কেন্দ্রীয় সালানা জলসার ইতিকথা

আলহাজ্জ মোহাম্মাদ মুতিউর রহমান

কেন্দ্রীয় সালানা জলসার ইতিকথা বর্ণনা করতে যাওয়ার আগে সালানা জলসা কী এবং কেন সে সম্পর্কে বলা প্রয়োজন বলে মনে করছি। জলসা আরবী ‘জালাসা’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ বৈঠক সভা সম্মেলন ইত্যাদি। গান বাজনার আসরকেও জলসা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতে জলসাকে একটি পবিত্র ধর্মীয় সম্মেলন হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। স্থানীয়, এলাকাভিত্তিক, জাতীয় এবং কেন্দ্রীয় বা আন্তর্জাতিক যে কোন পর্যায়েই জলসা অনুষ্ঠিত হোক না কেন এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সংগঠনের সদস্যদের মানবিক মূল্যবোধ এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে বুৎপত্তিলাভ। বরং একথা বললে বেশি বলা হবে না-একমাত্র আল্লাহ্‌কে পাওয়ার ও অন্যকে পাইয়ে দেয়ার চেষ্টাই হলো এর মূল কেন্দ্র বিন্দু বা মুখ্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্য। যুগ ইমাম হযরত মসীহ্ মাওউদ ও ইমাম মাহ্‌দী (আঃ) জলসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেনঃ

‘প্রত্যেক নিষ্ঠাবান ব্যক্তির সরাসরি জ্ঞান লাভের সুযোগ ঘটে। যোগদানকারীদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হয়। তারা তত্ত্বজ্ঞানে সমৃদ্ধ হন। আর সাক্ষাৎ লাভে ভাইদের পরিচিতির পরিধি ব্যাপকতর হয় এবং এ জামাতে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় হয়। এর মাঝে এসব কল্যাণও নিহিত।’

জ্ঞান মূলতঃ একজন থেকে অন্য জনের মাঝে সঞ্চারিত হয়ে থাকে। তাই জলসার সময় যুগ খলীফার পবিত্র বাণী ও জামাতে জ্ঞানী গুণীজনের মূল্যবান দরস বক্তব্য প্রভৃতি শুনে তাফক্‌কাহু ফিদ্দীন অর্থাৎ ধর্মীয় জ্ঞানে বুৎপত্তি লাভ হয়। আর ধর্মীয় জ্ঞানের ঝুলিতে প্রাচুর্য ঘটে।

আল্লাহ্ ‌তা’আলা মু’মিনদের আদেশ দিয়েছেন,

“কুনূ মা’আস সাদেক্বীন”
“তোমরা সত্যবাদীদের সাহচর্য অবলম্বন কর”।

জলসার সময় এ আদেশটি সফলভাবে পালিত হয়ে থাকে। এ সময় কেন্দ্রীয় বুযুর্গানের সাথে নামায পড়ে তাদের নসিহতমূলক কথাবার্তা শুনে তাঁদের চালচলন দেখে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক যাত্রা পথের অনেক পাথেয় সংগ্রহ করা যায়।

