খিলাফতের প্রতি আনুগত্য সর্বাবস্থায় জরুরী


আমীর মাহমুদ ভূইয়া

মুসলিম জাহান আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অনুসারী মুসলমানরা সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের শিকার হয়ে বিধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। অধঃপতিত মুসলমানরা নেযামে জামাতের স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা আজ শতধা বিভক্ত হয়ে পরস্পর ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। মুসলমানরা অনৈক্যের কারণে ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়তে দ্বিধাবোধ করছে না। ইরান-ইরাক যুদ্ধ এবং উর্দূভাষী ও বাংলাভাষীদের মধ্যেও অতীতে (জাতিগত) যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে অগণিত মুসলমান নিহত হয়েছে। মুসলমানরা ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ায় তাদের উন্নতি ও অগ্রগতি থেমে গেছে। তাদের মাঝে ধীরে ধীরে একতার শৃঙ্খল সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ায় তাদের জাতীয় জীবনে বার বার বিপর্যয় ও ধ্বংস নেমে এসেছে। তথাপি মুসলিম জাহানের চেতনা ফিরে আসেনি। বলা আবশ্যক, শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মতের এই চরম অধঃপতন ও বিপর্যয় মু‘মিন মুত্তাকীদের কাম্য নয়। মুসলিম জাহান নেতৃত্বশূণ্য অবস্থায় থাকতে পারে না।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বিশ্ববাসীকে ধ্বংস ও পতন থেকে পুণ্যের পথে চালিত করার জন্য এসেছিলেন। তিনি তাকওয়াভিত্তিক জীবন যাপন করতে বলেছেন। তিনি ঐশী নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য স্বীকার করে একতার শৃংঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন সুদৃঢ়তর করে প্রগতির পথে চলতে বলেছেন। আজ মুসলিম জাহান কোন্‌ পথে চলেছে? আজ মুসলমানরা জামা’তবদ্ধ না হয়ে চলায় পরজাতির কাছে প্রচন্ডভাবে মার খাচ্ছে। ফিলিস্তিনী মুসলমানরা ইহুদী চরমপন্থি অপশক্তির হাতে নিগৃহীত ও নিপীড়িত হচ্ছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরের মাঝে ঐক্য ও সংহতি নেই। মুসলিম জাহান আজ নানা বলয়ে বিভক্ত। ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলো পরাশক্তির করায়ত্তে থাকায় তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কোন ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করতে পারে না। অবাধ্য মুসলিম রাষ্টশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা যেমন ওআইসির নেই তেমনি নির্যাতিত মুসলমানদের পাশে দাঁড়াবার ক্ষমতা ও শক্তি কোনটাই এদের নেই। আরবলীগ ইরাক ও ফিলিস্তিনী জনগোষ্ঠীর জন্য কিছুই করতে পারছে না। এই সংগঠণ আরব দুনিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা স্থাপনে কোন অবদান রাখতে পারছে কি? তাহলে এই আরবলীগের কোন প্রয়োজন আছে কী?

