হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল (রাঃ)-এর কাদিয়ানের জীবন

আলহাজ্জ মোহাম্মাদ মুতিউর রহমান

হযরত মাওলানা হাজী হাফেয হেকীম নূরুদ্দীন খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বংশানুক্রমে হযরত উমর ফারুক (রাঃ)-এর বংশের লোক। তাঁর ইলহামী নাম আব্দুল বাসেত বা প্রাচুর্যদানকারীর দাস। তাঁর পিতার নাম হযরত হাফেয গোলাম রসূল সাহেব। তিনি শাহাপুর জিলার ভেরার অধিবাসী। কুরআন করীমের প্রতি তাঁর পরিবারের অগাধ ভালবাসা ছিল। তিনি (রাঃ) ১২৫৮ হিজরী বা ১৮৪১ খৃষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ৭ ভাই ও ২ বোনের মাঝে সবচেয়ে ছোট। তিনি পিতা-মাতার পবিত্র সংস্পর্শে ছোট বেলা থেকেই একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হিসেবে গড়ে ওঠেন। ছোট বেলা তিনি অনেকবার শ্বাসকষ্টে ভুগেছেন।

তিনি আরবী, উর্দূ, ফারসী এবং বিশেষ করে কু্‌রআন ও হাদীসের বিশেষ জ্ঞান লাভ করার জন্যে রামপুর লঁক্ষ্ণৌ, ভুপাল বারানসীসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে গমন করেন এবং অনেক কষ্ট সহ্য করে বিশিষ্ট আলেমদের সাহচর্যে এসে জ্ঞান আহরণ করেন। তাঁর ভাই ছিলেন চিকিৎসা শাস্ত্রের একজন ছাত্র। তাই ছোট বেলা থেকে তাঁরও চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতি ঝোঁক ছিল। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রেও পড়াশুনা করেন এবং পরিণত বয়সে একজন সুবিজ্ঞ হেকীম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এক সময় জম্মুর রাজার রাজচিকিৎসকও ছিলেন তিনি।

শাহ্‌ হাকীম আব্দুর রায্‌যাক নামের এক বুযুর্গের নসীহত মোতাবেক তিনি বহু বিশিষ্ট পুণ্যবান বুযুর্গদের সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করেন এবং বহু আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। তিনি নাসেখ মনসুখ সহ নানা প্রকার প্রচলিত ধ্যানধারণার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না আগে থেকেই।

তিনি একাধিক বার হজ্জব্রত পালন করেন। প্রথম বার যখন তিনি বায়তুল্লাহ্‌ দর্শন করেন তখন তিনি এ বলে দোয়া করেনঃ

‘হে আল্লাহ্‌ আমি তো সব সময় তোমারই মুখাপেক্ষী। এখন আমি কোন্‌ দোয়াটি করবো। আমি এই দোয়া করছি-আমি প্রয়োজনের সময় যে দোয়াই করবো তুমি সেই দোয়াই কবুল করো’। (মিরকাতুল ইয়াকীন, পৃঃ ৯৪)

মক্কা মদীনায় গিয়েও তিনি কুরআন এবং হাদীসের চর্চা করেন এবং বিখ্যাত আলেম উলামাদের সাহচর্যে আসেন। দেশে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি কখনো কখনো বাহাস-মোবাহাসাও (বিতর্ক) করেছেন।

হযরত মৌলভী নূরুদ্দীন সাহেব (রাঃ) ইসলামী জ্ঞান, আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান, খোদার প্রতি ভরসা এবং হেকিমী চিকিৎসা ক্ষেত্রে সারা হিন্দুস্তানে স্বনামধন্য ছিলেন। তখনও তিনি কোন সিদ্ধ পুরুষের সন্ধান লাভ করেন নি। অতএব তিনি অধিকাংশ সময় কোন কামেল সিদ্ধ পুরুষের পথনির্দেশনার জন্যে মহান আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করে থাকতেন যেন তার নির্দেশে ইসলামের বৈরীদের সাথে মোকাবেলা করা যায়। তখনও হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ) ইমাম মাহদী ও মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর দাবী করেন নি। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে হযরত মৌলভী নূরুদ্দীন সাহেব (সাল্লামাহু তাআলা) প্রথম কাদিয়ানে এসে হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য লাভ করেন। হযরত মির্যা সাহেবের সাথে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সময় তাঁর অনুরোধে তিনি খৃষ্টধর্মের মোকাবেলার পুস্তক রচনা শুরু করেন।

