খিলাফতের গুরুত্ব ও কল্যাণ

খালিদ আহমদ সিরাজী

“হে বন্ধুগণ! আমার আখেরী নসীহত এই, সমস্ত কল্যাণ ও বরকত খিলাফতে নিহিত। নবুওয়ত একটি বীজ বপন করে যার পরে খিলাফত এর তাসীর ও প্রভাব দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। তোমরা খিলাফতে হাক্কাকে মজবুতির সাথে ধর এবং এর আশিস ও বরকতে জগতকে উপকৃত কর যাতে খোদা তা’আলা তোমাদের উপর দয়া ও রহমত বর্ষণ করেন এবং তোমাদিগকে এই জাহানে উন্নত করেন এবং সেই জাহানে সম্মানিত করেন। আমরণ নিজের অঙ্গীকার পূরণ করে যাও। আমার সন্তানদিগকেও এবং হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর সন্তানদের তাদের খান্দানের অঙ্গীকার স্মরণ করাতে থাক। আহ্‌মদীয়তের মোবাল্লেগগণ যেন ইসলামের প্রকৃত সিপাহী সাব্যস্ত হন এবং দুনিয়াতে ও খোদায়ে কুদ্দুসের কর্মচারী বৃন্দে পরিণত হন।” (আল ফযল, ২০/০৫/১৯৫৯ইং)

উপরের কথাগুলি আমার নয় কথাগুলি বলেছেন সৈয়্যদনা হযরত মুসলেহ্‌ মাওউদ (রাঃ)।

আমাদের উপরে আল্লাহ্‌ তা’আলার অসীম করুণা তিনি অর্থাৎ আল্লাহ্‌ পাক আহ্‌মদীয়াত গ্রহন করার তৌফীক আমাদের দিয়েছেন। আমাদের এরূপ জামাতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যে সম্পর্ক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আল্লাহ্‌ জামা’তকে ভালবাসেন এবং এর মাধ্যমে ইসলামকে পৃথিবীতে জয়যুক্ত করবেন। তজ্জন্য আমাদের কর্তব্য হলো খিলাফতের আনুগত্যের বরকত গ্রহণ করে খোদাভীতির চাদরে আবৃত হওয়া। পার্থিব চাহিদার পরিবর্তে তাকওয়া হোক আমাদের বড় চাওয়া। আমাদের মুখ মন্ডল হোক খিলাফতের কল্যাণের আলোকে উদ্ভাসিত।

আল্লাহ্‌তাআলার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য আল্লাহ্‌ চান যেন জগদ্বাসী তাদের প্রভুর ইবাদত করে। সেজন্য আল্লাহ্‌ নবী প্রেরণ করে থাকেন। যখন নবীর মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নির্দেশনা প্রকাশ পায় তখন মু’মিন আল্লাহ্‌র প্রতি এক নতুন শক্তিশালী ঈমান লাভ করে। আল্লাহ্‌র নির্দেশ প্রত্যক্ষ না করলে ঈমান সুদৃঢ় হয় না। মানুষ আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক শিথিল করার ফলে শয়তানের কবলে অহরহ পড়তে থাকে ও বিদাত কাজে অংশগ্রহণ করতে থাকে। এই কঠিন সময়ে, দিকনির্দেশনা দেবার কেউ থাকে না। সেই প্রতিকূল অবস্থার সংশোধন এবং দিক নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেন খলীফাগণ। এই খলীফাগণের যারা অনুবর্তী হন তারাই প্রকৃত ঈমানদার, প্রকৃত মু’মিন। নবীর মৃত্যুর পর স্বভাবতই একটা জামা’তকে মৃতপ্রায় মনে হয়। কারণ তখন সে জমাতের বাহ্যত কোন কর্ণধার থাকেন না। এজন্য আল্লাহ্‌র ধর্মকে মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খলীফা নির্বাচন হয়। বিরুদ্ধবাদীরা এটাকে দুর্বলতা ভেবে আল্লাহ্‌র ধর্মের মূল উৎপাটনের লক্ষ্যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এবং বিভিন্ন নোংরা অপবাদ দিয়ে থাকে। এই অবস্থায় আল্লাহ্‌ সেই মৃতপ্রায় জামা’তকে খিলাফত নির্বাচনের মাধ্যমে পুন:জীবিত করে, শত্রুদের সকল বাধা, বিপত্তির মধ্যে দিয়ে তাদের জয়যুক্ত করে এক অলৌকিক নিদর্শন প্রদর্শন করেন। আল্লাহ্‌তাআলা নিজ খলীফাকে এ নব দীক্ষিতের দ্বারা নির্বাচিত করে জগদ্বাসীর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, আমি জামাতের জন্য দরূদ রাখি।

