হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রাঃ)-এর কয়েকটি অনন্য গুণাবলী

মাওলানা ফিরোজ আলম, মুরব্বী সিলসিলাহ

যুগে যুগে যখনই কোন নবী এসেছেন আল্লাহ্‌ তাআলা সে নবীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য, তাঁর হাতকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে সমসাময়িক যুগের লোকদের মধ্য থেকে এমন একব্যক্তিকে বেছে নেন যিনি প্রত্যাদিষ্ট নবীর পক্ষে তাঁর মিশনকে পৃথিবীতে সফল করার জন্য সকল প্রকারের ত্যাগ স্বীকার করে থাকেন; যিনি প্রত্যাদিষ্ট নবীর পরেই পুণ্য, বিশ্বস্ততা খোদাভীতি ও তাক্‌ওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামী থাকেন। যেমন আল্লাহ্‌ তাআলা মুসার ডানহস্ত হিসেবে দিয়েছেন হারূন ও ইউশা বিন নুনকে, ঈসাকে দিয়েছেন জেমস বা ইয়াকুব আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে বন্ধু হিসেবে দিয়েছেন হযরত আবুবকর (রাঃ)। অনুরূপ ভাবে এযুগের মসীহ ও মাহদী (আঃ)-এর সাহায্যকারী হিসেবে উপহার দিয়েছেন হযরত হাফেজ হেকিম নূরুদ্দীন (রাঃ) কে। এমন ব্যক্তিবর্গকে সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত করা হয় যার অর্থ একান্ত নিষ্ঠাবান ও বিশ্বস্ত।

হযরত নূরুদ্দীন (রাঃ)-এর আশৈশব খোদার প্রতি ছিল প্রবল আকর্ষণ। খোদার ভালবাসা তাঁকে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক শহর থেকে অন্য শহর বরং দেশ থেকে দেশান্তরে নিয়ে যায়। আমরা খোদার উপর তাঁর তাওয়াক্কুল বা নির্ভরশীলতার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরব; কিন্তু হযরত নূরুদ্দীনের ভালবাসা ও খোদার প্রতি আকর্ষণ একতরফা ছিলনা বরং তিনি তাঁর বই ‘মেরকাতুল একিনে’ এটি স্পষ্ট করেছেন যে খোদার জন্য আমরা যখনই কোন ত্যাগ স্বীকার করি খোদা প্রত্যুত্তরে তাঁর অঢেল দানে ভূষিত করেন। হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর প্রতি হযরত নূরুদ্দীনের নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার কিছু দৃষ্টান্ত এবং হযরত মসীহ মাওউদ তাঁকে কি দৃষ্টিতে দেখতেন তাও সংক্ষেপে এ প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করব; একই সাথে তাঁর পবিত্র কুরআনের প্রতি গভীর অনুরাগ, দোয়াতে অগাধ বিশ্বাস এবং বর্ণ, ধর্ম ও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের প্রতি তাঁর যে অসাধারণ ভালবাসা ছিল তার ও দু’একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরার চেষ্টা করব। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে তাঁকে খোদা খলীফা নিযুক্ত করেছেন; এসম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত আলোচনা থাকবে।

যৌবনেই এক খোদা ও একত্ত্ববাদের জন্য তিনি ছিলেন গভীরভাবে আত্মাভিমানী ছিলেন। ধাপে ধাপে তিনি কিভাবে আধ্যাত্মিক উন্নতি করেছেন তা নূরুদ্দীন নিজ বই ‘মেরকাতুল একিন ফী হায়াতে নূরুদ্দীন’ (নূরুদ্দীনের জীবনে উন্নতির সোপান) এ উল্ল্যেখ করেছেন, ১৮৫৮ সনে ১৭ বছর বয়সে শিক্ষায় ডিপ্লোমা নেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি রাওয়ালপিন্ডির একটি স্কুলে ভর্তি হন এবং তিন বছরে পড়ালেখা সমাপ্ত করেন। এ পরীক্ষায় তাঁর ফলাফল এত ভাল হয় যে, মাত্র একুশ বছর বয়সে তাঁকে ভেরা শহরের কয়েক মাইল দূরে ঝিলাম নদীর ওপারে অবস্থিত শহর পীন্ডদাদান খাঁন স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত করা হন। এমন সময়ে তাঁর সত্য স্বপ্ন দর্শনের অভিজ্ঞতাও আরম্ভ হয়, যা তাঁর আধ্যাত্মিক বৃত্তি ও উপলদ্ধির প্রখরতায় সহায়ক হয়। যাইহোক এ ঈর্ষণীয় পদ থেকে তিনি হঠাৎ করে ইস্তফা দেন। তাঁর ইস্তফা দেয়ার নাটকীয় ঘটনাটি তিনি এভাবে বর্ণনা করেনঃ

‘একদিন স্কুল পরিদর্শক পরিদর্শনে আসেন, তখন আমি খাবার খাচ্ছিলাম। আমি তাকে আমার সাথে খাবার জন্য আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি আমার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করে রাগতঃস্বরে বললেন, মনে হয় আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি। আমার নাম খোদা বক্‌শ এবং আমি স্কুল পরিদর্শক।

আমি বললাম, তাই নাকি! ভাল কথা, আপনি একজন সৎ মানুষ! কিন্তু একজন শিক্ষকের পরিবেশিত খাবার আপনি খান না, এটি কেমন কথা! এ বলে আমি খাবার অব্যাহত রাখলাম আর তিনি তাঁর টাট্টু ঘোড়ার রশি ধরে এ আশায় দাঁড়িয়ে রইলেন যে, আমি কোন ছাত্রকে ঘোড়াটি ধরতে বলবো। যখন দেখলেন যে, আমি কোন পদক্ষেপ নিচ্ছিনা তখন তিনি বললেনঃ দয়া করে একজন ছাত্রকে বলুন আমার টাট্টুটি সামলাতে।

আমি উত্তর দিলামঃ স্যার, আপনি এতটাই সতর্ক যে, একজন শিক্ষকের পরিবেশিত খাবারকে ঘুষ মনে করে তা গ্রহণ করেন না; এমতাবস্থায় আমি কীভাবে একজন ছাত্রকে আপনার ঘোড়াটি সামলাতে বলতে পারি । তারা বিদ্যালয়ে আসে পড়াশুনা করতে, আস্তাবল বালকের কাজ করার জন্য নয়। অধিকন্তু আপনি হয়তো এটিকে বাঁধতে এবং খাওয়াতেও বলবেন; যেখানে আপনি নিজেই একজন শিক্ষকের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে রাজী নন, সেখানে টাট্টুকে খাওয়ানো কীভাবে সিদ্ধ হতে পারে?

টাট্টু ঘোড়াটি অস্থির হয়ে উঠছিল, অবশ্য ততক্ষণে পরিদর্শকের কর্মচারী এসে গেল এবং সবকিছুর দেখাশুনা আরম্ভ করল। ইত্যবসরে তিনি জানালেন, ছাত্রদের পরীক্ষা নেয়ার মাধ্যমে কাজ আরম্ভ করবেন; সে মোতাবেক আমি ছাত্রদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে বসালাম এবং নিজে সরে গিয়ে দূরে বসে পড়লাম। পরিদর্শক পরীক্ষা নিলেন এবং আমাকে বললেন, আমি শুনেছি, আপনি খুবই যোগ্য মানুষ এবং নর্মাল স্কুলের কৃতি ডিপ্লোমাধারী; সম্ভবতঃ এটিই আপনার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণ।

আমি জবাব দিলামঃ স্যার, আমি কয়েক বর্গ-ইঞ্চি কাগজকে খোদা বলে গণ্য করি না। তখন আমি সার্টিফিকেটটি আনালাম, তার সামনেই সেটিকে ছিড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেললাম এবং দেখালাম যে খোদার সাথে আমি কোন কিছুকেই শরীক করি না। পরিদর্শক পুরো ঘটনার জন্য অনুতপ্ত হলেন এবং আমার সনদটি নষ্ট হবার জন্য তিনি নিজেকে দায়ী করলেন।