এরপর থেকে কখনো ব্যক্তিগতভাবে দেখাসাক্ষাৎ এবং অধিকাংশ সময় হযরত সাহেবের সাথে পত্রালাপ হতে থাকে। এসব তথ্য হযরত ইয়াকূব আলী ইরফানী (রাঃ) কর্তৃক সংকলিত মকতুবাত থেকে জানা যায়। এর কোন কোন পত্রে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) তাঁর (রাঃ) উন্নত চরিত্র সম্বন্ধে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁদের মাঝে হৃদ্যতা এত বেশি ছিল যা সেই পত্রগুলো পাঠে অবহিত হওয়া যায়। এমন কি সূফী মুন্সী আহমদ জান এর কন্যা হযরত সুগরা বেগমের সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়েও হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর পছন্দমত হয়েছিল। হযরত মসীহ্‌ মসীহ মাওউদ (আঃ) বরযাত্রী হিসেবেও লুধিয়ানায় গিয়েছিলেন ১৮৮৯ সনে। ১লা ডিসেম্বর, ১৮৮৮ তারিখে সবুজ ইশতেহারের মাধ্যমে হুযূর (আঃ) বয়আতের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর ‘তকমীলে তবলীগ’ এ শিরোনামে ১২ জানুয়ারী, ১৮৮৯ তারিখ বয়আতের শর্তাবলী প্রকাশ করেন। পরে হুযূর (আঃ) লুধিয়ানায় পৌঁছে ৪ মার্চ, ১৮৮৯ তারিখ একটি ইশতেহার প্রচার করেন। এতে বয়আতের তাৎপর্য ও কল্যাণের বিষয় বর্ণনা করেন। হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) বয়আতের জন্যে হযরত সূফী মুন্সী আহমদ জান সাহেবের মহল্লা জাদীদস্থ হুজরাকে পছন্দ করেন। এর নামকরণ হয় ‘দারুল বয়আত’। ২৩শে মার্চ, ১৮৮৯ বয়আতের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। হুযূর (আঃ)-এর নির্দেশে হযরত শেখ হামেদ আলী সাহেবকে দিয়ে প্রথম হযরত মৌলভী হাকীম নূরুদ্দীন সাহেব (রাঃ)-কে ডাকানো হয় এবং তিনি (রাঃ) প্রথম বয়আত নেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এভাবে তিনি (রাঃ) পবিত্র সিলসিলা আহ্‌মদীয়ায় দাখিল হন। আলহামদুলিল্লাহ্‌ আলা যালিক।

বয়আত গ্রহণ করার পূর্ব হতেই তিনি (রাঃ) সব সময় আর্থিকভাবে, পুস্তকাদি লিখে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-কে সহায়তা করে আসছিলেন। লেখরাম পেশওয়ারী বারাহীনে আহ্‌মদীয়া পুস্তকের খন্ডনে একটি নোংরা পুস্তক ‘তাকযীব বারাহীনে আহ্‌মদীয়া’ লেখে। এ পুস্তকের জবাবে তিনি (রাঃ) হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর নির্দেশে ১৮৮৮ সনে ‘তাসদীকে বারাহীনে আহ্‌মদীয়া’ লিখেন।

ভূমিকাস্বরূপ উপরোক্ত পরিচিতি দেয়ার পর হযরত আলহাজ্জ হেকীম নূরুদ্দীন (রাঃ)-এর কাদিয়ানের জীবন সম্পর্কে কিছু নিবেদন করার চেষ্টা করছি। জম্মুর চাকুরী থেকে অবকাশের পর ভেরায় একটি বড় দাওয়াখানা (চিকিৎসালয়) নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেন। বাড়ী নির্মাণের সামগ্রী আনার জন্যে লাহোর যেতে হলো। তাঁর মনে চাইলো একবার হুযূর (আঃ)-কে দেখেই যাই না কেন। সেজন্যে কাদিয়ান গেলেন। যেহেতু ভেরাতে বড় রকমের বাড়ী নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন তাই ফেরার জন্যে এক্কা গাড়ীও সাথেই রাখা ছিল। ফেরার জন্যে হুযূর (আঃ)-এর অনুমতির অপেক্ষা করছিলেন। কথোপকথন কালে হুযূর (আঃ) বললেন, ‘এখন তো আপনি অবসর হয়েছেন’। তিনি (রাঃ) বললেন, ‘এখন তো অবসরই আছি’। তিনি (রাঃ) এক্কাওয়ালে বিদায় করে দিলেন। পরে অনুমতি নিতে গেলে হুযূর (আঃ) বলেন, ‘এখন আপনি একজন স্ত্রীকে আনিয়ে নিন’। স্ত্রীকে আনার জন্যে লিখলেন এবং বাড়ীর কাজ বন্ধ করে দিলেন। কিছুদিন পর হুযূর (আঃ) বললেন, ‘আপনার পুস্তকাদির খুব শখ তাই আপনার লাইব্রেরীটি আনিয়ে নিন’। কয়েকদিন পরে আবার বললেন, ‘অন্য স্ত্রী আপনার মেজাজ-মর্জি বুঝেন এবং পুরনোও, আপনি তাকে অবশ্যই আনিয়ে নিন’। হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল (রাঃ) বলেন, ‘এর পরে স্বপ্নেও আর আমার বাড়ীর কথা মনে আসে নি। তাই তো আমি কাদিয়ানেই রয়ে গেলাম’। প্রিয় ইমামের প্রতি তাঁর ঐকান্তিক আনুগত্যের গভীরতা এ ঘটনা থেকে উপলব্ধি করা যায়।