প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অন্তর্ধানের পর মুসলমানদের মধ্যে ঐশী খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। সৎকর্মশীল মু‘মিনদের সঙ্গে মহান আল্লাহ্‌ এই খিলাফত ব্যবস্থা কায়েমের অঙ্গীকার করেছেন। নবীর তিরোধানের পর প্রতিনিধিত্বশীল এই ঐশী ব্যবস্থা জারী থাকবে। যেমন প্রাথমিক যুগে হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমর (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ)-এর খিলাফত কায়েম হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর যে খিলাফত কায়েম হয় তা ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তো মাত্র ত্রিশ বছর বিদ্যমান ছিল। এরপর শুরু হয় মুসলমানদের চরম অধঃপতন ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার পালা। ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর শিরোভাগে হযরত ইমাম মাহ্‌দী ও মসীহ্‌ মাওউদ হওয়ার দাবীকারক ভারতের কাদিয়ানে আবির্ভূত হযরত মির্যা গোলাম আহ্‌মদ (আঃ)-এর মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আশিসমন্ডিত শ্রেষ্ঠ অনুগত উম্মতী নবীর আগমনের ফলে মুসলিম দুনিয়ায় আধ্যাত্মিক মহাপরিবর্তন ও বিপ্লবের শুভ সূচনা ঘটে। মুসলিম জাহানে আবার ঐশী নেতৃত্ব (মুহাম্মদী নবুওয়তের প্রতিচ্ছায়া স্বরূপ) ইমাম মাহ্‌দী ও প্রতিশ্রুত মুহাম্মদী মসীহ্‌ (আঃ)-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুসলিম জাহানকে বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য একজন প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ ইবনে মরিয়ম (আঃ)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী সহী হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। এ সব ভবিষ্যদ্বাণী হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ)-এর মাধ্যমে সগৌরবে পূর্ণতা লাভ করেছে। তিনি ছাড়া অন্য কেউ আল্লাহ্‌ কর্তৃক প্রেরিত হওয়ার দাবী যথা সময়ে (হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীতে) করতে পারেনি। হাদীসে বর্ণিত প্রতিশ্রুত ঈসা ইবনে মরিয়ম ও হযরত ইমাম মাহ্‌দী (আঃ) সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণতাকল্পে নির্ধারিত হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর শিরোভাগে হযরত মির্যা গোলাম আহ্‌মদ (আঃ) আবির্ভূত হয়েছেন। যথা সময়ে আগমনকারী যুগ ইমামকে গ্রহণ করে নেওয়ার মাঝেই সবার মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত।

কোন নবীর নবুওয়তের ধারাই চিরকাল জারী থাকেনি। অতীতে বনী ইসরাঈলের মাঝে নবুওয়তের একটি পর্যায়ক্রমিক ধারা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বলবৎ ও সক্রিয় ছিল। তবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগমনের মধ্য দিয়ে পূর্ববর্তী নবুওয়তের সব ধারা রুদ্ধ হয়ে যায়। এখন মুহাম্মদী নবুওয়তের এই কল্যাণময় ধারা মানব জাতির জন্য চির প্রবহমান রয়েছে। এই মুহাম্মদী নবুওয়তের ধারায় সিক্ত ও আশিসমন্ডিত হয়ে আখেরী জামানায় (পতন যুগে) হযরত ইমাম মাহ্‌দী দ্বিতীয় ও মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) মুসলমানদের নেতৃত্ব প্রদান করবেন এবং তাঁর অন্তর্ধানের পর পরই খেলাফতের ধারার সূত্রপাত ঘটবে। আবার পুনরায় নবুওয়তের পদ্ধতিতে খিলাফতের ধারায় ঐশী প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা ইলাহী জামাতে কায়েম হবে বলে কুরআন হাদীসে ভবিষ্যদ্বাণী বর্ণিত হয়েছে। মোদ্দা কথা হলো, মুসলমানদের মধ্যে ঐশী নেতা এবং নেযামে জামাতের কার্যক্রম অবশ্যই বিদ্যমান থাকবে। কুরআন মজীদে আল্লাহ্‌ বলেন,

“তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ্‌ তাদের সঙ্গে ওয়াদা করেছেন, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে খলীফা নিযুক্ত করবেন যেভাবে তিনি তাদের পূর্ববর্তীগণকে খলীফা নিযুক্ত করেছিলেন; এবং অবশ্যই তিনি তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিবেন যাকে তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয়ভীতিপূর্ণ অবস্থার পর, তিনি তাদের জন্য নিরাপত্তার অবস্থায় পরিবর্তন করে দিবেন; তারা আমার ইবাদত করবে, আমার সঙ্গে কোন কিছুকেই শরীক করবে না এবং এরপর যারা অস্বীকার করবে তারা হবে দৃস্কৃতকারী”। (আন-নূরঃ ৫৬)

হযরত হুযায়ফা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন,

হযরত রসূল করীম (সাঃ) বলেছেন,

“তোমাদের মধ্যে নবুওয়ত কায়েম থাকবে যতদিন আল্লাহ্‌ চাইবেন, অতঃপর তিনি তা তুলে নিবেন এবং নবুওয়তের পদ্ধতিতে খিলাফত (খিলাফতে রাশেদা) কায়েম হবে। অতঃপর আল্লাহ্‌ যখন চাইবেন তখন তা-ও তুলে নিবেন। অতঃপর তাঁর তকদীর অনুযায়ী অদূরদর্শী বাদশাহাত চলবে। যখন এই রাজত্বকালের অবসান হবে তখন তাঁর অন্য তকদীর মোতাবেক অত্যাচার অবিচার ও নিগ্রহপূর্ণ যালিম রাষ্ট্র কায়েম হবে। এমনকি, আল্লাহ্‌তাআলার দয়ার উদ্রেক হবে এবং যুলুম নির্যাতন কালের অবসান হবে। অতঃপর পুনরায় নবুয়াতের পদ্ধতিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে”।

