিখেছিলঃ 

“পাদ্রী আলেকজান্ডার ডুই সাহেব গতকল্য সকাল সাতটা চল্লিশ মিনিটের সময় জিয়ন সিটিস্থ ‘শেল হাউজে মৃত্যুবরণ করেছেন। ঐ সময়ে তার পরিবারের কোন সদস্যই কাছে ছিল না। তার মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সরকারী রিসিভার মিষ্টার জন হার্টলের উপস্থিতিতে মৃত ডুই সাহেবের সুপ্রতিষ্ঠিত বাসগৃহটি, তার মূল্যবান তৈজসপত্র এবং সমুদয় গৃহস্থালী দ্রব্য সরকার কর্তৃক ‘সিজ’ হয়ে জিয়ন সিটির পাওনাদারদের নামে বরাদ্দ হয়ে যায়।  

অতঃপর এ পত্রিকাটির ১২ই মার্চ সংখ্যার সম্পাদকীয় মন্তব্যে ইহাও উল্লেখ করা হয়েছিলঃ

“পাদ্রী ডুই সাহেবের মৃত্যুর পর আমেরিকার সাধারণ রেওয়াজ মোতাবেক তদীয় পিতা, স্ত্রী বা ছেলের নিকট হতে এমন কি অন্য কারও নিকট থেকে কোন একটি শোকবাণীও আসেনি।”

(২) ইনডিপেনডেন্ট’ ম্যাগাজিনের ১৯০৭ সনের ১৪ই মার্চ সংখ্যার সম্পাদকীয় কলামে ডুইয়ের মৃত্যুর পরে খবর পরিবেশিত হয়েছিলঃ 

“তিনি (পাদ্রী ডুই সাহেব) তার ব্যক্তিগত মতবাদ এবং ধনসম্পদের প্রাচুর্যের প্রভাব মানুষের চক্ষুকে ঝলসিয়ে দিতেন। তিনি ঐশ্বর্যের চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু সহসা তিনি অধঃপতিত হয়ে গেলেন। এমতাবস্থায় তার স্ত্রী-পুত্র এবং তার স্বপ্রতিষ্ঠিত চার্চ ইত্যাদি সকলেই তাকে বর্জন করলেন। তার তথাকথিত পয়গম্বরী মর্যাদা জনসমক্ষে প্রদর্শনের জন্য এমনই রং-বেরঙ্গের বিচিত্র লেবাস তৈরী করে রেখেছিলেন, যা এমন কি পয়গম্বর ইউসুফ বা পয়গম্বর হারূন কখনও পরিধান করেননি।

(৩) নিউ ইয়র্ক হতে প্রকাশিত পত্রিকা Truth Seeker-এর ১৯০৭ সনের ১৫ই জুন সংখ্যার অভিমতঃ

“প্রতিশ্রুত মসীহ হওয়ার দাবীকারক ভারতের মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বয়সের দিক থেকে পাদ্রী আলেকজান্ডার ডুই সাহেব হতে ১৫ বৎসরের বয়োজ্যেষ্ঠ, বৃদ্ধ এবং রোগগ্রস্থ ব্যক্তি। দ্বিতীয়তঃ তিনি হলেন প্লেগ-মহামারীপূর্ণ একটা ধর্মান্ধ দেশের অধিবাসী। এক কথায় তিনি হলেন বিপন্ন জীবন যাপনকারী ] অপর দিকে পাদ্রী আলেকজান্ডার ডুই ছিলেন একজন স্বল্পবয়সী, স্বাস্থ্যবান, সবল এবং সুঠাম দেহের অধিকারী। সুতরাং, সঙ্গতভাবে তিনি একজন দীর্ঘায়ু প্রত্যাশী ব্যক্তি ছিলেন। 

এমতাবস্থায় পাদ্রী ডুইকে সম্বোধন করে এ ধরনের জীবনমরণ প্রশ্ন উঠার মত একটা মারাত্মক চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে দেওয়া মির্যা সাহেবের মত লোকের জন্য ছিল অত্যধিক ভীতিপ্রদ ব্যাপার। তথাপি শেষ পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক ডুইয়ের মৃত্যুতে তিনিই জয়ী হলেন।”

(৪) আমেরিকার বোষ্টনে হ্যারল্ড পত্রিকার Sunday Edition ১৯০৭ সনের ২৩শে জুন সংখ্যায় পাদ্রী ডুই সাহেবের মৃত্যুর পর এক গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিলঃ

‘Great is Mirza Gularn Ahmad,The Messiah’. He foretold pathetic end of Dowie and now he predicts Plague, Flood and Earth quake.