হিজরতের প্রাথমিক কাল

এ প্রসঙ্গে হযরত ডঃ মুফতি মুহাম্মদ সাদেক (রাঃ) লিখেন,

‘সম্মানিত পিতৃপ্রতীম মহান শিক্ষক ছিলেন হযরত হাফেয হাজী মাওলানা মৌলভী হেকীম নূরুদ্দীন সাহেব খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল (রাঃ) হযরত মসীহ্‌ মাওউদ মাহদীয়ে মা’হূদ আলায়হেস সালামের প্রকৃত প্রেমিক, মু’মিনগণের প্রথম, মুহাজিরগণের প্রথম । মহান দাতা আল্লাহ্‌র হাজার হাজার অনুগ্রহ ও দয়া অনন্ত কালের জন্যে তাঁর আত্মার ওপর ও তাঁর সন্তানসন্ততির ওপর বর্ষিত হোক! আর যেভাবে আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁকে এ পৃথিবীতে কল্যাণে ভরে দিয়েছেন তেমনই বরং এর চেয়েও অধিক অধিক সেই জগতে আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁকে সব কল্যাণ ও পুরস্কারে ভরে দিতে থাকুন এবং তাঁর সন্তুষ্টির মকাম ও মর্যাদাসমূহে অনন্ত কালের জন্যে উন্নতি দিতে থাকুন! আমীন সুম্মা আমীন!

জম্মু রাজ্যের চাকুরী থেকে যখন তিনি (রাঃ) পৃথক হন তখন তাঁর সেবায় আমি নিয়োজিত ছিলাম। কেননা, আমিও সেই সময় জম্মু হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলাম। তাঁর মাসিক আয় ছিল এক হাজার বা পনর শ টাকা। এর সবটাই প্রায় আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় হয়ে যেতো অথবা এর সমান বা এর চেয়ে অধিক ব্যয় হতো। টাকা পয়সা জমা করার অভ্যাস ছিল না তাঁর। এমতাবস্থায় রাজ্যের চাকুরী থেকে হঠাৎ আলাদা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর চেহারা মলিন হয়নি। এর কোন অনুভূতিই তাঁর ছিল না। যেভাবে দৈনন্দিন পড়াতে, রুগী দেখতে, লোকদের সঙ্গত কথার নির্দেশ দিতে এবং অসঙ্গত কথা থেকে বিরত রাখতে, নিজ পুস্তকাদি পাঠ করতে ব্যস্ত থাকতে নিজের বৈঠক খানায় খোলা দরবারে লাগিয়ে বসে থাকতেন। সেখানে লোকজন কোন লৌকিকতা ছাড়াই আসা যাওয়া করতো। এভাবেই সেসব দিনেও তিনি রীতিমত বসে থাকতেন যেন চাকুরী থেকে পৃথক হওয়ার কোন ঘটনাই ঘটেনি বা হলেও তা ছিল দৈনন্দিন বিষয়ের মত একটি সাধারণ বিষয়। জম্মু থেকে নিজের দেশে গেলেন। সেখানে তাঁর বাড়ীর সামনে নিজের দখলে অনেক খালি জায়গা পড়ে ছিলো। এতে লাইব্রেরী ও মেহমানদের থাকার জন্যে ঘর বানানো আরম্ভ হয়ে গেলো। এটা সম্ভবত ১৮৯২ সনের ঘটনা। ভেরা তখন সারা পাঞ্জাবের রুগীদের আসার কেন্দ্রে পরিণত হলো। নিকট ও দূর থেকে লোকদের আনাগোনা আরম্ভ হয়ে গেলো। সাধারণত বিনা পয়সায় ঔষধ দেয়া হতো। এ অবস্থাতেই বাড়ী তৈরী হচ্ছিলো। কোন প্রয়োজনে ২/৩ দিনের জন্যে তাঁকে লাহোর আসতে হলো। লাহোর পৌঁছে কাদিয়ান কাছাকাছি হওয়ার কারণে একদিনের জন্যে তিনি কাদিয়ান চলে এলেন। এটা সম্ভবত ১৮৯৩ সনের কথা। এখানে সে সময় হযরত মাওলানা মৌলভী আব্দুল করীম সাহেব মরহুম (রাঃ)-ও উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর (রাঃ) কাছে বললেন, হযরত সাহেব অর্থাৎ মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর ইচ্ছা মনে হয়, আপনি যেহেতু চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন তাই আপনি এখানেই থেকে যান। হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর ইচ্ছার কথা শুনতেই তিনি বললেন, বেশ তো। এখন এখান থেকে যাচ্ছি না। এখানেই পড়ে থাকবো। মালামাল আনার জন্য গেলেন না বা কোন মালামাল চেয়েও পাঠালেন না। বাস যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই থেকে গেলেন। এটা ছিলো তাঁর আনুগত্যের আত্মা। আল্লাহ্‌ তাআলা আমাদের সবাইকে এমনই আনুগত্য করার সাহস ও সৌভাগ্য দান করুন, আমীন’।

