খিলাফতের মাকাম ও মর্যাদাঃ হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল (রাঃ)-এর দৃষ্টিতে

মোহাম্মদ হাবীব উল্লাহ্‌

হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল (রাঃ) তাঁর বিভিন্ন মুল্যবান বক্তব্য ও ভাষণে, জুমুআর খুতবায় এবং কু্‌রআন করীমের দরসে জামাআতকে খলীফার মাকাম ও মর্যাদা সম্পর্কে বিশদভাবে বুঝিয়েছেন। তা থেকে চয়নকৃত কতিপয় উদ্ধৃতি বর্ণিত হলোঃ

‘খলীফা’-জাগতিক কোন দলিল প্রমাণ বা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হোন না বরং আল্লাহ্‌ তাআলারই সাহায্য ও সমর্থনে এ পদে অধিষ্ঠিত হোনঃ

অতএব মানুষ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখে নিক যে ‘ইসলাম’-এর চেয়ে আর বড় নে’মত বা মান সম্মানের কোন বস্তু জগতে নেই। আমি পূর্বে উল্ল্যেখ করেছি যে- যুগের চাহিদার প্রেক্ষিতে ‘খলীফা’ বানানোটা খোদা তাআলার প্রতিশ্রুতি; আর ‘সেই খলীফা’ দলীল প্রমাণ দ্বারা নয়, জনগণের ভোটের নির্বাচন দ্বারাও নয় বরং খোদা তাআলারই সাহায্য সমর্থন ও পরাক্রমশালী শক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হোন। এখন এ যুগের সর্বোচ্চ কল্যাণ দানকারীর প্রতি লক্ষ্য করে ভেবে দেখো! কেউ কি বলতে পারে যে সে ব্যক্তি ধান্দাবাজ ও (মুশরেক) আল্লাহ্‌’র প্রতি অংশীবাদিতা আরোপকারি আর ইবাদত বন্দেগীতে দূর্বল। কেউ হয়ত বলতে পারে যে ইবাদতকারী এক খোদার গুণগ্রাহী রূপে দৃশ্যমান এ ব্যক্তিটি সম্ভবতঃ ভান করছে মাত্র! কিন্তু আল্লাহ্‌ তাআলা সেই ব্যক্তির পবিত্র আকাঙক্ষা ও সত্যনিষ্ঠাকে নিজের সাহায্য ও সমর্থন যুগিয়ে তার দাবীর স্বপক্ষে সাক্ষ্য দান করে চলছেন। তবে এরূপ ধারণা হতে পারে যে সে বুঝি কেবল ভয় ভীতির সময়েই এক খোদার গোলামীতে রত থাকে, না! কক্ষণও নয়!! ভয়-ভীতির অবস্থা যখন শান্তি ও নিরাপত্তাপূর্ণ অবস্থায় পরিবর্তিত হয়ে যায়, তখনও সে, সেই পরম সত্যেরই দাসত্বে নিমগ্ন থাকে।

প্রকৃতপক্ষে ঈমান বৃদ্ধির জন্য খোদা তাআলা প্রদত্ত অনুগ্রহরাজির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে চিন্তা ভাবনা করার চেয়ে উত্তম কিছু নেই। ঈমান, আক্বীদা, আমল, পারস্পরিক লেনদেন ও নানা বিষয়ের দিকনির্দেশনাপূর্ণ অতুলনীয় এক নে’মত হলো- ‘ইসলাম’। আবার মুসলমানদের মধ্য থেকে সেই ‘ফিরকা’ যারা আল্লাহ্‌ তাআলার খলীফাগণের পরম্পরাকে মান্য করে চলে তাদের থেকে অগ্রগামী কেউ নেই, কেননা তারা জানে যে আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতিশ্রুতিপ্রাপ্ত তাঁর (যুগ খলীফার) চেয়ে বড় আর কেউই নেই। (খুতবাতে নূর থেকেঃ পৃষ্ঠা ১২)

