হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

স্যার চৌধুরী মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান (রা.)

“এসেন্স অব ইসলাম” পুস্তকের সঙ্কলনের ভূমিকা থেকে অনুদিত

হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.) ১৮৩৫ খ্রীস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কাদিয়ান একটি প্রত্যন্ত গ্রাম ছিল। এটি লাহোর থেকে প্রায় ৭০ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। হযরত মির্যা সাহেবের পিতৃপুরুষ পারস্য বংশীয় ছিলেন এবং তাঁরা মধ্য এশিয়ার সমরখন্দ এলাকায় বসবাস করতেন। ১৬শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তাঁর পূর্বপূরুষ মির্যা হাদী বেগ পূর্ব সমরখন্দ থেকে ভারতবর্ষে শ’ দুয়েক অধীনস্থ কর্মচারীসহ আগমন করেন এবং পূর্ব পাঞ্জাবে বসতি স্থাপন করেন। যেহেতু মির্যা হাদী বেগ সম্রাট বাবরের দূর সম্পর্কের ভাই ছিলেন, তাই তাঁকে কাদিয়ান ও পাশ্ববর্তী শ’ খানেক গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এলাকার কাযী ও জমিদার নিয়োগ করা হয়। তখন সেই গ্রামটির
নামকরণ করা হয় ইসলামপুর কাযিয়ান। কালের পরিক্রমায় ইসলামপুর অংশটি বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং কাযিয়ান অংশটি থেকে যায় যা পরবর্তিকালে বিবর্তিত হয়ে কাদিয়ান নাম ধারণ করে।

মির্যা হাদী বেগের উত্তর পূরুষগণ কাদিয়ানে সমৃদ্ধি লাভ করেন এবং মোগল সম্রাটগণের রাজত্ব কালে এক প্রকার আধা-রাজকীয় মর্যাদা উপভোগ করতে থাকেন। ১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগে মোগল রাজ কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে আসলে কাদিয়ানের প্রধানদের অবস্থাও দুর্বল হতে থাকে। হযরত মির্যা গোলাম আহমদ এর বড় দাদা (দাদার পিতা) মির্যা গুল মোহাম্মদ, যিনি এক জ্যোতিঃমণ্ডিত পণ্ডিত ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি কাদিয়ানকে জ্ঞান চর্চার এক কেন্দ্র এবং আলেমদের এক আশ্রয়স্থলে পরিণত করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত দয়ার্দ্রচিত্ত ছিলেন এবং অনেকগুলো গ্রাম তিনি এমন সব ক্ষুদ্রতর মুসলমান জমিদারদের দিয়ে দেন যারা শিখদের দ্বারা নিজ জমিদারী থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, এ সময় কেন্দ্রীয় মোগল কর্তৃত্বের স্থলে শিখদের অবস্থান দৃঢ়তর হতে থাকে।

মির্যা গুল মোহাম্মদের পর তার পুত্র মির্যা আতা মুহাম্মদ তাঁর উত্তরাধিকার লাভ করেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় শিখদের দাপটে ক্রমাগতভাবে কাদিয়ান এস্টেটের অধীনস্থ এলাকা হাত ছাড়া হতে থাকে। পরিশেষে রামগড়িয়া শিখ সম্প্রদায় শঠতার আশ্রয় নিয়ে খোদ কাদিয়ান নিজ করতলগত করে ফেলে এবং মির্যা আতা মুহাম্মদ সপরিবারে কাদিয়ান থেকে নির্বাসিত হয়ে প্রতিবেশী রাজ্য কপুরথলায় আশ্রয় নেন। মির্যা আতা মুহাম্মদ কপুরথলায় নির্বাসিত অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তাঁর পুত্র মির্যা গোলাম মুর্তাযা তাঁর মরদেহ কাদিয়ানে নিয়ে এসে তাঁদের পারিবারিক গোরস্থানে অত্যন্ত
মর্যাদার সঙ্গে দাফন করেন।

মহারাজা রণজিত সিং যখন পাঞ্জাবের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তিনি হযরত মির্যা গোলাম আহমদ-এর পিতা মির্যা গোলাম মর্তুজাকে কাদিয়ানে প্রত্যাগমনের অনুমতি দেন এবং কয়েকটি গ্রাম ফিরিয়ে দেন যেগুলো ইতিপূর্বে কাদিয়ান এস্টেটের
অন্তর্গত ছিল।

হযরত মির্যা গোলাম আহমদের জন্মের সময় তাঁদের পারিবারিক অবস্থা কিছুটা উন্নতি লাভ করে এবং অন্তর্বর্তীকালীণ দারিদ্র্য ও বঞ্চনার যুগের অবসান ঘটে।

মির্যা গোলাম মুর্তাযা মহারাজা রঞ্জিত সিং এর অধীনে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং কয়েকটি অভিযানে তাঁর অবদানের জন্য স্বীকৃতি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি এবং তাঁর পুত্র মির্যা গোলাম কাদির ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতেও বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন যা তদানিন্তন কর্তৃপক্ষের নিকট সমাদৃত হয়। জীবনের বাকি অংশে মির্যা গোলাম মুর্তাযা সাবেক কাদিয়ান এস্টেটের যেসব গ্রামের উপর কর্তৃত্ব তারা হারিয়ে ছিলেন, সেগুলোর অন্তত কয়েকটি পুনরুদ্ধারের বৃথা ও অর্থহীন প্রচেষ্টায়
তাঁর অর্থ, সময় ও শক্তি নিয়োজিত করেন। তাঁর সকল প্রচেষ্টার ব্যর্থতা তাঁর জীবনকে তিক্ততায় পূর্ণ করেছিল এবং হতাশা বুকে নিয়েই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, মির্যা গোলাম কাদির, যিনি এরপর পরিবারের প্রধান হন, এর মধ্যে প্রায় আঠারো মাইল দূরে গুরুদাসপুর জেলা প্রশাসনে একটি সাধারণ চাকুরীতে নিযুক্ত হন।

