সফরে এবং অসুস্থতায় রোযা পালন সম্পর্কিত নির্দেশনা


সংকলন: রইস আহমদ, মুরব্বী সিলসিলাহ্

ইসলাম ধর্ম হচ্ছে প্রাকৃতিক এবং এর সমস্ত বিধি বিধান পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের ফিতরত এবং চরিত্রের দিকে দৃষ্টি রেখে সন্নিবেশিত রেখে আল্লাহ্ তাআলা কুরআন করীমে বর্ণনা করেছেন। আর যার ব্যাখ্যা আঁ হযরত (সা.) এর বর্ণনাতে পাওয়া যায় আর অপর দিকে তিনি (সা.) তাঁর সুন্নত দ্বারা সেই বিধি বিধানের উপর আমল করে দেখিয়েছেন। আঁ হযরত (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ যিল্লী হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) নিজের বর্ণনা এবং নিজের জীবনে আঁ হযরত (সা.)-এর সুন্নতের উপর আমল করে আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন।

রোযা সম্বন্ধে আঁ হযরত (সা.)-এর সমস্ত নির্দেশ হাদীসে আছে। যার উপর তিনি আমল করেছেন এবং আমল করিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে, সাধারণ মানুষ এই বিধিবিধান ছেড়ে দিয়ে নিজের উপর এমন বোঝা নিয়েছে যেটা কুরআন এবং হাদীসের বিরোধী। যার মধ্যে আছে সফরে অথবা অসুস্থ অবস্থায় রোযা রাখোনা, সাবালক হওয়ার আগে শিশুদের রোযা রাখানো, গর্ভবতী এবং স্তনদানকারী মহিলাদের রোযা রাখা এর মধ্যে শামিল। আশ্চর্যজনক কথা অধিকাংশ আলেমধারী লোক সাধারণ মানুষকে শুধু এই জন্য এই ধারণা থেকে বাধা দেন না যে কোথাও যেন তাদের সম্মান না যায়। বিশেষ করে গয়ের আহ্‌মদীদের মধ্যে বংশ পরাম্পরায় ইসলামের শিক্ষার বিরুদ্ধে এই শিক্ষা জারী আছে। আল্লাহ্ তাআলার শুকুর যে, হযরত আকদাস মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী মসীহ্ মাহদী মাওউদ (আ.) হাকামান এবং আদালান হয়ে এসেছেন এবং তিনি এই সমস্ত অ-স্বভাবজাত এবং অপ্রয়োজনীয় বোঝা থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দিয়েছেন। রোযার আয়াতে আল্লাহ্ জাল্লাশানুহু কুরআন মজিদে বলেছেন,

“ইয়ুরিদুল্লাহ্ বিকুমুল ইয়ুসরা ওয়ালা ইয়ুরিদু বিকুমুল উসরা”।

অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা তোমাদের জন্য সহজ চান আর তোমাদেরকে কষ্টে ফেলতে চান না।

কিন্তু আফসোসের কথা যে রোযা সম্পূর্ণভাবে রহমত, মুসলমানরা অজ্ঞানতা এবং মূর্খতার দরুন কষ্টদায়ক বানিয়ে নিয়েছে। কিছু লোক তো এই সম্বন্ধে এত শিথীলতা করেছে যে, তাদের রমযানের কোন পরওয়া নাই। রমযানুল মোবারক মাস আসে আর তার ফজল ও রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করে চলে যায়। কিন্তু তাদের খবর পর্যন্ত থাকে না যে, রমযান আসলো এবং চলে গেল। আর কিছু লোক এর মধ্যে কট্টরতা অবলম্বন করে। সমস্ত রোযাকে তারা ইসলাম মনে করে। আর সমস্ত অসুস্থ, দুর্বল, বৃদ্ধ, গর্ভবতী, স্তনদানকারী এবং শিক্ষার্থীর জন্যও তারা বিশ্বাস রাখে যে, তারা যেন অবশ্যই রোযা রাখে। যদিও অসুস্থতা বেড়ে যায় অথবা স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।