একথা বলার পর তিনি (সাঃ) নীরব হয়ে যান। (মিশকাত, মুসনাদ আহমদ ও মুসলিম)

কুরআন হাদীস পাঠে এই সত্যই মূর্ত্য হয়ে উঠে যে, ইসলাম ধর্মে ঐশী নের্তৃত্ব এবং নেযামে জামাতের অকাট্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা আল্লাহ্‌র অপার অনুগ্রহে চালু থাকবে। আধ্যাত্মিকভাবে যিন্দা নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কালজয়ী শিক্ষা, আদর্শ ও কুরআনী শরীয়ত ব্যবস্থা এবং এর কল্যাণধারাকে মানবজাতির জন্যে চির প্রবহমান ও গতিশীল করে রাখা হয়েছে। কল্যাণের এই উৎসধারা অবারিত রয়েছে।

অপ্রিয় হলেও বলা দরকার, আমরা ইতায়াতে নিযামের কথা প্রায়শই বলে থাকি। তবে তা আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের বাইরে অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় কিনা ভেবে দেখা দরকার। তাহলেই আমাদের খিলাফতের প্রতি আনুগত্যের দীর্ঘ আলোচনার মর্মকথা উপলব্ধি করতে সহজ হবে। সুপ্রিয় পাঠক! ভুলে গেলে চলবে না আমরা ঐশী নেতৃত্বের প্রতি ইতায়াতের কথা বলছি। তবে হ্যাঁ, আমরা এটাও দেখছি আপনারা আপনাদের নিজস্ব পার্থিব সংগঠন এবং এই সংগঠনের নের্তৃত্বে সমাসীন ওলামা মাশায়েখ তাদের কিভাবে মান্য করছেন এবং তাদের আনুগত্য করছেন। এখন প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক ইসলামে এই তথাকথিত নেতৃত্ব এবং মানব রচিত সংগঠনের আনুগত্যের কোন নির্দেশ আছে কি না। তাহলে এটা কী কুরআনী শরীয়ত গর্হিত কাজ নয়? আপনাদের মনগড়া এই শরীয়তী ব্যবস্থাকে, কুরআনী শরীয়ত রদ ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। ঐশী সমর্থন ও সাহায্যপুষ্ট হয়েই ইসলামে নেতৃত্ব দেওয়া যায়। আমরা আবারো বলছি, ইসলামে নেতৃত্বের যে ধারা চলছে এর প্রতি অবশ্যই আনুগত্য করে ইসলামের প্রচার ও প্রসারতার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। আর এ পথেই অসাধারণ সফলতা নিহিত।

আলোচনাকে যথাসম্ভব সংক্ষেপ করে আমরা কুরআন হাদীসের আলোকে এ কথা বলতে পারি, আখেরী যামানায় আগমনকারী ইমাম মাহ্‌দী ও মসীহ্‌ মাওউদ হযরত মির্যা গোলাম আহ্‌মদ (আঃ)-এর মাধ্যমে পূর্ণ খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সহী হাদীসে ইমাম মাহ্‌দী (আঃ)-কে খলীফাতুল্লাহীল মাহ্‌দী বা আল্লাহ্‌র তরফ থেকে নিয়োগকৃত খলীফা বলে সম্বোধন করা হয়েছে (সুনানে ইবনে মাজা বাবু খুরুজুল মাহ্‌দী)

