প্রেস বিজ্ঞপ্তি
০২-মে, ২০২৩

“যুগ-খলীফার সাথে এক অটুট আধ্যাত্মিক বন্ধন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হোন” – লন্ডনে ওয়াকফে নও ইজতেমায় আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান


“সর্বদা সত্যকে আঁকড়ে ধরে থাকুন, আর কখনো মিথ্যায় লিপ্ত হবেন না”
– হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)

৩০ এপ্রিল ২০২৩, ইসলামের শান্তিপূর্ণ সেবার জন্য জীবন উৎসর্গকারী আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত, যুক্তরাজ্যের পুরুষ সদস্যদের জন্য আয়োজিত সমাবেশ, বার্ষিক জাতীয় ওয়াকফে নও ইজতেমা, যুক্তরাজ্যের সমাপনী অধিবেশনে ভাষণ প্রদান করেন আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)।

লন্ডনের বায়তুল ফুতূহ মসজিদে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানটিতে ওয়াকফে নও স্কিমের অন্তর্ভুক্ত ১,৫০০ সদস্যসহ ১,৭০০ এর অধিক পুরুষ ও বালক অংশগ্রহণ করেন।

এক অনুপ্রেরণাদায়ক ভাষণে, হুযূর আকদাস ধর্মভীরুতা অবলম্বন সংক্রান্ত বেশ কিছু গুণাবলী সম্পর্কে আলোচনা করেন যেগুলোর ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়াটা ওয়াকফে নও সদস্যদের ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়ার তাদের অঙ্গীকার প্রকৃত অর্থে পূরণের জন্য আবশ্যক।

হুযূর আকদাস ওয়াকফে নও সদস্যদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্য অর্জন প্রত্যেক জীবন-উৎসর্গকারীর “চূড়ান্ত উদ্দেশ্য” হতে হবে।

নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার সময় ওয়াকফে নও-রা যে অঙ্গীকার করে সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“সাধারণভাবে যখন আপনারা কোনো ব্যক্তির নিকট কোনো অঙ্গীকার করেন, আপনাদেরকে অবশ্যই সেটি পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায়, আপনারা অন্য ব্যক্তির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার দোষে অপরাধী হবেন। একজন ওয়াকফে নও হিসেবে আপনারা যে অঙ্গীকার করেছেন তা পুরোপুরি ভিন্ন পর্যায়ের; যেহেতেু, এটি কোনো ব্যক্তির সঙ্গে করা হয় নি; বরং, সরাসরি আল্লাহ্ তা’লার সঙ্গে করা হয়েছে। আপনারা প্রত্যেকে তাঁর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার এবং তাঁর জন্য প্রত্যেক কষ্ট স্বীকার ও কুরবানির অঙ্গীকার করেছেন।”

হুযূর আকদাস ওয়াকফে নও-র অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও সফলভাবে পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগের চেতনার রূপরেখা প্রদান করেন।

হুযূর আকদাস উদাহরণ প্রদান করেন কীভাবে পবিত্র কুরআনের ৫৩:৩৮ আয়াতে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর অঙ্গীকার পূরণের জন্য ও খোদার প্রতি অনুগত থাকার জন্য তাঁর প্রশংসা করা হয়েছে। যেখানে আল্লাহ্ তা’লা বলেন:

“এবং অঙ্গীকার পূর্ণকারী ইবরাহীমের”

উক্ত আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.) বলেন যে, আল্লাহ্ তা’লা ইবরাহীম (আ.)-এর পরম আনুগত্য ও আন্তরিক বিশ্বস্ততার পরীক্ষা নিয়েছেন। কারণ, তিনি কেবল অঙ্গীকারই করেন নি; বরং, তা পূর্ণ করেছেন। যেমনটি আমি বলেছি, আপনাদের অঙ্গীকারটি অত্যন্ত ভারী এবং গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি, আপনারা খোদার সামনে নিশ্চিত করেছেন যে, ধর্মের সেবার খাতিরে আপনারা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাঁর জন্য প্রত্যেক কষ্ট ও প্রত্যেক সম্ভাব্য ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকবেন।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, যদি ওয়াকফে নও স্কীমের প্রত্যেক সদস্য হৃদয়ের পবিত্রতা নিয়ে এই অঙ্গীকার অনুযায়ী জীবনযাপন করেন তাহলে একত্রে আপনারা বিশ্বে এক মহান আধ্যাত্মিক বিপ্লব ঘটাতে পারবেন এবং সমাজকে নৈতিক অবক্ষয়ের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে পারবেন। কিন্তু, এর জন্য আপনাদের আল্লাহ্ তা’লার সাহায্য ও ভালোবাসা প্রয়োজন হবে এবং এটি অর্জন করতে হলে সবকিছুর ওপরে তাঁকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে।”