শৈশব থেকেই হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.)-এর ঝোঁক ছিল ধর্মের দিকে আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ঝোঁক আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি যতই বড় হতে থাকেন, ধর্মচর্চা এবং ধর্মীয় বিষয়াবলী বিশেষত পবিত্র কোরআনের অধ্যয়নে বেশি থেকে বেশি সময় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তাঁর পিতা গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে তাঁর পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন এবং তিনি কোনো দিন স্কুলে যাননি। কৈশোর ও এরপর যৌবনে উপনীত হলে তাঁর পিতা বৈষয়িক বিষয়াদির দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে উদগ্রীব হন, যা ভবিষ্যৎ জীবনে তাঁর প্রয়োজন পড়তে পারে। কিন্তু এ প্রচেষ্টায় তিনি তেমন সফলতা লাভ করতে পারেননি। সন্তানসুলভ আনুগত্য ও পিতার প্রতি শ্রদ্ধার অনুভূতির কারণে, মির্যা গোলাম আহমদ (আ.) পূর্বপূরুষের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টার যে অংশ তাঁর পিতা তাঁর উপর ন্যস্ত করতেন তা সমাধা করার চেষ্টা করতেন। তবে এসবই তিনি নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে করতেন, কেননা বৈষয়িক বিষয়াদির প্রতি কোনো আকর্ষণ তাঁর হৃদয়ে ছিল না, তার হৃদয় প্রশান্তি পেতো না এতে।

একবার তাঁর পিতা তাঁর জন্য শিয়ালকোটে একটি সাধারণ প্রশাসনিক চাকুরীর ব্যবস্থা করেন। এটিও পিতার আনুগত্যের খাতিরে তিনি গ্রহণ করেন এবং যখনই তার পিতার মানসিকতা তাঁকে এ থেকে ইস্তফার সুযোগ করে দেয়, সেই প্রথম সুযোগেই তিনি পদত্যাগ করেন। তাঁর পিতার মৃত্যুকালীন অবস্থা তিনি এভাবে বর্ণনা করেন:

“যখন আমার পিতা ইন্তেকাল করেন, তখন আমার বয়স ৩৪ কি ৩৫। এক স্বপ্নে আমাকে সতর্ক করা হয়েছিল যে, তাঁর মৃত্যু আসন্ন। তখন আমি লাহোরে অবস্থান করছিলাম এবং দ্রুত কাদিয়ান প্রত্যাবর্তন করলাম। তিনি আমাশয়ে ভুগছিলেন কিন্তু, আমার এরূপ কোনো আশঙ্কা হয়নি যে তিনি পরের দিনই মৃত্যুবরণ করবেন। বরং তাঁর অবস্থার কিছু উন্নতিই পরিলক্ষিত হচ্ছিল এবং তাঁকে মনোবলের দিক থেকেও বেশ সুস্থ-সবলই মনে হচ্ছিল। পরের দিন দুপুরে আমরা সবাই তাঁর আশেপাশে ছিলাম যখন তিনি অত্যন্ত স্নেহভরে আমাকে খানিক বিশ্রাম নিতে বললেন, কেননা এটি ছিল জুন মাস এবং তাপ ছিল প্রচণ্ড। আমি উপর তলার এক কামরায় বিশ্রামের জন্য গেলাম এবং এক ভৃত্য আমার পা মালিশ করতে লাগলো। এমন সময় খানিকটা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আমার উপর ইলহাম অবতীর্ণ হল:

وَالسَّمَاءِ وَالطَّارِقِ

‘ওয়াস সামায়ে ওয়াত তারেক’

অর্থ: ‘সেই আগমনের কসম যেখান থেকে সকল ফয়সালা উৎসারিত এবং সেই ঘটনার কসম যা সূর্যাস্তের পর ঘটতে চলছে।’

আমার অন্তরে এ অনুভুতির উদ্রেক হয়েছিল যে এই বাণী সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে একটি শোকবার্তা বা সান্ত্বনাস্বরূপ ছিল। যেহেতু আমার পিতার মৃত্যু সে দিনই সূর্যাস্তের পর নির্ধারিত ছিল। সুবহানআল্লাহ্! (আল্লাহ্ তা’আলা অতীব পবিত্র)। কতো মহান সেই খোদা যিনি এমন এক ব্যক্তির মৃত্যুতে শোক বার্তা প্রেরণ করেন যিনি নিজ জীবনকে বৃথা নষ্ট হওয়ার আফসোস বুকে নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অনেকে আমার এ ব্যাখ্যায় অবাক হবেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। কিন্তু এটি স্মরণ রাখা উচিত যে, যখন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কারো সাথে অনুগ্রহের আচরণ করেন, তখন তিনি তার সাথে বন্ধুসুলভ ব্যবহার করে থাকেন। হাদীসের কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে যে কোনো বিশেষ অবস্থায় আল্লাহ্ তা’আলা হেসেছেন। এটিও তদনুরূপ অভিব্যক্তি।

যখন আমার উপর এই ইলহাম অবতীর্ণ হল, যা আমার পিতার মৃত্যুর পুর্বাভাস ছিল, তখন আমার মানবীয় দুর্বলতার জন্য এ চিন্তা আমার মনে উদ্রেক হল যে জীবিকা নির্বাহের কিছু উৎস, যা আমার পিতার নিকট ছিল, তা এখন বন্ধ হয়ে যাবে এবং আমরা হয়তো সমস্যাবলীর মধ্যে পড়বো। এমতাবস্থায় আমার উপর আরেকবার ইলহাম অবতীর্ণ হল:

أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ

‘আলায়সাল্লাহু বিকাফিন আব্দাহু’

অর্থ: ‘আল্লাহ্ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?’