হাদীসে এসেছে,

আল্ মু’মিনু মিরআতুল মু’মিনিন
অর্থাৎ এজন মু’মিন আর একজন মু’মিনের দর্পণ স্বরূপ।

দর্পণ বা আয়নার সামনে দাঁড়ালে এক ব্যক্তি যেমন তার মুখমন্ডলে বা দেহে নোংরা ময়লা থাকলে তা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতে পারে তেমনি জলসা প্রভৃতি সমাবেশে মু’মিনরা যখন একত্র হয় তখন পরস্পরের তুলনায় নিজের ত্রুটিবিচ্যুতি দর্পণের ন্যায় লক্ষ্য করতে পারে এবং যথাযথ সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আর ফাসতাবিকুল খয়রাত (পুণ্য কাজে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা কর)-এর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে পুণ্য কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। মু’মিনরা পরস্পর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ, কুরআন ও হাদীস পাঠে আমরা তা জানতে পারি। এ আবেগ ও অনুভূতি নিয়ে মু’মিনরা জলসার মহামিলন মেলায় সমবেত হন। দেশ রং সংস্কৃতি প্রভৃতির ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক কলেমার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মু’মিনরা একে অপরকে আরও বেশি চিনতে পারেন জামাতের এসব জলসায়। কাদিয়ান রাবওয়া লন্ডন প্রভৃতি স্থানের জলসাগুলোতে এর বাস্তব চিত্রই আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। জলসা শেষে মু’মিনরা যখন নিজ নিজ দেশে ফিরে যান তখন এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধন যে কত মধুর ও মূল্যবান এবং কত দৃঢ় ও অটুট সে উপলব্ধি নবায়ন করে ফিরে যান। আসলে এ জলসাগুলো এক মহাজাতি তথা এক জাতিসংঘের মিলন মেলায় পরিণত হয়ে যায়। জলসার সবচেয়ে বড় কল্যাণ লাভ হয় যিক্‌রে ইলাহী বা বিভু স্মরণের মাধ্যমে। আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল সল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের মহান মকাম ও মর্যাদা সমুন্নত হওয়ার লক্ষ্যে তাসবীহ্ তাহমীদ ইস্তিগফার ও দুরূদ শরীফের এক আধ্যাত্মিক মনোরম উদ্যানের সৃষ্টি হয় এ জলসার দিনগুলোতে। এক একটি জলসা যেন এক একটি ‘বিয়াযুল জান্নাহ্’ অর্থাৎ স্বর্গোদ্যান। ফিরিশ্‌তারা তাদের পালক বিস্তার করে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত এগুলো ঘিরে রাখেন এবং এতে অংশগ্রহণকারীদের ওপর ঐশী আশিস ও কল্যাণ বর্ষণ করতে থাকেন। মাটির ধরায় তখন যেন স্বর্গ রচিত হয়। আল্লাহ্‌তাআলার অনুগ্রহ বারিতে মু’মিনরা আবগাহন করে স্বর্গীয় অমিয় সুধা পান করতে করতে জলসা থেকে ফিরে যান। ঘটনাক্রমে যদি কেউ এতে যোগদান করে সে-ও এর সুফল থেকে বঞ্চিত হয় না।

উপরোক্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দৃষ্টিপটে রেখে যুগ ইমাম হযরত মির্যা গোলাম আহ্‌মদ কাদিয়ানী, ইমাম মাহ্‌দী ও মসীহ্ মাওউদ (আঃ) ঐশী ইঙ্গিতে নিজ কর্মক্ষেত্র দারুল আমান কাদিয়ানে ১৮৯১ খৃষ্টাব্দের ২৭শে ডিসেম্বর এ জলসার প্রবর্তন করেন। তখন থেকেই এ জলসার অগ্রযাত্রা শুরু হয়।

