মহানবী (সা.)-এর জীবনী: বদর যুদ্ধের দিকে পরিচালিত পরিস্থিতি

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০২-জুন, ২০২৩

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম ও আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২রা জুন, ২০২৩ লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “মহানবী (সা.) এর জীবনী: বদর যুদ্ধের দিকে পরিচালিত পরিস্থিতি” বিষয়ক জুমুআর খুতবা প্রদান করেন। প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় বদরের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
তাশাহ্‌হুদ, তাআউয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, বদরী সাহাবীদের জীবনের বিভিন্ন দিক, তাঁদের পরিচয় ও তাদের কুরবানী সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে খুতবায় বর্ণনা করা হয়েছে যার প্রেক্ষিতে অনেকে এই ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন যে, মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত যদি বর্ণনা না করা হয় তাহলে অপূর্ণতা থেকে যায় কেননা মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন মহানবী (সা.)-এর সত্তা যাঁর চতুষ্পার্শ্বে সাহাবীরা প্রদক্ষিণ করতেন। যাঁর সাহচর্যে থেকে সাহাবীরা কুরবানী করার অতুলনীয় গুণ অর্জন করেছিলেন।
হুযূর (আই.) বলেন, মহানবী (সা.)-এর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে পূর্বেও বিভিন্ন খুতবায় আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু তাঁর (সা.) জীবনের প্রতিটি দিক এত বিস্তৃত যে, তা একাধিক খুতবাতেও বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। বরং প্রতিটি খুতবাতেই তাঁর জীবনচরিতের কোনো না কোনো দিক বর্ণিত হয়ে থাকে, কেননা এটিই আমাদের জীবনের মূল কেন্দ্রবিন্দু বা আকর্ষণ আর তাঁকে বাদ দিয়ে আমাদের ধর্ম এবং আমাদের ঈমান পূর্ণতা লাভ করে না এবং শরীয়তের ওপর ষোলো আনা আমলও হতে পারে না।
হুযূর (আই.) বলেন, বদরের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মহানবী (সা.)-এর জীবনী বর্ণনা করা হবে, কেননা মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শের আলোকেই সাহাবীরা নিঃস্বার্থ কুরবানী করার অনুপ্রেরণা লাভ করেন এবং শহীদ, গাজী ও আল্লাহ্ তা’লার প্রিয়ভাজন হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।
বদরের যুদ্ধের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব এম এ (রা.) তাঁর সীরাত খাতামান্নাবীঈন পুস্তকে লিখেন, “মহানবী (সা.)-এর মক্কী জীবনে কুরাইশগণ মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার-নিপীড়ন করেছে এবং ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য যেসব ষড়যন্ত্র করেছে তা যে কোনো যুগে ও অবস্থায় দুই জাতির মাঝে যুদ্ধের সূচনার জন্য যথেষ্ট। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুসলমানরা যখন আবিসিনিয়ায় হিজরত করে তখন তারা সেখানেও পৌঁছে যায় এবং নাজ্জাশীর দরবারে গিয়ে মুসলমানদেরকে ফেরত আনার চেষ্টা করে। মহানবী (সা.)-কে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেয় এবং তায়েফে কুরাইশদের সমগোত্রীয়রা এক খোদার নাম নেয়ার কারণে তাঁর (সা.) প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে তাঁকে রক্তাক্ত করে। অবশেষে তারা নিজেদের জাতীয় পার্লামেন্ট (দ্বারুন্ নাদওয়ায়) মহানবী (সা.)-কে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা রাতের আঁধারে মহানবী (সা.)