বস্তুত খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো সমগ্র মানবজাতিকে একীভূত করে এক সমাজভুক্ত করা। নানা মানুষের নানা মত ও ফেরকা থাকলেও সমাজে গন্ডগোল থাকবেই। এক নেতা এক খলীফার অধীনে থাকলে এ ধরনের কোন সমস্যারই উদ্ভব হবে না। আল্লাহ্‌ পাক বলেছেন-হে মুসলমান! তোমরা আল্লাহ্‌র রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো এবং শত বাধায় বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আল্লাহ্‌ রজ্জু বলতে ইসলামী খিলাফতকে বোঝানো হয়েছে। তাই আমরা বিশ্বাস করি খিলাফতের বরকত পাওয়া সত্যিই একটি ভাগ্যের ব্যাপার। এই কল্যাণ থেকে যারা বিচ্ছিন্ন তারা সত্যি সত্যি হতভাগ্য।

এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয়, প্রথমত আল্লাহ্‌ খলীফাকে মনোনীত বা নির্বাচিত করেন। দ্বিতীয়ত তিনি তাঁর খলীফার দোয়া কবুল করেন। তৃতীয়ত যারা খলীফার আনুগত্য করে না, খলীফাকে স্বীকার করে না তাদের আমল বা পুণ্যকর্ম বা সৎকর্ম থাকে না। দিনে দিনে তারা অপকর্মে লিপ্ত হতে থাকে। এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কোনক্রমেই ভুলবার মত নয়। তাই তো মুসলেহ মাওউদ (রাঃ) বলেছেনঃ

“তোমাদের মধ্যে একজন আছেন যিনি তোমাদের ব্যাথায় ব্যথিত হন, তোমাদের ভালবাসেন। তোমাদের দুঃখে দুঃখিত হন। তোমাদের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করেন।” তোমাদের জন্য আল্লাহ্‌র নিকট দোয়ারত থাকেন। অন্যদের জন্য এমন কেউ নেই” (বারাকাতে খিলাফত, পৃঃ ৫)

যারা চিঠি, দোয়া বা অন্য কোন উপায়ে খলীফার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন তারাই জানেন, খলীফা সাহেব প্রত্যেক আহ্‌মদীর জন্য কতটা মায়া মমতা বোধ রাখেন, দোয়া করেন। যার অজস্র উদাহরণ দেওয়া যাবে।

একটি পরিবার পিতামাতা ছেলে মেয়েদের মঙ্গলের জন্য সর্বক্ষণ দৃষ্টি রাখেন ঠিক তেমনই খলীফা সাহেব তাঁর জামাতের সদস্যদের জন্য সর্বদা চিন্তিত থাকেন। আল্লাহ্‌র নির্বচিত খলীফাগণ সবাই একই স্বভাবের হন। খলীফার বরকত ও কল্যাণের মধ্যে অন্যতম সুযোগ এই খলীফার হাতে বার বার বয়’আত নবায়নের সুযোগ হয়। আর বয়ত করার মাধ্যমে বয়’আতকারী আধ্যত্মিক সুযোগ লাভ করতে থাকে। এ সম্পর্কে খলীফাতুল মসীহ্‌ রাবে’ (রাহেঃ)-এর প্রথম খুতবা জুমুআর একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি।

