খাতামান নাবীঈন এবং আহ্‌মদীয়া জামা’ত

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের বিরুদ্ধবাদী আলেমগণ হরহামেশাই এ অভিযোগ করে চলছেন আহ্‌মদীরা সরদারে দু’আলম হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের ‘খতমে নবুওয়তে’ অর্থাৎ তাঁকে ‘খাতামান্নাবীঈন’ রূপে বিশ্বাস করে না। এ অভিযোগটি একটা নির্জলা মিথ্যা।

আহ্‌মদীয়া জামাতের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম মাহ্‌দী ও মসীহ্‌ মাউদ হযরত মির্যা গোলাম আহ্‌মদ (আঃ) বলেন,

“যে পাঁচতি স্তম্ভের ওপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত তা-ই আমার ধর্ম বিশ্বাস। আমরা এ কথার উপর ইমান রাখি, খোদাতায়ালা ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং সাইয়্যেদেনা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইয়ে ওয়া সাল্লাম তাঁর রসুল এবং খাতামান্নাবীঈন”।

হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইয়ে ওয়া সাল্লাম এর খাতামান্নাবীঈন হওয়া সম্পর্কে তিনি (আঃ) এক হৃদয়গ্রাহী দর্শন পেশ করে বলেন,

আমাদের খোদা এক জীবন্ত খোদা, আমাদের কিতাব একটি জীবন্ত কিতাব এবং আমাদের রসূল হযরত খাতামান্নাবীঈন মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) একজন জীবিত রসূল।

আমরা আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের সদস্যরা খাতামান্নাবীঈন আয়াতের সেই সকল অর্থের উপর ই ইমান রাখি, যা কুরআন ও হাদীস, উম্মতের বিগত সর্বমান্য আলেম ও ইমামগণের সর্বসম্মত অভিমত এবং আরবী ভাষার বাগধারা ও আরবী অভিধান এবং ব্যাকরণ সম্মত। আমরা যেভাবে আক্ষরিক অনুবাদ ও অর্থের ওপরো ঈমান রাখি সেভাবে এর আসল ও মৌলিক অর্থের ওপরও ঈমান রাখি। এ সকল অর্থের সার কথা হলো, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নবীগণের মাঝে সর্বাপেক্ষা কামেল (পূর্ণতম)। তিনি নবীগণের মোহর। তিনি নবীগণের শোভা ও সৌন্দর্য্য। নবুওয়তের সব গুণ ও বৈশিষ্ট্য তাঁর মাঝে পরিসমাপ্তি হয়েছে। কামালতের শেষ ও শীর্ষ পর্যায়ে তিনি পৌছেছেন। প্রত্যেক প্রকারের ঐশী কল্যান ও গৌরব তাঁর হাতেই ন্যস্ত করা হয়েছে। তাঁর শরীয়ত অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ্‌র কার্যকারিতা ও কর্তৃত্ব কিয়ামতকাল অব্দি চলতে থাকবে। তিনি আখেরী শরীয়তের ধারক ও বাহক রসূল এবং অবশ্য মান্য আখেরী নেতা ও নবী। আসল ও মৌলিক অর্থেও তিনি (সাঃ) সকল নবীর অবসানকারী। কেননা তাঁর আবির্ভাবের পর কোন পূর্ববর্তী নবীর ফয়েজ ও কল্যাণ জারী থাকা সম্ভব নয়। মোট কথা, আমরা শাব্দিক এবং মৌলিক উভয় অর্থেই হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)-কে খাতামান্নাবীঈন বলে মান্য করি। তাই আমরা বিশ্বাস করি হযরত আদম (আঃ) সৃষ্টির পূর্বেই তিনি (সাঃ) খাতামান্নাবীঈন ছিলেন এবং তাঁর খতমে নবুওয়তের ফয়েজ ও কল্যাণ হতে অংশ লাভ করেই হযরত আদম (আঃ) সহ এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রসূল আবির্ভূত হয়েছেন।

আমাদের বিরুদ্ধবাদীরা অভিযোগ করে, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)-এর পর একজন উম্মতি ও যিল্লি (প্রতিচ্ছায়া) নবীর আসার পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে আমরা খত্‌মে নবুওয়তের অস্বীকারকারী হয়ে পড়েছি।

অবশ্য এটা আমরা বিশ্বাস করি, উম্মতে মুহাম্মদীয়াতেই এরূপ এক উম্মতি নবী আবির্ভূত হবেন, যিনি সর্ব্বোতভাবে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)-এর কামেল গোলাম ও পরিপূর্ণ অনুগত দাস হবেন এবং যিনি তাঁর (সাঃ)-এর সার্বিক আধ্যাত্মিক দাস হবেন এবং যিনি নিজের সার্বিক আধ্যাত্মিক মার্গ ও মর্যাদার ক্ষেত্রে আপাদমস্তক তাঁরই (সাঃ) আধ্যাত্মিক কল্যাণে অনুগৃহীত হবেন। আমরা বিশ্বাস করি, এরূপ উম্মতি নবীর আগমন কখনো খাতামান্নাবীঈন আয়াতের মর্মবিরোধী নয়; কেননা আত্মবিলীনকারী ও সর্বাঙ্গীন দাসকে তাঁর প্রভু হতে পৃথক করা যায় না।

হযরত খাতামান্নাবীঈন (সাঃ) এর বাণীর আলোকে আমাদের বিরুদ্ধবাদী আলেমগণও এ বিশ্বাস পোষণ করেন যে, ‘ঈসা নবীউল্লাহ্‌’ এ উম্মতের মাঝে নাযেল হবেন। (মুসলিম শরীফ, ২য় খন্ড, বাবু যিক্‌রিদ্দাজ্জাল)