এভাবে তিনি হিজরত করে কাদিয়ানে বসবাস আরম্ভ করেন। আর কখনো কাদিয়ান থেকে ভেরা যাওয়ার নামটি পর্যন্ত করেননি। এরপর হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর নির্দেশে এক স্ত্রীকে ভেরা থেকে কাদিয়ানে আনিয়ে নেন। এর পরে সেখানে জায়গা কিনে কাঁচা দেয়ালের বাড়ী বানিয়ে নেন। আর হিজরতে এমন পাকা-পোক্ত হয়ে যান যেন তাঁর ওপর ‘ধ্রুবতারা’ বসানো হয়েছিলো। তিনি সত্যিকার অর্থে একজন ওলীআল্লাহ্‌ ও কুতুব (নেতা) ছিলেন।

কাদিয়ানে তাঁর কর্মব্যস্ততা

কাদিয়ানে তাঁর অবস্থানের সময়কে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত হিজরতের প্রাথমিক কাল থেকে নিয়ে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ আলায়হেস সালামের মৃত্যু পর্যন্ত ১৫ বছর এবং দ্বিতীয়ত তাঁর ৬ বছরের খিলাফতকাল। প্রথম যুগে তিনি সকাল সকাল রুগী দেখে থাকতেন। এরপর ছাত্রদেরকে হাদীস ও চিকিৎসা শাস্ত্র পড়াতেন। মসনবী শরীফ এবং হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর পুস্তকাদিও পড়াতেন। পরে প্রত্যেক দিন আসরের নামাযের পর কুরআন শরীফের দরস দিতেন। মেহমানদের জিনিষপত্র তাঁর কাছে গচ্ছিত রাখতেন। গরীবদের সাহায্যের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। আর সব আহ্‌মদী ভাইদের সৎকাজ করার ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে থাকতেন। বাইরের থেকে ধর্মীয় ও চিকিৎসা সম্বন্ধীয় আসা চিঠি-পত্র লিখাতে ও লিখতে থাকতেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং অনেক সময় ইশা পর্যন্ত নামাযের সময় বাদে একটি স্থানে বৈঠক খানা বানিয়ে বসে থাকতেন। সেখানে কেবল চাটাই বিছানো থাকতো। তাঁর জন্যে কোন আলাদা চেয়ার থাকতো না। বিভিন্ন স্থান থেকে প্রয়োজনে লোকজন আসতো এবং তাঁর কাছ থেকে উপকৃত হতে থাকতো। একটি খোলা দরবার ছিলো। সেখানে কখনো কোন দারওয়ান নিযুক্ত ছিলো না। সাধারণত ভোরের দিকে তিনি মহিলাদের মাঝেও কুরআনের দরস দিতেন। যতদিন পর্যন্ত তাঁর বিশ্বস্ত শিষ্য ও বন্ধু হযরত মাওলানা আব্দুল করীম সিয়ালকোটি সাহেব (রাঃ) জীবিত ছিলেন তিনি মসজিদ মোবারকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও জুমুআর নামাযের ইমামতি করে আসছিলেন। আর মসজিদুল আকসাতে খলীফা আওওয়াল (রাঃ) জুমুআর নামায পড়াতেন। হযরত মাওলানা আব্দুল করীম সাহেব (রাঃ)-এর ইন্তেকালের পর তিনি পাঁচ ওয়াক্তের নামায ও জুমুআ এসব মসজিদে পড়াতে থাকতেন যেখানে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) যেতে পারতেন না। সাধারণত সব নামায মসজিদে মোবারকে হতো। বাইরে হাঁটতে যাওয়ার অভ্যাস ছিলো না তাঁর। কাদিয়ানে যখন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলো তখন তিনি এতে আরবী পড়াতে থাকেন। তিনি সদর আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) একবার বলেছিলেন,

‘মৌলভী সাহেবের একটি রায় আঞ্জুমানের শত রায়ের সমান মনে করা উচিত’।

পুস্তক প্রণয়ন

যেহেতু হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) অধিকাংশ সময় পুস্তক প্রণয়নের কাজে ব্যস্ত থাকতেন তাই হুযূরের সম্মানের খাতিরে তিনি পুস্তক প্রণয়নের প্রতি মনযোগী হতেন না। সেই যুগে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর আদেশে তিনি মাত্র একখানা পুস্তক প্রণয়ন করেছিলেন। এটা ছিল ধর্মপাল নামক এক আর্য্য সমাজীর ‘তরকে ইসলাম’ এর জবাবে প্রণীত। এ পুস্তক তিনি প্রণয়ন করেন আর এর পান্ডুলিপি প্রিয় লেখক এক একটি করে অধ্যায় হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-কে সন্ধাকালীন বৈঠকে শুনাতেন এবং হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-ই এ পুস্তকের নাম ‘নূরুদ্দীন’ রাখেন। এ পুস্তক ছাপানো ও প্রকাশনার কাজ তাঁর পুরাতন বন্ধু ও নিষ্ঠাবান সত্যবাদী হযরত মৌলভী হাকীম হাজী হাফেয ফযলুদ্দীন সাহেব মরহুম (রাঃ) করেছিলেন। খিলাফতের যুগে তিনি আর কোন পুস্তক প্রণয়ন করেন নি।