হুযূর আকদাস বলেন যে, উক্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করা সহজ কথা নয় এবং এর জন্য ওয়াকফে নও-দের আধ্যাত্মিক চ্যালেঞ্জসমূহ অতিক্রম করতে হবে।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.) বলেছেন যে, যখন হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহ্ তা’লার খাতিরে নিজের পুত্রকে উৎসর্গ করার সদিচ্ছা প্রদর্শন করেন তখন আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে থামিয়ে দেন এবং তাঁর আনুগত্য ও আন্তরিকতার সত্যায়ন করেন। এভাবে, ওয়াকফে নও-সহ প্রত্যেক জীবন-উৎসর্গকারীকে অবশ্যই আল্লাহ্ তা’লার খাতিরে প্রত্যেক কষ্ট ও প্রতিকূলতার মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি প্রত্যেক ওয়াকফে নও ও জীবন উৎসর্গকারী এটি অর্জন করতে পারেন তাহলে তারা নিজেদের ওয়াকফ-এর অঙ্গীকার সফলভাবে পূর্ণ করতে পেরেছেন বলে বিবেচনা করতে পারবেন।”

হুযূর আকদাস বলেন যে, মহানবী (সা.) ও প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.)-এর সাহাবীগণ তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের জন্য অনন্য কুরবানী করেছেন এবং সমস্ত বস্তুবাদী প্রয়াস ও পার্থিব সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করেছেন।

হুযূর আকদাস আল্লাহ্ তা’লার ভালোবাসা অর্জনের জন্য প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ের সর্বোত্তম পন্থা সম্পর্কে বলেন এবং উদ্ধৃত করেন যে, মহানবী (সা.) একবার এক সাহাবীকে পুনরায় নামায আদায় করতে বলেন যখন তিনি (সা.) দেখলেন উক্ত সাহাবী নামায খুব দ্রুত পড়েছে। উক্ত সাহাবী পুনরায় নামায পড়েন এবং তাকে আবার নামায আদায় করতে বলা হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি তাকে শিখিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন কীভাবে তার নামায পড়া উচিত যেন তা আল্লাহ্ তা’লার প্রত্যাশা অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য হয়।

মহানবী (সা.)-এর উত্তর উদ্ধৃত করতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“তিনি (সা.) তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, নামাযের সময় আমাদের উচিত আল্লাহ্ তা’লার গুণকীর্তন করা, তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করা এবং অর্থের ওপর মনোনিবেশ করতে করতে সূরা ফাতেহা, দরূদ শরীফ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দোয়াসমূহ পড়া। উপরন্তু, মহানবী (সা.) বলেন যে, একজন মুসলমানের উচিত পরিপূর্ণ বিনয়ের সঙ্গে সিজদা করা। অতএব, আপনাদের উচিত তাড়াহুড়ো না করে মহানবী (সা.) কর্তৃক নির্দেশিত উপায়ে যত্নের সাথে প্রত্যেক নামায আদায় করা।”

ওয়াকফে নও-দের প্রতিদিন পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করার পর, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“এটি জীবন উৎসর্গকারীদের জন্য আবশ্যক যে, তারা নৈতিক গুণাবলির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মান প্রদর্শন করবে এবং প্রত্যেক গুণাবলি অর্জনের চেষ্টা করবে। আপনাদের নিত্যদিনের জীবনে আপনাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী এবং সকলের সঙ্গে সর্বোত্তম নৈতিক মান ও শিষ্টাচার প্রদর্শন করতে হবে। সবর্দা সত্যকে ধারণ করবেন এবং কখনোই নিজেকে মিথ্যায় জড়িয়ে ফেলবেন না। অপরের সঙ্গে দয়া ও সম্মান প্রদর্শনপূর্বক কথা বলবেন।”

আরও একটি নৈতিক চ্যালেঞ্জ, যা হুযূর আকদাস (আই.) তুলে ধরেন, আহমদী মুসলমানদেরকে যেটি কাটিয়ে ওঠার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়, তা হলো সকল প্রকারের অশ্লীলতা পরিহার করা।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“এ ভুল ধারণার মধ্যে থাকবেন না যে, শালীনতা বা পর্দা কেবল নারী ও বালিকাদের চর্চা করার বিষয়। বরং, এটি পুরুষ ও বালকদের জন্যও আবশ্যকীয়। এ সমাজে অশ্লীলতা সর্বত্রই বিরাজমান। সুতরাং, যখন আপনারা বাইরে থাকেন তখন চারিদিকে, এবং বিশেষ করে সেই সমস্ত অশালীন বিষয়ের দিকে কৌতুহলের সঙ্গে তাকানো উচিত নয় যেগুলো আপনাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিপন্থি; বরং, এর পরিবর্তে আপনাদের উচিত নিজেদের দৃষ্টিকে অবনত রাখা।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও বলেন:

“একইভাবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেলিভিশন অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে সকল ধরনের অনৈতিক ও অশ্লীল বিষয়বস্তু পরিহার করুন। এসকল বিষয় দেখা খুবই ক্ষতিকর। এগুলো খুব সহজেই কারো মস্তিষ্ককে কলুষিত করতে পারে এবং আচরণে প্রভাব ফেলতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা ও মিডিয়ার রিপোর্ট হতে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, পর্নোগ্রাফি কিংবা এরকম অশ্লীল বিষয়বস্তু দেখা মারাত্মক ক্ষতির কারণ — ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় পর্যায়ে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় দেখা গেছে যে, এ ধরনের বিষয়বস্তু দেখার ফলে বালক ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে নারী ও বালিকাদের প্রতি গোলমেলে মনোভাব পরিলক্ষিত হয় এবং প্রায়ই সহিংসতায় গড়ায়।”

হুযূর আকদাস বলেন যে, ইসলাম এবং মহানবী (সা.) প্রতিনিয়ত মিথ্যা অপবাদের শিকার হচ্ছেন এবং তাই মানুষের নিকট ইসলামের সুন্দর ও প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরতে ওয়াকফে নও-দের ‘সম্মুখ সারিতে অবস্থান করতে হবে’।
“জগতকে পবিত্র কুরআনের অতুলনীয় শিক্ষা দ্বারা আলোকিত করা এবং মানবজাতিকে মহানবী (সা.) এর অনুপম শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করা প্রত্যেক আহমদীর এবং বিশেষত, ওয়াকফে নও-দের মুখ্য দায়িত্ব। তবলীগের ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য এটি আবশ্যকীয় যে, আপনারা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করবেন এবং অবশ্যই আন্তরিকভাবে খোদার নিকট দোয়া করবেন যেন তিনি আপনাদের ও অন্যান্য আহমদী, যারা ইসলামের প্রচারে রত, তাদের কাজকে বরকতমণ্ডিত করেন।”

হুযূর আকদাস ওয়াকফে নও ও খিলাফতের মাঝে যে দৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলা উচিত এ সম্পর্কে কথা বলেন।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“এটিও অপরিহার্য যে, ওয়াকফে নও সদস্যরা যুগ-খলীফার সঙ্গে অটুঁট আধ্যাত্মিক বন্ধন রচনা করতে চেষ্টা করবেন এবং খিলাফতের প্রতি আনুগত্যের ও বিশ্বস্ততার সর্বোচ্চ পর্যায় প্রদর্শন করবেন। আপনারা যদি খিলাফতের প্রতি আন্তরিক থাকেন তাহলে এটি কেবল ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের উপকার সাধন এবং আল্লাহ্ তা’লার পুরস্কার লাভের উপায় হিসেবে কাজ করবে না; বরং, এটি জামা’তের মধ্যে বিরাজমান একতার উত্তোরত্তর দৃঢ়তা প্রদান নিশ্চিত করবে।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ জাগতিক শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জনের উপরও গুরুত্বারোপ করেন এবং বলেন:

“ধর্মীয় পড়াশোনা ছাড়াও ওয়াকফে নও-দের অবশ্যই জাগতিক পড়াশোনায় উৎকর্ষ অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। সর্বদা জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করুন এবং তুচ্ছ বিষয়ে সময় অপচয় করবেন না। কীভাবে আপনারা মানবতার সেবা করতে পারেন এবং জ্ঞানগত দিক থেকে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন তা বিবেচনা করুন … যেসকল ওয়াকফে নও সদস্য বাইরে পড়াশোনা করছেন কিংবা কাজ করছেন, বিশেষত, গবেষণায় নিয়োজিত আছেন, তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের চেষ্টা করতে হবে। তোমরা যদি জাগতিক ও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে উৎকর্ষ অর্জন করতে পারো তাহলে তোমাদের কাছে আল্লাহ্ তা’লার শিক্ষা ও বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার এবং ইসলামকে দুর্নামের হাত থেকে রক্ষা করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্র থাকবে। উপরন্তু, তোমরা, ইনশাল্লাহ্, মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতকারী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পতাকাতলে সম্মিলিত করার তৌফিক অর্জন করবে।”
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) তার বক্তব্যের শেষে দোয়া করেন এবং বলেন:
“আপনারা প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.)-এর আধ্যাত্মিক সেনাবাহিনীর বিশ্বস্ত সৈনিক বলে পরিগণিত হোন, যাদের মিশন জমি বা দেশ বিজয় করা নয়; বরং, মানুষের হৃদয় জয় করা, সকল দেশ ও গোত্রের মানুষকে আল্লাহমুখী করা। ওয়াকফে নও হিসেবে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ইসলাম ও আহমদীয়াতের বাণী পৌঁছাতে আপনারা অসাধারণ ভূমিকা পালনকারী হোন।”