খিলাফত ও আনুগত্য

আলহাজ্জ মোহাম্মাদ মুতিউর রহমান

সূরা নিসার ৬০ আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাল্লাহু তাআলা বলেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً

অর্থঃ ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ্‌র এবং আনুগত্য কর এই রসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের আদেশ দেয়ার অধিকারী। এরপর তোমরা কোন বিষয়ে মতভেদ করলে তা আল্লাহ্ এবং এ রসূলের প্রতি সমর্পণ কর যদি তোমরা আল্লাহ্ ও আখিরাত দিবসে ঈমান রাখ। এটা বড়ই কল্যাণজনক এবং পরিণামের দিক দিয়ে অতি উত্তম’।

আমরা এ প্রবন্ধে দু’টি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। একটি হলো খিলাফত আর অন্যটি হলো খিলাফতের প্রতি আনুগত্য। বিষয় দুটো খুবই গুরুত্ববহ এবং অতি ব্যাপক। প্রবন্ধের কলেবরের প্রতি দৃষ্টি রেখে সংক্ষেপে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্।

‘খিলাফত’ শব্দটি আরবী। এর অর্থ পরে আসা, স্থলাভিষিক্ত বা প্রতিনিধিত্ব। আমরা এ প্রতিনিধিত্ব তিন ভাবে দেখতে পাই।

এ প্রবন্ধে আমরা এ তৃতীয় স্তরের খিলাফত নিয়ে আলোচনা কেন্দ্রীভূত রাখবো, ইনশাআল্লাহ্।

Institution of Khilafat (খিলাফত ব্যবস্থা) বা খলীফার পদটি পার্থিব নয় ঐশী এবং খুবই পবিত্র ও গুরত্বপূর্ণ। অথচ দুঃখের সাথে বলতে হয় ইসলাম বিদ্বেষী কোন কোন মহল জ্ঞানত এবং কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত এ পদটিকে তুচ্ছ, হেয় ও অবমূল্যায়ণের লক্ষ্যে দরজী, হাজাম প্রভৃতি এবং তথাকথিত পীর মুর্শিদের স্থলবর্তী কাউকে কাউকে এ নামে আখ্যায়িত করে সমাজে এটা চালু করে দিয়েছে, নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালিক।

আগেই বলেছি, খিলাফত ঐশী প্রতিষ্ঠান। আল্লাহ্‌ তা’আলা স্বয়ং নিজ পরিকল্পনা অনুযায়ী এটা প্রতিষ্ঠা করেন। ঈমানদার ও আমলে সালেহ্ বা সময়োপযোগী পুণ্য কাজ সম্পাদনকারীদের মাঝে। কারা মু’মিন এবং কারা মু’মিন নয় বা কারা সত্যিকারের ঈমানদার তা পরীক্ষা করার নিমিত্তে খিলাফত ব্যবস্থা একটি ঐশী মানদন্ড। কুরআন করীমের সূরা নূরের ৫৬ আয়াতের বা বিখ্যাত আয়াতে ইস্তিখলাফের লাইয়াসতাখলিফান্না অংশে ‘লামে’ তাগিদ ও শেষে ‘নূনে’ সাকীলা রয়েছে। এথেকেও এটা প্রমাণিত হয়, খিলাফত ব্যবস্থা অবশ্য অবশ্যই আল্লাহ্ তা’আলা প্রতিষ্ঠা করতে থাকবেন যতদিন সত্যিকারের ঈমানদার ও আমলে সালেহকারী বান্দা থাকবেন।

মানবীয় প্রচেষ্টায় যে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না কুরআন এবং হাদীসের আলোকে আমরা তা-ই জানতে পারি। আর বাস্তবত ঐতিহাসিকভাবেও এটা সত্য। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তুরষ্কের নামমাত্র খিলাফতের পতনের পর মুসলমানরা বিশেষ করে পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশে জোরে শোরে খিলাফত আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কেননা, মুসলমানরা এটা বুঝতে পেরেছিলেন, খিলাফতের অনুপস্থিতিতে মুসলমানদের অস্তিত্ব ও ঐক্য-সংহতি সেটা রাজনৈতিকভাবেই হোক বা ধর্মীয়ভাবেই হোক টিকে থাকতে পারে না। এর পুরোধা ছিলেন আলী ভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী। মিঃ গান্ধীজিও এতে সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু ঐশী সমর্থন না থাকায় তাদের সব চেষ্টা ভেস্তে যায়। মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকাত আলী দুঃখ ও ক্ষোভে সেই যে বিলাত গেলেন আর দেশে ফিরে আসেন নি। সুতরাং এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়, মানবীয় প্রচেষ্টায় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয় না, হতে পারে না। আজকাল খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে যারা তথাকথিত আন্দোলন করছেন তাদেরও যে একই পরিণতি দেখতে হবে সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায়।