পটভূমি ও প্রথম জলসা

১৮৯১ খৃষ্টাব্দে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) ‘আসমানী ফয়সালা’ নামে একখানা পুস্তিকা প্রণয়ন করে সেসব আলেমদের আহবান করেন যারা তাঁকে ‘কাফির’ আখ্যা দিয়েছিলেন। কুরআন মজীদে মু’মিনদের যে চিহ্নাবলী বর্ণনা করা হয়েছে এর ভিত্তিতে তাঁর সাথে প্রতিযোগিতার জন্যে এ আহ্বান জানানো হয়েছিল। এ প্রতিযোগিতায় সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্যে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনের লক্ষ্যে লাহোরে একটি আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠারও প্রস্তাব দেন তিনি। এ আঞ্জুমানের সদস্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেই ব্যক্তিকে নিযুক্ত করতে হবে। তিনি এ আঞ্জুমানের অবকাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে আরও পরামর্শের জন্যে জামাতের লোকদের ২৭শে ডিসেম্বর, ১৮৯১তারিখে কাদিয়ানে আসার আহ্বান জানান। এ জলসায় অংশগ্রহণের জন্যে ৭৫ জন নিষ্ঠবান ব্যক্তি উপস্থিত হন। সেদিন যুহরের নামাযের পর কাদিয়ানের মসজিদে আকসাতে জলসা আরম্ভ হয়। হযরত মৌলভী আব্দুল করীম সিয়ালকোটি সাহেব ‘আসমানী ফয়সালা’ পুস্তিকা খানা পাঠ করেন। পুস্তিকাখানা প্রকাশের জন্যে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে জেনে নিয়ে ওপরে বর্ণিত আঞ্জুমানের সদস্যদের নিযুক্ত করার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। জামাতের বন্ধুগণ হুযূর (আঃ)-এর সাথে মুসাফাহা (করমর্দন) করে ধন্য হন। এ ছিল সংক্ষেপে প্রথম জলসার কার্য বিবরণী। এটিই পরবর্তী পর্যায়ে সালানা জলসার রূপ নেয়। আর ৭৫ জনের পরিবর্তে ৭৫ হাজার কেন রাবওয়ার শেষ সালানা জলসাতে অর্থাৎ ১৯৮৩ সনে এতে উপস্থিতির সংখ্যা তো ছিল প্রায় পৌনে ৩ লাখ। অতএব এ জলসাও হযরত ইম��ম মাহ্‌দী (আঃ)-এর সত্যতার এক জ্বলন্ত নিদর্শন তা বললে অত্যুক্তি হবে না।

হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর জীবদ্দশায় আরও জলসা (১৮৯২-১৯০৮)

আহ্‌মদী জামাতের দ্বিতীয় সাল��না জলসা অনুষ্ঠিত হয় ২৬-২৮ ডিসেম্বর, ১৮৯২ সনে কাদিয়ান��। এতে ৫০০ জন উপস্থিত হন। কাদিয়ানের বাইরে থেকে আসেন ৩২ জন। ১৮৯৩ সনের জলসা অনিবার্য কারণে বন্ধ থাকে। ১৮৯৪ থেকে ১৯০০ সন পর্যন্ত কাদিয়ানের মসজিদে আকসায় সালানা জলসা হতে থাকে। ১৮৯৬ সনে লাহোরে সর্বধর্ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) প্রণীত ‘ইসলামী উসুল কি ফিলাসফী’ নামক প্রবন্ধ পাঠ করা হয়। এ প্রবন্ধ তিনি কুরআনে হাকীমের ভিত্তিতে প্রণয়ন করেন। ইসলামের পক্ষ থেকে এ প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয় এবং এটি শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে। এ সম্বন্ধে আল্লাহ্‌ তা’আলা হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-কে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন এবং তিনি (আঃ) তা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচারও করেছিলেন। এটা ছিল ইসলামের সত্যতার একটি বড় নিদর্শন। এ বছরও সালানা জলসা স্থগিত ছিল। কেননা, তারিখগুলোতেই সেই সর্বধর্ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

১৯০০ সনের জলসায় মসীহ্ মাওউদ (আঃ) অসুস্থ্যতার কারণে মাত্র একবার ভাষণ দিয়েছিলেন ১৫০০ শ্রোতা এ বারের জলসায় যোগ করেছিলেন। ১৯০১ সনের জলসায়ও অনেক লোক সমাগম হয়। হযরত নওয়াব মুহাম্মদ আলী খান সাহেব (রাঃ) তাঁর ডায়েরিতে ২রা ডিসেম্বর তারিখ লিখেনঃ

অত্যধিক মেহমান হওয়ার কারণে জুমুআর নামাযে স্থান সঙ্কুলান হচ্ছিল না।

১৯০৫ সনের সালানা জলসার স্মরণযোগ্য বিষয় হলোঃ বেহেশ্‌তি মাকবেরার ব্যবস্থাপনার জন্যে একটি আঞ্জুমান গঠন। এর নাম রাখা হয় ‘আঞ্জুমান কারপরদায মাসালেহ বেহেশতি মাকবেরা’

হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর জীবনের শেষ জলসা অনুষ্ঠিত হয় কাদিয়ানের মসজিদুল আকসাতে ২৬-২৮ ডিসেম্বর, ১৯০৭ সনে। ২৬ তারিখ হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) যখন প্রাতঃভ্রমণে গেলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই অনেক লোক সমাগম হয়ে যায়। হুযূর (আঃ) একটি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে যান। দু’ঘন্টা ধরে ভক্তরা তাঁর সাথে মুসাফাহা করার সুযোগ লাভ করেন। ২৭-২৮ তারিখ হযরত মসীহে মাওউদ (আঃ) ‘তাযকিয়ায়ে নাফস’ বা আত্মশুদ্ধি বিষয়ে জামাতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্য রাখেন। ২৮শে ডিসেম্বর তিনি (আঃ) বলেনঃ

‘জীবনের কোন ভরসা নেই। আজ এখানে যারা উপস্থিত হয়েছেন এদের মাঝে কে আগামী বছর জীবিত থাকবে আর কে মারা যাবে তা জানা নেই।’

এ জলসায়ও অনেক লোক সমাগম হয়। জুমুআর দিন মসজিদে আকসার আশেপাশের দোকান ঘর বাড়ী এবং ডাকঘরের ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে লোকেরা নামায আদায় করেন। সালানা জলসার সূচনালগ্ন থেকে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) তাঁর জীবনের ১৪ বছরের জলসার দিনগুলোতে (তিনটি জলসা অর্থাৎ ১৮৯৩, ১৯৯৬ ও ১৯০২ সনের জলসা অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়) সশরীরে উপস্থিত থেকে জলসা কল্যাণমন্ডিত করেন।

প্রথম খিলাফতকালীন সালানা জলসা (১৯০৮-১৯১৪)

হযরত হাকীম হাফেয হাজীউল হারমাঈন শরীফাঈন মাওলানা নূরুদ্দীন সাহেব, খলীফাতুল মসীহ্ আওয়াল (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ৬টি জলসা রীতিমত অনুষ্ঠিত হয়। যদিও ১৯০৯ সনের সালানা জলসা অনিবার্যকারণে ১৯১০ সনের ২৫-২৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯১০ সনের সালানা জলসা ২৫-২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। এর উপস্থিতি ছিল ২৫০০ জন।

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রাঃ)-এর খিলাফতকালীন সালানা জলসা (১৯১৪-১৯৬৫)

আলহাজ্জ হযরত মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদ আহ্‌মদ সাহেব, খলীফাতুল মসীহ্ সানী আল মুসলেহুল মাওউদ (রাঃ)-এর খিলাফত ১৯১৪ সনের ১৩ই মার্চ থেকে ১৯৬৫ সনের ৮ই নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাপ্ত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত কাদিয়ান দারুল আমানে ৩৩টি সালানা জলসা অনুষ্ঠিত হয়। ৩২টি জলসা মসজিদে নূর ও এর চারিদিকের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪১ সনের জলসা অনুষ্ঠিত হয় মসজিদে আকসাতে। কাদিয়ান থেকে হিজরতের পর ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সনের জলসা অনুষ্ঠিত হয় লাহোরে। এসব জলসার কোন কোনটির উল্ল্যেখযোগ্য বিষয়ের বিবরণ এরূপঃ

একটি তাৎপর্যপূর্ণ জলসা

১৯৪৪ সনের জলসা বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এবছর আল্লাহ্ তা’আলার ফযলে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রাঃ)-কে জানানো হয়, তিনিই মুসলেহ মাওউদ। সুতরাং তিনি এ জলসায় যে বক্তব্য রাখেন তাতে শপথ- পূর্বক এ বিষয় উপস্থাপন করেন, আমি ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লেখিত মুসলেহ মাওউদ। মুসলেহ মাওউদ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীতে আল্লাহ্ তা’আলা মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর প্রতিশ্রুত পুত্রের যে ৫২টি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন তা আমার মাঝে পূর্ণ হয়েছে। ৪ ঘন্টা ধরে তিনি বক্তব্য রাখেন। এ জলসায় উপস্থিতি ছিল প্রায় ২৩,৬০০ জন।