আয়ের পথ

কাদিয়ানে বাহ্যিকভাবে তাঁর আয়ের উৎস চিকিৎসা ছাড়া আর কিছু ছিলো না। তাঁর পারিবারিক খরচ, ধর্মীয় ব্যাপারে আগে বেড়ে অংশ নেয়া – এসব ব্যাপারে একটি মোটা অংকের অর্থ ব্যয় হতো। আর আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন, এ অর্থ কোথা থেকে আসতো। তিনি বলতেন, আল্লাহ্‌ তাআলা নিজ ফযলে আমার প্রয়োজন পুরো করে থাকেন। আর আমাকে কোথা থেকে দিবেন তা কেউ অনুমান করতে পারে না। কখনো তাঁর এমন প্রয়োজন দেখা দেয়নি যা পুরো হয়নি এবং অদৃশ্য থেকে এজন্যে উপকরণ সৃষ্টি হয়নি।

তাঁর সফর

নিজ জন্মস্থান ভেরা থেকে হিজরত করে কাদিয়ান এসে যাওয়ার পর তিনি হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর আদেশ ছাড়া কোন সফর করেন নি। তাঁর সফরের বিবরণ নিম্নে দ���ওয়া হলোঃ

হযরত মসীহ্‌ মাওউদ যখন ১৯০৫ সনে দিল্লী গিয়েছিলেন। তখন হযরত মাওলানাকেও কয়েকদিন পরে সেখানে হুযূর (আঃ) ডেকে নেন। এভাবে সেই লাহোরের সফরেও তিনি সঙ্গী ছিলেন যে সফরে হুযূর (আঃ) মুত্যুবরণ করেন।

খিলাফতের মসনদে

কাদিয়ানে তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর মৃত্যুর পর। তখন আল্লাহ তাআলা জামাআতের সবার মনে একথা জাগ্রত করলেন যে এখন মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর একজন খলীফা হওয়া আবশ্যক। তিনি হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে সবার ওয়াজেবুল ইতায়াত বা অবশ্যমান্যকারী ইমাম হবেন। সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো তখন হযরত মৌলভী নূরুদ্দীন সাহেবের ওপর। তিনিই খিলাফতের মসনদের যোগ্য। তাঁর কাছে আবেদন করা উচিত যেন তিনি এ পদ গ্রহণ করেন। অতএব খাজা কামালউদ্দিন সাহেব ও হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হযরত উম্মুল মু’মিনীনের সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁকেও এ পরামর্শ দেন যেন হযরত মৌলভী সাহেবকে খলীফা বানানো হয়। হযরত মৌলভী সাহেবের কাছে যখন এ কথা পৌঁছলো তখন তিনি এক বদনা পানি চাইলেন, ওযূ করলেন ও নওয়াব সাহেবের সেই বাড়ীতে, যেখানে তখন লাইব্রেরী ও ফাযেল মাওলানা হযরত শের আলী সাহেবের অফিস, আলাদাভাবে নামায পড়েন ও সিজদায় পড়ে অনেক কান্নাকাটি করেন। এরপর সবাই বাগানে সমবেত হন। সেখানে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর পবিত্র মরদেহ চৌকির ওপর রাখা ছিলো। সেখানে তাঁর সমীপে ‘খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করুন’ একটি কাগজে এ মর্মে এক আবেদন লেখা ছিলো। সবাই এভাবে ইতাআত করবো যেভাবে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর ইতাআত করতাম-সে কথাও এতে লেখা ছিল। এরপর আঞ্জুমানের সদস্যগণ এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিলো। ডঃ মুফতী মুহাম্মদ সাদেক সাহেব এটা পড়ে শুনান। এরপর হযরত মৌলভী সাহেব একটি বক্তৃতা দেন।

এর সংক্ষিপ্তসার এরূপঃ

আমি তো চাচ্ছিলাম যেন হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর সন্তানাদি থেকে কাউকে বা অন্য কোন বুযুর্গকে খলীফা বানানো হয়। হাফীযাহ্‌ বেগম (রাঃ) [হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর ছোট মেয়ে যার বয়স এ সময় ৪ বছর ছিল]-কেও খলীফা বানানো হলে আমি তো তার হাতেও বয়আত করতে প্রস্তুত ছিলাম। তোমরা আমাকে খলীফা বানাতে চাইলে, আমার ইতাআত করতে হবে।

এর ওপর সবাই ইতাআত করতে স্বীকার করলেন। পরে তিনি বসে গেলেন আর বয়আত আরম্ভ হলো। উপস্থিত সবাই বয়আত করলেন। দোয়া হলো। এরপর তিনি হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর জানাযা পড়ালেন। যে লেখাটি ডঃ মুফতি মুহাম্মদ সাদেক সাহেব পাঠ করছিলেন এবং তাঁর (রাঃ) বক্তৃতা দুটোই বদর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো। খিলাফতের প্রাথমিক দিনগুলোতে তিনি (রাঃ) অধিকাংশ সময় অন্দরে একাকী থাকতেন। দোয়ায় মশগুল থাকতেন। দোয়ার জন্যে তাঁকে একটি কোঠা নির্মাণ করে দেয়া হয়েছিলো। তিনি বলতেন, আমার মনে হয় আমার কাঁধে একটি ভারী বোঝা রেখে দেয়া হয়েছে এতে আমি ডুবে যাচ্ছি। সেই সময়ে তাঁর দিনের বৈঠকখানা ছিলো মসজিদে মোবারক। কিন্তু রুগীরা যেহেতু তাঁর দৃষ্টির মুখাপেক্ষী ছিলো এবং রুগীদের মসজিদে ভীড় করা সমীচীন ছিল না তাই তিনি কিছুদিন পর পুনরায় তাঁর চিকিৎসালয়েই রীতিমত বসা আরম্ভ করলেন।

তাঁর শিষ্য

কুরআন, হাদীস ও চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর ছাত্র ছিল শত শত বরং হাজার হাজার। কেননা, দরসে কুরআনে অধিক সংখ্যায় লোক যোগদান করতেন। ধর্মীয় জ্ঞানে তাঁর বিশেষ শিষ্যদের মাঝে হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ সানী (রাঃ)ও ছিলেন। তাঁকে তিনি বিশেষভাবে কুরআনের তরজমা, বুখারী শরীফ ও মাওলানা রুমীর মসনবী শরীফ পড়াতেন। তাঁর চিকিৎসা শাস্ত্রের শিষ্যদের মাঝে সেই সময় কাদিয়ানে ছিলেন মৌলবী কুতুবউদ্দিন সাহেব, মুফতি ফযলুর রহমান সাহেব ও আব্দুর রহমান কাগাফী সাহেব। আর ছিলেন মৌলভী গোলাম মোহাম্মদ সাহেব (ইঁনি ১৯২৫ সনে ইন্তেকাল করেন)।

তাঁর আত্মীয়স্বজন

তিনি জনগণের কল্যাণ করতেন। হাজার হাজার হিন্দু মুসলিম, খৃষ্টান তাঁর দয়ার স্বীকৃতি দিতেন। তাঁর মৃত্যুর দিন কোন কোন হিন্দুও কাঁদতে ছিলেন। তাঁর ভাইদের সন্তানদের প্রতি তিনি অনেক দয়াপরবশ ছিলেন। এদের মাঝে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র হাকীম মীর আহমদ মোহাজের সাহেব কাদিয়ানে থাকতেন।

খিলাফতকালীন ঘটনা

তাঁর খিলাফতকালীন সময়ে নিম্নোক্ত সংক্ষিপ্ত বিশেষ বিশেষ ঘটনা উল্ল্যেখযোগ্যঃ

মৃত্যু শয্যায়

তিনি যখন ঘোড়া থেকে পড়ে যান এর আঘাতে পূঁজ জমার কারণে অস্ত্রোপচার করা হয় তখন তাঁর স্বাস্থ্য খুব দুর্বল হয়ে যায়। অভ্যাসের বিপরীত ঠান্ডার কারণে মোজা পরা আরম্ভ করেন এবং লম্বা লাঠিতে ভর দিয়ে চলা-ফেরা আরম্ভ করতে থাকেন। বিশেষভাবে সিঁড়িতে উঠতে কষ্ট হতো। প্রত্যেক অসুখের সময় তিনি হযরত উলুল আযম (দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী) মিয়াঁ মাহমুদ আহমদকে নিজের স্থলে ���ামায পড়াতে এবং খুতবা দিতে নিযুক্ত করতেন। শেষ রোগ যাতে তিনি ইন্তেকাল করেন এ প্রসঙ্গে ডাক্তারদের মতামত এই, তাঁর T.B হয়েছিল। জ্বর থাকতো সব সময়। সামান্য সামান্য কা��িও ��িল। হযরত নওয়াব মুহাম্মদ আলী খান সাহেব তাঁকে নিজের বাড়ীতে নিয়ে যান এবং শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সেবা-শুশ্রূষার দায়িত্ব পালন করেন। আর সেখানেই ১৯১৪ সনের ১৩ই মার্চ তারিখ জুমুআর দিন তিনি (রাঃ) ইন্তেকাল করেন।(ইন্নালিল্লাহি ……রাজিউন)। তখন তাঁর (রাঃ) বয়স প্রায় ৭৩ বছর। এদিক থেকে তিনি হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর সাথে সাদৃশ্য রাখেন ১৯১৪ সনের ১৪ মার্চ হযরত মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ, খলীফাতুল মসীহ্‌ সানী (রাঃ) তাঁর (রাঃ) জানাযার নামায পড়ান। তিনি (রাঃ) বেহেশতি মকবেরাতে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ আলায়হেস সালামের সমাধির নিকটবর্তী স্থানে সমাহিত হন। আল্লাহুম্মা নূর কবরাহু ইলা ইয়াওমিল ক্বিয়ামাহ্‌ অর্থাৎ, হে আল্লাহ্‌! কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাঁর কবরকে জ্যোতির্ময় করো।

