প্রেস বিজ্ঞপ্তি
২৬-ডিসেম্বর, ২০২২

ঈমানোদ্দীপক ভাষণের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হলো জলসা সালানা কাদিয়ান ২০২২


“আমাদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত যে, আল্লাহ্ তা’লার ইচ্ছানুসারে আমরা আমল করছি কিনা।” — হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)

২৫ ডিসেম্বর ২০২২, এক ঈমানোদ্দীপক বক্তৃতার মধ্য দিয়ে আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত কাদিয়ান এবং আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের বার্ষিক সম্মেলন (জলসা সালানা) সমাপ্ত করেন আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)।

হুযূর আকদাস টিলফোর্ডের ইসলামাবাদে অবস্থিত মসরূর হল থেকে সমাপনী অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন। আর, কাদিয়ানের জলসাগাহে ১৪,৫০০-এর অধিক মানুষ সমবেত হয়েছিলেন।

আফ্রিকার দেশগুলোর, যাদের সমাপনী অধিবেশন একইসাথে অনুষ্ঠিত হয় সেগুলোর, মধ্যে ছিল নাইজেরিয়া, আইভোরি কোস্ট, গিনি-বিসাউ, গিনি কোনাক্রি, টোগো, বুরকিনা ফাসো, মালি এবং জিম্বাবুয়ে।
ভাষণের শুরুতে হুযূর আকদাস উল্লেখ করেন যে, ১৮৯১ সালে কাদিয়ানে অনুষ্ঠিত প্রথম আনুষ্ঠানিক জলসায় মাত্র ৭৫ জন অংশগ্রহণকারী উপস্থিত ছিলেন। পরের বছর ৩২৭ জন জলসায় যোগদান করেন।

তার পর থেকে আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের ওপর বর্ষিত মহান আল্লাহ্ তা’লার অনুগ্রহরাজির বর্ণনা দিতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“বর্তমানে আল্লাহ্ তা’লার অনুগ্রহরাজি এমন যে, দেশে দেশে হাজার হাজার মানুষ রয়েছেন যারা জলসা সালানায় অংশগ্রহণ করছেন। এটি কি প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর জন্য আল্লাহ্ তা’লার সাহায্য ও প্রতিশ্রুত অঙ্গীকারের পূর্ণতার নিদর্শন নয়? অবশ্যই! যদি আপত্তি উত্থাপনকারী আর চিন্তা-চেতনায় অন্ধদের চোখ বন্ধ না থাকে, তাহলে এই একটি লক্ষণই প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর প্রতি আল্লাহ্ তা’লার সাহায্য ও তাঁর সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।”

হুযূর আকদাস গুরুত্ব আরোপ করে বলেন যে, জলসা সালানায় অংশগ্রহণকারীরা যেন তাদের ধর্মীয় দায়-দায়িত্ব অবশ্যই পূর্ণ করেন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বক্তব্যে হুযূর আকদাস প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর সঙ্গে কৃত বয়আতের (দীক্ষা) দ্বিতীয় শর্ত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

বয়আতের দ্বিতীয় শর্তটি হল:

“বয়আতকারী ব্যক্তি মিথ্যা, ব্যাভিচার, কামলোলুপ দৃষ্টি, সকল প্রকার অবাধ্যতা ও পাপাচার, অন্যায়, খিয়ানত এবং নৈরাজ্য ও বিদ্রোহের সকল পথ পরিহার করে চলবে। প্রবৃত্তির উত্তেজনা যতই প্রবল হোক না কেন, এর কাছে পরাভূত হবে না।”

হুযূর আকদাস বলেন যে, বয়আতের এই শর্তে নয়টি পাপের উল্লেখ রয়েছে যা একজন প্রকৃত আহমদী মুসলমানকে অবশ্যেই এড়িয়ে চলতে হবে।