অন্য দিকে আমরা দেখতে পাই, ক্ষুদ্র ও দুর্বল একটি জামাতের মাঝে আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে যে খিলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মহান আল্লাহ্‌র নামে সেই খিলাফত ব্যবস্থা আজও টিকে আছে এবং শুধু টিকেই নেই সারা বিশ্বে প্রতিদিন এর প্রভা বিকাশ করে বিশ্বের ১৮৫টিরও অধিক দেশকে আত্মস্থ করে নিয়ে দিন দিন এটি উন্নতির পথে ধাবমান রয়েছে। এ খিলাফতকে ধ্বংস ও অকার্যকর করার জন্যে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বহু চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্‌র করুণার ছায়ায় যার অবস্থান একে ধ্বংস করে এমন সাধ্য কোন মানবীয় শক্তির নেই। এর স্থায়িত্ব সম্বন্ধে এ জামাতের পবিত্র প্রতিষ্ঠাতা অনেক আশার বাণী শুনিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। এখন শুধু এতটুকু বলে রাখি ১৯৮২ সনে হযরত মির্যা তাহের আহমদ যখন চতুর্থ খলীফা হলেন তখন তিনি (রাহেঃ) উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেনঃ

‘ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ্ খিলাফতে আহ্‌মদীয়া আর কখনও কোন শঙ্কা বা সংকটের সম্মুখীন হবে না। জামা’ত এর যৌবনে উপনীত হয়েছে। কোন অমঙ্গলকামী ব্যক্তি এখন আর খিলাফতের লেশমাত্র ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। আর এমনি ধারায় মহা সমারোহে জামা’ত উন্নতি করে যাবে’। (জুমুআর খুতবা, ১৮-৬-১৯৮২, আল্ ফযল ২০-৬-১৯৮২, পাক্ষিক আহ্‌মদীর ১৮-৭-১৯৮২ তারিখের সংখ্যার বরাতে)

খিলাফত নবুওয়্যতের পরিশিষ্ট। নবুওয়্যতের কাজকে পূর্ণতা দেয়ার জন্যে প্রত্যেক নবুওয়্যতের পর খিলাফত থাকা আবশ্যক। যেভাবে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

মা কানাতিন্নবুওয়্যতু কাত্তু ইল্লা তাবিয়াতহা খিলাফাতুন
অর্থাৎ প্রত্যেক নবুওয়্যতের পর খিলাফতের নিযাম বা ব্যবস্থা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। (কানযুল উম্মাল)