খলীফার বিরোধিতা-এক চিরন্তন রীতিঃ

এটাও আল্লাহ্‌ তাআলার এক অমোঘ নিয়ম। আদিকাল থেকে চলে আসছে যে-খলীফাগণকে ধিক্কার দিয়ে ভৎসনা করা হয়। আদম (আঃ)-এর প্রতি ধিক্কারকারী অপবিত্র আত্মার বংশধরেরা আজও বিদ্যমান। সাহাবাগণের (রেজুআনাল্লাহু আলাইহিম) প্রতি বড় বড় সব আপত্তি উত্থাপনকারীরা আজও আছে, তবে আল্লাহ্‌ তাআলাই নিজ অনুগ্রহ ও দয়ায় তাদের শক্তি ও শাসনাধিকার দান করেন আর ভয়-ভীতি ও শঙ্কাকে শান্তি-স্বস্তি ও নিরাপত্তায় বদলিয়ে দেন। আল্লাহ্‌ তাআলার প্রকৃত গুণগ্রাহী ও নিষ্ঠাবান ইবাদতগুযার হও। খোদা মুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করো। এক্ষেত্রেও আল্লাহ্‌ তাআলা ‘রাযীতু লাকুমুল ইসলামা দ্বীনা’ (আল মায়েদাঃ ৪) বলেছেন। ‘ইসলাম’-ইসলাম শব্দটির দাবী এই যে, ‘কিছু করে দেখাও’। বর্তমান সময়ে আমরা (আমরা বলতে ওই লোকেরা যারা ইমামের হাতে তওবা করেছি) সাধারণ মুসলমানদের থেকে অগ্রগামী হওয়ায় পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

আমাদের মধ্যে ইলহামপ্রাপ্ত ব্যক্তি রয়েছেন। আমাদের মধ্যে ‘হাদী ও ইমাম’ আছেন। আমাদের মধ্যে তিনি আছেন, যাকে খোদা সাহায্য সমর্থন দিয়ে চলছেন। যার সাথে খোদার বড় বড় প্রতিশ্রুতি আছে। তাঁকে ন্যায় বিচারক মীমাংসাকারী খোদা-ই পাঠিয়েছেন। কিন্তু তোমরা নিজেদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেখো! সাহায্য সহযোগিতা ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে যতটা সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা তোমাদের জন্য আবশ্যকীয় ছিল- ততটা করেছো কী?

রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সূরা হুদ আমাকে বৃদ্ধ করে ফেলেছে! এতে কোন্‌ বিষয় ছিল? ‘ফাস্‌তাক্বিম কামা উমিরতা’ (সূরা হুদঃ ১১৩) তুমি সহজ সরল রীতি নীতি অবলম্বন করো, কেবল তুমিই নও বরং তোমার সঙ্গী-সাথীরাও। এই সঙ্গী সাথীরা, যারা হুযূর (সাঃ)-কে বৃদ্ধ করে দিয়েছে। কোন ব্যক্তি নিজের দায়িত্ব তো নিজে গ্রহণ করতেই পারে তবে সঙ্গী সাথীদের নিশ্চয়তা বিধান করা – কেমন করে সম্ভব? এটা খুবই ভয় ও বিপদসঙ্কুল অবস্থা। এমন না হয় যে- তোমাদের অলস উদাসীনতার কারণে আল্লাহ্‌ তাআলার সেই প্রতিশ্রুতি যা তোমাদের ইমামের সাথে রয়েছে, পূর্ণ হতে গিয়ে মাঝ পথে মূলতবী হয়ে যায়। মূসা (আঃ)-এর মত প্রতাপশালী নবীর সাথে ‘কেনান’ নামক স্থানে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু তাঁর জাতির অলস উদাসীনতা তা থেকে বঞ্চিত করে দেয়। এজন্য নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য উপলব্ধি করো আর গভীরভাবে অনুধাবন করো। দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলো। আর এই নে’মত-এর কদর কর যা আজকের কল্যাণমন্ডিত দিনে পূর্ণতা লাভ করেছে। আমি আবারো বলছি যে, অনুগত হয়ে দেখিয়ে দাও। [প্রাগুক্তঃ পৃষ্ঠা ২৪]

হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর জাতি থেকেই ‘খলীফা’ হতে থাকবেনঃ