মিথ্যাবাদিতার পাপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ পবিত্র কুরআনের সূরা আল হাজ্জ-২২:৩১ আয়াতটিসহ বেশ কিছু আয়াত উদ্ধৃত করেন:

“অতএব, তোমরা প্রতিমাসমূহের অপবিত্রতা হতে দূরে থাকো এবং মিথ্যা কথা বলা হতেও দূরে থাকো।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে এমন স্পষ্ট সতর্কবাণী আমাদের হৃদয়কে প্রকম্পিত করার জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত। আমাদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে নিজেদেরকে বিশ্লেষণ করা উচিত যে, আল্লাহ্ তা’লার ইচ্ছানুসারে আমরা আমল করছি কিনা। মিথ্যা বলা কতটা গুরুতর পাপ যে, প্রতিমা পূজার সমান্তরালে এর বর্ণনা করা হয়েছে … মহানবী (সা.) তো এর মানদণ্ড এত উঁচুতে স্থাপন করেছেন যে, এমনকি রসিকতার ছলেও মিথ্যা বলাকে তিনি মিথ্যা হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। এই হলো সেই মানদণ্ড যা অর্জনে আমাদের প্রয়াসী হতে হবে।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও বলেন:

“পৃথিবীতে খোদা তা’লার রাজত্ব কায়েম করতে আমরা প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর হাতে বয়আত গ্রহণ করেছি। যদি আমরা মিথ্যার আশ্রয় নিতে শুরু করে দিই তাহলে পৃথিবীতে খোদার রাজত্ব কায়েম করার পরিবর্তে আমরা পৃথিবীতে শয়তানের রাজত্ব প্রতিষ্ঠাকারীতে পরিণত হবো। সুতরাং, আমাদের জন্য এটি অনেক দুশ্চিন্তা ও ভাবনার বিষয়।”

হুযূর আকদাস ব্যভিচারের কথাও উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, মিডিয়ার মাধ্যমে বর্তমান যুগ সকল সীমা অতিক্রম করেছে এবং অশ্লীলতায় এমনভাবে নিপতিত হয়েছে যা পূর্বে কখনো হয় নি।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) পবিত্র কুরআনের সূরা বনী ইসরাঈল-১৭:৩৩ আয়াত উদ্ধৃত করেন, যেখানে বলা হয়েছে:

“তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হবে না, নিশ্চয় এটি প্রকাশ্য অশ্লীলতা ও নিকৃষ্ট পন্থা।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“ব্যভিচারের মধ্যে এমন সকল ধরনের কুরুচিপূর্ণ আচরণ অন্তর্ভুক্ত যেগুলো মন্দ, অশ্লীলতা এবং নির্লজ্জতার দিকে নিয়ে যায়। … সুতরাং, আহমদী মুসলমান হিসেবে আমাদেরকে একদিকে যেখানে সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই পাপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিরাপদ রাখতে হবে, সেখানে পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে অন্যদেরকেও বুঝানোর চেষ্টা করা উচিত। বস্তুত, অশ্লীলতা ও ব্যভিচার ছড়ানো নাস্তিক্যবাদীদের একটি এজেন্ডা, যারা মানুষকে খোদা তা’লা ও ধর্ম থেকে দূরে নিয়ে যেতে চায়। তাই এই জিহাদে আমাদেরকে অবশ্যই সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।”

হুযূর আকদাস বলেন যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাদীসসমূহে শেষ যুগের লক্ষণাবলী সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে যে, ব্যভিচার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে, আর বর্তমান যুগে এটি পূর্ণ হয়েছে।

অপর এক অপকর্মের কথা বলতে গিয়ে হুযূর আকদাস বয়আতের দ্বিতীয় শর্তের কথা উল্লেখ করেন এবং গুরুত্বারোপ করেন যে, কারো প্রতি কোনো প্রকার অবিচার করা পাপ।