এ ইলহাম আমাকে গভীরভাবে আশ্বস্ত করে ও সন্তুষ্ট করে এবং আমার অন্তরে দৃঢ়ভাবে স্থান করে নেয়। সর্বশক্তিমান খোদা যার হাতে আমার প্রাণ, এর কসম করে বলছি, তিনি এ আশ্বস্তকারী ইলহামের প্রতিশ্রুতি এমনভাবে পূরণ করেছেন যা আমার নিকট কল্পনাতীত ছিল। তিনি আমার সকল প্রয়োজন এমনভাবে পূরণ করেছেন যেমনটি কোনো পিতার পক্ষেও কারো জন্য করা সম্ভব নয়। আমি অবারিত ধারায় তার অনুগ্রহ ও আশীষ লাভ করেছি, যা আমার পক্ষে গণনা করা সম্ভব নয়।

আমার পিতা সেই দিনই সূর্যাস্তের পর মৃত্যুবরণ করেন। আর এটিই ছিল প্রথম দিন যে দিন আমি ইলহামের মাধ্যমে ঐশী অনুগ্রহের নিদর্শন লাভ করি, যার প্রভাব আমার জীবদ্দশায় কখনো নিঃশেষ হবে বলে আমি কল্পনা করতে পারি না। ইলহামের শব্দগুলো আমি মোটামুটি মূল্যবান একটি পাথরে খোদাই করে একটি আংটিতে বসিয়ে নিয়েছিলাম এবং তা আজও আমার নিকট যত্ন সহকারে সংরক্ষিত আছে। আমার জীবনের প্রায় চল্লিশটি বছর আমার পিতার ছায়ায় অতিবাহিত হয়েছিল, আর তাঁর ইহলোক ত্যাগের পর থেকে আমি নিরবচ্ছিন্ন ধারায় ঐশী ইলহাম লাভ করতে শুরু করলাম।”

(কিতাবুল বারীয়া, রূহানী খাযায়েন, ১৩ খণ্ড, পৃ: ১৯২-১৯৫, পাদটীকা)

এটি ছিল হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.)-এর ইলহাম লাভের প্রথম অভিজ্ঞতা। যেমনটি তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন, সে সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৪ কি ৩৫ বছর।

সময়ের অতিক্রমণের সাথে সাথে এরূপ অভিজ্ঞতা ক্রমাগত বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তা সংখ্যায় ও বিষয়াদির পরিসরে ব্যাপকতা লাভ করে। এর মধ্যে নিরাপত্তা, উন্নতি ও সমর্থনের পাশাপাশি সুমহান ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ ও ঐশী নিদর্শনাবলীও প্রকাশিত হতে থাকে।

পিতার মৃত্যুতে হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.) পিতার অর্ধেক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন, কিন্তু এর সম্পূর্ণ অংশের ব্যবস্থাপনা নিজ বড় ভাইয়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজে সেই যৎসামান্য অনাড়ম্বর জীবনোপকরণে সন্তুষ্ট হয়ে যান যা তাঁর ভাই তাঁর ভরণ-পোষণের জন্য প্রদান করতেন। ইহজগত তাঁর উদ্বেগের কেন্দ্র ছিল না, বরং তাঁর সর্বশক্তি ও মনোযোগ খোদা তা’আলার সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং সন্তুষ্টি অর্জনে নিবদ্ধ ছিল।

তাঁর পিতা অল্প বয়সেই তাঁকে বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু, সাংসারিক জীবনের দায়িত্বাবলীও তাঁকে সেই সাধনা থেকে দুরে সরাতে পারে নি যা তিনি নিজ জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে তাঁর দুই পুত্র হয়েছিল, মির্যা সুলতান আহমদ এবং মির্যা ফযল আহমদ। ঐশী দিক নির্দেশনা অনুসারে ১৮৮৪ সালে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন দিল্লীর এক সম্ভ্রান্ত সৈয়দ বংশে। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তিনি বেশ কয়েকজন সন্তান লাভ করেন। এর মধ্যে তাঁর মৃত্যু কালে তিন পুত্র ও দুই কন্যা জীবিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ জনের জন্ম ১২ই জানুয়ারি, ১৮৮৯ এবং তাঁর নাম রাখা হয় মির্যা বশির উদ্দিন মাহমুদ আহমদ। তাঁর জন্মের মধ্য দিয়ে তাঁর পিতার এক মহান ও বহুমুখী ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয় যা তিনি ২০ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ তে প্রকাশ করেছিলেন।

হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.)-এর ধর্মীয় অধ্যায়ন কেবল ইসলামের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। অল্প বয়সেই তিনি তদানীন্তন ভারতবর্ষে প্রচলিত ধর্মমতগুলোর অধ্যয়নে নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং এ অনুশীলন তাঁর অন্তরে ইসলামী শিক্ষাসমূহের অনুরাগ ও উপলব্ধিকেই গভীরতর করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তিনি ইসলামের সপক্ষে এক মহান পাহলোয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধের উপলব্ধির ঘাটতি, যা এমনকি মুসলমান আলেম সমাজের মধ্যেও বিদ্যমান ছিল, আর সাধারণভাবে মুসলমানদের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের মধ্যে ডুবে থাকা এবং ইসলামী শিক্ষাসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি তাকে অত্যন্ত মর্মাহত করতো।

তাঁর নিজ পরিবারেরই শাখা-প্রশাখা কুসংস্কারে ডুবে ছিল এবং সাধারণভাবে তারা ধর্ম ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও অনুশীলনের প্রতি বিদ্রুপাত্মক ছিল। তাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে ইসলামকে অস্বীকার করতো, আর নিজ অবিশ্বাসের মিথ্যা গরীমায় তারা রসূলুল্লাহ (সা.)-কে পর্যন্ত বিদ্রুপ করতো এবং পবিত্র কুরআনকে অবমাননাকর দৃষ্টিতে দেখতো। এ বিষয়টি হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.)-কে অত্যন্ত ব্যথিত করতো এবং যদিও তিনি বারংবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তাদেরকে ইসলাম, সর্বশক্তিমান খোদা, রসূলুল্লাহ (সা.) এবং পবিত্র কুরআনের নিষ্ঠাপূর্ণ আনুগত্যের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য, তাঁর এ প্রচেষ্টা তাঁর আত্মীয়-স্বজনের দৃষ্টিভঙ্গী ও আচার আচরণে সামান্য প্রভাবই বিস্তার করতে সমর্থ হয়। এ ইলহামটি তাঁকে আরো বিষণ্ণ করে:

