খেলাফতের তাৎপর্য

আনোয়ারা বেগম

মুসলিম ঐক্যের একমাত্র মাধ্যম হলো খিলাফত। ইসলামের আদর্শ কায়েম রাখার জন্যও খিলাফত দরকার। নবীগণের ওফাতের পর তাঁদের কার্যাদি, আদর্শ-মতাদর্শ জারী রাখার জন্য খেলাফতের প্রয়োজন। হে ঈমানদারগণ! যতদিন তোমরা ঈমান জারী রাখবে ততদিনই খিলাফত থাকবে। নবুয়তের পরে দ্বিতীয় কুদরত খিলাফত। সূরা আন্-নুরের ৫৬নং আয়াতে বলা হয়েছে,

নিশ্চয়ই তিনি পৃথিবীতে তাঁদের মধ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করবেন যেভাবে তিনি খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে।

আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট নবী রসূল ও খলীফাগণ মানুষের আধ্যাত্মিক ব্যাধি নিবারণ করার লক্ষ্যে এই দুনিয়ায় আগমন করে থাকেন। আর খোদা তা‘আলা তাদেরকে সমসাময়িক আধ্যাত্মিক রোগ-ব্যাধি দূর করার পন্থা বাতলিয়ে থাকেন। সময়োপযোগী সেই ব্যবস্থাপত্রগুলি “তাহরীক” বলে অভিহিত। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে,

“ইন্নী যায়ালুন ফিল্ আরদি খলীফা”-“নিশ্চয়ই পৃথিবীতে আমি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবো”। তখন ফিরিশ্‌তারা বললো, হে আল্লাহ্! আমরা তো তোমার প্রশংসা করছি ইবাদতও করছি। তাহলে মানব সৃষ্টির কি দরকার? তারাতো পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করবে। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা বললেন, “আমি যা জানি তোমরা তা জানো না”।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন,

“ওয়াদাল্লাহুল্লাযীনা আমানু মিনকুম ওয়া আমিলুস্ সালিহাতি লা ইয়াস্ তাখলি ফান্নাহুম ফিল আরদি কামাস্ তাখ্‌লাফাল্লাযীনা মিন ক্বাবলিহিম”
অর্থাৎ “তোমাদের মধ্যে যাহারা ঈমান আনে এবং পুণ্যকাজ করে তাহাদের সঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা অঙ্গীকার করিয়াছেন যে, নিশ্চয়ই তিনি তাহাদের মধ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করিবেন যেভাবে তিনি খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাহাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে”। (সূরা আন্-নূর ৫৬নং আয়াত)

খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ওয়াদা স্পষ্ট ও সন্দেহাতীত।

খিলাফত দুই প্রকার। যথা (১) কুদরতে উলা অর্থাৎ মহিমার প্রথম বিকাশ এবং (২) কুদরতে সানী অর্থাৎ মহিমার দ্বিতীয় বিকাশ। নবী ও রসূলগণ আল্লাহ্ তা‘আলার মহিমার প্রথম বিকাশ। যেহেতু নবী ও রসূলগণ মৃত্যুর অধীন তাই নবীর মৃত্যুর পরে খেলাফতের মাধ্যমে মহিমার দ্বিতীয় বিকাশ ঘটে। খলীফা ঐশী ইঙ্গিতেই নির্বাচিত হয়ে থাকেন। খলীফার নির্বাচন খোদা তা‘আলাই করে থাকেন। খলীফার বিরুদ্ধাচরণ মূলতঃ বিদ্রোহেরই নামান্তর। হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) বলেছেন,

“আমি আবু বকরকে আমার পরে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে আমি চিন্তা করে দেখলাম যে এটা আল্লাহ্ তা‘আলার কাজ। খলীফার মসনদে কাউকে সমাসীন করা খোদা তা‘আলাসরই কাজ।”