নবী মানুষ, তাই তাঁকে এক সসীম জীবনে নিজ কাজ করে যেতে হয়। তাঁর কাজকে পুর্ণরূপ দেয়ার জন্যে তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই খিলাফতের এক শৃঙ্খল বা ধারা আরম্ভ হয়। একটা উদাহরণ দিয়ে কথাটা বলা যায়, আলো যতই দূরে যায় এর প্রখরতা ততই কমে আসে। সেই আলোকে প্রখর করতে হলে বা দূরবর্তী স্থানে আলো পৌঁছতে হলে চাই চিমনি। নবীর পরবর্তী কালে খিলাফত ব্যবস্থা সেই চিমনীর কাজ করে থাকে। আল্লাহ্‌ তা’আলা সূরা নূরের ৩৬ আয়াতে এ রকম একটি তুলনা দিয়েছেন। নবীকে তুলনা করা হয়েছে ‘মিসবাহ’ অর্থাৎ প্রদীপের সাথে আর তাঁর পরবর্তী খিলাফতকে তুলনা করা হয়েছে ‘মিশকাত’ অর্থাৎ তাকের সাথে।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম হযরত নু’মান বিন বশীর (রাঃ)-এর বর্ণনায় ‘খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়্যত’ বা নবুওয়্যতের পদ্ধতিতে খিলাফতের কথা বলে গেছেন (মিশকাত, পৃষ্ঠা ৪৬১)। এ হাদীস অনুযায়ী আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর হযরত আবূ বকর (রাঃ)-এর মাধ্যমে খুলাফায়ে রাশেদীনের ধারা প্রবর্তিত হয়েছিল। তেমনিভাবে সেই হাদীসের শেষাংশে ‘সুম্মা তাকূনু খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়্যত’ অংশে পরবর্তী যুগে হযরত মসীহ্ মাওউদ ও ইমাম মাহ্‌দীর (আঃ) মাধ্যমেও নবুওয়্যতের পদ্ধতিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এ ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী আজ আহ্‌মদী জামাতে খিলাফতের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে এবং জামাতে আহ্‌মদীয়াতেই শতবর্ষ ধরে খিলাফত ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে। এটা যে আহ্‌মদী জামাতের সত্যতার এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রসঙ্গত বলা যায়, আহ্‌মদী জামাতের ঘোরতর বিরোধী মৌলভী মৌদূদী সাহেব পর্যন্ত বলেছেন, ইমাম মাহ্‌দীই নবুওয়্যতের পদ্ধতিতে ফিলাফত প্রতিষ্ঠাকারী (ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন, পৃষ্ঠা ২৫ ও ১২১ এবং সীরাতে সারওয়ারে আলম, পৃষ্ঠা ৩৮৭)। দীর্ঘ দিন গত হয়ে গেল আহ্‌মদী জামা’ত ছাড়া আর কোথাও খিলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি বা নেই। আর আহ্‌মদীয়া খিলাফত শতবর্ষ সময় ছুঁই ছুঁই করছে, আলহামদুলিল্লাহ্ আলা যালিক। আগামী বছর (২০০৮ইং) সারা বিশ্বে এর শতবর্ষ পূর্তি উদযাপিত হতে যাচ্ছে ইনশাআল্লাহ্।

নবুওয়্যতের পর খিলাফত দ্বিতীয় কুদরত। এর গুরুত্ব অপরিসীম। যুগ ইমাম হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর বিখ্যাত পুস্তক আল্ ওসীয়্যত থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে আপাততঃ এ প্রসঙ্গের ইতি টানতে চাচ্ছিঃ

‘ইহা খোদা তাআলার রীতি বা সুন্নত এবং যখন থেকে তিনি পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন তখন থেকে সব সময়ই তিনি এ রীতি প্রকাশ করে আসছেন। তিনি তাঁর নবী ও রসূলগণকে সাহায্য করে থাকেন এবং তাঁদের বিজয়মন্ডিত করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ

কাতাবাল্লাহু লাআগলিবান্না আনা ওয়া রুসুলী
অর্থাৎ খোদা তাআলা এটা নির্ধারিত করে রেখেছেন, তিনি এবং তাঁর রসূলগণ বিজয়ী থাকবেন (সূরা মুজাদালাঃ ২২)