তিনি বলেন, সত্য কথা হলো, ডিপ্লোমা ছিড়ে ফেলা আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল, যা আমার জন্য স্বর্গীয় কল্যাণরাজির দ্বারকে খুলে দিয়েছে।

১৮৮৯ সনের মে মাসে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর মা ভেরায় ইন্তেকাল করেন। ১৮ বছর পুর্বে তুর্কী-রাশিয়া যুদ্ধ চলাকালে একদিন নূরুদ্দীন মাকে বললেন, আপনার ৮জন সন্তানের মাঝে আমি ব্যতীত সবাই বিবাহিত; আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আমার জীবন ধর্মের সেবার জন্য উৎসর্গ করতে চাই। তিনি ত্রস্ত হয়ে বললেন, আমি জীবিত থাকতে তা কিভাবে হতে পারে। হযরত নূরুদ্দীন (রাঃ) আর জোর দেননি। এরপর তাঁর ভাইয়েরা কিছুদিন পরপর একের পর এক মারা যেতে থাকেন। প্রত্যেকের মৃত্যুর পর তাদের বিধবারা নিজ নিজ তল্পি-তল্পা নিয়ে পারিবারিক বাসস্থান ছেড়ে চলে যায় আর এভাবে ঘর খালী হয়ে যেতে থাকে। একবার তিনি গ্রীস্মের মাঝামাঝি জম্মু থেকে মায়ের সাথে দেখা করার জন্য ব���ড়ী আসেন। দুপুরের খাবারের পর তিনি যখন আরাম করছিলেন তখন হঠাৎ করে পার্শ্বের ঘর থেকে মায়ের বেদনার্ত কান্নার চিৎকারে তিনি জেগে উঠেন, তিনি বলছিলেন; ইন্না লিল্লাহে ��য়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন (২.১৫৭)। তিনি তাঁর কাছে গেলেন এবং বললেন যে, এমন দোয়া যার আল্লাহ্‌র ইচ্ছার সামনে ধৈর্য্যপূর্ণ সমর্পনের অর্থ রয়েছে তা আর্তনাদের স্বরে পড়া উচিৎ নয়। তারপর তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি কি জানেন, এ বিশাল ঘর আজকে কেন জনমানবশূন্য। তিনি বললেনঃ বেশ কয়েকবছর পূর্বে তুমি যা বলেছিলে তা আমার মনে আছে। আমার প্রত্যেক ছেলের মৃত্যুর পর সে কথা আমার স্মরণ হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আপনি কি অন্য কিছু অনুধাবন করেন? তিনি বললেনঃ হাঁ, আমার মৃত্যুর সময় তুমি আমার কাছে থাক আর সবকিছুর দেখা শুনা কর, আমার এই প্রবল বাসনা সত্ত্বেও আমার মৃত্যু হবে তোমার অবর্তমানে। আর তাই হয়েছে। তিনি জম্মু ছিলেন এবং সময়মত পৌঁছতে পারেন নি।

আমাশয় রোগে ভেরায় তাঁর এক ভাগ্নে মারা যায়। এর অল্প কিছু দিন পর তিনি কোন কারণে জম্মু থেকে ভেরা আসেন। আমাশয়ে আক্রান্ত অপর এক ব্যক্তিকে তাঁর ভাইয়ের চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করতে দেখে তার বোন বললেন, আমার ছেলে যখন অসুস্থ্য ছিল তখন তুমি যদি এখানে থাকতে তাহলে সে মারা যেত না। তিনি এ কথা শুনে কেঁপে উঠেন কারন একথাটি তৌহীদ পরিপন্থি এবং নূরুদ্দীনকে খোদার আসনে বসানোর নামান্তর ছিল। তিনি বোনকে বললেন যে, তোমার আর একটি ছেলে হবে যে আমাশয়ে আক্রান্ত হবে আর আমার চিকিৎসা সত্বেও সে এ রোগে মারা যাবে। নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে তার ঘরে একটি সুদর্র্শন সন্তানের জন্ম হয় আর সে আমাশয়ে আক্রান্ত হয়। তার ভাই চিকিৎসা করতে থাকেন। বোন ভাইয়ের কথা স্মরণ করেন এবং ভাইকে আরোগ্যের জন্য দোয়ার অনুরোধ করেন। তিনি দোয়া করেন এবং বোনকে জানান যে, বাচ্চা মারা যাবে কিন্তু তার ঘরে আর একটি বাচ্চা হবে সে বড় হবে এবং উন্নতি করবে; পরবর্তীতে তাই হয়েছে।

এভাবে মা বোনকে তিনি যেখানে একত্ত্ববাদের শিক্ষা দিলেন সেখানে এক খোদার প্রতি যে তাঁর ব্যক্তিগত অনুরাগ ও শ্রদ্ধাবোধ কতটা ছিল তাও স্পষ্ট হয়।

একবার জোহরের নামায বাদ পড়ার কারণে মৌলভী নূরুদ্দীন এতটা মর্মাহত হন, যেন তিনি ক্ষমার অযোগ্য কোন কবিরা গুনাহ্‌ করেছেন । তিনি ভগ্ন ও ব্যথিত হৃদয়ে রহ্‌মতের দ্বার-পথে (মদিনায়) মসজিদে প্রবেশ করলেন যার উপরে এ আয়াত লিখিত ছিল, ‘তুমি বল! হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের প্রাণের ওপর অন্যায় করেছো, তোমরা আল্লাহ্‌র রহ্‌মত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সকল পাপ ক্ষমা করেন। নিশ্চয় তিনি অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (৩৯ঃ৫৪); এ ঐশী নিশ্চয়তা সত্ত্বেও তিনি শান্তি পাননি। তিনি মিম্বর ও নবী করীম (সাঃ)-এর কামরার মধ্যবর্তী একটি স্থানে দাঁড়িয়ে নামায পড়া আরম্ভ করলেন; রুকুতে তাঁর মনে পড়ল যে, নবী করীম (সাঃ) মিম্বর ও তাঁর কামরার মধ্যবর্তী স্থানটিকে বেহেশতের বাগানের অংশ তুল্য আখ্যায়িত করেছেন আর এভাবে যেন তিনি বেহেশ্‌তে অবস্থান করছিলেন, সেখানে যা আকাঙ্খা করবেন তাই পাবেন; সুতরাং তিনি তাঁর ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

হযরত নূরুদ্দীন (রাঃ) উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান, সুদুর মক্কা মদীনায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিফলিত হয় আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ, খোদা ও রসুলের প্রতি অগাধ ভালবাসা এবং একত্ববাদ ও তাওয়াক্কুলের অনুপম দৃষ্টান্ত।