তিনি আরো বলেছেন,

“যদি হাবসী গোলামও নেতা হন তাহলে তাঁর কথা মান্য করবে। কারণ আমার পরে যারা জীবিত থাকবে তারা বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন সকলে আমার সুন্নত এবং সত্য ও সঠিক পথ প্রাপ্ত খুলাফা মাহ্‌দীঈনের সুন্নতের উপর কায়েম থাকবে”।

প্রত্যেক মামুর মিনাল্লাহ অর্থাৎ নবীর পরে অবশ্যই খিলাফত কায়েম হয়ে থাকে। আল্লাহ্ তা‘আলা সৎকর্মশীল মোমেনগণের সঙ্গে, তাদের মধ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছেন সূরা আন্ নূরের ৫৬নং আয়াত নাযেলের মাধ্যমে।

প্রত্যেক নবীই খলীফাতুল্লাহ্। ইমাম মাহ্‌দী ও মসীহে মাওউদ (আঃ) সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত আছে,

“ফাইন্নাহু খলীফাতুল্লাহীল মাহ্‌দী”
অর্থাৎ “আগমনকারী মাহ্‌দী আল্লাহ্‌র তরফ থেকে নিয়োগকৃত খলীফা হবেন।” (ইবনে মাযা)

হযরত আদম (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন,

“ইন্নী যায়েলুন ফিল্ আরদি খলীফা”
অর্থাৎ “আমি পৃথিবীতে খলীফা নিযুক্ত করতে যাচ্ছি।” (সূরা আল বাকারাহঃ ৩১)

হযরত দাউদ (আঃ) কে খলীফা বলা হয়েছে।

“ইয়া দাউদু ইন্না যাআ’লনাকা খালিফাতান ফিল আরদি”
অর্থাৎ “হে দাউদ! আমরা তোমাকে জমীনের উপরে খলীফা নিযুক্ত করলাম।” (আস্‌-সাফ্‌ফাতঃ ২৭)

পবিত্র কুরআনে আরো কতিপয় খেলাফতের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন, কোন জাতি খোদা তা‘আলার রুদ্র রোষের শিকার হয়ে যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তখন তাদের পরে যাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়।

“স্মরণ করো, সেই সময়কে যখন তিনি নূহের জাতির পর তোমাদিগকে স্থলাভিষিক্ত করেছেন।” (আল আরাফঃ ৭০)

এবং “স্মরণ কর যখন তিনি আদমজাতির পর তোমাদিগকে স্থলাভিষিক্ত করেছেন।” (আল আরাফঃ ৭৫)

খিলাফত নবীর স্থলাভিষিক্ত। খলীফাগণকে বলা হয় “আমীরুল মুমেনীন” বা “বিশ্বাসীগণের নেতা”। ঐশী ইঙ্গিতেই খলীফা নির্বাচিত হয়ে থাকেন। খলীফার নির্বাচন খোদা তা‘আলাই করে থাকেন।

খলীফা ব্যতীত খেলাফতের কথা চিন্তাই করা যায় না। ইসলামের রজ্জু বা রশিই হলো খিলাফত। আর তা শক্তভাবে আঁকড়িয়ে ধরা প্রত্যেক আহ্‌মদীর কর্তব্য। প্রমাণ স্বরূপ দেখুন আহ্‌মদীয়া জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর ওফাতের পর প্রথম খলীফা, দ্বিতীয় খলীফা, তৃতীয় খলীফা, চতুর্থ খলীফা, ইনাদের প্রত্যেকের ওফাতের পর পরই শুভ সূচনা হলো এক যুগের পর আর এক স্বর্ণ যুগের নতুন অধ্যায়। যার মূল্য কেবল মাত্র আহ্‌মদীগণই বুঝতে পারেন। খলীফার হাতে হাত রেখে বার বার বয়’আত নবায়নের তাৎপর্য হলো ইসলামের রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়িয়ে ধরা। এতে বয়’আতকারীর আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়। খলীফাগণের ওফাতের পর পরই খোদা তা‘আলা তাঁর দ্বিতীয় প্রকার কুদরতের অর্থাৎ দ্বিতীয় কুদরতের প্রকাশ জারী রেখে পতনোন্মুখ জামা’তকে রক্ষা করলেন, খেলাফতের ধারাবাহিকতায় খলীফা নির্বাচন করে। কেননা তাঁর ঐশী জামা’ত নেতৃত্ববিহীন চলতেই পারে না। আল্লাহ্‌র নির্বাচিত খলীফাগণের সকলেই একই আধ্যাত্মিকতার ধারক হয়ে থাকেন।