‘গালাবা’ শব্দের অর্থ এই, যেহেতু রসূল ও নবীগণও ইচ্ছা পোষণ করে থাকেন যেন খোদার ‘হুজ্জত’ বা অকাট্য যুক্তি প্রমাণ পৃথিবীতে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় আর কেউই যেন এর মোকাবেলা করতে সক্ষম না হয়, সেই লক্ষ্যে খোদা তা’আলা প্রবল নিদর্শনসমূহের মাধ্যমে তাদের (অর্থাৎ নবীগণের) সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করেন এবং যে সাধুতা তাঁরা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতে চান খোদা তা’আলা এর বীজ তাঁদের মাধ্যমে বপন করেন। কিন্তু তিনি তাঁদের হাতে এর পূর্ণতা দান করেন না বরং এমন সময়ে তাঁদের মৃত্যু দান করেন যখন বাহ্যিকভাবে এক প্রকার বিফলতাজনিত ভীতি বিদ্যমান থাকে। আর তিনি বিরুদ্ধবাদীদের হাসি ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করার সুযোগ দেন। (খোদা তা’আলা) নিজ কুদরত বা শক্তি ও মহিমার আর এক হাত দেখান এবং এমন উপরণ সৃষ্টি করেন যাতে সেসব উদ্দেশ্য, যার কোন কোনটি অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল তা-ও পূর্ণতা লাভ করে। সংক্ষেপে খোদা তা’আলা দুই প্রকার শক্তি ও মহিমা প্রকাশ করেনঃ প্রথমে নবীগণের মাধ্যমে তাঁর এক হাত প্রদর্শন করেন। দ্বিতীয়ত, অপর আর একটি হাত এমন সময় দেখান যখন নবীর মৃত্যুর পর বিপদাবলী উপস্থিত হয় এবং শত্রু শক্তি লাভ করে মনে করে থাকে, এখন (নবীর) কাজ বিফল হয়ে গেছে। তখন তাদের এ প্রত্যয়ও জন্মে, এখন জামা’ত (পৃথিবী থেকে) মিটে যাবে। এমনকি জামাতের লোকজনও উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ে। তাদের কোমর ভেঙ্গে যায় এবং কোন কোন হতভাগ্য মুরতাদ হয়ে যায়। তখন খোদা তা’আলা দ্বিতীয় বার নিজ শক্তি ও মহিমা প্রকাশ করেন এবং পতনোন্মুখ জামা’তকে রক্ষা করেন। সুতরাং যারা শেষ পর্যন্ত ধৈর্য অবলম্বন করে তারা খোদা তা’আলার এ মু’জিযা বা অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পায়………………………..’

‘হে বন্ধুগণ! যেহেতু আদিকাল থেকে আল্লাহ্ তা’আলার বিধান এটাই, তিনি দু’টি শক্তি দেখান যেন বিরুদ্ধবাদীদের দু’টি মিথ্যা আনন্দ ব্যর্থ করে দেখান। সুতরাং খোদা তা’আলা তাঁর চিরন্তন নিয়ম পরিহার করেন এখন এটা সম্ভব নয়। এজন্য আমি তোমাদের যে কথা বলছি তাতে তোমরা দুঃখিত ও চিন্তিত হয়ো না। তোমাদের চিত্ত যেন উৎকন্ঠিত না হয়। কারণ তোমাদের জন্য দ্বিতীয় কুদরত দেখাও প্রয়োজন এবং এর আগমন তোমাদের জন্য শ্রেয়। কেননা, এটা স্থায়ী। এর ধারাবাহিকতা কিয়ামত পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হবে না। সেই দ্বিতীয় কুদরত আমি না যাওয়া পর্যন্ত আসতে পারে না’……….

‘আমি খোদার পক্ষ থেকে এক প্রকার কুদরত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি। আমি খোদার মূর্তিমান কুদরত। আমার পর আরও কোন কোন ব্যক্তি হবেন যারা দ্বিতীয় বিকাশ হবেন। অতএব তোমরা খোদার দ্বিতীয় কুদরতের অপেক্ষায় দোয়া করতে থাক।’ (আল্ ওসীয়্যত)

এতক্ষণ আমরা খিলাফত বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকসম্পাত করলাম। এখন আমরা এ খিলাফতের প্রতি ইতায়াত বা আনুগত্য বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আমরা প্রবন্ধের সূচনায় কুরআনে হাকীমের যে আয়াতে করীমা উপস্থাপন করেছি এতে আল্লাহ্‌র আনুগত্যের পর রসূলের আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। এরপর আল্লাহ্ ও রসূলের আদেশের আলোকে যারা আদেশ দেয়ার অধিকারী তাদের আনুগত্যের কথাও বলা হয়েছে। খলীফা, দেশের শাসক, পিতা মাতা প্রভৃতি এদের আওতাভুক্ত। আমরা এখন খলীফার ইতায়াতের প্রসঙ্গে আলোকপাত করবো।