খিলাফতের দু‘টি ধারা রয়েছে। নবী করীম (সাঃ)-এর তিরোধানের পর নবুওয়তের পদ্ধতিতে খিলাফত কায়েম হয়। খিলাফতে রাশেদার যুগ ত্রিশ বছরের মধ্যেই (৬৩২-৬৬১ খৃঃ) অবসান ঘটে। এরপর রাজতন্ত্রমূলক (যুলুম অত্যাচার ও উৎপীড়নের) উমাইয়া শাসন (৬৬১-৭৫০ খৃঃ) কায়েম হয়। এরপর আব্বাসীয় সাম্রাজ্যবাদী শাসন (৭৫০-১২৫৮ খৃঃ) এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যবাদী শাসন (১২৮৮-১৯০৮) কায়েম হয়ে যায়। তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের মাধ্যমে নামমাত্র খেলাফতি শাসনকালেরও পরিসমাপ্তি ঘটে।

প্রিয় পাঠক! ইতিহাসের কার্যক্রমেই খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়ত সম্পর্কিত ভব্যিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতাকল্পে উসমানীয় সাম্রাজ্যবাদের শেষ দিকে খ্রিষ্টীয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে অর্থাৎ হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীতে হযরত মির্যা গোলাম আহ্‌মদ (আঃ)-এর আবির্ভাব এবং তাঁর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতে ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়াই যুক্তিসংঙ্গত। বর্তমানে আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতে-ই ঐশী খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে। আহ্‌মদীয়া মুসলমানরাই একজন খলীফার গতিশীল নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। আহ্‌মদীয়া খলীফার আসন এখন জগতময় পরিব্যপ্ত রয়েছে। বিশ্বের এক ইমামের অধীনে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারতার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ১৮৮৯ইং সালের ২৩শে মার্চ আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’ত নামে একটি স্বর্গীয় প্রতিষ্ঠান জগতে আলো ছড়াবার জন্যে কায়েম হয়। তেষট্টি বছর বয়সে (১৯০৮ সালের ২৬মে) ইসলামে আহ্‌মদীয়া আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ১৯০৮ইং সনের ২৭মে খিলাফত আলা মিন হাজিন নবুওয়ত বা নবুওয়তের তরীকায় বা পদ্ধতিতে ইসলামী খিলাফতের দ্বিতীয় ধারা আহ্‌মদীয়া জামাতে কায়েম হয়েছে। খিলাফতে নেতৃত্বের ধারাক্রমে হযরত মাওলানা আলহাজ্জ হেকিম নূরুদ্দীন (রাঃ) (১৯০৮-১৯১৪), হযরত মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রাঃ) (১৯১৪-১৯৬৫), হযরত মির্যা নাসের আহমদ (রাহেঃ) (১৯৬৫-১৯৮২), হযরত মির্যা তাহের আহমদ (রাহেঃ) (১৯৮২-২০০৩) খলীফা হয়েছেন। হযরত মির্যা মাসরূর আহমদ (আই:) ২৩শে এপ্রিল, ২০০৩ খিলাফতের মসনদে সমাসীন হন পঞ্চম খলীফা হিসেবে। এভাবে প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আঃ)-এর জামাতে ইসলামী খিলাফতের কল্যাণময় ধারা অব্যাহত রয়েছে।

সুধী পাঠক! খিলাফতের প্রতি আনুগত্য বিষয়ে হাদীসে সুস্পষ্ট নির্দেশাবলী রয়েছে। একজন প্রকৃত মুসলমান সে যে আনুগত্য করে জামা’তবদ্ধ হয়ে চলবে-এই প্রশ্নের সদুত্তর যখন ইতিপূর্বে মিলেছে তখন ইতায়াতের ব্যাপারে গড়িমসি করা উচিত হবে না। হ্যাঁ, খিলাফতের প্রতি অবশ্যই আনুগত্য করতে হবে। কারণ আল্লাহ্‌ এবং তাঁর প্রিয় রসূল (সাঃ) এই আনুগত্যের জোর তাগিদ দিয়েছেন। তবে মনে রাখতে হবে এই ইতায়াতে নেযামের মধ্যমণি হলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। এরপর তাঁর বিশেষ প্রতিনিধি হযরত ইমাম মাহ্‌দী (আঃ) এবং তাঁর অবর্তমানে তাঁর জামাতের সম্মানিত খলীফাগণ। আমরা খোলাফায়ে রাশেদীন এবং মোজাদ্দেদীয়তের যামানার কথা এবং তাদের আনুগত্যের কথা ইতিপূর্বে বলে এসেছি। মোদ্দাকথা হলো ঐশী নের্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য করেই ইসলাম ধর্মের সেবা করতে হবে। মুসলমান পরিচয় দিয়ে নেযামে জামাতের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে চলার কোন সুযোগ নেই।