হযরত খলীফাতুল মসীহ রাবে’ (রাহেঃ) ১০ জুন ১৯৮২ইং বৃহস্পতিবার বাদ নামায যুহর মসজিদে মোবারক রাবওয়ায় খিলাফতের মসনদে অধিষ্ঠিত হন। পরের দিন শুক্রবার জুমুআর খুতবায় বলেন,

“অতএব বয়’আত করা একান্ত জরুরী। এটি একটি সুন্নত যে কোন মূল্যেই হোক অবশ্যই একে জীবিত রাখতে হবে। এজন্য যা আবশ্যক তা এই, বয়াতের বাক্যগুলো উচ্চারণের সময যখন মন-প্রাণ বিশেষভাবে বেদনাবোধ করে, তখন একটি নতুন জীবন লাভ হয়, একটি নতুন রূহ প্রাপ্তি ঘটে আর একটি নব-জীবন লাভ হয়। এই সময়টার মূল্যবোধকে অনুধাবন করুন। একে হাতছাড়া হতে দিবেন না”। (আলফযল-২২-০৬-১৯৮২)

আল্লাহ্‌তাআলার নির্বাচিত নবী (খলীফাতুল্লাহ্‌) এবং নবীর ইন্তেকালে যারা নবীর জামাতে খলীফা নির্বাচিত হন তাঁদের হাতে বয়’আত করে এক অপূর্ব আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ হয়। সেই শক্তি দিয়ে নফসে আম্মারার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে পাপ মুক্ত হওয়া এবং পুণ্যবান হওয়া, সৎকর্মপরায়ণ বড় সহজ হয়। নতুবা মানুষ খলীফার হাতে বয়’আত না করে জামাতে সামীল না হয়ে কখনও নিজ শক্তিতে সহজে পুণ্যবান হতে পারে না। আল্লাহ্‌র নির্বাচিত খলীফার হাতে বয়াতের তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) বলেছেনঃ

“দ্বিতীয় লাভ এই তওবার (বয়’আত) মাধ্যমে যা পাওয়া তা এই, তাওবায় এক শক্তি এবং দৃঢ়তা থাকে। তওবা খলীফার কল্যাণে মা’মুর মিনাল্লাহ বা আল্লাহ্‌ প্রেরিতদের হাতে হাত রেখে খাঁটি অন্তকরণে করা হয়। এই সুযোগটি শুধুমাত্র খলীফার মাধ্যমে সম্ভব।”

খলীফা পথভ্রষ্ট হবার প্রশ্ন উঠে না। তখন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে তখন খিলাফত হাত ছাড়া হয়ে যাবে। অতএব এই মহামূল্য নেয়ামতের অবমূল্যায়ণ বা এর প্রতি অবহেলা করো না। আর ঐশী বাণী (ইলহাম)-কে হেয় দৃষ্টিতে দেখ না।

এত নেয়ামত জগদ্বাসী উপকৃত হবে খিলাফতের বরকতের মাধ্যমে। এ কথাটি, ভুলে গেলে চলবে না নবুওয়ত যেমন লড়াই করে কায়েম করা যায় না তেমনি নবুওয়তের পদ্ধতিতে খিলাফত বা ইমামতও যুদ্ধ করে কায়েম করা যায় না। খলীফা হন মু’মিনদের ভোটে এবং আল্লাহ্‌র অনুমোদনে।

পৃথিবীর মুসলমানেরা বিগত শত শত বৎসর যাবৎ এই খিলাফতের জন্য অপেক্ষা করে আসছে। মস্তক বিহীন দেহের কোন মূল্য নেই। খলীফা বিহীন মুসলমান জাতিরও সেরূপ কোন গুরুত্ব থাকতে পারে না। আমরা জানি শরীয়তের বিধান অনুসারে,

খলীফা নির্বচন করা মুসলমানের জন্য জরুরী। খলীফাহীন ইসলাম কর্ণধারবিহীন তরণীর তুল্য বিপন্ন ও লক্ষ্যভ্রষ্ট। এই জন্য মুসলিম জগতের পক্ষে খলীফা নির্বাচন করা জরুরী হইয়াছে। উহা না করা পাপ ও ধর্মচ্যুত এবং নির্বাচিত খলীফাকে না মানা ধর্মদ্রোহিতা। (ইসলাম দর্শন, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, বৈশাখ, ১৩২৭ বাংলা)