১৯৫০ থেকে ধারাবাহিকভাবে রাওয়ায় জলসা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৯৫১ সনে প্রথম জলসার রেকর্ডিং এর ব্যবস্থা ছিল। ১৯৫২ সনের উপস্থিতি ছিল ৫০,০০০ জন। ১৯৫৬ সনের জলসার উপস্থিতি ৬০ হাজার। এ জলসার হুযূর (রাঃ) খিলাফতে সালেসা সম্বন্ধে এ সুসংবাদের ঘোষণা দেনঃ

‘তিনি যদি খোদাতা’আলার ওপর ঈমান নিয়ে দাঁড়ান তাহলে……………..বিশ্বের সরকারগুলোও তার বিরুদ্ধে দাঁড়া হলে তাঁর সাথে দ্বন্দ্বে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।’

১৯৫৮ সনের জলসার উপস্থিতি সংখ্যা ১ লক্ষ। এতে প্রথমবারের মত প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৫৯সনের জলসা সালানা নির্বাচনের কারণে জানুয়ারী ১৯৬০ সনে অনুষ্ঠিত হয়। ডিসেম্বর মাসেও যথারীতি জলসা অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিতি ৭০,০০০। ১৯৬১ সন��র জলসায় হুযূর (রাঃ) অসুস্থ্য থাকার কারণে উদ্বোধনী ও সমাপ্তি ভাষণ দেন হযরত সাহেবযাদা মির্যা বশীর আহ্‌মদ সাহেব (রাঃ)। উপস্থিতি ১ লক্ষ। হযরত মুসলেহ মাওউদ (রাঃ)-এর খি�����ফতের শেষ জলসা হয় ১৯৬৪ সনে।

হযরত হাফেয মির্যা নাসের আহ্‌মদ এম,এ(অক্সন), খলীফাতুল মসীহ সালেস (রাহেঃ)-এর খিলাফতকালীন সালানা জলসা (১৯৬৫-১৯৮২)

৮ই নভেম্বর, ১৯৬৫ তারিখ কুদরতে সানীয়ার তৃতীয় বিকাশ ঘটে। এ আমলে ১৫টি জলসার সব জলসাই রাবওয়াতে অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় খিলাফতের প্রথম জলসা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সনের ১৯-২১ ডিসেম্বর তারিখে। উপস্থিত ৮০,০০০ জন। রেডিও পাকিস্তানের জাতীয় সংবাদে এ জলসার খবর প্রচারিত হয়। ১৯৬৬ সনের সালানা জলসা রমযানের কারণে ২৬-২৭ জানুয়ারী, ১৯৬৭ অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ৮৫ হাজার। এভাবে ১৯৬৭ সনের সালানা জলসা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সনের ১০-১২ জানুয়ারী। উপস্থিত সংখ্যা ১ লক্ষ। ১০-১১ তারিখ মধ্যবর্তী রাতে অআহ্‌মদী রুটি প্রস্তুতকারীরা ধর্মঘট করলে হুযূর (রাহেঃ)-এর তাহরীক অনুযায়ী উপস্থিত মু’মিনরা এক রুটি খেয়ে জলসা শুনার ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সনে যুদ্ধের কারণে জলসা স্থগিত করা হয়। অর্থাৎ ১৯৭৩ সনের জলসায় হুযূর (রাহেঃ) ১৯৮৮ সনে শতবার্ষিকী জুবিলী পালনের ঘোষণা দেন। এবারের জলসায় উপস্থিতি সোয়া লক্ষ। ১৫ শতাব্দীর প্রথম জলসা ২৬-২৮ ডিসেম্বর, ১৯৮০ তারিখ অনুষ্ঠিত হয়। ৮৮তম এ জলসার উপস্থিতি সংখ্যা ২ লক্ষ। ১৯৮১ সনে তৃতীয় খিলাফতের শেষ জলসা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিতির সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ। তৃতীয় খিলাফতের সব জলসা মসজিদ আকসা রাবওয়াতে অনুষ্ঠিত হয়।

হযরত মির্যা তাহের আহ্‌মদ, খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহেঃ)-এর খিলাফত কালীন জলসা (১৯৮২-২০০২)