সন্তানসন্ততি

তাঁর (রাঃ) মৃত্যুকালে তাঁর স্ত্রী হযরত সোগরা বেগম সাহেবা ও তাঁর পাঁচ ছেলে ও এক কন্যা জীবিত ছিলেন। প্রথম স্ত্রী মরহুমা ফাতেমা বিবির সন্তানসন্ততির মাঝে বিবি হাফসা মরহুমা স্বামী মুফতি ফযলুর রহমান সাহেব জীবিত ছিলেন। পাঁচ পুত্রের নাম এইঃ আব্দুল হাই মরহুম, আব্দুস সালাম, আব্দুল ওয়াহাব, আব্দুল মন্নান, মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্‌ ও কন্যা মোকাররমা বিবি আমাতুল হাই মরহুমা। এঁকে হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ সানী (রাঃ) বিয়ে করেছিলেন। পুত্রের মাঝে মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্‌ সাহেব ৬ মাস পরে ও হযরত সাহেবজাদী আব্দুল হাই সাহেবা প্রায় ১ বছর পরে মারা যান।

ওসীয়্যতসমূহ

তিনি ৩ বার ওসীয়্যত লেখেন। সর্ব প্রথম ১৯০৫ সনে তিনি ওসীয়্যত লেখেন। তখন ভূমিকম্পের কারণে তিনি হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) ও তাঁর অন্যান্য সাহাবাসহ হযরত সাহেব (আঃ)-এর বাগানে অবস্থান করছিলেন। বাইরে বেরুতে পারেন নি। তখন তিনি তাঁর এক ওসীয়্যত লেখেন। এটা ছিলো তাঁর ঈমান, ধর্ম-বিশ্বাস ও কর্মের সারাজীবনের গবেষণার সংক্ষিপ্তসার। সেই ওসীয়্যত বদর পত্রিকা ছাপিয়েছিলো।

দ্বিতীয় ওসীয়্যত তিনি সেই সময় লেখেন যখন খিলাফতের প্রাথমিককালে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে আহত হন। আর এক রাতে তাঁর ব্যথা হৃৎপিন্ডের দিকে যাচ্ছিল। তখন তিনি দোয়াত কলম চাইলেন এবং একটি কাগজে কেবল এ শব্দগুলো লেখেন-‘খলীফা মাহমুদ’ এবং তাঁর শিষ্যদের কাগজ দিয়ে দেন এবং বলেন, খাম বন্ধ করে নিজেদের কাছে রেখে দাও। এ ওসীয়্যত প্রকাশিত হয়নি। যদিও এ শিষ্যদের মাধ্যমে কয়েকজন লোকের এ বিষয়টি জানা হয়ে গিয়েছিল। এরপর ভাল হয়ে গেলে তিনি এ খামটি নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেন।

তৃতীয় ওসীয়্যত তিনি মৃত্যু শয্যায় মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে করেছিলেন। এতে তাগিদ দেয়া হয়েছিল ‘যিনি তাঁর পরে খলীফা হবেন তিনি যেন হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর পুরনো ও নতুন মুরীদদের সাথে কোমল আচরণ করেন। এ ওসীয়্যত লিখিয়ে তিনি এটা মৌলভী মুহাম্মদ আলী সাহেবকে বলেন, দুবার উচ্চস্বরে পাঠ করুন। তাঁর পাঠ করার পর এটি হযরত নবাব মুহাম্মদ আলী খান সাহেবের কাছে সোপর্দ করেন। আর এতদনুযায়ীই হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ সানী (রাঃ)-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

বেহেশতি মাকবেরা ওসায়া-এর মাধ্যমে তিনি তাঁর (রাঃ) ভেরাস্থ কৃষি জমি নিজ জীবদ্দশায়ই সদর আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়াকে হেবা করে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর (রাঃ) ভেরাস্থ কাদিয়ানের বাড়ী ও লাইব্রেরী সন্তানসন্ততিকে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন।

আল্লাহুম্মাগফিরলাহু ওয়ারহামাহু ওয়ারফা’ দারাজাতাহু ফী জান্নাতিন ‘আলা। আমীন, সুম্মা আমীন অর্থাৎ হে আল্লাহ্‌ তাঁকে ক্ষমা কর তাঁর প্রতি কৃপা কর, এবং জান্নাতে উচ্চ মকামে তাঁর মর্যাদাসমূহ উন্নীত কর। তাই যেন হয়, পুনঃ তাই যেন হয়।”

(আহ্‌মদীয়া একাডেমী, রাবওয়া কর্তৃক প্রকাশিত ও জনাব মুহাম্মদ আযীয আকসীর কর্তৃক সংকলিত পুস্তক ‘হায়াতে নূরুদ্দীন’, অবলম্বনে)

হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-কে হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল কতটা শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন এবং ভালবাসতেন তা ‘ফতেহ ইসলাম’ পু্‌স্তকের একটি উদ্ধৃতি থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবেঃ

‘মাওলানা মুরশেদানা, ইমামানা! আস্‌সালামু আলায়কুম ওয়া রাহমাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু। আলী জনাব! আমার প্রার্থনা এই, আমি সব সময় যেন হুযূরের সমীপে উপস্থিত থাকি এবং যুগের ইমামের কাছ থেকে সেই উদ্দেশ্য লাভ করি যে উদ্দেশ্যে তাঁকে সংস্কারক নিযুক্ত করা হয়েছে। অনুমতি দেয়া হলে চাকুরী ইস্তেফা দিয়ে দিনরাত হুযূরের মহান সেবায় পড়ে থাকবো কিংবা আজ্ঞা হলে এ চাকুরী ছেড়ে পৃথিবী ঘুরে লোকদেরকে সত্য ধর্মের দিকে আহ্বান করবো এবং এ পথেই প্রাণ দেবো। আমি আপনার পথে কুরবান। আমার যা কিছু আছে তা আমার নয়, আপনার।

হযরত পীর মুরশেদ! আমি পূর্ণ সরলতা ও আন্তরিকতার সাথে নিবেদন করছি, আমার সব ধনসম্পদ ধর্ম প্রচারে ব্যয় করা হলে আমার উদ্দেশ্য সফল হবে। বারাহীনের কোন ক্রেতা পুস্তকের মুদ্রণ কাজ স্থগিত থাকার কারণে অস্থির হয়ে থাকলে আমাকে এ নগণ্য সেবা করার যেন অনুমতি দেয়া হয় যাতে আমি নিজের পক্ষ থেকে তার সব অর্থ ফিরিয়ে দেই।

হযরত পীর মুরশেদ! এ অযোগ্য লজ্জাবনত অধম আরও নিবেদন জানাচ্ছি, অনুমতি হলে নিজেকে সৌভাগ্যশালী মনে করবো। আমার ইচ্ছা বারাহীনের গোটা ছাপা খরচ যেন আমার ওপর ন্যস্ত করা হয় এবং মূল্যস্বরূপ যা কিছু আদায় হয় তা যেন আপনার প্রয়োজনে ব্যয় করা হয়। আপনার সাথে আমার ফারুকী (অর্থাৎ হযরত উমর ফারুকের ন্যায়) সম্পর্ক আর আমি এ পথে আমার সব কিছু বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। দোয়া করবেন আমার মৃত্যু যেন সিদ্দীকের মৃত্যু হয়”। (ফতেহ্‌ ইসলাম, পৃষ্ঠা ৩৪ বাংলা সংস্করণ)

মুরশেদও তাঁর একনিষ্ঠ শিষ্যের প্রশংসা করতে গিয়ে তাঁর পত্রপত্রাদিতে অনেক প্রশংসা করেছেন। এ প্রসঙ্গে আগেই উল্ল্যেখ করেছি। এখন আরও কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তাঁর (আঃ) একটি পংক্তিতে তিনি বলেনঃ

চেহ্‌ খোশ বুদে আগার হার ইক যা উম্মত নূরে দীঁ বুদে
হামে বুদে আগার হার দিল পুর আয নূরে ইয়াক্বীন বুদে॥

অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তি নূরুদ্দীন হলে কতই আনন্দের হতো!
আমাদের প্রতিটি অন্তর দৃঢ়বিশ্বাসের জ্যোতিতে ভরপুর হলে (কতই না আনন্দের হতো)!!

হযরত মসীহেয্‌যামান (আঃ) তাঁর (রাঃ) সম্বন্ধে আরও বলেন,

তাঁর নাম তাঁর আন্তরিকতার নূর অনুযায়ী “নূরুদ্দীন”। আমি তাঁর কোন কোন ধর্মীয় সেবা, যা তিনি ইসলামের বাণীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যে হালাল ধন ব্যয় করে করছেন, সব সময় আক্ষেপের দৃষ্টিতে দেখে থাকি, হায়! আমায় দিয়েও যদি সেই সেবা সাধিত হতো। তাঁর হৃদয় ধর্মের সেবার উদ্দেশ্যে যে প্রেরণা রয়েছে তা মনে করে আল্লাহ্‌র অসীম ক্ষমতার চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে যে তিনি কিভাবে নিজ বান্দাদেরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে থাকেন! তিনি (অর্থাৎ নূরুদ্দীন সাহেব) নিজের সব ধন, সব শক্তি ও নিজের আয়ত্তাধীন সব সামগ্রী সহ আল্লাহ্‌ ও রসূলের আদেশ পালনের জন্যে প্রস্তুত রয়েছেন’। (ফতেহ্‌ ইসলাম, ৩৩ পৃষ্ঠা, বাংলা সংস্করণ)

আল্লাহ্‌ তাআলা আমাদের সবাইকে হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়ালের সদ্‌গুণাবলী নিজেদের মাঝে আত্মস্থ করার সৌভাগ্য দান করুন।

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে মে, ২০০৮ইং