ইব্রাহিম (আ.)-এর অসাধারণ ত্যাগ: ঈদুল আযহিয়ার তাৎপর্য

১৯৩৭ সনের ২২শে ফেব্রুয়ারিতে হযরত খলিফাতুল মসীহ্‌ সানী (রাঃ) প্রদত্ত ঈদুল আযহিয়া খুতবার সারাংশের অনুবাদ

ঈদুল আযহিয়া মানুষের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ত্যাগের অনুভূতির সাথে জড়িত। কুরবানীর বিষয়টি সার্বজনীন, কিন্তু নিজের সন্তানকে কুরবানী করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। কোন কোন মানুষের জন্য হয়তো সুখ স্বাচ্ছন্দ ত্যাগ করার চেয়ে সন্তান কুরবানী করা সহজ। কিন্তু এ ধরনের মানুষ ব্যতিক্রম, এবং এ ধরনের মানসিক অবস্থার জন্য তাদের সাধারণ মানুষ হিসেবে গণ্য করা যায় না। মানুষের চারিত্রিক গুণাবলী সাধারণত সর্বসাধারণের মাধ্যমে নিরুপন করা হয়। শতকরা ৯৯ ভাগ, বস্তুত এরও বেশী সংখ্যক মানুষ সন্তান সন্ততির জন্য নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ ত্যাগ করে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মনোভাব এভাবেই গড়ে উঠেছে, কারও জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে। এটি মানুষের জীবনের এক বিস্ময়কর ব্যাপার এবং এর সমতুল্য কিছুই নেই। কেবলমাত্র একজন উন্মাদ ব্যক্তির পক্ষেই এটা করা সম্ভব নচেৎ সাধারণ মানুষ এর ব্যতিক্রম করে না।

ঈদুল আযহিয়া মানুষের এই সার্বজনীন ও সবচেয়ে স্পর্শকাতর অনুভূতির সাথেই সংশ্লিষ্ট। কয়েক হাজার বছর পূর্বে, ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহ্ কর্তৃক নির্দেশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কুরবানী করার জন্য, যার জন্য মা-বাবা তাদের সমস্ত জীবন যাপন করে। এ ধরনের অস্বাভাবিক নির্দেশ পেয়েও ইব্রাহিম (আ.) তৎক্ষণাৎ তৈরি হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এই চিন্তা করেন নি যে আল্লাহ্ মানব অনুভূতি বিরুদ্ধ এক নির্দেশ দিয়েছেন। ইব্রাহিম (আ.) তাঁর সিদ্ধান্তে নিঃসংকোচ ছিলেন। তাঁর বংশ রক্ষার কথা তিনি চিন্তা করেননি। তিনি বৃদ্ধ বয়সে তাঁর একমাত্র পুত্রকে কুরবানী দিতে প্রস্তুত হলেন। কোন প্রশ্ন, কোন ব্যাখ্যা, ইতস্তত বোধ, উদ্বিগ্নতা কোন কিছুরই অবতারণা হলো না, যেন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তিনি তাঁর ছেলেকে শুতে বললেন এবং ছুরি হাতে নিয়ে প্রবল উৎসাহে মানব স্বভাব বিরুদ্ধ কাজটি সম্পাদন করতে মনোযোগী হলেন। ইব্রাহীম (আ.)-এর এই সিদ্ধান্তে যে কেউই বিস্মিত হবে। সেই সময় লোকজনের এই ধারণা করাই স্বাভাবিক যে ইব্রাহিম (আ.) একজন পাগল, অনুভূতিহীন ও হৃদয়হীন। কেননা তিনি যে কাজটি করতে যাচ্ছেন তা কোন অশিক্ষিত বর্বর জাতিও করতে অনুমতি দেয় না। কিন্তু কুরআনে বর্ণিত আছে, ইব্রাহিম (আ.) একজন কোমল হৃদয়ের অধিকারী, জ্ঞানী, ওলী ছিলেন। সামান্য দুঃখজনক ঘটনাও তাকে পীড়া দিত, তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝরত।

ইব্রাহিম (আ.) উন্মাদও ছিলেন না বা অনুভূতিহীনও ছিলেন না। যখন তিনি তাঁর ছেলেকে ঐশী প্রস্তাব দেন তখন পিতা-মাতার সহজাত ভালবাসা তাঁর মধ্যেও বিদ্যমান ছিল। যখন তিনি জেনেছিলেন যে লুত (আ.)-এর জাতিকে শাস্তি প্রদান করা হবে, তিনি সারারাত আল্লাহ্‌র কাছে শাস্তি মওকুফের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। তিনি কোন প্রশ্ন করেননি যখন ঐশী নির্দেশ হল তাঁর ছেলেকে কুরবানী করার জন্য।