হেকিম আলী হোসেন সাহেবের সন্ধানে যখন দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তিনি তাঁর চুড়ন্ত গন্তব্য লঁক্ষ্ণৌয় পৌঁছেন। গাড়ী থেকে নামার পর পরই তিনি কাউকে জিজ্ঞেস করলেন, হাকীম আলী হুসেন সাহেব কোথায় থাকেন? তাঁকে বলা হলো, তিনি ষ্টেশনের সামনেই থাকেন। কোন প্রস্তুতি ছাড়াই যেমন ছিলেন সে অবস্থায় মাল-পত্র নিয়ে সোজা সে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। প্রবেশদ্বারের সাথেই তিনি একটি বড় কামরা দেখলেন, যার শেষ প্রান্তে শুভ্র শুশ্রুমন্ডিত, সুদর্শন ও আকর্ষণীয় এবং ধবধবে সাদা পোষাক পরিহিত, ফিরিশ্‌তাতুল্য এক ব্যক্তি গদিতে হেলান দিয়ে বসে আছেন। সামনে তাঁর ব্যবহারের বিভিন্ন জিনিষ-পত্র সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত ছিল। দেয়ালের গা ঘেঁষে কয়েকজন সম্মানীত ব্যক্তি সশ্রদ্ধ বসে ছিলেন। মেঝে সাদা চাঁদরে আবৃত। পুরো দৃশ্যটি আগন্তকের কাছে স্বপ্নিল বলে মনে হলো। তিনি এমন দৃশ্য ইতিপূর্বে কখনো দেখেননি। নিজের মাল-পত্র প্রবেশদ্বারের এক পার্শ্বে রাখলেন এবং কক্ষে মধ্যমণি অর্থাৎ হেকিম সাহেবের দিকে সরাসরি সাহসিকতার সাথে এগিয়ে গেলেন যাকে তিনি যথার্থই চিনতে পেরেছিলেন। মেঝের সাদা-শুভ্র আচ্ছাদনীতে তাঁর ধূলোমাখা পায়ের ছাপ সৃষ্টি হতে দেখে তিনি কিছুটা লজ্জিত হলেন, কিন্তু কিছু করার ছিলনা। সম্মানিত বুজুর্গের সামনে এসে তিনি গভীরস্বরে বললেন আস্‌সালামু আলাইকুম ওয়া রহ্‌মাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু এবং করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। হেকীম সাহেব নমনীয়তার সাথে তাঁর সালামের উত্তর দিলেন এবং হাত বাড়িয়ে তাঁর ধূলোমাখা হাত নিজের দুর্বল হাতে নিলেন। আগন্তুক হেকীম সাহেবের সামনে বসলেন। উপস্থিত ভক্তরা যা ঘটছিলো তা দেখে যারপরনাই ক্ষুদ্ধ আর তাঁর সালামও তাদের কানে শ্রুতিকটু ঠেকলো। তাদের নেতৃস্থানীয় একজন নিজের রাগ সংবরণ করতে না পেরে; বলেই বসলেন যে, আপনি কোন্‌ সভ্য দেশ থেকে এসেছেন? তিনি বললেন, ‘‘আমার এ অনানুষ্ঠানিকতা, আমার সাহসভরা সালাম সে নিরক্ষর নবীর শিক্ষার প্রতিফলন যিনি আরবের তৃণলতাহীন মরু প্রান্তরে জন্ম গ্রহণ করেছেন, যিনি এক সময় ছাগপাল চরাতেন, খোদার অশেষ কল্যাণরাজি তার উপর বর্ষিত হোক, আমার পিতা-মাতা তাঁর জন্য নিবেদিত’’। তাঁর এ উত্তর উপস্থিত লোকদের বজ্রপাতের মত আঘাত করে আর হেকীম সাহেব ছিলেন আবেগ আপ্লুত । তিনি প্রশ্নকারীকে (অপর একজন মুরিদ) বললেনঃ আপনি রাজদরবারী ছিলেন; কিন্তু কখনো এভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছেন কি?

সংক্ষিপ্ত নিরবতার পর হেকিম সাহেব তাঁকে আগমনের উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জনের জন্য এসেছেন। উত্তরে হেকিম সাহেব বললেনঃ আপনি দেখছেন, আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি আর এখন পড়ানো পছন্দ করি না এবং শিক্ষকতা করবো না বলে মনস্থির করেছি। আগন্তুক কিছুটা উস্মা ও বেদনাবিধূর কন্ঠে বললেনঃ তাহলে তো সিরাজী দার্শনিকের এ কথা ভুল যে, কারো মনে আঘাত দেয়া পাপ। হেকীম সাহেব এতে গভীরভাবে আন্দোলিত হন। তিনি চিন্তা করে বললেন, মৌলভী নূর হাকীম একজন দক্ষ চিকিৎসক। আমি তাঁর কাছে আপনার জন্য সুপারিশ করবো, তিনি আপনাকে উত্তমভাবে পড়াবেন। আগন্তক আরেকটি ফার্সী উক্তি শুনালেন, ‘খোদার ভূমি একান্ত বিস্তৃত আর আমার চলারও শক্তি আছে।’ একথা শুনে হেকীম সাহেব পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করলেন আর বললেন, আমি আমার সংকল্প পরিহার করছি।

এসবকিছু একজন নূরুদ্দীনের উপস্থিত উত্তর যা হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এবং তাঁর খোদার প্রতি পরম ভালবাসার বাস্তব প্রতিফলন যা সকল হৃদয়কে আন্দেলিত করে।

হযরত মৌলানা নূরুদ্দীন (রাঃ) বলতেন যে, তাঁর খোদার সাথে তাঁর একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল, যা সম্পর্কে পৃথিবী অনবহিত। তাঁর জীবনের প্রায় সকল ঘটনায় বুঝা যায় যে নূরুদ্দীনের খোদা তাঁর এ দাবীকে সত্যায়ন করেছেন।

একবার তাঁর ইবনে খাল্‌দুনের ইতিহাস পড়ার গভীর আগ্রহ জন্মে। এক বই বিক্রেতা সত্তর রূপীর বিনিময়ে তাঁর কাছে বইটি বিক্রি করার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। তিনি তাকে বললেন, সম্পূর্ণ অর্থ তিনি নগদ পরিশোধ করা যাবেনা বরং কিস্তিতে আদায় করবেন। বিক্রেতা সম্মত হয়নি। একই দিন বিকেলে যখন ক্লিনিকে আসলেন তখ��� তিনি বইটি তাঁর টেবিলে দেখতে পেলেন। অনেক খোঁজ-খবর নেয়ার পরও উদঘাটন হলো না যে, বইটি কীভাবে তাঁর কাছে পৌঁছলো। একদিন এক রোগী বললেন, তিনি এক শিখ ব্যক্তিকে তাঁর টেবিল��� বইটি রাখতে দেখেছেন। রোগী বললেন যে তিনি তাঁর নাম জানেন না, কিন্তু তাঁকে চিনেন। কয়েকদিন পর তিনি সেই শিখকে তাঁর কাছে নিয়ে এলে তিনি বললেন, বই বিক্রেতার কাছে ঘটনাটি শুনে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বইটি ক্রয় করে এনে তাঁর টেবিলে রেখে দিয়েছেন। তিনি আরও বললেন, তাঁর মালিক তাঁকে সে অর্থ ফেরৎ দিয়েছেন যিনি তাকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, নূরুদ্দীনের যা কিছু প্রয়োজন তা তাঁর পক্ষ থেকে যেন তাঁকে সরবরাহ করা হয়।

খোদা তাআলা মানুষকে নূরুদ্দীনের সেবায় নিয়োজিত করে রেখেছিলেন।

মৌলভী নূরুদ্দীন কাশ্মীরের কোষাগার হতে বেশ বড় অংকের বেতন পেতেন, এছাড়া বিভিন্ন সময় তাঁকে বিভিন্ন প্রকার মূল্যবান উপহারও দেয়া হতো। যার পুরোটাই তিনি এতিম, বিধবা, ছাত্র এবং দরিদ্রদের কল্যাণে ব্যয় করতেন। একজন হিন্দু দোকানদার প্রায়শঃ তাঁকে ভাবী দুর্দিনের জন্য কিছু সঞ্চয় করার পরামর্শ দিতো। তিনি বলতেন, এটি আল্লাহ্‌র উপর তাঁর পূর্ণ ভরসার পরিপন্থী কাজ হবে আর আল্লাহ্‌ সবসময় তাঁর চাহিদা পূরণ করবেন। যে দিন তিনি চাকরি হতে অব্যহতি পত্র পেলেন দোকানী তার কাছে আসলো এবং জিজ্ঞেস করল, আমার পরামর্শ মনে আছে মৌলভী সাহেব! তিনি বললেন, তিনি তার পরামর্শকে বরাবরের মত এখনও ঘৃণা করেন।