আহ্‌মদীয়া জামা’ত আল্লাহ্‌র জামা’ত-সত্য জামা’ত। শত বৎসর পূর্বে লাগানো এ ছোট্ট চারা গাছটি বিভিন্ন চড়াই উৎরাই ডিঙ্গিয়ে আজ বিশাল বৃক্ষের আকার ধারণ করেছে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন ১৮৫টি দেশেরও বেশী দেশে আহ্‌মদীয়াত প্রচারের মাধ্যমে। হযরত ইমাম মাহ্‌দী (আঃ)-এর উপরে ইলহাম

“আমি তোমার প্রচারকে দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছিয়ে দেব”।

দুনিয়ার কিনার তক পৌঁছানোর কি সুমহান ব্যবস্থা! আহ্‌মদী জামাতের চতুর্থ খলীফা মির্যা তাহের আহমদ রাহেমাল্লাহুর বহু তাহরীকের একটি সর্বোৎকৃষ্ট তাহরীক MTA অর্থাৎ মুসলিম টিভি আহ্‌মদীয়ার সার্বক্ষণিক প্রচারের কি সুমহান ব্যবস্থা MTA অর্থাৎ MIRZA TAHIR AHMAD কি অপূর্ব সমন্বয়!

MTA ঐশী নিয়ামত। পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশের দেশে দেশে বিভিন্ন জাতি-বর্ণের মধ্যে ভেদাভেদবিহীনভাবে চব্বিশ ঘন্টা আল্লাহ্ তা‘আলার অমোঘ বাণী প্রচার করে যাচ্ছে। জামা’ত আহ্‌মদীয়ার তৃতীয় খলীফার সেই বাণী “Love For All, Hatered For None”– অর্থাৎ “সবার জন্য ভালবাসা কারো জন্য ঘৃনা নয়” বর্তমান যুগের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। খেলাফতের সুদৃঢ় পবিত্র রজ্জুর দরুনই এটা সম্ভব হয়েছে। এজন্য আমরা মহান খোদা তা‘আলার দরবারে কোটি কোটি শোকরিয়া জানাই। MTA ব্যবস্থা বর্তমানে অস্থিতিশীল সমাজ ব্যবস্থা থেকে স্বীয় পরিবার বর্গকে অবক্ষয় মুক্ত রাখার কি অপূর্ব ব্যবস্থাপনা!

আধ্যাত্মিক এক নেতার নেতৃত্ব মানার মধ্যে যে নেয়ামত তা দুনিয়ার কোন দেশে বা জাতিতে পাওয়া যাবে না, আহ্‌মদীয়া জামাতের ন্যায় মহা সৌভাগ্যবান সংগঠনটির ব্যবস্থাপনার মধ্যে যা নিহিত। যা দ্বিতীয় কুদরতের আকারে প্রকাশ পেয়েছে। এই খেলাফতে আহ্‌মদীয়া ইনশাআল্লাহ্ কেয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে। অতএব খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ওয়াদা স্পষ্ট ও সন্দেহাতীত। ঐশী জামা’ত কখনো নেতৃত্ববিহীন থাকতে পারে না। কিছুদিন পূর্বে আমাদের প্রাণপ্রিয় খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহেঃ) ইন্তেকাল করেন। তখন খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়তের ধারায় প্রতিষ্ঠিত খিলাফত মজলিসে ইন্তেখাবের ব্যবস্থাপনায় হযরত মির্যা মাসরূর আহমদ (আই:) আহ্‌মদীয়া জামাতের পঞ্চম খলীফা নির্বাচিত হন। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁহার হাত মজবুত করুন এবং দীর্ঘায়ু দান করুন। (আমীন!)

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩০শে জুন ২০০৭