আল্লাহ্‌ বলেন,

“হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ্‌র এবং আনুগত্য কর এই রসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে আদেশ দেওয়ার অধিকারী”। (সূরা নিসাঃ ৬০)

নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর অনুসারীদেরকে উদ্দেশ্য করে কুরআন মজীদে আল্লাহ্‌ বলেন,

“তুমি [নবী মুহাম্মদ (সাঃ)] বলে দাও, তোমরা [বিশ্বাসীগণ] যদি আল্লাহকে ভালবাস তাহলে আমার আনুগত্য কর, আল্লাহ্‌ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দিবেন”। (সূরা আলে ইমরানঃ ৩২)

আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রসূল (সাঃ)-এর এতায়াত করে ধারাক্রমে অন্যান্যদের (যুগ ইমাম) আনুগত্য করে জামা’তবদ্ধ হয়ে চলতে হবে। তবে নবী রসূল এবং তাদের অবর্তমানে তাদের খলীফাগণের আনুগত্য করতে হবে। আল্লাহকে যেমন ভালবাসতে হবে, তেমনি তাঁর প্রিয় রসূল (সাঃ)-কে অবশ্যই সর্বাগ্রে ভালবাসার পাত্র হিসাবে গ্রহণ করে নিতে হবে। এই ভালবাসার হকদার রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর প্রতিনিধি ইমাম মাহ্‌দী ও মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-ও বটে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর যে ভালবাসা ও প্রীতিময় আত্মিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল এর তুলনা হয় না। নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে ভালবাসার দাবী আনুগত্যের দাবী তখনই সত্য প্রমাণিত হবে যখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আধ্যাত্মিক সন্তান হযরত মসীহ্‌ ও মাহ্‌দী (আঃ)-এর সাথে সুদৃঢ় ভালবাসা ও আনুগত্য রাখা হবে। তাহলে আল্লাহ্‌র ভালবাসা লাভ হবে। হুযূর পাক (সাঃ) স্বয়ং আমাদের বলেছেন,

“তোমরা ইমাম মাহ্‌দী এবং মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর যুগ পেলে বরফের ওপর হামাগুড়ি দিয়েও যদি তোমাদের যেতে হয় তবু গিয়ে তাকে আমার পক্ষ থেকে সালাম পৌঁছাবে”। (কনযুল উম্মাল, সুনানে ইবনে মাজা বাবু খুরুজুল মাহ্‌দী)

কোন কোন হাদীসে আছে,

“তোমরা তার কাছে হাযির হয়ে বয়’আত করবে”। (মিসবাহ যুজাজা, হাসিয়া ইবনে মাজা, বাবু খুরুজুল মাহ্‌দী)

কত জোড়ালো নির্দেশ! কত কষ্ট করে যেতে হবে এবং শান্তির বাণী পৌঁছাতে হবে।

ইমাম মাহ্‌দী (আঃ) মুসলিম জাহানের ইমাম হবেন। সুতরাং তাঁর আনুগত্য করা তাঁর মান্যকারীদের জন্য আবশ্যক। তাঁর জামাতে খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে। তাঁর অবর্তমানে তাঁর খলীফাগণ মু‘মিনদের জামাতে ইমাম হিসাবে নিযুক্ত রয়েছেন। কাজেই (আমাদের) তরবিয়তের জন্যে তারা যেসব কথাবার্তা বলছেন তদনুসারে আমল করা উচিত। যুগ ইমামকে মান্য করা সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস নীচে প্রদত্ত হলো এ হাদীসগুলো যুগ ইমামকে মান্য করার ব্যাপারে আধ্যত্মিক প্রেরণা যোগাবেঃ

  • হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, আঁ হযরত (সাঃ) বলেছেনঃ

    “স্বচ্ছলতা হোক বা অস্বচ্ছলতা হোক, আনন্দমুখর পরিস্থিতি হোক বা নিরানন্দ হোক, ন্যায্য প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হোক বা স্বজনপ্রীতি হতে দেখ, যে কোন অবস্থা হোক, সব অবস্থায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত শাসকদের আদেশ মেনে চলা এবং তাদের আনুগত্য করা তোমাদের জন্য ফরয”। (মুসলিম, কিতাবুল আমারত)

যুগ ইমাম এবং তাঁর প্রতিনিধির আনুগত্যে শিথিলতা দেখানো যাবে না। সর্বদা ঐশী নের্তৃত্বের আনুগত্য করতে হবে।

  • হযরত আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, আঁ হযরত (সাঃ) বলেছেনঃ

    “যে ব্যক্তি তার নেতা বা আমীরের মধ্যে কোন বিষয় লক্ষ্য করে যা তার দৃষ্টিতে অপ্রিয় তখন সে যেন ধৈর্য ধারণ করে। কারণ যেব্যক্তি জামা’ত হতে এক বিঘতও দূরে সরে যায় সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করবে।”

  • হযরত আরফজাহ (রাঃ) রেওয়ায়াত করেছেন, আমি আঁ-হযরত (সাঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ

    তোমরা যখন এক হাতের ওপর একত্র হও এবং তোমাদের মধ্যে একজন আমীর (নেতা) নিযুক্ত হয়ে থাকেন। এরপর কেউ এসে যদি তোমাদের এই একতার (ঐক্যবদ্ধ) অবস্থাকে লাঠিতে ভাঙ্গতে চেষ্টা করে, তোমাদের জামাতে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে তোমরা তাকে হত্যা কর” [অর্থাৎ তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ কর এবং তার কথা শুনবে না]। (বুখারী, মুসলিম)

যুগ ইমামের হস্তক্ষেপের ফলে মু‘মিনদের জামাতে ফেৎনা ফাসাদ সৃষ্টিকারীরা সফলকাম হবে না। তবে ঐশী নের্তৃত্বকে অশুভ শক্তির ব্যাপারে সর্বদা সজাগ ও সতর্ক থাকতে হয়।

  • হযরত ওবাদা বিন ছাবেত (রাঃ) হতে বর্ণিত,

    “আমরা আঁ হযরত (সাঃ)-এর হাতে একথার ওপর বয়’আত করেছি, আমরা তাঁর (সাঃ) কথা শুনব এবং মান্য করব সে কথা আমাদের ভাল লাগুক বা না লাগুক। আমরা যেখানেই থাকি না কেন। কোন কিছু নিয়ে প্রাপকের সাথে ঝগড়া করবো না। সত্যের ওপর দৃঢ় অবস্থান নেব এবং সত্য কথাই বলব এবং আল্লাহ্‌র ব্যাপারে কোন দোষারোপকারীর দোষারোপে ভীত হব না”। (মুসলিম, কিতাবুল আমারত)

  • হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বলেছেন,

    “আমি আঁ হযরত (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যে-ব্যক্তি আল্লাহ্‌ তাআলার আনুগত্য করা থেকে নিজেকে পৃথক করে সরে পড়েছে সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দাঁড়াবে যে,তার হাতে কোন যুক্তিপ্রমাণ বা অজুহাত থাকবে না। এরপর সে যদি সেই অবস্থায় মারা যায় যে, সে ইমামের হাতে বয়’আত করেনি তাহলে সে জাহেলিয়তের মৃত্যুবরণ করবে।”

  • বলা হয়েছে,

    “যে ব্যক্তি জামা’ত থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়তের মৃত্যু”। (মুসলিম)

    নেযামে জামাতের বাইরে গিয়ে ধর্মের সেবা করা যায় না।

  • হাদীসে বর্ণিত আছে,

    “তিনজন লোক কোন নির্জন প্রান্তরে থাকলেও একজনকে আমীর না বানিয়ে থাকা জায়েয নয়”।

    বলা হয়েছে,

    “তিনজন লোক সফরে বের হলে তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়”। (সুনানে আবু দাউদ)

ইসলামে বল্‌গাহীনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলা নিষেধ।

  • নবী করীম (সাঃ) বলেছেন,

    “যে ব্যক্তি জান্নাতের আনন্দ উপভোগ করতে চায় সে যেন জামা’তকে আঁকড়ে ধরে”। (মুসলিম)