দোকানীর সাথে কথা শেষ হবার পুর্বেই রাজ্য কোষাগারের পক্ষ থেকে এক বার্তাবাহক তাঁকে একটা পত্র দিল যার সাথে তিনি সে মাসে যত দিন কাজ করেছেন তার বেতন বাবত ৪৮০ রূপী ছিল। এতে দোকানদার অসন্তুষ্ট হলো এবং ভাবল যে, এটি কোষাগার কর্মকর্তাদের কান্ডজ্ঞানহীনতা বই কিছু নয়। দোকানদারের সম্ভিত ফিরে আসার পূর্বেই রাণীর একজন দূত তাঁর পক্ষ থেকে বেশ বড় একটি অংক নিয়ে তাঁর সামনে উপস্থিত, সাথে রাণী এ জন্যও ক্ষমা চেয়ে পাঠিয়েছেন যে, এ মূহুর্তে এর তুলনায় বড় অংক দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলনা। দোকানী পুরোপুরী কাবু হয়ে গেল। নিজের লজ্জা ঢাকার জন্য সে বিড়বিড় করে বললো, ভাল কথা কিন্তু আপনার কাছে তো এক ব্যক্তি প্রায় দু’লক্ষ রূপী পাবে; যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি তা পরিশোধের সন্তোষজনক ব্যবস্থা না করবেন সে আপনাকে যেতে দেবেনা। ঠিক তখনই ঋণদাতার একজন প্রতিনিধি আসলো, করজোড় করে বললো, আমার মালিক নির্দেশ দিয়েছেন যে আমি যেন আপনার মালমাত্তা প্রেরণসহ ফেরত যাবার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেই আর একই সাথে আপনার যত টাকা প্রয়োজন তা অগ্রিম আপনাকে প্রদান করি। মৌলভী সাহেব তাকে বললেন, আপনি আপনার মালিককে ধন্যবাদ জানাবেন এবং বলবেন, কোষাগার এবং অন্য উৎস থেকে আমি প্রয়োজনের অধিক অর্থ পেয়ে গেছি এবং আমি নিজেই আমার সমস্ত মালামাল সাথে নিয়ে যেতে পারবো।

দোকানদার দাঁড়ালো এবং মাথা নেড়ে বললো, মনে হয় আল্লাহ্‌ও পক্ষপাতিত্ব করে থাকেন। কয়েক টাকা আয়ের জন্য আমাদেরকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয় আর এখানে ঋণদাতা নির্বোধকে দেখ, যে ঋণ ফেরত না চেয়ে আরো দেয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে ।

মৌলভী সাহেব বললেন, আল্লাহ্‌ তাঁর দাসের মনের অবস্থা ভাল জানেন। আমি ইনশাআল্লাহ্‌ সত্তর এ ঋণ পরিশোধ করবো। এ বিষয়গুলো আপনার বোধশক্তির উর্দ্ধে।

এ ছিল হযরত নূরুদ্দীনের বিশ্বাস আর এ হলো খোদার সে প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা যা তিনি পবিত্র কোরআনে প্রদান করেছেন যে,

“যে খোদাকে ভয় করে খোদা তার জন্য মুক্তির কোন পথ বের করেন আর তাকে এমন স্থান থেকে রিয্‌ক দেন যা সে ভাবতেও পারেনা; আর যে খোদার উপর নির্ভর করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।”

তাঁর ঋণ পরিশোধের ঘটনাও শুনুনঃ কাদিয়ানে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করার এক বছরের মাথায় এক ব্যক্তি জম্মু থেকে কাদিয়ান আসেন এবং মৌলভী নূরুদ্দীনকে এক লক্ষ পঁচানব্বই হাজার টাকা নগদ প্রদান করেন। ঠিক এত টাকাই পাওনাদারকে দিতে হতো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ টাকা তাকে কেন দেয়া হলো? সে ব্যক্তি বললো, মহারাজা পূর্বের বছর রাজ্যের জঙ্গল ঠিকা দেয়ার সময় এই শর্ত রেখেছিলেন যে, ঠিকাদার তার মোট আয়ের অর্ধেক মৌলভী নূরুদ্দীনকে দেবে। সেই ভিত্তিতে টেন্ডার দেয়া হয় আর তিনি ঠিকা পেয়েছেন এবং লভ্যাংশের অর্ধেক মৌলভী নূরুদ্দীনকে হস্তান্তরের জন্য এসেছেন। হযরত মৌলানা সাহেব তাকে বললেন, আপনি টাকা জম্মু নিয়ে যান এবং এই টাকা আমার পাওনাদারকে ফেরত দিন। পরবর্তী বছর পুনরায় ঠিকাদার লাভের অর্ধেক নিয়ে তাঁর কাছে আসলেন কিন্তু মৌলভী সাহেব তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেন। ঠিকাদার বললেন, তিনি তাঁকে এই টাকা দিতে বাধ্য কেননা এটি তার ঠিকার শর্ত; কিন্তু মৌলভী সাহেব এক পয়সাও নিবেন না বলে জানিয়ে দেন। ঠিকাদার বললেন, আপনি গত বছর গ্রহণ করেছেন! (তিনি বললেন) সেটি আমাকে ঋণ মুক্ত করার জন্য আল্লাহ্‌র বিশেষ অনুগ্রহ ছিল। আমার এখন তেমন কোন প্রয়োজন নেই।

এ হলো নূরুদ্দীনের সাথে খোদার বিশেষ সম্পর্কের প্রমাণ।

জম্মু থেকে ফিরে আসার পর তিনি যে জায়গায় ক্লিনিক ঘর নির্মাণ করেন সে জায়গাটি ছিল সরকারী, যা সম্পর্কে পৌর কর্মকর্তাদের আপত্তি ছিল কিন্তু হযরত নূরুদ্দীনের প্রতি সম্মান বসতঃ তারা তাঁর কাজে বাধা দেয়নি অবশ্য বিষয়টি ডেপুটি কমিশনারকে জানানো হয়। ডেপুটি কমিশনার এসে নির্দেশ দিলেন যে, তাঁর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখতে হবে, এবং তাঁকে বললেন যে আপনি কি জানেন, এ জায়গাটি সরকারী সম্পত্তি? হাঁ, আমি জানি; কিন্তু পুরো শহরটিই সরকারী সম্পত্তি। তা কীভাবে? সরকার যদি শহরের কোন স্থানে সেনানিবাস প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে কেউ কি তাতে বাঁধা দিতে পারবে? অবশ্যই না। আর এভাবে পুরো শহরই সরকারের আয়ত্তাধীন বিবেচিত হতে পারে। আর কোন কথা না বলে ডেপুটি কমিশনার জানতে চাইলেনঃ আপনি যা চাইছেন তা করতে এ জায়গার কতটুকু অংশ আপনার দরকার?

এই জায়গাটি একটি মহাসড়ক ও গণযাতায়াত পথের মধ্যে অবস্থিত। এর পুরোটাই আমার দরকার। ডেপুটি কমিশনার তহ্‌শিলদার এবং পৌরসভার অন্যান্য সদস্যদের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনাদের কোন আপত্তি আছে কি? তাঁরা বললেনঃ প্রস্তাবিত ভবনটি জনসেবামূলক কাজে ব্যবহৃত হবে তাই আমাদের কোন আপত্তি নেই।

ডেপুটি কমিশনার নির্দেশ দিলেন, মাটিতে খুঁটা গেড়ে জমির নির্ধারিত অংশ চিহ্নিত করে দেয়া হোক; যা করা হয়েছে, এর পর তিনি চলে গেলেন।

তহ্‌শিলদার মৌলভী নূরুদ্দীনের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করলেনঃ এত সহজে পৌরসম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকার ডেপুটি কমিশনারের নেই।

কিছুদূর চলে যাবার পর ফিরে এসে ডেপুটি কমিশনার মৌলভী নূরুদ্দীনকে বললেনঃ আমি দেখতে পেয়েছি, এ পথটি বরাবর একটি খোলা পয়নালা বয়ে যাচ্ছে এটি আপনার জন্য অস্বস্তির কারণ হবে। আমি মনে করি, ওপাশে আপনার ভবনের দেয়াল ঘেষে পৌরসভার একটি বহিরালম্ব তৈরী করে দেয়া উচিত। পৌরসভার কমিশনারদের লক্ষ্য করে তিনি বললেন, আপনাদের কোন আপত্তি আছে কি? তাদের কোন আপত্তি ছিল না। তিনি মৌলভী নূরুদ্দীনকে বললেনঃ তাহলে বিষয়টির নিস্পত্তি হলো। আপনি ভবন তৈরীর কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।