ইসলাম ফিতরতের ধর্ম। কখনই এর উদ্দেশ্য এই নয় যে, মানূষকে তার সফলতার পথ থেকে সরিয়ে দিবে। এর কারণ এটাই যে, ইসলাম নিজের কিছু বিধি বিধানের এমন কিছু শর্ত নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, যদি এই শর্ত কারো মধ্যে পাওয়া যায় তবে সে যেন এই হুকুমের উপর আমল করে আর যদি না পাওয়া যায় তবে যেন না করে। যেমন হজ্জ যাকাত ইত্যাদির বিধি বিধান। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলা বলেন,

“ওয়া মান কানা মিনকুম মারিজান আও আলা সাফারিন ফা ইদ্দাতুম মিন আইয়্যামিন উখার ইয়ুরিদুল্লাহা বিকুমুল ইয়ুসরা ওয়ালা ইয়ুরিদু বিকুমুল উসরা”। (সূরা বাকারা: ১৮৬)

অর্থাৎ, আর যে অসুস্থ অথবা মুসাফির হয় তা হলে সে যেন অন্য দিন গণনা পূর্ণ করে। আর আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ চান কঠিন চান না।

অসুস্থ এবং মুসাফিরদের রোযা রাখার বিধি বিধান সম্বন্ধে এই যুগের হাকামান আদালান সৈয়্যদনা হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) বলেন,

যে ব্যক্তি অসুস্থ এবং মুসাফির অবস্থায় রোযা রাখে সে খোদা তাআলার স্পষ্ট হুকুমের অস্বীকার করে। খোদা তাআলা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন অসুস্থ এবং মুসাফির যেন রোযা না রাখে। অসুস্থ সুস্থ হলে, মুসাফির সফর শেষ হলে রোযা রাখবে। খোদার এই হুকুমের উপর আমল করা উচিত কেননা নাজাত ফজলের ফলে হয়। নিজের আমলের জোর দেখিয়ে কেউ নাজাত পেতে পারে না। খোদা তাআলা এটা বলেন নি যে, অসুস্থতা ছোট অথবা বড় আর সফর ছোট অথবা বড় বরং হুকুম সাধারণ ভাবে। আর এর উপর আমল করা উচিত। অসুস্থ এবং মুসাফির যদি রোযা রাখে তাহলে তার উপর আদেশ ভঙ্গের ফতওয়া অবশ্যই লাগবে। (বদর, ১৭ অক্টোবর ১৯০৭, ফিকাহ্ আহ্‌মদীয়া ২৯০)

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.) বলেন,

রমযান মাসে সফর করা অবস্থায় রোযা রাখা প্রকৃত পক্ষে যদি আপনারা গভীরভাবে চিন্তা করেন তবে দেখবেন এতে নেকী নাই। কেননা মানুষ রমযান মাসে সহজভাবে রোযা রাখে আর যদি রমযানের পরে রোযা আলাদা ভাবে রাখতে হয় তবে বুঝা যায় যে, কঠিন কাজ ছিল। কিছু লোক নেকীর বাহানায় সহজ চায়। আর বলে যে, রোযাকে টালবাহানা করে যতগুলো চলে যায় যাক তা না হলে পরে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হবে। তো যাই হোক আল্লাহ্ অন্তরকে জানেন এই জন্য আল্লাহকে ধোকা দেওয়া যাবে না।

হুযূর (রাহে.) আরো বলেন,

আপনি দ্বিতীয়বার বিশ্লেষণ করে দেখেন আপনি এটা জানতে পারবেন যে অধিকাংশ সফরে রোযা পালনকারী এই জন্য রোযা রাখে যে, এখন রমযান মাস চলছে সবাই রোযা রাখছে আমিও রেখে নেই। পরে কে রাখবে।

কিছু পিতা মাতা তাদের ছোট ছোট শিশুকে রোযা রাখান আর তার পর গর্ববোধ করে বলে যে, আমার বাচ্চা এতগুলো রোযা রেখেছে, তাদের রোযা রাখানোর উদ্দেশ্য এটাই যে, পরে তারা ঘোষণা দিতে পারে। আসলে এটা বাচ্চাদের যুলুমের উপর যুলুম আর রোযা থেকে তাকে ঘৃণা এবং সামনে অস্বীকৃতি করার সমার্থক।

স্তন্যদানকারী এবং গর্ভবতীর সম্বন্ধে তো আঁ হযরত (সা.)-এর বাণীই আছে যে, আল্লাহ্ তাআলা তাদেরকে রোযা থেকে অবকাশ দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে, আঁ হযরত (সা.) বলছেন,