ينقطع ابائک و يبدء منک

‘ইয়াকতা’উ আবা’আকা ওয়া ইউবদা’উ মিনকা’

অর্থ: তিনি (খোদা তা’লা) তোমার বংশের অন্যান্য শাখাকে কর্তন করবেন এবং তোমার মধ্য দিয়ে (তাঁর অনুগ্রহরাজিকে) জারি করবেন।

চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হতে হতে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের বিপরীতে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় এর পতাকাবাহী পাহলোয়ান হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করার এক অদম্য চেতনা তাঁর মনে স্থান করে নেয়, এবং অবশেষে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও এর শিক্ষাসমূহের কল্যাণরাজি বর্ণনা করে এক গ্রন্থ লেখার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন এবং এ যুগান্তকারী বইয়ের নাম রাখেন ‘বারাহীনে আহ্‌মদীয়া’। এ বইয়ের মুখবন্ধে তিনি ঘোষণা করেন যে, ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী যে কেউ বারাহীনে আহ্‌মদীয়া গ্রন্থে বর্ণিত যুক্তি ও দলিলসমূহের খণ্ডন করতে পারবে এবং ইসলামের সপক্ষে তিনি যে দলিলসমূহ পেশ করেছেন, তার এক-পঞ্চমাংশও নিজ ধর্মের সপক্ষে পেশ করতে পারবে, তাকে ১০,০০০ (দশ হাজার) রূপী পুরস্কার দেয়া হবে, যা সেই সময় হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.)-এর সাকুল্য সম্পত্তির মূল্যমান ছিল। শত বছর পেরিয়েও আজ অবধি কেউ এ চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে নি। বারাহীনে আহ্‌মদীয়া রচনাকালেই, যখন এর মাত্র তিন বা চার খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে, তাঁর উপর এ ইলহাম অবতীর্ণ হয় যে, খোদা তা’আলা তাঁকে হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হিসেবে প্রত্যাদিষ্ট করেছেন এবং ইসলামের পুনর্জাগরণের দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পণ করেছেন। তাঁর উপর প্রত্যাদিষ্ট দায়িত্বের সূত্র ধরেই ১৮৮৯ সালের ২৩শে মার্চ তিনি আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের ভিত্তি রচনা করেন। এর পরপরই তাঁর উপর ইলহামের মাধ্যমে এ সংবাদও অবতীর্ণ হয় যে, রসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক শেষ যুগের জন্য প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহ্‌দী তিনিই।

বারাহীনে আহ্‌মদীয়ার ১ম খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তা মুসলমানদের মধ্যে এক অসাধারণ ও অভূতপূর্ব কীর্তি রূপে স্বীকৃত হয় এবং শীর্ষস্থানীয় মুসলমান আলেমগণ, বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকী অত্যন্ত প্রশংসাসূচক বাক্যে এ মহান কর্মের গুণকীর্তন করে। এভাবে পরপর প্রকাশিত বারাহীনে আহ্‌মদীয়ার খণ্ডগুলোর বদৌলতে এর বিশিষ্ট লেখক সমসাময়িক ইসলামী জগতের সবচেয়ে সুপরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বের আসনে উপনীত হন।

প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহ্‌দী মনোনীত হওয়ার দাবী ঘোষণার সাথে সাথে সর্ব দিক থেকে অত্যন্ত তিক্ত ও অশ্রাব্য আক্রমণের এক ঝড় তাঁর উপর আপতিত হয়। তাঁকে ইসলাম ধর্মত্যাগী বা মুরতাদ ঘোষণা করা হয় এবং সব ধরনের নোংরা ও কুরুচিপূর্ণ উপমা তাঁর উপর আরোপ করা হয়। তাঁকে দাজ্জাল বলা হয় এবং ঘোষণা করা হয় যে, তাঁর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। মুসলমান আলেম সমাজের দৃষ্টিতে মহা সম্মানিত আসন থেকে অকস্মাৎ তিনি অধঃপতিত হন এবং তাঁর পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ বা ব্যাখ্যা তাঁদের বিরোধিতার কঠোরতা ও তিক্ততাকে প্রশমিত করতে ব্যর্থ হয়। তাঁর বাকি জীবনও এরূপই চলতে থাকে এবং এখন যদিও তাঁর মৃত্যুর শতবর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে তথাপি তথাকথিত আলেম সমাজের গলার সবচেয়ে ধারালো কাঁটা এখনো তিনি এবং তাঁর এই জামা’ত। এ জামা’তের সদস্যগণ সময়ে সময়ে অত্যন্ত কঠোর বিরোধিতার শিকার হন। কিন্তু, এ বিরোধিতা কেবল এ জামা’তের পরিচিতিকেই ব্যাপকতর করে, যার ফলস্বরূপ ক্রমাগত বেশি থেকে বেশি বিবেকবান ও চিন্তাশীল মানুষ এ জামা’তে যোগদান করতে থাকে।

হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.)-এর উপর শুরুর দিকে অবতীর্ণ ইলহামগুলোর অন্যতম হল:

میں تیری تبلیغ کو زمین کے کناروں تک پہنچاونگا

‘আমি তোমার প্রচারকে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে দিব।’