হুযূর আকদাস একটি হাদীস উল্লেখ করেন যেখানে মহানবী (সা.) বলেন যে, “নিজেকে সেই ব্যক্তির দোয়া থেকে রক্ষা করো, যার ওপর কোন প্রকার যুলুম করা হয়েছে; কেননা, তার ও আল্লাহ্র মাঝে কোনো অন্তরায় নেই।”

তাঁর বক্তব্যে হুযূর আকদাস বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কুফল সম্পর্কে বলেন।

একটি হাদীস উল্লেখ করে হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন যে, তোমরা দেখবে আমার পরে মানুষের সাথে অন্যায় আচরণ করা হবে। অনেক কিছুই হবে যেগুলোকে তোমরা অসঙ্গত হিসেবে জানো, আর যা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী হবে। তখন লোকেরা মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, ‘ইয়া রসূলুল্লাহ (সা.), এমন অবস্থায় আপনি আমাদেরকে কেমন আচরণ করার আদেশ করেন?’ মহানবী (সা.) উত্তরে বলেন যে, তোমরা তাদের [শাসকদের] অধিকার প্রদান করবে এবং আল্লাহ্র কাছে নিজেদের অধিকার চাইবে। তাদের অধিকার প্রদান করে যাও, তাদের সাথে বিদ্রোহ কোরো না।”

প্রত্যেক আহমদীর অবশ্যই পরিত্যাগ করা উচিত এমন পাপসমূহ তুলে ধরার পর, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“সুতরাং, এটিই আমাদের কর্মপরিকল্পনা। আমরা ‍যদি এর ওপর আমল করি, তবে আমরা পৃথিবীতে এক মহান বিপ্লব সাধন করতে সমর্থ হবো। বয়আতের প্রতিটি শর্তের মাঝে প্রজ্ঞার অপরিসীম ভাণ্ডার রয়েছে। একজন আহমদী মুসলমানের উচিত তার বিশ্বাসকে জাগ্রত রাখার জন্য এগুলো নিয়ে চিন্তা অব্যাহত রাখা। কেবল তখনই আমরা বয়আতের অধিকার আদায় করতে পারবো।”

তাঁর বক্তৃতার শেষলগ্নে হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আজ লাজনা ইমাইল্লাহ্ সংগঠনের প্রতিষ্ঠার একশত বছর পূর্ণ হয়েছে। লাজনার এ বিষয়টি স্মরণ রাখা উচিত, এই বিশ্লেষণ করুন যে, এই একশত বছরে লাজনা সদস্যাগণ নিজেদের মাঝে পবিত্র পরিবর্তন কতটা আনয়ন করেছেন আর নিজেদেরকে বয়আতের শর্তসমূহ পূরণকারী কতটা বানিয়েছেন; এজন্য কতটুকু প্রচেষ্টা করেছেন এবং নিজ সন্তানাদি ও বংশধরদেরকে কতটা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সঙ্গে কৃত বয়আতের অঙ্গীকার রক্ষাকারী এবং তাঁর দাবির সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারী এবং তাঁকে মান্যকারী বানিয়েছেন? যদি আমরা এভাবে নিজেদের সন্তানদের লালন-পালন করে থাকি, তাহলে নিশ্চিতভাবে লাজনা ইমাইল্লাহ্‌র সদস্যাবৃন্দ আল্লাহ্ তা’লার কৃতজ্ঞ বান্দা। সুতরাং, আজ আমাদেরকে এই পর্যালোচনা করতে হবে, আর যেখানে কোনো ঘাটতি রয়ে গেছে, সেখানে গুরুগম্ভীর প্রতিজ্ঞা করুন যে, লাজনা ইমাইল্লাহ্‌র নতুন শতাব্দীতে এই অঙ্গীকারের সঙ্গে আমাদের প্রবেশ করতে হবে যে, আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মসমূহকে বয়আতের অধিকার রক্ষাকারী হিসেবে গড়ে তুলবো।”