আল্লাহ্ তাআলা মুসাফেরের জন্য নামায অর্ধেক এবং স্তন্যদানকারী ও গর্ভবতীর রোযা অবকাশ দিয়েছেন।

রোযা সম্বন্ধে হযরত মুসলেহ্ মাওউদ (রা.) এর কিছু নির্দেশনা পেশ করা হলো, হুযূর (রা.) বলেন,

কেউ কেউ আছেন যারা ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে রোযা রাখান অথচ প্রত্যেক ফরয এবং হুকুমের জন্য আলাদা আলাদা সীমা এবং আলাদা আলাদা সময় আছে। আমাদের দৃষ্টিতে কিছু বিধিনিষেধের সময় চার বছর বয়স থেকে শুরু। আর কিছু এমন আছে যার সময় সাত বছর থেকে শুরু। আর কিছু এমন আছে যার সময় সাত বছর থেকে বার বছরের মধ্যে। আর কিছু এমন আছে যার সময় ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। আমার নিকট রোযার হুকুম ১৫ থেকে ১৮ বছরের বাচ্চার উপর। আর এটাই সাবালক হওয়ার সময় সীমা। ১৫ বছর থেকে রোযা রাখার অভ্যাস করাতে হবে আর ১৮ বছর বয়সে রোযা ফরজ মনে করা উচিত। আমার স্মরণ আছে, যখন আমরা ছোট ছিলাম তখন আমাদেরও রোযা রাখার শখ হতো, কিন্তু হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) রোযা রাখতে দিতেন না। সুতরাং বাচ্চাদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য তাদের শক্তি বাড়ানোর জন্য রোযা রাখা থেকে তাদের বাধা দেওয়া উচিত। তারপরে যখন তাদের সময় এসে যায়, যখন তারা নিজেদের শক্তিতে পৌঁছে যাবে যা ১৫ বছর বয়সে তখন তাদের রোযা রাখানো হোক। আর সেটাও খুব ধীরের সাথে। প্রথম বছর যতগুলো রাখবে পরের বছর তার থেকে কিছু বেশি আর তৃতীয় বছরে তার থেকে বেশি, এই ভাবে পর্যায়ক্রমে রোযা রাখার অভ্যাস বানানো হোক। (আল ফজল ১১ এপ্রিল ১৯২৫, ফিকাহ্ আহ্‌মদীয়া ২৯১ পৃষ্ঠা)

তিনি আরো বলেন,

বৃদ্ধ যার শক্তি শেষ হয়ে গেছে আর রোযা তাকে জীবনের বাকী কাজ থেকে বঞ্চিত রাখে তার জন্য রোযা রাখা নেকী নয়। তারপর সেই শিশু যার শক্তি অর্জনের অধ্যায় চলছে আর সামনের ৫০/৬০ বছরের জন্য শক্তি জমা করছে তার জন্যও রোযা রাখা নেকী হতে পারে না। কিন্তু যার মধ্যে শক্তি আছে আর সে রমযান পায় সে যদি রোযা না রাখে তবে সে গুনার ভাগীদার হবে। (আল ফজল, ২ ফেব্রুয়ারী ১৯২৫, ফিকাহ্ আহ্‌মদীয়া ২৯১ পৃষ্ঠা)

রমযান মুসলমানদের দিক থেকে নিজের সত্ত্বা এবং বংশধরের কুরবানীর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হয়। রোযা দ্বারা আত্মাকে পবিত্র করা এবং সত্য স্বপ্নের অভ্যস্ত করা ছাড়াও গরীবদের জীবন সম্বন্ধে অনুভূতি সৃষ্টি করা এবং মু’মিনদের মধ্যে কুরবাণীর রূহকে উন্নতি করার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রোযা এক বরকতময় ইবাদত। যাদের রোযা রাখার হুকুম আছে তারা রোযা রাখুন আর যাদের হুকুম নাই যেমন অসুস্থ ও মুসাফির রোযা যেন না রাখে আর গণনা পরে পূর্ণ করে। আল্লাহ্ তাআলা আমাদের সবাইকে রোযার হুকুমের উপর আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

প্রাপ্ত সুত্রঃ পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে আগস্ট, ২০০৮ইং