এসব উক্তি আহ্‌মদী জামাতের দ্বিতীয় খলীফার খিলাফতের প্রথম দিকে করা হয়েছিল। আজকাল আর এ ধরনের চীৎকার শোনা যায় না। অথচ প্রায় শত বৎসর যাবৎ এই খিলাফত সমগ্র বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। যারা খিলাফতের জন্য ব্যাকুল ছিলেন তারা মরে গেছেন। আজ যারা জীবিত আছে তারা খিলাফতকে ভুলে গিয়ে রাজনীতি নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত। তারা খলীফা চায় না চায় দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন “ইসলাম শাসন”। অথচ খলীফা ছাড়া প্রকৃত ইসলমী শাসন কায়েমই হতে পারে না। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি আহ্‌মদীয়া জামাতের সদস্য ছাড়া সবাই খিলাফতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।

অতএব ধ্রুব সত্য, পৃথিবীর বুকে আজ এমন একটিও মুসলিম রাষ্ট্র নেই, যা খলীফাতুল মুসলেমীন কর্তৃক স্বীকৃতি প্রদত্ত, সনদ প্রদত্ত। তাই আজ মুসলিম উম্মাহকে এ কথাটি ভেবে দেখতে হবে, আজকের বিশ্বেও কোন একটিও মুসলিম দেশের শাসন কর্তৃক সে প্রজাতান্ত্রিক, আমীরতান্ত্রিক, যা-ই হোক না কেন ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ কিনা। এরূপ শাসনকর্তৃত্বকে যদি বৈধ বলাই হয়, তাহলে কুরআন করীম কি এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না? রসূলুল্লাহ্‌র (সাঃ) হাদীস বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না? আজকের পৃথিবীর কোন মুসলিম রাষ্ট্রকে কি প্রকৃত অর্থে দারউল-ইসলাম বলে অভিহিত করা যাবে? আমার মনে হয় খাতিরে আজ দেরী হলেও মুসলিম উম্মাহর এ প্রশ্নগুলোর সমাধান খোঁজা প্রয়োজন।

আজ ইসলামে প্রতিশ্রুত মাহ্‌দী ও মসীহ্‌র ৫ম খিলাফতের বরকতে আহ্‌মদীগণ সারা পৃথিবীর মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন লা শরীক আল্লাহ্‌র বাণী। ইলাহী আলোয় আজ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে সত্যিকারের ইসলাম। বনী আদমের প্রাণে প্রাণে সঞ্চারিত হচ্ছে ঐশী প্রেম। ঐশী ডাক আজ উচ্চারিত হচ্ছে তাঁর কন্ঠে। পৃথিবী অতি দ্রুত ধ্বংসের দিকে ধাববান। এর পরিত্রাণের ব্যবস্থা খলীফার মাধ্যমে আহ্‌মদীয়া জামাতের দায়িত্বে। যাদের অন্তর্দৃষ্টি আছে তারা দেখতে পাবে, খিলাফতের বরকতে উম্মতে মুহাম্মদীয়াকে ঐক্যবদ্ধ করে পবিত্র কলেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” এর ঝান্ডা তলে এক খলীফার অধীনে ও আনুগত্য আনবার কল্যানপ্রসূ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। শত অত্যাচার, শত বাধা বিপত্তি জুলুম করেই খিলাফতকে ধ্বংস করতে পারেনি খিলাফতের বৈরীতা। মানবতার মহা ঐক্যের ডাক দিয়ে বিদাত ও ধর্ম ব্যবসা করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে না যুগ খলীফা। তাই এই ঐক্য অবশ্যম্ভাবী। এ এক ঐশী তকদীর। এই খলীফার কল্যাণে ধন্য সে, যে এই খলীফার ডাকে লাব্বায়েক বলে।

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে জানুয়ারী ২০০৭