খলীফার প্রতি ইতায়াতের বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে আমরা প্রথম যে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে চাচ্ছি তা হলো আদম সৃষ্টির দিনের কথা। আল্লাহ্‌ তা’আলা খলীফা আদমকে (আঃ) সৃষ্টি করে তাঁকে সিজদা অর্থাৎ তাঁর আনুগত্য করার জন্যে ফিরিশ্‌তাদের আদেশ করলেন। সবাই সিজদা করলেন কেবল ইবলীস এথেকে বিরত থাকলো। আল্লাহ্‌র প্রতি ইবলীসের ঈমানের কমতি ছিল না। কিন্তু সে আল্লাহ্‌ তা’আলার নির্দেশমতে আদমের আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জানালো। কারণ দেখানো হলো আদম মাটির তৈরী আর সে আগুনের তৈরী। তাই আমরা দেখতে পাই ইবলীসের ঈমান থাকা সত্ত্বেও ‘কানা মিনাল কাফিরীন’ অর্থাৎ সে কাফির হয়ে লাঞ্ছিত ও বিতাড়িতদের মাঝে গণ্য হয়ে গেল। সুতরাং এত্থেকে আমরা বুঝতে পারি ঈমানের ‘মোকাম ও ইতিয়াতের মোকাম’ একই স্থান থেকে উৎসারিত। একটি থেকে স্খলিত হলে অন্যটি থেকেও স্খলিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

ঈমানকে নিরঙ্কুশ ও নিষ্কুলুষ রাখতে হলে খিলাফতের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে শেষ পর্যায় পর্যন্ত ইতায়াতের মোকামকে যে সমুন্নত রাখতে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ইয়াদুল্লাহি ফাওকাল জামাআত’ অর্থাৎ আল্লাহ্‌র হাত (অর্থাৎ আশিসের হাত) জামাতের ওপর। এ হাদীস থেকে একথা সুস্পষ্ট, জামা’ত হওয়ার জন্যে একজন ওয়াজিবুল ইতাআত বা অবশ্যমান্য ও আনুগত্যযোগ্য ইমাম বা খলীফা এবং একটি সুশৃংখল একই মতাদর্শী জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন। সারা বিশ্বে এমন ইমাম বা খলীফা এবং এরকম জনগোষ্ঠী আহ্‌মদী জামা’ত ছাড়া দৃশ্যমান হয় না। প্রায় একশ’ বছর ধরে সারা বিশ্বে আহ্‌মদী জামাতের খলীফা এ জামাতের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। যদিও বিভিন্নভাবে এ খিলাফতকে নিশ্চিহ্ন ও অকার্যকর করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এটাই খিলাফতে হাক্কা ইসলামীয়া অন্য কথায় নবী করীম সাল্লল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম কর্তৃক প্রতিশ্রুত খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়্যত। এখন এর পঞ্চম পর্যায় বিশ্বব্যাপী বিকাশ ঘটিয়ে যাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ্ আলা যালিক।

নবী করীম সাল্লল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন,

মান আত্বা’নী ফাক্বাদ আত্বাআল্লাহ্ ওয়া মান আসানী ফাক্বাদ আসাআল্লাহ্-ওয়া মান আত্বা’ আমীরী ফাক্বাদ আত্বানী ওয়া মান আসা আমীরী ফাক্বাদ আসানী। (বুখারী, মুসলিম)
অর্থাৎ যে আমার ইতায়াত বা আনুগত্য করে সে আল্লাহ্‌র আনুগত্য করে। যে আমার অবাধ্যতা করে সে আল্লাহ্‌ আবাধ্যতা করে। যে আমার আমীর বা খলীফার আনুগত্য করে সে আমার আনুগত্য করে। যে আমার আমীরের অবাধ্যতা করে সে আমার অবাধ্যতা করে।

এ হাদীসের মাধ্যমে রসূল বা নবীগণের পর তাঁর আমীর বা প্রতিনিধি এবং খলীফার আনুগত্যের আবশ্যকতা প্রমাণিত হয়। খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে আমরা আনুগত্যের এ দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।

মু’মিনের বৈশিষ্ট্য হলো “সামী’না ওয়া আত্বা’না” শুনলাম এবং মান্য করলাম। আর কাফিরের চিহ্ন হলো ‘সামী’না ওয়া আসায়না’ অর্থাৎ শুনলাম এবং অমান্য করলাম। অতএব যে-ব্যক্তি ঈমান আনেন তিনি তার গলায় আনুগত্যের একটি ফাঁস পরিয়ে নেন। গৃহপালিত পশুর ন্যায় তার রশি যার হাতেই দেয়া হোক না কেন তিনি তারই আনুগত্য করবেন। এটাই সর্বতো কাম্য।