তিনি চলে যাবার পর, একজন পৌরকমিশনার বিড়বিড় করতে লাগলোঃ এটা একটা অদ্ভুত সমাধান। পৌরসভাকে শুধুমাত্র একটি মূল্যবান ভূমিখন্ড থেকেই বঞ্চিত করা হয়নি বরং বহিরালম্ব তৈরীর জন্য অতিরিক্ত এক হাজার রূপীও জরিমানা হলো। মৌলভী নূরুদ্দীন মন্তব্য করলেনঃ এ বিষয়গুলো আপনাদের বোধশক্তির উর্ধ্বে।

নূরুদ্দীনের জীবন্ত খোদা এভাবে তাঁর পাশে দাড়াতেন।

নূরুদ্দীনের একটি গৃহ নির্মাণাধীন ছিল যার নির্মাণ খরচ আসে বার’শ রূপীতে। তিনি ভাবছিলেন কীভাবে তা পরিশোধ করা যায়; ইত্যবসরে একদিন বন্ধু মালিক ফাতেহ্‌ খান এলেন এবং বললেন, প্রাদেশিক দরবারে যোগদানের জন্য তিনি রাওয়ালপিন্ডি যাচ্ছেন আর একই সাথে দিল্লিতেও রাজপ্রতিনিধি�����র একটি দরবার অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। মৌলভী নূরুদ্দীন জানালেন, তিনি তাঁর সাথে যাবার আগ্রহ রাখেন; সে মোতাবেক যেমন ছিলেন ঠিক সে অবস্থায় রোগীদের রেখে এবং স্ত্রীকে কিছু না জানিয়ে তিনি টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে বসলেন। ঝিলমে মালিক ফাতেহ্‌ খান রাওয়ালপিন্ডির ট্রেন ধরলেন এবং মৌলভী নূরুদ্দীন দিল্লি যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর কাপড় পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল তাই তিনি তহ্‌শিলদার মালিক হাকিম খানের কাছ থেকে একটা কোট, পাগড়ি এবং পাজামা ধার করলেন। লাহোরগামী ট্রেন ধরার জন্য তিনি ষ্টেশনের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন। তিনি দেখলেন ঝিলম থেকে লাহোর পর্যন্ত তৃতীয় শ্রেনীর ভাড়া হলো পনের আনা এবং ধার করা কোটের পকেটে হাত দিয়ে দেখেন যে, তাতে সমপরিমান পয়সা রয়েছে। এ পয়সায় তিনি লাহোর পৌঁছে দেখেন যাত্রীদের ভীড়ে ষ্টেশন লোকে লোকারণ্য, সবাই দিল্লীর দরবারে যাবার জন্য অপেক্ষমান। তাঁর কাছে ভাড়ার কোন টাকা ছিল না আর থাকলেও ভিড়ের কারণে বুকিং অফিসের জানালায় পৌঁছা অনেকটা অসম্ভব ছিল। এসময় রেভরেন্ড গোলক নাথ তাঁর সাথে গায়ে পড়ে আলাপ জমালেন, তিনি তাঁকে জানতেন। তিনি যখন জানতে পারলেন যে মৌলভী নূরুদ্দীন দিল্লী যেতে চাচ্ছেন, তখন তিনি তাঁর জন্য একটি টিকেট নিয়ে এলেন। তাঁকে পকেটে হাত ঢুকাতে দেখে রেভরেন্ড প্রতিবাদ করে বললেন, তিনি উক্ত টিকেটের মূল্য গ্রহণ করবেন না।

বিকেলে তিনি দিল্লী পৌঁছেন এবং কৌতুহল তাঁকে শহরের বাইরে ক্ষমতাসীন প্রধানদের ক্যাম্পের কাছে নিয়ে গেল। কয়েক মাইল হাটার পর তিনি খেয়াল করলেন যে, সুর্য অস্ত-প্রায়; তাই শহরে ফিরে আসার কথা ভাবছিলেন এমন সময় ভূপালের মুন্সী জামাল উদ্দীন সাহেবের একজন খাদেম ছুঁটে এসে তাঁকে বললো, মুন্সী সাহেব তাঁকে হাঁটতে দেখে ডেকে আনার জন্য পাঠিয়েছেন। তাঁর যাওয়ার পর মুন্সী সাহেব তাঁর চিরাচরিত স্নেহের সাথে তাঁকে স্বাগত জানালেন এবং বললেনঃ আমার দৌহিত্র মুহাম্মদ উমর অসুস্থ্য; আমার ইচ্ছা আপনি তাঁকে পরীক্ষা করুন। মুহাম্মদ উমরকে পরীক্ষা করে হাকীম নূরুদ্দীন টিউমার নির্ণয় করলেন যার দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন। মুন্সী সাহেব তাঁকে তাঁর সাথে ভূপাল যাবার অনুরোধ করলে তিনি বললেন, তিনি হঠাৎ করে বাড়ী ছেড়েছেন তাই দীর্ঘ দিন বাহিরে থাকতে পারবেন না। মুন্সী সাহেব তাঁকে বাড়ীতে পাঠানোর জন্য পাঁচশত রুপী প্রদান করলেন এবং তাঁর সাথে ভূপাল যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। উক্ত অর্থ তিনি তাঁর হিন্দু পাওনাদারকে প্রেরণ করলেন এবং তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তা না করার জন্য স্ত্রী’কে পত্র পাঠালেন। এর কয়েকদিন পর মুন্সী সাহেব তাঁকে আরও সাতশত রুপী প্রদান করলেন, তাও তিনি তাঁর পাওনাদারকে পাঠালেন আর সকল প্রকারের দুঃশ্চিন্তামুক্ত হয়ে তিনি উৎফুল্ল মনে মুন্সী সাহেবের সাথে ভূপাল গেলেন।

বারশত টাকার প্রয়োজন তাই খোদা তাঁর জন্য বারশত টাকার ব্যবস্থা করলেন।

কোন অভাব দেখা দিলে তা বিমোচনের উপায় হলো যা আছে তা খোদার পথে খরচ করাঃ

একসময় তাঁর কাছে খুব ভাল কাপড়ের দুটি ওয়েষ্টকোট ছিল। সেগুলোর একটি পরিধানের আগেই চুরি হয়ে যায়। তিনি এ টিতে কোন দুঃখবোধ করেননি বরং আল্লাহ্‌ তাঁকে আরো উত্তম দানে ভূষিত করবেন এ বিশ্বাসে তিনি আন্তরিকভাবে সূরা বাকারার ১৫৭ নং আয়াত অর্থাৎ, ‘যারা তাদের উপর বিপদ এলে বলে নিশ্চয় আমরা আল্লাহ্‌রই এবং নিশ্চয় তাঁরই দিকে আমরা প্রত্যাবর্তণ করবো’ পড়তে থাকেন আর অন্য ওয়েষ্টকোটটি সদকা করে দেন। কিছুদিন পর এক ধনী ব্যক্তির ছেলে গণোরিয়ায় আক্রান্ত হলে তিনি তাঁর বন্ধুকে কোন একজন অপরিচিত চিকিৎসক ডাকতে বলেন। বন্ধুটি হেকীম নূরুদ্দীনকে চিনতেন। তিনি ছেলেটিকে দেখতে যাবার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন। বিস্তারিত পরিচয় জানার পর হেকীম সাহেব বল্‌লেনঃ এটি তো আমার হারিয়ে যাওয়া ওয়েষ্ট কোট, তিনি সে লোকটির সাথে রোগীকে দেখতে যান আর তাকে একটি বাগানে বসা দেখতে পান। রোগী নিজের উপসর্গ বর্ণনা করে একটি ব্যবস্থাপত্রের জন্য তাঁকে অনুরোধ জানান। বাগানে কিছু কলাগাছ ছিল। হেকীম সাহেব তাঁকে কলাগাছের পানির সাথে চুনের যৌগ মিশিয়ে সেবন করতে বলেন যা সহজলভ্য ছিল। রোগী তৎক্ষণাৎ মিশ্রণ তৈরী করে খেয়ে নেয়। হেকিম সাহেব চলে গেলেন, পরদিন হেকীম সাহেব তাকে আবার দেখতে এলে রোগী তাঁকে বলল, ঔষধের প্রথম ডোজই তাকে সুস্থ করে তুলেছে তাই তার আর চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। চিকিৎসক বুঝতে পারলেন যে পুরো ঘটনাটিই ছিল ঐশী অনুগ্রহের ফল। পরদিন রোগীর বন্ধু তাঁর কাছে অত্যন্ত দামী কাপড়ে জরি করা কিছু পোষাক ও বেশ কিছু নগদ টাকা নিয়ে আসে যা রোগী কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ তাঁর জন্য পাঠিয়েছে। চিকিৎসক পুনরায় বলেন যেঃ এটিই আমার সে ওয়েষ্টকোট। রোগীর বন্ধুটি জানতে চান ওয়েষ্ট কোটের রহস্যটি কি? চিকিৎসক তাকে পুরো ব্যাপারটি খুলে বলেন; তিনি আরও বলেন যে, যেহেতু এত দামী পোষাক তাঁর কোন কাজে আসবে না, তাই এগুলো বিক্রি করে তাঁকে টাকাগুলো দেয়া যুক্তিযুক্ত হবে। কাপড় ভাল দামে বিক্রি হলো ফলে তাঁর হাতে এত পরিমান টাকা এসে গেল যে তিনি হজ্বের উদ্দেশ্যে হেজাজ গমনে মনস্ত করেন।