    “যে ব্যক্তি জামা’ত ত্যাগ করে এক বিঘৎ পরিমাণ দূরে সরে গেছে সে নিজের গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলেছে। তবে সে যদি জামাতে প্রত্যাবর্তন করে তো স্বতন্ত্র কথা”। (আহ্‌মদ ও হাকেম)

  • রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) বলেছেন,

    “শাসনকার্যে সর্বাপেক্ষা মন্দ বিষয় বিদ্রোহ”। (মুসলিম)

    আল্লাহ্‌ বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেছেন।

    “যে আনুগত্য থেকে এক হাত পরিমাণও সরে যায় তা কিয়ামতের দিন প্রমাণ নিয়ে আসবে এবং যে নিজ স্কন্ধে আনুগত্য না নিয়ে মরবে সে জাহেলিয়তের মৃত্যুবরণ করবে”। (মুসলিম)

  • প্রিয় নবী করীম (সাঃ) বলেছেন,

    “আমীর যদি হাবশী গোলামও হয় এবং তার মাথা যদি শুকনা কিসমিসের মত হয় তবুও তাকে মান্য করা বাধ্যতামূলক”। (বুখারী)

খলীফা কর্তৃক নিযুক্ত স্থানীয় ও জাতীয় আমীর এবং নেতৃত্বের ধারাক্রমে স্থানীয় প্রেসিডেন্ট ও অঙ্গ সংগঠনের অন্যান্য নের্তৃবৃন্দের আনুগত্যও করতে হবে।

  • “সর্বাপেক্ষা উত্তম নেতা সেই ব্যক্তি যাকে তোমরা ভালবাস এবং সে-ও তোমাদের ভালবাসে। যার জন্য তোমরা দোয়া কর এবং সে-ও তোমাদের জন্য দোয়া করে”। (মুসলিম)

এখানে নেতার গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে। নেতাকে কঠোর হৃদয়হীন পাষাণ প্রকৃতির হলে চলবে না। তাকে কোমল হৃদয়ের অধিকারী হতে হয়। যিনি শাসন করবেন ও মমতায় কাছে টেনে নিবেন।

  • প্রিয় রসূল (সাঃ) বলেছেন,

    “যে পর্যন্ত কোনো মুসলমানকে কোনো পাপ কার্য করতে আদেশ না দেয়া হয়, সে পর্যন্ত স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আমীরকে মান্য করতে হবে এবং তার কথা শুনতে হবে”। (বুখারী)

নেতা ন্যায়সঙ্গত আদেশ দিলে তা মাথা পেতে মেনে নিতে হয়। যেখানে সেখানে বসে নেতার বিরুদ্ধে সমালোচনা করা অন্যায়।

  • হাদীসে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন,

    “হে মানবগণ! নিশ্চয় আমি তোমাদের ইমাম। সুতরাং রুকুতে, সেজদায়, কিয়ামে এবং সালামে আমার আগে যাবে না”। (মুসলিম)

    “ইমামের আগে যে নামাযে মাথা উঠায় সে গাধা”। (বুখারী)

কাজেই গাধার দলে ভিড়ে যাওয়া মু‘মিনের কাজ হতে পারে না।

মু‘মিন মুত্তাকীদের সঙ্ঘবদ্ধ হযে জীবন যাপন করতে হয়। জামা’ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এককভাবে চলা সঙ্গত নয়। একক জীবন যাপনকারী শয়তানের শিকারে পরিণত হয়। জামা’তবদ্ধভাবে এক ইমামের অধীনে জীবন যাপন জান্নাত প্রাপ্তির পূর্বশর্ত। জামা’ত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া জাহেলিয়তে প্রত্যাবর্তনের শামিল।

আমরা আহ্‌মদী মুসলমানরা বড়ই সৌভগ্যবান। আমরা যুগ ইমামের হাতে বয়’আত করেছি এবং তাকে গ্রহণ ও বরণ করে নিয়েছি। এখন খাঁটি অন্তরে কেবলমাত্র আল্লাহ্‌র খাতিরে তাঁর আনুগত্য করা এবং তাঁর আদেশ নিষেধ সমূহকে কার্যে পরিণত করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে জানুয়ারী ২০০৭