ছোটদের বইতে একটি কাহিনীর কথা এখানে স্মর্তব্য। মেঠো পথ দিয়ে এক বিরাটকায় উট হেঁটে যাচ্ছে। তার নাকের ছিদ্রের রশি দুটো মাটি দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। গর্ত থেকে বের হলো একটা পুচ্‌কে ইঁদুর। বের হয়ে সে রশি ধরে দিল টান। অমনি উটটি ফিরে পথ ধরলো ইঁদুরের পিছনে পিছনে। সামনে চলছে ক্ষুদ্রকায় ইঁদুর আর তার অনুসরণে চলছে বিরাটকায় উটটি। এ হলো ইতায়াত বা আনুগত্যের এক চিত্র। খিলাফতের ইতায়াতের ব্যাপারে এ দৃষ্টান্তটি প্রযোজ্য। খিলাফতের উচ্চ মোকাম থেকে শুরু করে আমীর প্রেসিডেন্ট প্রভৃতি আর এর সবচেয়ে নিচু যে ‘সায়েকের’ পদটি রয়েছে এর প্রত্যেকের আনুগত্যই খিলাফতের সাথে সম্পৃক্ত। এটা একটা চেইন অব কমান্ড বা আদেশের শৃঙ্খল। আনুগত্যের যে কোন পর্যায়ে শৃঙ্খলের কড়াটি যদি অস্বীকার করা হয় তাহলে আনুগত্যের গোটা বিষয়টিই হাত ছাড়া হয়ে যাবে। সুতরাং আদেশ কে দিল সেটা বড় কথা নয় বড় কথা হলো আদেশটা কী দিলো এটারই আনুগত্য করতে হবে। এ প্রসঙ্গে অনেক ঘটনার উল্ল্যেখ করা যেতে পারে। প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এথেকে ক্ষান্ত থাকলাম।

প্রসঙ্গত আরও একটি বিষয় আলোচনার দাবী রাখে। কখনও আপাত দৃষ্টিতে খিলাফতের পক্ষ থেকে কোন শাস্তিমূলক আদেশ এলেও তা অবনত মস্তকে মেনে নেয়া ঈমানের চাহিদা। এর বিপরীত কোন কার্যক্রম গ্রহণকারীর ভাগ্যে যে ইবলীসের পরিণতি হবে তা বলাই বাহুল্য। খলীফার এহেন আদেশ পালনের অনেক ঘটনা ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে। স্বর্ণাক্ষরে উজ্জ্বল একটি ঘটনার উল্ল্যেখ করা থেকে বিরত থাকতে পারলাম না।

হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী একটার পর একটা দেশ করতলগত করে যাচ্ছে। কোন কোন মুসলমান ভাবতে লাগলো, এ সেনাপতি খালিদের বীরত্বের সুফল। খলীফা উমর (রাঃ) বুঝতে পারলেন, মুসলমানরা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে ভুলে গিয়ে শির্‌কে লিপ্ত হতে যাচ্ছে। তাই মুসলমানদের এথেকে মুক্তি দেয়ার জন্যে তিনি (রাঃ) ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর হযরত খালিদ (রাঃ)-কে পদাবনতি করে তার অধীনস্থ একজন সৈনিক হযরত আবূ ওবায়দাকে (রাঃ) সেনাপতি নিযুক্ত করেন। হযরত খালিদ (রাঃ) অবনত মস্তকে তা মেনে নিয়ে খিলাফতের প্রতি আনুগত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