তিনি শুধু দৈহিক বা মানসিক চিকিৎসাই বিশেষত্ব রাখতেন না বরং আধ্যাত্মিক চিকিৎসা ছিল তাঁর আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দু। তিনি আত্মার সংশোধন ও আরোগ্যের জন্য নিবেদিত ছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁর মেটেরিয়া মেডিকা, তাঁর ব্যবস্থাপত্র, এবং চিরসাথী (হামায়েল শরীফ) গ্রন্থ ছিল পবিত্র কুরআন। কুরআনে প্রজ্ঞার যে অফুরাণ ভান্ডার রয়েছে তা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার কোন সুযোগ তিনি নষ্ট করেন নি। যতক্ষণ নিজের চিন্তা-চেতনার উপর তার নিয়ন্ত্রণ ছিল তিনি কুরআন শিখানো অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বলতেন, কুরআন আমার রিয্‌ক এবং আমার আত্মার সতেজতার উৎস; দিনে আমি বেশ কয়েকবার এটি পড়ি কিন্তু আমার আত্মার চাহিদা কখনও মিটেনা। এটি নিরাময়, এটি রহমত, এটি আলো, এটি হেদায়েত। কুরআন কি ভাবে পড়া উচিৎ ? এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনঃ এটিকে যদি পড়তে হয় তাহলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো খোদাভীতি। আল্লাহ্‌ স্বয়ং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি মুত্তাকীকে (খোদাভীরু) কুরআন শিখাবেন। কুরআন পাঠের জন্য ছাত্রের জীবিকার চিন্তা থেকে মুক্ত থাকা দরকার। যদি সে তাকওয়ার পথ অনুসরণ করে আল্লাহ্‌ তাকে এমন স্থান থেকে রিয্‌ক প্রদান করবেন যা সে ভাবতেও পারবেন না অধিকন্তু তিনি তার অভিভাবক হয়ে যাবেন।

কুরআন পাঠের নিয়ম হলো, কুরআনের ছাত্রের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কুরআন এমনভাবে পাঠ করা উচিত যেন কুরআন তার উপর নাযেল হচ্ছে আর প্রত্যেক আয়াত তাঁর জন্য নাযেল হয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, যেখানে আদম এবং ইবলিসের কথা বলা হয়েছে সেখানে তার আপন অবস্থা বিশ্লেষণ করা উচিৎ আর নিজেকে প্রশ্ন করা উচিৎ যে, সে কি আদম না ইবলিস? আর একই রীতি সম্পূর্ণ কুরআনে অনুসরণ করা উচিৎ। এছাড়া কুরআনের রহস্য উম্মোচনের জন্য তার অব্যাহতভাবে দোয়া করে যাওয়া উচিৎ।

১৯০৩ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে কাদিয়ানে একজন নবাগত এভাবে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেনঃ আমি এবং আমার সাথী কাদিয়ানে প্রায় আসরের কাছাকাছি সময়ে পৌঁছি। আমাদেরকে মসজিদে আকসার দিকে পাঠানো হলো। নামাযের পর নামাযীরা একজন একান্ত সম্মানিত ব্যক্তি প্রদত্ত দরস শুনার জন্য হাতে কুরআন নিয়ে বৃত্তাকারে বসলেন। তিনি এমনভাবে কুরআনের একটি অংশ তেলাওয়াত এর মাধ্যমে আরম্ভ করলেন যা শ্রোতাদের উপর জাদুর মত প্রভাব বিস্তার করল এবং তাদের গভীরভাবে আন্দোলিত করল। তারপর তিনি তেলাওয়াতকৃত আয়াতগুলোর অর্থ ব্যাখ্যা করে এতে অন্তর্নিহিত দর্শন ও প্রজ্ঞার উপর আলোকপাত করেন। এমন ব্যাখ্যা আমি ইতিপূর্বে কখনও শুনিনি। আমার হৃদয় গভী���ভ��বে অভিভূত হলো, আমি পাশে বসা ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনিই কি প্রতিশ্রুত মসীহ্‌? তিনি বললেন না, ইনি মৌলভী নূরুদ্দীন। আমি হতভম্ব ছিলাম যে; যদি এই কামেল, শুধু শিষ্য হয়ে থাকেন, তাহলে গুরু কত মহান হবেন!

মৌলভী নূরুদ্দীন প্রায়ই বলতেন, আল্লাহ্‌ যদি জিজ্ঞেস করেন যে তুমি কি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করবে? উত্তরে তিনি তাঁর কাছে কুরআন চাইবেন।

হযরত চৌধুরী জাফরুল্লাহ খান সাহেবের পিতা তাঁর ওকালতী জীবনের শেষ প্রান্তে পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেছেন। তিনি যখন মৌলভী নূরুদ্দীনের কাছে এর উল্ল্যেখ করেন তিনি যারপরনাই আনন্দিত হন এবং উপস্থিত লোকদের সম্বোধন পূর্বক বলেনঃ নাসরুল্লাহ্‌ খাঁন মৌলভী নূরুদ্দীনকে এতটাই ভালবাসেন যে, তাঁর ভালবাসা লাভের জন্য তিনি নিজ স্মৃতিপটে সে গ্রন্থকে স্থান দিয়েছেন যাকে নূরুদ্দীন সবচেয়ে বেশি ভালবাসে; আর এভাবে নিজের জন্য নূরুদ্দীনের ভালবাসা পাওয়া নিশ্চিত করলেন।

তিনি কাশ্মীরের মহারাজার বিশেষ ও ব্যক্তিগত পরিচর্যাকারীদের উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআনের দরস দেয়ারও সুযোগ পেয়েছেন যা তারা গভীর ভাবে মূল্যায়ন করত। মহারাজার ভাই রাজা অমর সিং তার কাছে পবিত্র কুরআন শিখেছেন এবং তিনি তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন। মহারাজা নিজেও তাঁর কাছে প্রায় অর্ধেক কুরআনের অর্থ শিখেছেন।

একবার এক যুবরাজের বিয়ে উপলক্ষ্যে তাঁকে একটি দীর্ঘ সফর করতে হয়; একমাস দীর্ঘ সে সফরে নূরুদ্দীন প্রায় অর্ধেক কুরআন করীম মুখস্থ করে ফেলেন। একবার আরম্ভ করার পর যতক্ষণ পুরো কুরআন মুখস্থ হয়নি তিনি অত্যন্ত মনযোগ সহকারে মুখস্থ করা অব্যাহত রাখেন। এভাবে মৌলভী, হেকীম, হাজী নূরুদ্দীন হাফেজ্ব হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন।