যখন হজ্জ যাত্রীরা ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বায়েক লাশারিক আলাকা লাব্বায়েক’ উচ্চারণ করতে করতে কা’বা থেকে মীনা যায়, তখন তাদের মানসপটে ইব্রাহিম (আ.)-এর এই তৎপরতা ভেসে ওঠে। এবং ঈদের নামাযে আমরা যখন ‘আল্লাহু আকবার’ উচ্চারণ করি তা ইব্রাহিম (আ.)-এর কুরবানীর মহত্ম স্মরণ করে এবং মহান আল্লাহ্ তাআলার মহিমার স্বাক্ষী হয়।

দুঃখের বিষয় আল্লাহ্ তাআলার মহিমা আমরা আমাদের জীবনে অনুভব করতে চাই না। আমরা খুবই সুন্দরভাবে ‘আল্লাহু আকবার’ উচ্চারণ করে ইব্রাহিম (আ.) এর কুরবানীর মহত্ম ঘোষণা করি। কিন্তু আমরা চিন্তা করি না যে, এই ধরণের কাজ আমাদেরও করা উচিত। এটা মোটেও অসম্ভব কিছু নয়। এতো নয় যে ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহ্‌র বান্দা আর আমরা নই। আল্লাহ্ তাআলা কখনো ব্যর্থ হন না, ব্যর্থ হই আমরা।

আমাদের এই দুনিয়ায় মানুষ তার প্রিয় কারো জন্য অত্যন্ত আকর্ষণ অনুভব করে। কিন্তু পরকাল এক আজব দুনিয়া। সেখানে প্রিয় ব্যক্তিই তার ভালবাসার মানুষের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু এতে তার অবস্থানের বিন্দুমাত্রও তারতম্য ঘটে না। তিনি মানুষের দিকে এগিয়ে আসেন কিন্তু মানুষের ঔদাসীন্য তাঁর মহত্মে কোন কমতি করে না। তাঁর সত্ত্বার তল পাওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তেমনি মানুষের পক্ষে তাঁর ভালোবাসার বর্ণনাও অসম্ভব যা কিনা পার্থিব ভালোবাসা হতে ভিন্ন। সন্তানের প্রতি পিতা মাতার ভালোবাসা, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা কোন কিছুই এর তুল্য নয়। তিনি মানুষের নিকট ভালোবাসা খোঁজেন যদিও তাঁর মর্যাদা মানুষের ওপরে। মানুষ তাঁরই সৃষ্ট ক্ষুদ্র জীব, তবুও মানুষ তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।

মানুষের প্রতি আল্লাহ্ তাআলার যে ভালোবাসা, তা কোন চাহিদা নয় বরং করুণা। তাঁর এই আকুল আকাংক্ষা কোন দুর্বল আবেগ নয় বরং দয়া। কিন্তু মানুষ মোটেও এই বিষয়ে দৃষ্টিপাত করে না। সে অন্য মানুষের অধীনস্ত হতে অভ্যস্থ, কিন্তু তার সৃষ্টিকর্তা তাকে যে মর্যাদা এবং মুকুট দান করেছে তা সম্পর্কে সে উদাসীন। এই ধরণের মানুষের জন্য দুঃখ! এই ধরনের মানুষের জন্ম যদি না হতো তাহলেই ভালো হতো। এরা পশু পাখিরও অধম কেননা সেগুলোও তাদের সৃষ্টিকর্তার গুণকীর্তন করে। কিন্তু মানুষকে চিন্তা করার শক্তি দেয়া হয়েছে, তবুও সে তার সৃষ্টিকর্তার থেকে দূরে সরে যায়। তাকে চোখ কান দেয়া হয়েছে, কিন্তু সে এগুলো যথাযথ ব্যবহার করছে না। তাকে পরকালের অমৃত স্বাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছে, কিন্তু সে দুনিয়ার বিষ গ্রহণ করছে। তবুও আল্লাহ্ তার প্রতি বিমুখ হন না। তিনি যে কত মহান তা তাঁর ঐশীবাণী থেকেই বুঝা যায়:

“মানুষ আমার নবীকে অস্বীকার করছে কিন্তু তা আমাকে নবী পাঠানো থেকে বিরত রাখতে পারবে না। আমি এখনো তাদের পাঠাচ্ছি এবং পাঠাতে থাকবো। মানুষ তাদের অগ্রাহ্য করুক, আমি তাদের আহ্বান করা বন্ধ করবো না। আমি মানুষকে এজন্যই সৃষ্টি করেছি তারা যেন আমার ইবাদত করে। তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা সেখানে প্রবেশ করবে সরাসরি অথবা কিছুদিন জাহান্নামের বাসিন্দা হয়ে। মানুষ যে পরিস্থিতিতেই আমার কাছে আসুক না কেন আমি তাকে ছেড়ে যাব না। তাকে আমার নিকটেই রাখব।”

তাই এই ঈদ থেকে আমরা যেন শিক্ষা নিতে পারি সেই প্রার্থনা করা উচিত সবার।

পাক্ষিক আহ্‌মদী - সংখ্যাঃ ৩০শে নভেম্বর, ২০০৮ইং

জামালউদ্দিন আহমদ সৌরভ, রিভিউ অফ রিলিজিয়ন্স্, সংখ্যাঃ জানুয়ারি ২০০৭