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বয়স ৯৯ বছর হয়েছিল। আল্লাহ্‌ তাআলা নিজ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাঁকে নেক সন্তান দান করেন। ইসমাইল (আঃ)-এর মত এক মহান পুত্র সন্তান তাঁকে দিলেন। ইসমাইল (আঃ) বড় হলে নির্দেশ হলো যে, তাঁকে কুরবানী (উৎসর্গ) করে দাও। এবারে ইব্রাহীম (আঃ)-এর কুরবানীর প্রতি লক্ষ্য করে দেখো! কালের আবর্তে বয়স ৯৯ বছরে পৌঁছে গেছে। ঐ বৃদ্ধ বয়সে ভবিষ্যৎ সন্তান লাভের সম্ভাবনা কই আর সেই শক্তিই বা তাঁর কোথায়? তথাপি সেই নির্দেশ পালন করতে ইব্রাহীম নিজের পুরো শক্তি-সামর্থ্য, ইচ্ছা-আকাঙক্ষা কুরবানী করে দিয়েছেন। নির্দেশিত হওয়ার সাথে সাথে তিনি (আঃ) পুত্রকে কুরবানী করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছেন, অপর দিকে পুত্রও এমনি পুণ্যাত্মা ছিলেন যে ইব্রাহীম (আঃ) ছেলেকে যখন বললেন, হে পুত্র! ‘ইন্নী আরা ফিল মানামি আন্নি আযবাহুকা’ (আস্‌ সাফ্‌ফাতঃ ১০৩) কোন ওজর আপত্তি না করে তখন সেই পুত্র বলে যে, ‘ইফ্‌ আ’ল মা তু’মার্ব সাতাজিদুনি ইন্‌ শাআল্লাহু মিনাস্‌ সাবিরিন্‌’ (আস্‌ ���াফ্‌ফাতঃ ১০৩), ‘পিতা! জলদি করুন’। তা না বলে সেই পুত্র বলতে পারতো যে ‘এটা স্বপ্নের কথা, এর ব্যাখ্যা হতে পারে’। কিন্তু তা না বলে বললো, ‘তবে করেই ফেলুন’। আমাদের আজকা���কার ঈদুল আযহিয়ার পশু কুরবানী ওই পবিত্র কুরবানীরই নমুনা হিসেবে করা হয়। কিন্তু পর্যবেক্ষণ করে দেখো! সেই কুরবানীতে আর এই কুরবানীতে কতটা তফাৎ! আল্লাহ্‌ তাআলা ইব্রাহীম (আঃ) আর তাঁর পুত্রকে কী পুরস্কার দিয়েছিলেন? তাঁর (আঃ) পরবর্তী প্রজন্ম ধারায় হাজার হাজার বাদশাহ আর নবী সৃষ্টি করেছেন। সেই বিশাল যুগ দান করেছেন যার সমাপ্তি ঘটবার নয়। ‘খলীফা‘ হলে তা ইব্রাহীম (আঃ) এর জাতি থেকেই হবে। ধর্মানুরাগী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ ও খলীফাগণ কিয়ামতকাল পর্যন্ত এই জাতি থেকেই সৃষ্টি লাভ করতে থাকবেন। [খুতবাতে নূর থেকে পৃষ্ঠা ১৪২]

খোদা তাআলা নিজেই যেমন বলেন যে, আমার শাসন ব্যবস্থা এসব লোকেরা খামখেয়ালীপনার সাথে তাচ্ছিল্যভাবে মেনে থাকে। খোদার রাজ্যে মানুষের হাল অবস্থাই যখন এমন, তাহলে নবীগণের শাসনকাল যখন চলে লোকেরা তখন আরও আপত্তিসমূহ অন্বেষণ করতে থাকে আর বলে ‘লাও লা নুযযিলা হাযাল কুরআনু আ’লা রাজুলিম্‌ মিনাল ক্বারইয়াতাইনি আ’যীম’ (আল যুখরুফঃ ৩২) অর্থাৎ ওহী লাভের উপযুক্ত হলেন ওমুক সম্ভ্রান্ত বংশীয় ব্যক্তি বা ওমুক বিজ্ঞ আলেম। এ থেকে প্রকাশ পায় যে মানুষ রসূলের আবির্ভাব হওয়া বিষয়ে নিজেরা মনগড়া কিছু কার্যকারণ ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে নেয় যার সাথে ঐশী পরিকল্পনা মোটেই খাপ খায় না-এমনটাই হয়ে থাকে। আর রসূলের খলীফার শাসন ব্যবস্থা যখন চলতে থাকে তখন তো হাসি-তামাশা, ঠাট্টা-বিদ্র্বপ আর ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে ‘হায় হায়’ রব তোলা হয়। এজন্যই আল্লাহ্‌ তাআলা বলেছেন, ‘আ হুম ইয়াক্বসিমুনা রাহমাতা রাব্বিকা নাহনু ক্বাসামনা বাইনাহুম মাঈ’ শাতাহুম’ (আল যুখরুফঃ ৩৩) অর্থাৎ -কী! এই লোকেরা ঐশী অনুগ্রহরাজি নিজেরাই বিতরণ করছে? যখন কী’না দেখছে যে জীবনোপকরণের ক্ষেত্রে আমরা তাদের স্ব-নির্ভর রাখিনি আর আমরা নিজেরাই সেসব বন্টন করছি। অতএব, তারা যখন জানেই যে খোদার পরিকল্পনায় সবকিছু ঘটছে তাহলে নবী রসূল এবং তাদের খলীফাগণের নির্বাচন তো তারই ইচ্ছানুযায়ী হওয়াই আবশ্যকীয়।