মানুষ যখন খোদার সন্তুষ্টির জন্য কোন ত্যাগ স্বীকার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে খোদা সে আন্তরিকতার অকল্পনীয় ফল দিয়ে থাকেন । তিনি সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে মানুষের চিকিৎসা করে পয়সা নেবেন না; তাঁর এ পবিত্র সিদ্ধান্ত তাঁকে কাশ্মীরের রাজ চিকিৎসকের পদে উন্নীত করেছে।

একদিন সন্ধায় মহারাজার পক্ষ থেকে জরুরী ভিত্তিতে তাঁকে ডাকা হলো। যখন তিনি বের হতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখন এক মেথরাণী একান্ত আকুতি ভরা কন্ঠে তাঁকে সাথে গিয়ে তার ব্যথায় জর্জরিত স্বামীকে পরীক্ষা করার অনুরোধ জানান। তিনি মহারাজার বার্তাবাহককে বললেন আপনি যান এবং মহারাজাকে নিশ্চয়তা দিন যে, আমি এখনই আসছি। দূত আশ্চর্য হলো এবং বললো এক মেথর রাজার উপর প্রাধান্য পাবে! হাকিম সাহেবের কোন সন্দেহ ছিলনা যে দূত রাজার কাছে সে কথাই বলবে যাকে সে স্পর্ধা ভেবেছে। কিন্তু তাঁর মানবতাবোধ একজন তুচ্ছ মেথরের কষ্টকে কখনও উপেক্ষ করতে পারেনা। তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন রোগীর মারাত্মক কবজ (কোষ্টকাঠিন্য) হয়েছে। তিনি রোগীকে এনেমা দিলেন ফলে রোগী তখনই আরাম বোধ করলো। সে ব্যক্তি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল এবং এভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলঃ আল্লাহ্‌ আপনাকে অশেষ দানে ভূষিত করুন এবং তাঁকেও যিনি আপনাকে এখানে আমাদের নাগালের মাঝে রেখেছেন। এ দোয়া এমন হৃদয় নিংড়ানো ছিল যে হাকিম সাহেব নিশ্চিৎ ছিলেন, মহারাজার কষ্ট যাই হোক না কেন তিনি তা থেকে অবশ্যই আরোগ্য লাভ করে থাকবেন কেননা তাঁকেও এ কল্যাণের অংশ আখ্যা দেয়া হয়েছে।

তিনি যখন রাজ প্রাসাদে আসলেন দেখলেন যে ঘটনা অবিকল তাই, মহারাজার চিকিৎসার আর কোন প্রয়োজন ছিলনা। মহারাজা বিলম্বের হেতু জিজ্ঞেস করলে তিনি মহারাজাকে পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং বললেন যে, বেচারা মেথরের কল্যাণেই তাঁর কষ্ট দূরীভূত হয়েছে। মহারাজা তাঁর আচরণকে একজন সত্যিকারের চিকিৎসকসূলভ আচরণ আখ্যা দিয়ে তাঁকে দু’টো ভারী স্বর্নের কড়া (বালা) উপহার দিলেন। রাজ প্রাসাদ থেকে বের হবার পুর্বে তিনি সে দূতকে ডেকে তাকে একটি বালা উপহার দিলে সে বিষ্ময়াভিভূত হলো এবং পুরো ঘটনা জানতে চাইলো। উত্তরে তিনি বললেন, যদি আপনি মহারাজার কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ না করতেন তাহলে আমি এই বালা পেতাম না, সুতরাং একই কারণে আপনিও পুরস্কারের অংশীদার।

তিনি তাঁর রোগীদের মধ্যে কোন পার্থক্য করতেন না, ধনী-দরিদ্র সকলেই তাঁর সর্বোত্তম চিকিৎসা পেত আর এর সাথে তাঁর আন্তরিক দোয়াও অন্তর্ভুক্ত থাকতো। এক রাতে তাঁর কাছে এক ব্যক্তি আসেন যিনি স্ত্রী’র প্রসব বেদনার কারণে চরম উদ্বেগাকুল ছিলেন। তার ভয় ছিল, মহিলা হয়ত সকাল পর্যন্ত মারা যাবে। মৌলভী সাহেব তাকে ঔষধ দিয়ে সেবন বিধি বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, তিনি তার জন্য দোয়া করবেন এবং আরো বললেন, তাঁকে যেন রোগীর অবস্থা সম্পর্কে অবহিত রাখা হয়। রাতে সে মহিলা সম্পর্কে তাঁকে আর কিছু জানানো হয়নি। পরের দিন প্রত্যুষে তিনি সে মহিলার খবরা-খবর নেয়ার জন্য লোক পাঠালে মহিলার স্বামী হাস্যোৎফুল্ল চেহারায় তাঁর কাছে এসে বলে, তার ঘরে ফেরার এক ঘন্টা পর তার স্ত্রী নিরাপদে এক সন্তান প্রসব করে এবং নিশ্চিন্তে রাত্রি যাপন করে। হযরত মৌলানা সাহেব বললেন, আমাকে জানালেনা কেন? সে বলল মহাশয়, যেহেতু চিন্তার আর কোন কারণ ছিলনা তাই আমি রাতে আর আপনাকে বিরক্ত করা সমীচীন মনে করিনি। কষ্টের কথা বলছেন! আপনি কি জানেন, যখন আপনারা সবাই রাতের বাকী অংশ সুখঃনিদ্রায় অতিবাহিত করছিলেন সেখানে নূরুদ্দীন একটি বারও চোখ বন্ধ না করে সময়টি বেদনাঘণ দোয়ায় অতিবাহিত করছিল।

মানুষের সেবার কোন সুযোগ তিনি নষ্ট করতেন না। দিওয়ান লক্ষণ দাস কাশ্মীরের প্রধান মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর নির্দেশ জারী করেন যে, কেউ যেন তাঁর সাথে দেখা করতে ঘরে না আসে। তিনি পশ্‌তু ভাষা খুব পছন্দ করতেন তাই তাঁর সকল আরদলী পশ্‌তু ভাষাভাষী ছিল। কেউ তার সাথে ঘরে দেখা করতে আসলে তাঁর পাঠান চাকরগণ তাকে কোন ভব্যতা ছাড়াই বিদায় দিয়ে দিতো। এক সন্ধ্যায় শেখ ফাতেহ্‌ মোহাম্মদ সাহেব বললেন, প্রধান মন্ত্রীর সাথে তাঁর কিছু কাজ আছে কিন্তু তার পখতুন কর্মচারীদের কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ঘরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। তাঁর অতিথি হেকিম নূরুদ্দীন তাঁকে তখনই গিয়ে প্রধান মন্ত্রীর সাথে দেখা করার অনুরোধ করেন কিন্তু তিনি বললেন যে, তাঁর ঘরে কর্তব্যরত পখতুন আরদালিদের কারণে তিনি সাহস পাচ্ছেন না। তখন নূরুদ্দীন বললেন, তিনি এখনই প্রধান মন্ত্রীকে লিখবেন। মেজবান তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তিনি কাগজ কলম নিয়ে নিম্ন লিখিত পত্র লিখলেন।

আমি শুনেছি আপনি আপনার দর্শনার্থীদের তাড়িয়ে দেয়ার জন্য দরজায় শক্তিশালী পখতুন পাহারাদার নিযুক্ত করেছেন। নাগরিকরা রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে তাঁদের বাসভবনে দেখা করে থাকেন, দয়া করে আপনার দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে বাসভবনের একটি বড় কামরা ইরানী কার্পেটে সজ্জিত করুন। আপনার সুবিধানুসারে আপনি তাদের অভ্যর্থণা জানাতে পারবেন বা যার সাথে দেখা করার ইচ্ছা হবেনা তাকে আপনি না বলতে পারেন কিন্তু দর্শনার্থীদেরকে আপনার পখতুন পাহারাদারগণ এভাবে তাড়িয়ে দেবে তা আপনার মহান পদমর্যাদার পরিপন্থী।