হযরত ইমাম মাহদী (আঃ)-এর সাথে মোবাহালার সময়ের এবং তারপর ঐশী শাস্তি পাওয়ার পরে ডঃ জন আলেকজাণ্ডার ডুই (আহ্‌মদীয়াত, পৃ:১৪৭)

 

উক্ত পত্রিকাটির ১৯০৭ সনের ২৩শে জুন সংখ্যাতে হযরত মির্যা সাহেবের ১৯০৩ সনের ২৩শে আগষ্ট তারিখের মোবাহালা’ চ্যালেঞ্জের পূর্ণ বিবরণটিও ছাপা হয়েছিল।* (টীকাঃ পত্রিকাটির সম্পাদীয় নিবন্ধ লেখক উৎসাহের সাথে পাদ্রী ভুইয়ের পরিণতি সম্পর্কে হযরত আকদস (আঃ) প্রণীত কেতাব হাকীকাতুল ওহী -এর ২৫৬-৫৭ পৃষ্ঠাতে লিখিত ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণ বিবরণটিও ইংরেজী ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন।)

অবশেষে নবী হওয়ার মিথ্যা দাবীকারক আলেকজান্ডার ভুইয়ের পতন সম্পর্কে হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)-এর প্রখ্যাত কেতাব “হাকীকাতুল ওহী’ হতে একটি মূল্যবান উদ্ধৃতির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। উক্ত কেতাবের তাতিম্মা ৭৭ পৃষ্ঠায় তিমি বলেছেনঃ “আমার অভূদয়ের মুখ্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে সলীবকে তথা ক্রুশীয় মতবাদকে ধ্বংস করা। সুতরাং, পাদ্রী আলেকজান্ডার ডুইয়ের (আমার ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক) মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সলীবের একটি বিরাট অংশ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল।”

হযরত ইমাম মাহদী (আঃ)-এর সাথে মোবাহালার সময়ের এবং তারপর ঐশী শাস্তি পাওয়ার পরে ডঃ জন আলেকজান্ডার ডুই 

“সুতরাং আমি আল্লাহর শপথ করে ঘোষণা করছি যে, আগমনকারী প্রতিশ্রুত মসীহ (আঃ)-এর হাতে খিনজির কতল হওয়ার ব্যাপারে আঁ হযরত (সাঃ) যে ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন পাদ্রী আলেকজান্ডার ডুই সাহেবই সে খিনজির তথা নিকৃষ্ট শূকরস্বভাববিশিষ্ট লোক।” 

অবশেষে তৌহীদেরই বিজয় হবে এবং মিথ্যা উপাস্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হবেঃ

“আমার সর্বশক্তিমান খোদা ও মৌলা যদি বার বার আমাকে এরূপ সান্ত্বনা না দিতেন যে,অবশেষে তৌহীদেরই বিজয় হবে এবং মিথ্যা উপাস্য ধ্বংস হবে, তাহলে কোন সময় হয়ত এমনও ঘটে যেত যে, এ চিন্তায় অধীর হয়ে আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম । আল্লাহ আমাকে জ্ঞাত করেছেন, অবশেষে নতুন জমীন ও নতুন আকাশ সৃষ্টি হবে। পাশ্চাত্য হতে সত্যের সূর্য উদীয়মান হওয়ার দিন অত্যাসন্ন এবং ইউরোপবাসী সেদিন প্রকৃত খোদার সন্ধান পাবে। অতঃপর তওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ” – (তাযকেরাঃ ২৮৫পৃঃ)

জিয়ন সিটিতে আহমদীয়া মসজিদ ও মিশন হাউজ

পাদ্রী ডুই প্রতিষ্ঠিত জিয়ন সিটি সম্পর্কে বদর পত্রিকায় ১৯৪৮ সনের ১৩ই ডিসেম্বর সংখ্যায় নিম্নলিখিত খবর পরিবেশিত হয়ঃ
কাদিয়ান শহরে আবির্ভূত হযরত মির্যা গোলাম (আঃ)-এর সঙ্গে পরস্পরের ধর্মীয় মতবাদে কে সত্য কে মিথ্যা তা যাচাই করার নিমিত্ত প্রার্থনা প্রতিযোগিতা সংগ্রামে তথা মোবাহালাতে নেমে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জিয়ন সিটির প্রতিষ্ঠাতা পাদ্রী আলেকজান্ডার ডুই আল্লাহ্‌র গযবে নিপতিত হয়ে ১৯০৭ সলে পরলোক গমন করেন। উক্ত জিয়ন সিটি শহরটির অস্তিত্ব থাকলেও জেনারেল ওভারসিয়ারের’ মতবাদের জন্য বিশেষ গীর্জা হিসেবে তথা চার্চ অব জিয়ন সিটির ‘ লেশমাত্রও বৈশিষ্ট্য নেই। স্বপ্রতিষ্ঠিত এ শহরেই পাদ্রী ডুই সাহেবের কবর বিদ্যমান। শহরের বর্তমান অধিবাসীদের কেউই এখন হয়ত আর জুই সাহেবের নামও জানে না। তবে আহমদীয়া জামাতের ইতিহাসে এ শহরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইদানিং ঐ শহরটিরই কেন্দ্রস্থলে আহমদীয়া জামাতের মাধ্যমে ত্রিশ হাজার ডলার ব্যয় করে একটি আহমদীয়া মসজিদ ও একটি মিশন হাউজ স্থাপিত হয়েছে। জিব্রাইল রোডের এক সমৃদ্ধশালী মমোরম স্থানে অবস্থিত জিয়ন সিটির এ সর্বপ্রথম মসজিদ হতে দৈনিক পাঁচবার আযান দেওয়া হচ্ছে। এক আল্লাহর ইবাদত হচ্ছে।

(সূত্র: আহ্‌মদীয়াত পৃষ্ঠা ১৩৫ – ১৪৯)