সূরা হুযুরাতে আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন, ‘আন্না ফিকুম রসূলুল্লাহে লাও ইউতিউ’কুম ফি কাছিরিম্‌ মিনাল আম্‌রি লাআনিত্‌তুম’ (আল হুযুরাতঃ ৮) অর্থাৎ-তোমাদের মধ্যে মুহাম্মদ (সাঃ) খোদার রসূল। তোমরা যদি নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলো তবে তোমরা দুঃখ কষ্ট ও বিপদাবলীর সম্মুখীন হবে। এটা খোদারই নির্ধারণ যে তাঁর নিজ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইমাম বানানো, খলীফা বানানো, – এটা তাঁরই কাজ। তোমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি সেখানে কোন কাজে আসবে না। ‘রমুযে সালতানাত খাবেয়েশে খুসরওঁয়া দানদ্‌’- সম্রাট খসরূর স্বজনেরা সাম্রাজ্য পরিচালনার রহস্যাবলী ভালভাবেই জানতেন। আমাদের বলাতেই আল্লাহ্‌ তাআলা যদি এক ব্যক্তিকে মামুর (প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষ) বানিয়ে দেন আর তার স্বভাব চরিত্র অপবিত্র নৈতিকতাপূর্ণ অকেজো বলে সাব্যস্ত হয়, অত্যাচারী, স্বেচ্ছাচারী, বিদ্বেষপরায়ণ পরিলক্ষিত হয়, তবে দেখো! কত বড় বিপদ!! এ কারণেই মানুষদের গড়া সংগঠনের ও সমাজের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টদেরকে অপসারণ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে অথবা তার (প্রেসিডেন্টের) নিজেকেই পদত্যাগ করে চলে যেতে হয়। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ নিজেদের দেহকে কেঁটে ছিঁড়ে পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে আর পৃথিবীর প্রতিটি প্রতিবন্ধকতা দূর করে চলছে শুধু এজন্য যে তার জীবন ধারণের যোগান আসবে। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখো! কোন কিছুই অযথা আগাম আসেনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অল্প দিনেই প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। প্রতিটি রোগের আক্রান্তকারীর জীবাণু সম্পর্কে জানা হয়েছে কিন্তু তবুও রোগব্যাধি হচ্ছেই-অহরহ মৃত্যুও ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা তিন লাখ বছর পূর্বের অবস্থা পর্যন্ত জানাতে সক্ষম হচ্ছেন যে সে যুগে এমনটা বিরাজ করছিল, তবে আগামীকাল কী ঘটবে বা কয়েক মুহূর্ত পর কী ঘটতে যাচ্ছে? এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই। তাহলে এটা কেমন নির্বুদ্ধিতা যে এমন ‘মহামর্যাদাপূর্ণ নির্বাচন’ কর্মটি মানুষ নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেয় আর বলে যে নবী আর প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষ আমাদেরই ইচ্ছানুযায়ী হোক। (খুতবাতে নূর থেকে, পৃষ্ঠাঃ ১৭০)

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে মে, ২০০৮ইং