এ ইলহামের সময় এমনকি তাঁর নিজ এলাকাতেও তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল না আর প্রচার কার্যক্রমের সাধারণ উপকরণ ও সামর্থ্যও তাঁর ছিল না। সে সময়ে মানচিত্রগুলোতে কাদিয়ান চিহ্নিত থাকতো না এবং সেখানে কোনো টেলিগ্রাফ অফিসও ছিল না। প্রাদেশিক রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার সাথেও কাদিয়ান যুক্ত ছিল না, এমনকি কাদিয়ান যাওয়ার জন্য কোনো পাকা রাস্তা পর্যন্ত ছিল না। নিকটতম রেল স্টেশন ও টেলিগ্রাফ অফিস ১১ মাইল দূরে ছিল এবং সেখানে পৌঁছতে প্রায় ঘণ্টা তিনেকের সফর আবশ্যক ছিল। মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাব সত্ত্বেও আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের প্রচার শতাব্দীকাল ধরে বিস্তৃত হতে হতে পৃথিবীর দূরতম প্রান্তগুলোতে পৌঁছেছে এবং এ ভবিষ্যদ্বাণী অসাধারণভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে এবং এক অসাধারণভাবে এর বিভিন্নমুখী পূর্ণতা আমরা দেখে চলেছি।

হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.)-এর দাবীর বিরোধিতায় মূল আপত্তি যা পূর্বেও ছিল, এবং আজও আছে, তা হলো: পবিত্র কুরআনে রসূলুল্লাহ (সা.)-কে খাতামান নাবীঈন [৩৩:৪১] বলা হলেও তিনি [মির্যা সাহেব] নবী দাবী করেছেন, যা এর পরিপন্থী। তাঁর দাবী উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ভুলভাবে উপস্থাপন করা থেকেই এ আপত্তির উদ্ভব। প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা নবুওয়তকে শরীয়তধারী নবীর মধ্যে সীমিত করে তাঁর বিরোধিতা করেছে এই বলে যে, তিনি এরূপ (শরীয়তধারী) নবুওয়তের দাবী করেছেন। এ আপত্তির বিপরীতে বারবার এবং জোরালোভাবে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। বারংবার তিনি ঘোষণা দেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে তিনি এর বিস্তৃততম ও সবচেয়ে উচ্চাঙ্গীন অর্থে খাতামান নাবীঈন বলে পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখেন, এবং তাঁর নিজের নবুওয়তের দাবীর অর্থ কেবল এটুকুই যে, তিনি বহুল সংখ্যায় আল্লাহ্‌র সাথে বাক্যালাপের সৌভাগ্যে ভূষিত হয়েছেন; এবং তিনি নতুন কোনো শরীয়ত আনেন নি বরং তিনি সম্পূর্ণভাবে কুরআনের অনুগত এবং রসূলুল্লাহ (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের ফলে এবং তাঁর মধ্যে নিজেকে বিলীন করে তাঁরই প্রতিভূ হওয়ার কারণেই আল্লাহ্ তা’লা ঘন ঘন বাক্যালাপের সৌভাগ্য তাঁকে দান করেছেন। এ বিষয়টি তাঁর লেখনী থেকে নেয়া নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিগুলো থেকে স্পষ্ট হয়:

زعشاق فرقان و پیغمبریم
بدیس آمدیمو بدیں بگزریم

যু আশ্‌শাকে ফুরকান ও পয়গম্বরীম
বদেস আমদীম ও বদেস বুগযরীম

অর্থ: আমরা তাঁদেরই অন্তর্ভূক্ত যাঁরা কুরআন ও রসূল (সা.)-এর প্রেমিক;
এ পথেই আমরা এতোদুর এসেছি আর এ পথই আমরা সর্বদা অনুসরণ করবো।

আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের সারাংশ ও সারমর্ম হলো: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’। এই পার্থিব জীবনে আমরা যা বিশ্বাস করি এবং আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় ও তাঁরই প্রদত্ত তৌফিকে যা নিয়ে আমরা এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করবো তা হলো: আমাদের সম্মানিত নেতা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) হলেন খাতামান নাবীঈন ও খায়রুল মুরাসালীন যাঁর মাধ্যমে ধর্ম পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে এবং যে নেয়ামত দ্বারা সত্যপথ অবলম্বন করে মানুষ আল্লাহ্ তা’লা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে তা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস রাখি যে, কুরআন শরীফ শেষ ঐশী গ্রন্থ এবং এর শিক্ষা, বিধান, আদেশ ও নিষেধের মাঝে এক বিন্দু বা কণা পরিমাণ সংযোজনও হতে পারে না। এখন আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে এমন কোনো ওহী বা ইলহাম হতে পারে না যা পবিত্র কুর’আনের আদেশাবলীকে সংশোধন বা রহিত করতে কিংবা কোনো একটি আদেশকেও পরিবর্তন করতে পারে।

যদি কেউ এমন মনে করে তবে আমাদের মতে সে ব্যক্তি বিশ্বাসীদের জামা’ত বহির্ভূত, ধর্মত্যাগী ও কাফির। আর এও আমাদের বিশ্বাস যে, সীরাতুল মুস্তাকীমের উচ্চমার্গে উপনীত হওয়া তো দুরের কথা, কোনো মানুষ আমাদের নবী (সা.)-এর সত্যিকার ও পূর্ণ অনুসরণ ছাড়া কোনো ধরনের আধ্যাত্মিক সম্মান ও উৎকর্ষ কিংবা মর্যাদা ও নৈকট্য লাভ করতেই পারে না। যা কিছু আমাদের উপর বর্ষিত হয়েছে তা কেবল রসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতিফলন হিসেবে ও তাঁর মাধ্যমেই আমরা লাভ করেছি।

(ইযালা-এ-আওহাম, রূহানী খাযায়েন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৬৯-১৭০)