-এর বাড়িতে আক্রমণ করে, কিন্তু খোদা তা’লা তাঁকে রক্ষা করেন এবং তিনি (সা.) শত্রুদের চোখে ধুলো দিয়ে সওর গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। কুরাইশদের এহেন অত্যাচার-নিপীড়ন এবং খুনী চক্রান্তই ছিল যুদ্ধের ঘোষণার নামান্তর এবং কোনো জাতি যদি আত্মহত্যা করতে না চায় তাহলে এমন পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করা তাদের জন্য আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। মুসলমানদের জায়গায় যদি অন্য কোনো জাতি হতো তবে তারা নিশ্চিতভাবে অনেক পূর্বেই কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কুরাইশদের অত্যাচার যখন বেড়ে যায় তখন আব্দুর রহমান বিন অওফ ও অন্যান্য সাহাবীরা মহানবী (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত হয়ে কুরাইশদের মোকাবিলা করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তখন তিনি (সা.) বলেন, “উমিরতু বিল আফয়ে ফালা তুক্বাতিলু” অর্থাৎ আমাকে এখনও পর্যন্ত ক্ষমার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাই আমি তোমাদেরকে লড়াই করার অনুমতি দিতে পারি না। অতঃপর অত্যাচারের মাত্রা যখন ছাড়িয়ে যায় এবং খোদা তা’লার দৃষ্টিতে ইতমামে হুজ্জত বা দলীল-প্রমাণ অকাট্যরূপে উপস্থাপন করা হয় তখন খোদা তা’লা হিজরতের অনুমতি প্রদান করেন। মহানবী (সা.)-এর হিজরত মূলত কাফিরদের আলটিমেটাম গ্রহণ করার নামান্তর ছিল।
মহানবী (সা.) যতদিন মক্কায় ছিলেন সকল প্রকার অত্যাচার সহ্য করেছেন, কিন্তু কুরাইশদের বিরুদ্ধে তরবারি ধারণ করেন নি, কেননা প্রথমত কুরাইশদের বিরুদ্ধে কোনো প্রদক্ষেপ নেয়ার পূর্বে আল্লাহ্ তা’লার সুন্নত অনুযায়ী অকাট্য দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন আবশ্যক ছিল। দ্বিতীয়ত খোদা তা’লার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানরা যেন চুড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত ক্ষমা ও ধৈর্যের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে যার পরে নীরব থাকা আত্মহত্যার নামান্তর। তৃতীয়ত মক্কায় কুরাইশদের এক প্রকার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। যতদিন তিনি (সা.) মক্কায় ছিলেন সেই শাসনব্যবস্থার সম্মান করেছেন এবং শান্তি বিঘ্ন হয় এমন কোনো পদক্ষেপ তিনি নিজের পক্ষ থেকে গ্রহণ করেননি। চতুর্থত এটিও আবশ্যক ছিল যে, যতক্ষণ পযর্ন্ত তাঁর (সা.) জাতি খোদা তা’লার দৃষ্টিতে শাস্তির যোগ্য না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাদের মাঝে অবস্থান করেন। কেননা খোদা তা’লার রীতি অনুযায়ী নবী যতদিন জাতির মাঝে অবস্থান করেন ততদিন পর্যন্ত শাস্তি অবতীর্ণ হয় না।
মহানবী (সা.)-এর মদীনায় হিজরতের পর মক্কার কুরাইশরা যদি ইসলামের বিরোধিতা থেকে বিরত হতো তাহলে তখনও তাদের ক্ষমা লাভের সুযোগ ছিল। কিন্তু তারা পূর্বের চেয়ে আরও প্রবলভাবে বিরোধিতা আরম্ভ করে। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের কথা জানতে পেরে তারা তাঁকে ধরে আনার জন্য একশ’ উট পুরস্কার ঘোষণা করে যা বর্তমান যুগে কোটি কোটি টাকার সমপরিমাণ। সেই সাথে তারা মদীনার নেতৃবৃন্দের কাছে হুমকি দিয়ে পত্র লিখে যে, যদি তারা মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে এবং তাঁকে মদীনা থেকে বের করে না দেয় তাহলে কুরাইশরা সমবেতভাবে তাদের ওপর আক্রমণ করবে। আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলূল ও তার প্রতিমাপূজারী সাথীরা যখন এই পত্র পায় তখন তারা মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সমবেত হয়। মহানবী (সা.) যখন এ সম্পর্কে জানতে পারেন তখন তিনি তাদেরকে বলেন, তারা তোমাদের ততটা ক্ষতি সাধন করতে পারবে না যতটা তোমরা নিজেরা নিজেদের ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করার মাধ্যমে করবে।
হুযূর (আই.) বলেন, কুরাইশরা এতেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা আরবের বিভিন্ন গোত্রের যোগসাজশে তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়। এক কথায় সমগ্র আরব মুসলমানদের মোকাবিলার জন্য প্রস্তত হয়ে যায়। এমনকি সেই দিনগুলোতে মুসলমানরা রাতে অস্ত্র সাথে নিয়ে ঘুমাতেন। স্বয়ং মহানবী (সা.) শত্রুদের আক্রমণের আশঙ্কায় বিনিদ্র রাত যাপন করতেন। এ সময় সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এভাবে উল্লেখ রয়েছে,