তখনই চিঠি প্রেরণ করা হলো। অল্প সময়ের মধ্যেই দিওয়ান সাহেবের ব্যক্তিগত সচিব হারিকেন হাতে আসলেন এবং হেকিম নূরুদ্দীনকে বললেন, দিওয়ান সাহেব তাঁকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য পাঠিয়েছেন। এভাবে তাৎক্ষণিক ডাক পড়াতে শেখ ফাতেহ্‌ মোহাম্মদ কিছুটা শংকিত হলেন এবং তাঁকে রাতের এ প্রহরে যেতে বারণ করলেন, কিন্তু তিনি গেলেন। তিনি বাহিরে কোন পাহারদার দেখতে পেলেন না। দিওয়ান সাহেব তাঁ��ে হৃদ্যতাপূর্ণ অভ্যর্থনা জানালেন এবং বললেন, আপনি দেখে থাকবেন দরজায় কোন পাহারাদার নেই। আমি তাদের সকলকে বিদায় করে দিয়েছি। অমুক অমুক কামরা দর্শনার্থীদের জন্য ইরানী কা��্পেটে সজ্জিত করা হয়েছে ।

দর্শনার্থী সংক্রান্ত তাঁর প্রস্তাবের এত দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য ধন্যবাদ জানালে উত্তরে তিনি বলেন, একটি রাজ্যে আপনার মত মানুষের অনেক প্রয়োজন রয়েছে যারা পরিস্কার কথা বলতে জানে। আমি আপনাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি তাই এখন থেকে আর কাউকে ফিরিয়ে দেয়া হবেনা, আর আপনার জন্য কোন বিধি-নিষেধ নেই আপনি যখন ইচ্ছা আসতে পারেন।

হযরত মৌলানা নূরুদ্দীন (রাঃ) বলেন আমি সমসাময়িক লোকদের মধ্যে সবচেয়ে কামেল ব্যক্তির স্বাক্ষাতের জন্য ব্যাকুল ছিলাম যিনি ইসলামের সমর্থণে শত্রুদের মুখবন্ধ করার সকল যোগ্যতা রাখবেন। হেজাজ থেকে ফিরে এসে আমি চরম হতভম্ব ছিলাম। এক খোদা প্রেমিকের আহবানের অপেক্ষায় আমি একান্ত আকুল হয়ে সন্ধান অব্যাহত রাখি।

কাশ্মীরে একব্যক্তি কুরআন এবং হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে আপত্তি কর, যা ছিল হযরত নূরুদ্দীনের জন্য প্রচন্ড মর্মপীড়াদায়ক। কিছুদিন পর রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে কাদিয়ানের হযরত মির্যা গোলাম আহমদের একটি বিজ্ঞাপন দিলেন, যাতে উচ্চপদস্থ এক সরকারী কর্মকর্তার সকল আপত্তির যথাযথ উত্তর ছিল; তখনই সেটি নিয়ে তিনি তার কাছে যান এবং বলেন, নিন, ইনি এমন এক ব্যক্তি যিনি ওহী লাভের দাবী করেন এবং বলেন যে, আল্লাহ্‌ তাঁর সাথে কথা বলেন। একথার উত্তরে সে ব্যক্তি বলে যে, এটি ভেবে দেখার বিষয়।

হযরত মির্যা সাহেব সম্পর্কে তিনি বলেনঃ

এমতাবস্থায় আমি এমন এক মহা সম্মানিত ব্যক্তির আগমনের সংবাদ পেলাম যিনি একজন মহাজ্ঞানী পন্ডিত, শতাব্দীর মুজাদ্দেদ এবং যুগের মাহ্‌দী ও মসীহ্‌ এবং বারাহীনে আহ্‌মদীয়ার লেখক। কালক্ষেপণ না করে আমি স্বয়ং তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে গেলাম এবং তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলাম যে, তিনিই প্রতিশ্রুত হাকাম (মিমাংসাকারী) এবং তিনিই সে ব্যক্তি যাকে আল্লাহ্‌তা’লা ধর্মকে পুনঃর্জীবিত করার লক্ষ্যে নিযুক্ত করেছেন। আমি তৎক্ষণাৎ খোদার ডাকে সাড়া দিলাম এবং খোদার দরবারে এ মহান পুরস্কারের জন্য কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ সেজদা করলাম। হে মহাদয়ালু খোদা! সমস্ত প্রশংসা তোমার এবং তোমার অনুগ্রহের জন্য আমার বিনয়াবনত কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করো। আমি যুগের মাহ্‌দীর চরণে নিজেকে নিবেদন করলাম এবং আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে তাঁর হাতে বয়’আত করলাম। তাঁর স্নেহ ও অনুগ্রহ আমার উপর ছেয়ে গেল, আমি পুরো আত্মনিবেদনের চেতনা নিয়ে তাঁকে ভালবাসলাম। তিনি আমার সকল সম্পদ, আমার স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা, সকল আত্মীয়-স্বজন এবং আমার প্রাণের চেয়েও আমার কাছে বেশী প্রিয়। তাঁর জ্ঞান, পান্ডিত্য এবং আধ্যাত্মিক বোধ-বুদ্ধি আমার হৃদয়কে জয় করেছে। আমি খোদার কাছে একান্ত কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে এ ব্যক্তির পানে পথ প্রদর্শন করেছেন। এটি আমার সৌভাগ্য যে, আমি তাঁকে অন্য সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিয়েছি।

চাকুরী জীবনের অবসানের পর জম্মু থেকে তিনি ভেরা চলে গেলেন এবং সেখানে একটি বিশাল বাড়ী নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিলেন যা যুগপৎ তাঁর বাসস্থান এবং ক্লিনিকের কাজ দেবে। নির্মাণ কাজ চলাকালে কিছু নির্মাণ সামগ্রী ক্রয়ের জন্য তাঁকে লাহোর যেতে হলো। লাহোরে নিজ কাজ শেষে তিনি ভাবলেন, ভেরা গমন একদিন বিলম্বিত করে হযরত মির্যা সাহেবকে দেখার উদ্দেশ্যে কাদিয়ানের একটি সংক্ষিপ্ত সফর করা যেতে পারে। যেমন চিন্তা তেমন কাজ; তিনি কাদিয়ান পৌছলেন। তাঁর সাথে কথা বলার সময় হযরত মির্যা সাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি এখন অবসর আছেন? তিনি ইতিবাচক উত্তর দিলেন। তিনি ভাবলেন, আজই ফিরে যাবার অনুমতি নেয়া সমীচিন হবেনা। তারপর তিনি ভাবলেন, তাঁকে ফিরে যাওয়ার প্রোগ্রাম দু’দিন স্থগিত রাখা উচিত। পরের দিন হযরত সাহেব বললেন, আপনার দেখাশোনা করার জন্য মানুষ প্রয়োজন তাই আপনি আপনার স্ত্রী’কে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁর স্ত্রী’কে লিখলেন, তিনি যেন কাদিয়ান চলে আসেন আর সাথে একথাও বললেন, তাকে হয়ত কিছুদিন কাদিয়ান অবস্থান করতে হবে তাই নির্মাণ কাজ স্থগিত করে দেয়া হোক। তাঁর স্ত্রীর কাদিয়ান আসার পর একদিন হযরত সাহেব বললেন মৌলভী সাহেব, আপনি বই ভালবাসেন তাই ভেরা থেকে আপনার বই আনিয়ে নিতে পারেন। তিনি সে অনুসারে ব্যবস্থা নিলেন। কিছুদিন পরে তাঁকে বলা হলো যে, ভেরাকে এখন আর তার ঘর ভাবা উচিত হবেনা; এতে তার কিছু চিন্তা হলো। তিনি হয়ত পুনরায় ভেরা যাবেন

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে মে, ২০০৮ইং