যে পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত এগুলোতেই আমাদের ঈমানের। আর খোদার যে কালাম, অর্থাৎ কুরআনকে আঁকড়ে ধরার আদেশ রয়েছে আমরা সেটিকেই আঁকড়ে ধরি। ফারুক (রা.) [হযরত উমর (রা.)]-এর ন্যায় আমাদের ঘোষণা ‘হাসবুনা কিতাবুল্লাহ’ (আল্লাহ্‌র কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট), এবং আয়েশা (রা.)-র ন্যায় যখন কুরআন ও হাদীসের মধ্যে বিরোধ দেখা যায়, তখন আমরা কুরআনকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আমরা এই কথার উপর ঈমান রাখি যে, খোদা তা’লা ব্যতীত কোনো মা’বুদ নেই এবং সৈয়্যদনা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম তাঁর রসূল ও খাতামুল আম্বিয়া। আমরা ফিরিশতা, মৃত্যুর পর পুনরুত্থান, কিয়ামত, বেহেশ্ত ও দোযখে বিশ্বাস রাখি। আমরা ঈমান রাখি যে, কুরআন শরীফে আল্লাহ্ তা’লা যা বলেছেন এবং আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম হতে যা বর্ণিত হয়েছে উল্লিখিত বর্ননানুসারে তা যাবতীয় সত্য। আমরা ঈমান রাখি, যে ব্যক্তি এই ইসলামী শরীয়ত হতে বিন্দু মাত্র কম করে, অথবা যে বিষয়গুলি অবশ্যকরণীয় বলে নির্ধারিত তা পরিত্যাগ করে এবং অবৈধ বস্তুকে বৈধকরণের ভিত্তি স্থাপন করে, সে ব্যক্তি বে-ঈমান এবং ইসলাম বিদ্রোহী। আমি আমার জামা’তকে উপদেশ দিচ্ছি যে, তারা যেন বিশুদ্ধ অন্তরে পবিত্র কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’ -এর উপর ঈমান রাখে এবং এই ঈমান নিয়ে মরে। কুরআন শরীফ হতে যাদের সত্যতা প্রমাণিত, এমন সকল নবী (আলায়হিমুস সালাম) এবং কিতাবের উপর ঈমান আনবে। নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত এবং এতদ্ব্যতীত খোদা তা’লা এবং তাঁর রসূল কর্তৃক নির্ধারিত যাবতীয় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে নিষিদ্ধ মনে করে সঠিকভাবে ইসলাম ধর্ম পালন করবে। মোট কথা, সে সমস্ত বিষয়ের উপর আকিদা ও আমল হিসেবে পূর্ববর্তী বুযুর্গানের ‘ইজমা’ অর্থাৎ সর্ববাদি-সম্মত মত ছিল এবং সে সমস্ত বিষয়কে আহ্‌লে সুন্নত জামা’তের সর্ববাদি-সম্মত মতে ইসলাম নাম দেয়া হয়েছে তা সর্বতোভাবে মান্য করা অবশ্য কর্তব্য। আমরা আসমান ও যমীনকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, এটিই আমাদের ধর্মবিশ্বাস।

(আইয়ামুস সুলেহ, রূহানী খাযায়েন, ১৪ খণ্ড, পৃ. ৩২৩)

আমি আল্লাহ্ তা’লাকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমি কাফির নই। আমি বিশ্বাস করি যে,

لاالہ الا اللہ محمد رسول اللہ

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ

আল্লাহ্ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ্‌র রসূল।

আমি রসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে বিশ্বাস করি যে,

وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ

ওয়া লাকির রাসূলুল্লাহে ওয়া খাতামান নাবীঈন

কিন্তু তিনি আল্লাহ্‌র রসূল এবং খাতামান নাবীঈন।

যেমন সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা’লার নামসমূহ, এবং যেমন পবিত্র কুর’আনের শব্দসমূহ এবং যেমনটি সেই সকল পূর্ণাঙ্গতা বা শ্রেষ্ঠত্বসমূহ যা আল্লাহ্‌র বিচারে রসূলুল্লাহ (সা.) লাভ করেছেন এমন গুরুগম্ভীর কসমের সাথে আমি ঘোষণা করছি যে, আঁ-হযরত (সা.)-এর উপর আমার ঈমান রয়েছে। আমার ধর্ম বিশ্বাসের কোনো অংশ আল্লাহ্ তা’লা এবং তাঁর রসূল (সা.)-এর আদেশের পরিপন্থী নয়। যদি কেউ এরূপ ধারণা করে থাকে, তবে নিশ্চয় তা তার ভুল বুঝার ফল। যে কেউ আমাকে এর পরও কাফির গণ্য করে, এবং আমাকে কাফির অভিহিত করা থেকে বিরত হয় না, তার স্মরণ রাখা উচিত যে, মৃত্যুর পরে এর জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। সর্বশক্তিমান খোদা তা’লা সাক্ষী যে, খোদা তা’লা এবং তাঁর রসূল (সা.)-এর উপর আমার ঈমান এতোটাই দৃঢ় যে, যদি এ যুগের সকলের ঈমানকে এক পাল্লায় রেখে আমার ঈমানকে আরেক পাল্লায় রাখা হয়, তবে আল্লাহ্‌র ফযলে আমার ঈমান ভারী সাব্যস্ত হবে।

(কারামাতুস সাদেকীন, রূহানী খাযায়েন, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৬৭)

আমার শিক্ষার সারাংশ এই যে, খোদাকে এক ও অদ্বিতীয় জ্ঞান কর এবং খোদা তা’লার বান্দাদের জন্য সহমর্মিতার অনুভূতি অবলম্বন কর। আর সদাচরণকারী ও সৎ চিন্তার ধারণকারী মানুষ হয়ে যাও। এমন হয়ে যাও যেন কোনো বিশৃঙ্খলা ও অশিষ্ট আচরণের কোনো কিছু তোমাদের নিকটেও আসতে না পারে। মিথ্যা বলা পরিত্যাগ করো, আর বানোয়াট কথা বলা থেকে বিরত হও, আর নিজ জিহ্বা বা হাত দিয়ে কাউকে কষ্ট দিও না।