১৯৮২ সনের ১০ জুন থেকে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহেঃ)-এর খিলাফতের পর্যায় আরম্ভ হয়। তাঁর খিলাফত কালে ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সনের ২টি জলসা রাবওয়াতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে যথাক্রমে উপস্থিতি ২ লক্ষ ২০ হাজার ও পৌনে ৩ লক্ষ। ১৯৮৩ সনে পাকিস্তানের রাবওয়াতে শেষ জলসা অনুষ্ঠিত হয়।

যুক্তরাজ্যে সালানা জলসা

১৯৬৪ সনের আগস্ট ২৯-৩০ তারিখ থেকে যুক্তরাজ্যে সালানা জলসা হয়ে আসছে। ১৯৮৪ সনে হুযূর খলীফা রাবে (রাহেঃ)-এর ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিতিতে যুক্তরাজ্যের জলসা (১৯তম)-ও কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করে আসছে। এ বছর উপস্থিতি ছিল ৩ হাজার। ১৯৮৫ সনের ৫-৭ এপ্রিল প্রথম বারের মত লন্ডনের সারে এলাকার টিলফোর্ডের ‘ইসলামাবাদ’ নামক স্থানে প্রথম জলসা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৪৮টি দেশের ৭ হাজার লোক উপস্থিত হন। ১৯৮৭ সনের জলসার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এতে প্রথম বার বিভিন্ন দেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। উপস্থিত ছিল ১১৪টি দেশের ৭ হাজার। ১৯৮৮ সনে ১১৭টি দেশের ৫,১১৯ জন উপস্থিত হন। জলসার বক্তৃতায় হুযূর (রাহেঃ) মোবাহালার চ্যালেঞ্জ দেন। ১৯৮৯এর জলসা শতবার্ষিকী জুবিলী জলসা হিসেবে পালিত হয়। এত ১২০টি দেশের ১৪ হাজার বন্ধু যোগদান করেন। এতে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর সাহাবী হযরত মৌলভী মোহাম্মদ হুসেন সাহেব (রাঃ) যোগদান করেন। বৃটেনের জলসার বড় আকর্ষণ হলো আন্তর্জাতিক বয়’আত অনুষ্ঠান। ১৯৯৩ সন থেকে এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। এম.টি.এ (MTA) – এর মাধ্যমে সারা বিশ্ব এতে যোগদান করে। ২০০০ সনে যুক্তরাজ্যের এ সালানা জলসায় (৩৫তম) উপস্থিত ছিল ২৩,৪০৭ জন। ২০০১ সনের ২৪-২৬ আগস্ট তারিখ এ সালানা জলসা অনুষ্ঠিত হয় জার্মানীর মেনহেইমে। এতে উপস্থিত ছিল ৪৮ হাজার ১০৯ জন। ২০০২ সনের সালানা জলসা অনুষ্ঠিত হয় ২৬-২৮ জুলাই টিলফোর্ডের ইসলামাবাদে। এতে ৭৪টি দেশের ১৯ হাজার ৪শ’ জন উপস্থিত ছিলেন। এটা চতুর্থ খলীফার জীবনকালীন শেষ জলসা।

হযরত মির্যা মাসরূর আহ্‌মদ, খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই:)-এর খিলাফতকালীন সালানা জলসা (২০০৩ থেকে চলছে)