হাদীসে বলা হয়েছে, “আল ইমামু জুন্নাতুন ফাক্বাতিলূ মিন ওয়ারায়ইহী” অর্থাৎ ইমাম ঢাল স্বরূপ, তাঁর পেছনে থেকে সংগ্রাম কর। আজ মুসলিম বিশ্বের দিকে দৃষ্টি দিলে দুঃখ ও আফসোস ছাড়া আর করার কিছু নেই। সেটা আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, লেবানন, সিরিয়া প্রভৃতি যে দেশের বেলায়ই হোক না কেন। ইহুদী খৃষ্টান চক্র তথা পরাশক্তির প্রভাবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নিজ দেশে বা নিজ ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের সাথে রক্তক্ষয়ী মারাত্মক সংঘাত ও কলহ বিবাদে লিপ্ত হয়ে ধ্বংসের অতল গহ্বরে যে তলিয়ে যাচ্ছে এ কথা অনস্বীকার্য। এর কারণ কি? এর কারণ গোটা মুসলিম বিশ্বের অবশ্যমান্য কোন ইমাম বা নেতা নেই। বিশ্ব নেতা বা খলীফা আছে একমাত্র আহ্‌মদী জামাতে। তাই এ ক্ষুদ্র জামা’ত সেই বিশ্ব নেতার সঠিক নেতৃত্বে ও তাঁর অনুসারীদের সঠিক আনুগত্যে জামা’ত দিনে দিনে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির পথে ধাবমান। আজ এখন ইসলামী বিশ্ব যদি এ আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের আনুগত্য করে, যথাসময়ে আল্লাহ্ কর্তৃক সৃষ্ট ‘হাবলুল্লাহ্’ বা আল্লাহ্‌র রজ্জু (সূরা আলে ইমরানঃ ১০৪) দৃঢ়ভাবে ধরে, এঁর নেতৃত্বে একত্র ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় তাহলে মুসলিম বিশ্বের জন্যে এক সোনালী প্রভাতের উদয় হবে তা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়।

প্রসঙ্গত কবীর-এর একটি বচনের কথা মনে হলো। তিনি বলেছেনঃ

চল্‌তি চাক্কি দেখ কার যিয়া কাবীরা রোয়ে

দু’পাটন কে বিচ মেঁ সাবিত না রাহা কোয়ে॥

চল্‌তি চাক্কি দেখ কার নাহাক্ক্ যিয়া কাবীরা রোয়ে

খুটা পাকাড় কার জো রাহ্ জায়ে সাবিত রাহা ওয়ে॥

অর্থাৎ

যাঁতা চলতে দেখে কবীরের প্রাণটা কাঁদে

দুটো পাটার মাঝে কেউ প্রতিষ্ঠিত থাকে না সবই গুঁড়িয়ে যায়।

যাঁতা চলতে দেখে অযথাই কবীরের প্রাণটা কাঁদে

যে খুটা আঁকড়িয়ে থাকে সে-ই প্রতিষ্ঠিত থাকে অর্থাৎ ধ্বংস হয় না॥

সুতরাং যে কোন পরিস্থিতিতে খিলাফত বা ঐশী নেতৃত্বরূপ খুঁটা যারা আঁকড়িযে থাকে তারা প্রতিষ্ঠিত থাকে। এ শ্লোক থেকেও আমরা এই দিকনির্দেশনা পেয়ে থাকি।

পরিশেষে আনুগত্য প্রসঙ্গে যুগ ইমাম হযরত মির্যা গোলাম আহ্‌মদ কাদিয়ানী, ইমাম মাহ্‌দী ও মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর একটি মূল্যবান উক্তির অবতারণা করতে চাচ্ছি। তিনি (আঃ) বলেছেনঃ

ইতাআত কোই ছুটিছি বাত নেহিঁ। আওর সাহল আমর নেহিঁ। ইয়ে ভী ইক্ মাওত হোতা হ্যাঁয়। জেয়সে ইক্ যিন্দা আদমী কী খাল উতারী যায়ে ওয়েসে হী ইতাআত হ্যাঁয়’

অর্থাৎ আনুগত্যের বিষয়টি খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এটা সহজ বিষয়ও নয়। এটাও এক প্রকার মৃত্যুবিশেষ। যেভাবে একজন জীবিত ব্যক্তির গায়ের চামড়া তুলে ফেলা হয় সেভাবেই ইতাআত বা আনুগত্যের বিষয়টি সাধিত হয়ে থাকে। (আল হাকাম, ৩১শে অক্টোবর, ১৯০২)

আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের সবাকে সঠিক অর্থে খিলাফতের বিষয়টি উপলব্ধি করে এর যথার্থ আনুগত্য করার সৌভাগ্য দান করুন, আমীন!

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে মে ২০০৭