প্রত্যেক প্রকারের গুনাহ থেকে দুরে থাকো, আর নিজ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখো। পবিত্র ও পাপমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করো। … কাম্য যে সমগ্র মানব জাতির প্রতি সহানুভূতি তোমার মূলনীতি হয়ে যাক। আর নিজ হস্ত, জিহ্বা ও চিন্তাকে প্রত্যেক অপবিত্র পরিকল্পনা ও বিশৃঙ্খলার পথ অবলম্বন ও অবিশ্বস্ততা থেকে রক্ষা করো। সর্ব প্রকার অন্যায়, সীমালঙ্ঘন, অসততা, ঘুষ, অন্যায়ভাবে অন্যের অধিকার হরণ, স্বজনপ্রীতি থেকে বিরত থাকো। অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ করো। কুদৃষ্টি থেকে নিজ চক্ষুকে রক্ষা করো। আর কর্ণকে গীবত শ্রবণ থেকে দূরে রাখো।

আর কোনো ধর্মের বা কোনো জাতির বা কোনো শ্রেণীর কোনো মানুষের অমঙ্গল বা ক্ষতি সাধনের আকাংখা করো না। আর প্রত্যেকের জন্য সদুপদেশ দানকারী হয়ে যাও। আর এমন যেন হয় যে, বিশৃঙ্খলাকারী, দুষ্ট, বদমায়েশ ও অসদাচরণকারী লোকেরা কখনো তোমার সঙ্গী না হয়। প্রত্যেক পাপ থেকে বাঁচো, আর প্রত্যেক নেকী অর্জনের প্রয়াসী হও। তোমাদের অন্তঃকরণ যেন ধোঁকা থেকে মুক্ত হয়। আর তোমাদের অন্তরে কখনো পাপকর্ম ও বিদ্রোহের পরিকল্পনার উদ্রেক যেন না হয়।

আর সেই খোদাকে চেনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করো যার সন্ধান লাভের মধ্যে আমাদের নাজাত, যার সান্নিধ্য লাভ করাই চূড়ান্ত মুক্তি। সেই খোদা কেবল তাঁরই নিকট প্রকাশিত হন, যিনি হৃদয়ের স্বচ্ছতা ও আন্তরিক ভালবাসা নিয়ে তাঁর হৃদয়ে অবতীর্ণ হন, যিনি পরিপূর্ণরূপে তাঁর হয়ে যান। যে হৃদয় পবিত্র, সেই হৃদয়ই তাঁর সিংহাসন, আর সেই জিহ্বা যা মিথ্যা, কটু ও বৃথা বাক্য থেকে মুক্ত, তাঁর ঐশীবাণী অবতরণের স্থান হয়ে যায়। প্রত্যেক এমন ব্যক্তি যিনি তাঁর সন্তুষ্টিতে বিলীন হন, তাঁর অলৌকিক শক্তির বিকাশস্থল হয়ে যান।

(কাশফুল গিতা, রূহানী খাযায়েন, ১৪ খণ্ড, পৃ. ১৮৭-১৮৮)

স্মরণ রাখো, আমাদের ধর্মবিশ্বাস এই যে, পবিত্র কুরআন শেষ কিতাব ও শেষ শরীয়ত, এবং এরপর কিয়ামত পর্যন্ত এ অর্থে কোনো নবী নেই যিনি শরীয়তধারী হবেন অথবা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুবর্তিতার মাধ্যম ব্যতীত অন্য কোনো পথে ওহী লাভ করতে পারেন। বরং কেয়ামত পর্যন্ত এ দ্বার রূদ্ধ হয়ে গেছে আর নবী (সা.)-এর অনুবর্তিতার মাধ্যমে ওহীর নেয়ামত লাভের দরজা কেয়ামত পর্যন্ত খোলা আছে। সেই ওহী যা [রসূলুল্লাহ (সা.)-এর] অনুবর্তিতার ফল তার ধার কখনো ছিন্ন হবে না। কিন্তু, শরীয়তধারী নবুওয়ত বা স্বাধীন নবুওয়তের ধারা ছিন্ন হয়ে গেছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত এ দ্বার উন্মূক্ত হবে না। যে বলে যে, সে মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুবর্তী নয়, আর শরীয়তধারী নবী বা এ উম্মতের বাইরে শরীয়তবিহীন নবী হওয়ার দাবী করে, তার উপমা এমন ব্যক্তির ন্যায় যাকে এক প্লাবনে শক্তিশালী স্রোত ভ্রান্ত পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে যা থেকে মৃত্যুর পূর্বে উদ্ধার পাওয়ার তার কোনো পথ নেই।

(রিভিউ বর মুবাহাসা বাটালভী ও চক্রালভী, রূহানী খাযায়েন, ১৯ খণ্ড, পৃ. ২১৩)

এ মূলনীতি অত্যন্ত প্রিয় ও শান্তির পথ প্রশস্তকারী, এবং পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তি রচনাকারী এবং নৈতিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক যে, আমরা ধরাপৃষ্ঠে আগমনকারী সকল নবীকে সত্য বলে মেনে নিই। তারা ভারতবর্ষেই এসে থাকুন না কেন, বা পারস্যদেশে বা চীনে বা অন্য কোনো দেশে, খোদা তা’লা কোটি কোটি হৃদয়ে তাঁদের সম্মান ও মাহাত্ম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আর তাদের ধর্মমতের শিকড়কে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আর বহু শতাব্দী ধরে তাদের ধর্ম পালিত হয়ে আসছে। এটিই সেই নীতি যা কুরআন আমাদের শিখিয়েছে। এ নীতির অনুসরণেই আমরা প্রত্যেক এমন ধর্মের যা এ শর্ত পূরণ করে (অর্থাৎ শত শত বছর ধরে প্রচলিত) -এর প্রবর্তকদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকি, তা হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক হোক, বা পারসী (যরথুস্ত্রীয়)-দের বা চীনাদের ধর্মের বা ইহুদীদের বা খ্রিস্টান হোক না কেন।