২০০৩ সনের ২২শে এপ্রিল ৫৩ বছর বয়সে তিনি পঞ্চম খলীফার মসনদ লাভ করেন। তাঁর খিলাফতকালীন প্রথম (৩৭তম) জলসা অনুষ্ঠিত হয় ২০০৩ সনের ২৫-২৭ জুলাই ইসলামাবাদে। উপস্থিতি ২১টি দেশের ২৫ হাজারের বেশি। ২০০৪ সনের সালানা জলসা অনুষ্ঠিত হয় ৩০-৩১ জুলাই ও ১লা আগস্ট তারিখে। এতে ৭৫টি দেশের ২৫ হাজার জন উপস্থিত হন। ২০০৫ সনের সালানা জলসা অনুষ্ঠিত হয় ২৯-৩১ জুলাই তারিখে। এতে উপস্থিতি ছিল ২৫,২৪৯ জন। এটি অনুষ্ঠিত হয় রাসমুর এরিনার ভাড়া করা স্থানে। সালানা জলসার জন্য জামা’ত ২০৮ একরের একটি নতুন জায়গা ক্রয় করেছে এ বছর। ২০০৬ সনের জলসা অনুষ্ঠিত হয় ২৮-৩০ জুলাই Alton, Hampshire এর নতুন স্থানে। এর নামকরণ করেছেন হুযূর আকদস (আই:) হাদীকাতুল মাহ্‌দী (মাহ্‌দীর কানন)। এ জলসায় ৮১টি দেশ থেকে ২৯,৮০০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি উপস্থিত হন।

কাদিয়ানের সালানা জলসা

রাবওয়া থেকে খিলাফতের হিজরতের পর সরকারী বাধ্যবাধকতার কারণে রাবওয়াতে কেন্দ্রীয় সালানা জলসা অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কিন্তু ১৯৪৭ সনে দেশ বিভাগের পরও কাদিয়ানে সালানা জলসা যথারীতি অব্যাহত রয়েছে। ১৯৪৭ সনে ২৫৩ জন দরবেশ এবং ৬২ জন অমুসলিম জলসায় যোগদান করেন। ১৯৯১ সনের জলসা ছিল ঐতিহাসিক। ১০০তম এ জলসায় হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহেঃ)-এর যোগদানে দেশ বিভাগের পর কোন খলীফার এই প্রথম জলসায় যোগদান। উপস্থিতি সংখ্যা ছিল ২২ হাজার। ২০০৫ সনের ১১৪তম কাদিয়ানের সালানা জলসায় হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আল খামেস (আই:) যোগদান করলে এ জলসার রওনক বৃদ্ধি পায়। এ জলসার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৭০ হাজার। এছাড়াও আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের যে কোন স্থানের জলসায় খলীফায়ে ওয়াক্তের উপস্থিতিতে সেই জলসা আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করে।

মোটামুটি এ হলো কেন্দ্রীয় সালানা জলসার ইতিকথা। আগেই বলেছি এ জলসাও আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের সত্যতার নিদর্শন বহন করে। এমন কোন জলসা নেই যা আহ্‌মদী জামাতের উন্নতির লক্ষ্যে একটি মাইল ফলক হিসেবে পরিলক্ষিত হয়নি বা কোন না নিদর্শন বয়ে নিয়ে আনেনি। প্রত্যকটি জলসা একটি আন্তর্জাতিক তথা জাতিসংঘের রূপ পরিগ্রহ করে। জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সারা স্তরের মানুষ এসব জলসায় যোগদান করে এক ‘উম্মতে ওয়াহেদা’র রূপ ধারণ করে। একজন হাজী হিসেবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও হৃদয়ের উপলব্ধিতে বলতে পারি পবিত্র মক্কা মুয়ায্‌যমায় ২০/৩০ লক্ষ লোকের সমাগম হলেও এখানে সেই ‘উম্মতে ওয়াহেদা’র রূপ পরিদৃষ্ট হয় না যা এ জলসাগুলোতে পরিদৃষ্ট হয়। এর কারণ এসব জলসার মধ্য মণি হলেন বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সঃ) কর্তৃক প্রতিশ্রুত “খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়্যত”-এর ধারায় যুগ খলীফা। কা’বার বিশ্বসমাবেশে খিলাফতের আধ্যাত্মিক ছোঁয়াচ নেই, আছে রাজতন্ত্রের জাঁকজমক। যেদিন এ বিশ্ব মিলন মেলা খিলাফতের ঐশী নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হবে সেদিন এটা আবার ১৫শ’ বছর আগের সেই আধ্যাত্মিক রূপ ও রং ফিরে পাবে, ইনশাল্লাহ্।

(আল্ ফযল রাবওয়ার সৌজন্যে তথ্যাদি সরবরাহ করা হলো)

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে জানুয়ারী ২০০৭