আমরা কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট শিক্ষানুযায়ী বিশ্বাস করি, ঈসা ইবনে মরিয়ম মারা গেছেন। তাই হযরত খাতামান্নাবীঈনের (সাঃ) বাণীর আলোকে আমরা বিশ্বাস করি, আগমনকারী ‘ঈসা নবীউল্লাহ্‌’ উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মাঝেই তাঁর (সাঃ) গোলামদের মধ্য হতেই সৃষ্টি হবেন। আমরা কুরআন, হাদীস ও বুযূর্গানে উম্মতের বক্তব্যের ভিত্তিতে বিশ্বাস করি, প্রতিশ্রুত আগমনকারী ‘ঈসা নবীঊল্লাহ্‌’ একদিকে যেমন নবী হবেন, তেমনি অন্যদিকে তিনি খাতামান্নাবীঈনের (সাঃ) উম্মতও হবেন। এ বিশ্বাস কখনও খত্‌মে নবুওয়তের পরিপন্থী নয়।

সূরা আন্‌-নিসার নবম রুকুর একটি আয়াত থেকেও আমারা জানতে পারি, ইসলামে উম্মতি নবীর আগমন হবে। আয়াতটি হলো, “আর যে ব্যক্তিই আল্লাহ্‌ তা’আলার এবং মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আনুগত্য ও অনুবর্তিতা করবে তারা সেই সকল লোকদের দলভুক্ত হবে যাদেরকে খোদা তা’আলা পুরস্কারে ভুষিত করেছেন, অর্থাৎ নবীদের দলে, সিদ্দীকদের দলে, শহীদদের দলে, এবং সালেহীনদের দলে। আর এ সকল লোক সর্বোত্তম সাথী। এটা আল্লাহ্‌ তা’আলার পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ এবং আল্লাহ্‌ তা’আলা সকল বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত”।

এ আয়াতটিতে সুস্পষ্টতঃ জানানো হয়েছে যে, পুরস্কারপ্রাপ্তদের পথ হলো সেই পথ, যে পথে পরিচালিত ও পদচারণা করে মানুষ নবীদের, সিদ্দীকদের, শহীদদের এবং সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত হয়। আমাদের উপরোল্লিখিত বিশ্বাস যে খত্‌মে নবুওয়তের পরিপন্থী নয় তা ইসলামের অতীত বুযুর্গগণের উক্তি থেকেও আমরা জানতে পারি। এ ক্ষেত্রে বহু বুযুর্গের উক্তি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু স্থানাভাবে আমরা মাত্র কয়েকজন বুযুর্গের উদ্ধৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছিঃ

ধর্মের অর্ধাংশের শিক্ষায়িত্রী হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর উক্তি সর্বপ্রথমে পেশ করছি। তিনি বলেনঃ

“তোমরা আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম কে ‘খাতামুল আম্বিয়া’ (নবীগণের খাতাম) বলবে; তাঁর পরে কোন নবী নেই-এ কথা বলোনা”। (তাক্‌মেলা মাজমাউল বেহার, পৃষ্ঠা ৮৫; তফসীর আল-দুরুল মান্সুর, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২০৪)

শেখ আকবর হযরত মুহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী বলেনঃ

“হযরত ঈসা (আঃ) আমাদের মাঝে শরীয়ত ব্যতীরেকে ‘হাকাম’ (মীমাংসাকারী) রূপে অবতরণ করবেন এবং কোন সন্দেহ নেই যে, তিনি নবী হবেন”।

হযরত শাহ্‌ ওলিউল্লাহ্‌ মুহাদ্দিস দেহ্‌লভী (রহঃ) বলেনঃ

“নবুয়তের বিভিন্ন ভাগ বা প্রকার হয়ে থাকে। এর একটি ভাগ বা প্রকার হযরত খাতামান্-নাবীঈন সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের পরেও বাকী আছে”। (ইমাম মালেক প্রণীত প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থের শরাহ্‌ বা ব্যাখ্যা ‘আল্‌-মুসাওয়া’, ২১৬ পৃষ্ঠা, দিল্লি হতে প্রকাশিত)

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের পবিত্র প্রতিষ্ঠাতা ইমাম মাহ্‌দী ও মসীহ্‌ মাওউদ হযরত মির্যা গোলাম আহ্‌মদ কাদীয়ানী (আঃ) তাঁর উম্মতি নবী হওয়ার দাবীর ব্যাখ্যায় বিভিন্ন গ্রন্থে বহু বক্তব্য রেখেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর একটি উদ্ধৃতি:

“আমি যদি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মত না হতাম এবং তাঁর অনুবর্তিতা না করতাম অথচ পৃথিবীর সমস্ত পর্বতের সমষ্টি বরাবর আমার পূণ্য কর্মের উচ্চতা ও ওজন হতো, তাহলেও আমি কখনো খোদার সাথে কথা বলার ও তাঁর বাণী লাভের সম্মানের অধিকারী হতে পারতাম না। কেননা এখন মুহাম্মদীয় নবুওয়ত ব্যতিরেকে অপর সমস্ত নবুওয়তের দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে। শরীয়ত নিয়ে আর কোন নবী আসতে পারেন না। অবশ্য শরীয়ত ব্যতিরেকে নবী হতে পারেন। কিন্তু নবী শুধু তিনিই হতে পারেন, যিনি প্রথমে রসুল করীম (সাঃ)-এর উম্মতি (অনুবর্তী) হন”। (তাজাল্লিয়াতে ইলাহিয়া, পৃষ্ঠা ২৬)