(তোহফা কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন, ১২ খণ্ড, পৃ. ২৫৯)

প্রত্যেক নবীর সত্যতা তিনভাবে বুঝা যায়:

প্রথমত, যুক্তির মাধ্যমে, অর্থাৎ দেখা উচিত, সেই নবী বা রসূল যখন আসলেন তখন সুস্থ্য বিবেকের সাক্ষ্য কী? তখন তাঁর আসার আদৌ প্রয়োজন ছিল, কি ছিল না? আর মানুষের এমন সময় কোনো সংশোধনকারীর জন্ম নেয়ার প্রয়োজন – বর্তমান অবস্থা এটা দাবী করে নাকি করে না।

দ্বিতীয়ত, পূর্ববর্তী নবীদের ভবিষ্যদ্বাণী, অর্থাৎ দেখা উচিত, পূর্বের কোনো নবী তাঁর পক্ষে বা তাঁর যুগে কারো আবির্ভূত হবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন কিনা?

তৃতীয়ত, ঐশী সাহায্য এবং আসমানী নিদর্শন, অর্থাৎ দেখা উচিত, তাঁর পক্ষে স্বর্গীয় সমর্থন রয়েছে কি?

এ তিনটি লক্ষণ আল্লাহ্‌র সত্য প্রত্যাদিষ্টকে চেনার জন্য আদি থেকে নির্ধারিত। এখন হে বন্ধুগণ, খোদা তা’লা তোমাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে এ তিনটি লক্ষণ আমার সত্যায়নের উদ্দেশ্যে এক স্থানে একত্র করে দিয়েছেন। এখন ইচ্ছা হলে গ্রহণ কর, না হয় প্রত্যাখ্যান কর।

(লেকচার শিয়ালকোট, রূহানী খাযায়েন, ২০ খণ্ড, পৃ. ২৪১)

প্রথম থেকেই আমার দৃষ্টিভঙ্গী এই যে, আমার দাবীকে অস্বীকার করার কারণে কেউ কাফির বা দাজ্জাল সাব্যস্ত হতে পারে না। হ্যাঁ, এমন ব্যক্তি অবশ্যই ভ্রান্তিতে এবং সঠিক পথ থেকে বঞ্চিত। আর আমি এমন ব্যক্তিকে অবিশ্বাসী বলে অভিহিত করি না। হ্যাঁ, আমি অবশ্যই এমন ব্যক্তিকে ভ্রান্তিতে নিপতিত এবং সত্য পথ ও এর কল্যাণ থেকে দূরে বলে মনে করি যারা সেই সত্যকে অস্বীকার করে যা খোদা তা’লা আমার উপর উন্মোচন করেছেন। সন্দেহ নেই যে, আমি এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে ভ্রান্তির অন্ধকারে নিমজ্জিত বলে মনে করি যারা ন্যায় ও সততা থেকে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু, কলেমা পাঠকারী কাউকে আমি কখনো কাফির অভিহিত করি না যতক্ষণ না আমাকে অস্বীকার করা এবং আমাকে কাফির অভিহিত করার ফলস্বরূপ সে নিজের উপর কাফির নাম আরোপ না করে। এ ক্ষেত্রে সর্বদা সূচনা আমার বিরুদ্ধবাদীরা করেছে। তারা আমাকে কাফির বলে অভিহিত করেছে। আমার জন্য ফতওয়া প্রস্তুত করেছে। আমি উপযাজক হয়ে কখনো তাদের জন্য কোনো ফতওয়া প্রস্তুত করি নি। আর তারা নিজেরা এ কথার সাক্ষ্য দিতে পারবে যে, যদি আল্লাহ্ তা’লার দৃষ্টিতে আমি মুসলমান হয়ে থাকি, তাহলে তাদের বিষয়ে রসূলুল্লাহ (সা.)-এর ফতওয়া এই যে, তারা নিজেরাই কাফির। সুতরাং আমি তাদেরকে কাফির বলি না; বরং তারা নিজেরাই আমাকে কাফির বলে রসূলুল্লাহ (সা.)-এর ফতওয়ার অধীনে পড়ে যায়।

(তিরিয়াকুল কুলূব, রূহানী খাযায়েন, ১৫ খণ্ড, পৃ. ৪৩২-৪৩৩)

হযরত মির্যা গোলাম আহমদ, প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহ্‌দী (আ.) তাঁর পুরো জীবন ইসলামের সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন। ২৬ মে, ১৯০৮ লাহোরে তিনি ইন্তেকাল করেন। এর পূর্বের দিন বিকাল পর্যন্ত তিনি একটি প্রবন্ধের রচনা কাজে ব্যস্ত ছিলেন যার উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশের মুসলমান ও অমুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য একটি নীতিমালা প্রদান করা, এবং যার নামকরণ তিনি করেন পয়গামে সুলেহ (শান্তির বাণী)

তিনি উর্দু, আরবী ও ফারসীতে আশির অধিক পুস্তক রচনা করেন, যেগুলোতে বহু শতাব্দীর অধঃপতনে এর মধ্যে যে সংযোজন ও হস্তক্ষেপ হয়েছে তা থেকে মুক্ত করে ইসলামী শিক্ষাসমূহকে পবিত্র কুরআন ও রসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ্‌র ভিত্তিমূলে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর লেখনী ও বক্তৃতাতে সেই নবজীবন দানকারী দর্শনকেও তুলে ধরেছেন যা পবিত্র কুর’আনের প্রতিটি আদেশ-নিষেধের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে, এবং যা বস্তুত সেই দিকনির্দেশনা যা তাঁর আগমনে সূচিত এ ক্রান্তিলগ্নে মানবজাতির জন্য প্রয়োজন।