وَاذْكُرُوا إِذْ أَنتُمْ قَلِيلٌ مُّسْتَضْعَفُونَ فِي الْأَرْضِ تَخَافُونَ أَن يَتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآوَاكُمْ وَأَيَّدَكُم بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ۡ
অর্থাৎ “হে মুসলমানগণ! আর স্মরণ করো তোমরা যখন খুবই স্বল্প ছিলে, দেশে দুর্বল বলে গণ্য হতে (এবং) তোমরা ভয় করতে যে, কোথাও লোকেরা তোমাদেরকে ছোঁ মেরে না নিয়ে যায়, তখন তিনি তোমাদের আশ্রয় দিলেন এবং তাঁর সাহায্যের মাধ্যমে তোমাদের সমর্থন যোগালেন আর পবিত্র জীবিকা তোমাদের দান করলেন যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।” (সুরা আল্ আনফাল: ২৭)

হুযূর বলেন, এটি ছিল মদীনার বাহিরের অবস্থা আর মদীনার অভ্যন্তরীণ অবস্থাও স্থিতিশীল ছিল না। প্রথমত, একদিকে অওস ও খাযরাজ গোত্রের বড় একটি অংশ মুশরিক ছিল এবং বাহ্যত ভাই-বান্ধব হওয়া সত্ত্বেও এহেন পরিস্থিতিতে তাদের ওপর ভরসা করা সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত, মুনাফিকদের দল ছিল; যারা বাহ্যত মুসলমান হলেও আশঙ্কার কারণ ছিল। তৃতীয়ত, ইহুদিদের সাথে একটি চুক্তি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের কাছে এই চুক্তির কোনো মূল্যই ছিল না। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে মহানবী (সা.)-এর প্রতি খোদা তা’লার পক্ষ থেকে তরবারির যুদ্ধ সংক্রান্ত ওহী অবতীর্ণ হয়। তরবারির যুদ্ধ সংক্রান্ত সর্বপ্রথম সূরা হাজ্জ এর ৪০-৪১ নং আয়াত ২য় হিজরীর ১২ই সফর মোতাবেক ১৫ই আগস্ট ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে অবতীর্ণ হয়। জিহাদ ফরয হওয়ার পর মহানবী (সা.) কুরাইশদের অনিষ্ঠ থেকে মুসলমানদের সুরক্ষিত রাখার জন্য চারটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথমত, তিনি স্বয়ং সফর করে আশেপাশের বিভিন্ন গোত্রের সাথে শান্তি চুক্তি করেন। দ্বিতীয়ত, ছোট ছোট গোয়েন্দা দল প্রেরণ করে কাফিরদের গতিবিধি সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করেন। তৃতীয়ত, এসব দল প্রেরণের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল মক্কা ও এর আশেপাশের দরিদ্র মুসলমানদেরকে মদীনায় নিয়ে আসা। চতুর্থত, কুরাইশদের সেসব ব্যাবসায়িক কাফেলার গতি রোধ করা যা মদীনার পাশ দিয়ে সিরিয়াতে গমন করত। কেননা এই কাফেলাগুলো যে পথ দিয়ে যেত তার আশেপাশের গোত্রগুলোকে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতো। তাছাড়া এই কাফেলাগুলো অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থাকত যার ফলে মদীনার এত নিকট দিয়ে তাদের যাতায়াত মুসলমানদের জন্য আশঙ্কার কারণ ছিল। আর কুরাইশদের অর্থ উপার্জনের বড় মাধ্যম ছিল ব্যবসা, তাই এ পথে বাধা সৃষ্টি করার মাধ্যমে তাদেরকে শান্তি চুক্তি করতে বাধ্য করাও উদ্দেশ্য ছিল। ইতিহাস থেকে এটি প্রমাণিত যে, যেসব বিষয় কুরাইশদেরকে চুক্তি করতে বাধ্য করেছিল তার মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হলো, ব্যাবসায়িক কাফেলার পথে বাধা সৃষ্টি করা। কেননা এসব ব্যবসার লভ্যাংশ তারা ইসলামকে ধ্বংস করার কাজেও ব্যবহার করত, বরং কোনো কোনো কাফেলা শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করা হতো। তাই প্রত্যেকে এটি বুঝতে পারবে যে, এসব কাফেলার পথে বাধা সৃষ্টি করা একান্তই বৈধ বিষয় ছিল।
হুযূর (আই.) বলেন, এই বর্ণনার ধারা অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ্।
এরপর হুযূর (আই.) সম্প্রতি প্রয়াত চারজনের স্মৃতিচরণ করেন। তারা হলেন, মুকাররম খাজা মুনির উদ্দিন কমর সাহেব, মুকাররম ডাঃ মির্যা মুবাশ্বের আহমদ সাহেব, মুকাররমাহ্ সৈয়দা আমাতুল বাসিত সাহেবা এবং মুকাররম শরীফ আহমদ বন্দেশা সাহেব। হুযূর (আই.) তাদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন।