দোয়া, অবিচলতা, নম্রতা ও ধৈর্য-ধারণই বিজয় ও সাফল্যের চাবিকাঠি

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৮-এপ্রিল, ২০২৩

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম ও আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২১শে এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় তাকওয়ার গুরুত্ব এবং রমযানের পর আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করেন। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) পাকিস্তান, বুরকিনা ফাঁসো, বাংলাদেশ, আলজেরিয়া এবং অন্যান্য দেশের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করার আবেদন করেন।

তাশাহ্‌হুদ, তাআউয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, সম্প্রতি পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আহমদীদের ওপর যেসব অত্যাচার-নিপীড়ন চলছে সেগুলোর প্রেক্ষিতে কেউ কেউ হুযূরকে চিঠি লিখে বলে থাকেন, অনেক ধৈর্য ধরা হয়েছে, এবার আমাদেরও পাল্টা কিছু প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। আর এর স্বপক্ষে এই যুক্তি দেখানোরও চেষ্টা করেন যে, হযরত মুসলেহ্ মওউদ (প্রতিশ্রুত সংস্কারক) (রা.)’র যুগে জামা’ত পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং তিনি এর অনুমতি দিয়েছিলেন। হুযূর (আই.) প্রথমেই এই ভ্রান্তির অপনোদন করেন; প্রতিশ্রুত সংস্কারক (রা.) পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আইনের গণ্ডির ভেতরে থেকে কিছু পদক্ষেপ অবশ্যই গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তিনি কখনোই নৈরাজ্যবাদীদের মতো মিছিল ইত্যাদি করার অনুমতি দেন নি। উপরন্তু, যুগ-খলীফা হিসেবে তিনি স্বয়ং যদি কোনো প্রতিবাদ করার অনুমতি দিয়েও থাকেন, জামা’তের যে কোনো কর্মকর্তার এই অধিকার নেই যে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জামা’তের সদস্যদের আন্দোলনের নির্দেশ দেবে। ১৯৪৭ সনে দেশ-বিভাগের পূর্বে বেশ কিছু ইংরেজ ও জামা’ত বিরোধী কর্মকর্তা বারবার চেষ্টা করেছে যেন মুসলেহ্ মওউদ (রা.)’র বক্তব্যকে উস্কানিমূলক আখ্যা দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার বা হেনস্তা করা যায়, কিন্তু প্রতিবারই তারা হতাশ হয়েছে। কারণ তিনি (রা.) সবসময় বক্তৃতা বা ভাষণে ধৈর্য ধরার ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার উপদেশ প্রদান করতেন। আর আদতেও তাঁর পক্ষে এমন কোনো নির্দেশ দেয়া সম্ভব না যা ইসলামী শিক্ষা ও হযরত মসীহ্ মওউদ (প্রতিশ্রুত মসীহ্‌) (আ.)-এর নির্দেশ পরিপন্থী। প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.) অসংখ্য স্থানে জামা’তকে ধৈর্য ধারণ ও দোয়া করার উপদেশ দিয়েছেন। তিনি এ-ও বলেছেন, যাদের পা দুর্বল এবং আমার সাথে এসব কণ্টকাকীর্ণ, বন্ধুর পথে চলতে পারে না এবং ধৈর্য ধারণের শক্তি রাখে না- তারা চাইলে আমাকে পরিত্যাগ করতে পারে।
বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করে যার উত্তরে হুযূর (আই.) বলেন, আজ যারা আহমদী তাদের অনেকেই এই বিরোধীদের মধ্য থেকেই এসেছে। এটি সত্য- আমরাও চাইলে তাদের মতো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি; কিন্তু আমরা যুগের ইমামকে মেনেছি, যিনি শান্তি বজায় রাখার এবং আল্লাহ্ তা’লার কৃপারাজির উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য আমাদেরকে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের শিক্ষা দিয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে আইনের আওতায় থেকে নিজ অধিকার আদায়ের জন্য চেষ্টা করা যেতে পারে, তবে কখনো কখনো পুরো বিষয়টিই আল্লাহ্ তা’লার হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। খোদা তা’লা স্বয়ং আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন এবং তিনি এসেছেনও। এটি নবীদের ইতিহাস আর এটিই আমাদের জন্য প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.)-এর শিক্ষা যে, আমাদেরকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এই উত্তরে তারা হতবাকও হয় এবং ভূয়সী প্রশংসাও করে বলে, এটিই শান্তিপ্রিয় লোকদের যথার্থ প্রতিক্রিয়া।
হুযূর (আই.) প্রতিশ্রুত সংস্কারক (রা.)’র খুতবার আলোকে এ বিষয়ে তাঁর (রা.) বক্তব্য সুস্পষ্ট করেন এবং ধৈর্য সম্পর্কে প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.)-এরও বিভিন্ন উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। মুসলেহ্ মওউদ (রা.) একটি খুতবায় অত্যন্ত বিশদভাবে ধৈর্যের অর্থ বর্ণনা করেছেন। তিনি (রা.) ধৈর্যকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আখ্যায়িত করে বলেন, এটি নবীদের জামাতের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধানতম দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম, যা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না কিংবা জগৎকেও নিজের অনুগামী বানাতে পারে না। ধৈর্য প্রদর্শন ছাড়া কোনো জাতিই সফলতার মুখ দেখে নি। ধৈর্য দুপ্রকার হয়ে থাকে; একটি হলো, কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মানুষ ধৈর্য ধরে। দ্বিতীয়ত, সেই সময়েও মানুষ ধৈর্য ধরে যখন তার কোনো মোকাবিলা করার বা প্রতিক্রিয়া দেখানোর শক্তিই থাকে না, অর্থাৎ অপারগতার ধৈর্য। প্রথমটি হলো, শক্তি বা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বে নৈরাজ্যবাদী ও অত্যাচারীদেরকে তাদের মতো করেই পাল্টা জবাব না দেয়া, বরং আল্লাহ্ তা’লার খাতিরে চূড়ান্ত ধৈর্য প্রদর্শন করা। আর দ্বিতীয়টির দৃষ্টান্ত হলো, ঐশী বিপদাপদের সময় আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট থেকে ধৈর্য ধারণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। উর্দু ভাষায় ধৈর্য বলতে নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকাকে বুঝায়, কিন্তু আরবীতে এর অর্থ অনেক ব্যাপক। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা’লা যেসব স্থানে ধৈর্য ধরার নির্দেশ দিয়েছেন তার সাথে আভিধানিক বিশ্লেষণ যোগ করে মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, সব্‌র বা ধৈর্য শব্দের তিনটি অর্থ আছে। ১. পাপ পরিহার করা আর আপন সত্তাকে তা থেকে বিরত রাখা। ২. অবিচলতার সাথে সৎকর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। ৩. অধৈর্য হওয়া ও বিলাপ করা থেকে বিরত থাকা। তিনি (রা.) অভিধান ও পবিত্র কুরআনের আলোকে এসব অর্থের বিস্তারিত ব্যাখ্যাও করেছেন। সংক্ষেপে, ধৈর্য হলো অবিচলতা, বিনয় এবং দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি কামনার নাম। আর এটি তখনই হবে যখন আমরা নিজেদের অবস্থা আল্লাহ্ তা’লার শিক্ষানুযায়ী সাজাবো এবং নিজেদের জীবন অতিবাহিত করব। তবে সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে, কোনো দুর্বলতার কারণে যেন ধৈর্য ধারণ না হয়, জাগতিক কোনো ভয়ের কারণে যেন না হয়, বরং শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই যেন হয়। কোনো শাসকের অত্যাচার সত্ত্বেও যদি আল্লাহ্‌র কথা ভেবে ধৈর্য ধরা হয় তবে সেটিই প্রকৃত ধৈর্য, আর যদি প্রাণভয়ে নিশ্চুপ থাকা হয় তবে সেটি ধৈর্য নয়। এমন অসংখ্য আহমদী রয়েছে যারা শুধু একবার অনুমতি পেলে অত্যাচারী শত্রুদের উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত এবং নিজেদের প্রাণেরও কোনো মায়া করে না; কিন্তু যেহেতু এটি আমাদের শিক্ষা পরিপন্থী এবং বয়আতের সময় আমরা মানুষকে কোনো প্রকার কষ্ট না দেয়ারও অঙ্গীকার করে থাকি- সেজন্য তারা ধৈর্য ধরে। প্রতিশ্রুত সংস্কারক (রা.) এ-ও বলেছেন, আমাদের কর্মের মাধ্যমে যেন ধৈর্য ও আত্মমর্যাদাহীনতার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য প্রকাশ পায়। আমরা যদি তাদের অন্যায়ের বিপরীতে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাই তাহলে সবাই আমাদেরকে তাদের মতোই মনে করবে। এরূপ হলে জাগতিক ক্ষেত্রেও ভালোর বদলে পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহ্‌র ওপর ভরসা করে ধৈর্য ধরলে অন্যদের ওপরও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
একথা সঠিক, প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.) তাঁর রচনাবলীতে কতক কঠিন শব্দ প্রয়োগ করেছেন, কিন্তু তার অর্থ এটি নয় যে, আমরাও তা করতে পারি। আল্লাহ্ তা’লা এবং তাঁর নবীদের মর্যাদা ভিন্ন হয়ে থাকে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা জজের অধিকার আছে আদালতে অপরাধীকে চোর আখ্যায়িত করার, তিনি তাকে যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি দেন ও তার সংশোধনের চেষ্টা করেন। কিন্তু যে কেউ-ই এটি করার অধিকার রাখে না। প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.) যদি মানুষের দুর্বলতা প্রকাশ করে তা চিহ্নিত করে থাকেন তবে তা তাদের সংশোধনের জন্য ও ভুল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রক্ষার জন্য করেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর ব্যক্তিসত্তার ক্ষেত্রে একথাই বলেছেন, গালিগালাজ শুনেও আমি এসব লোককে দোয়া দিয়ে থাকি। তিনি (আ.) বলেছেন, ধৈর্য হচ্ছে এক অলঙ্কার; যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে এবং রাগান্বিত হয়ে কথা বলে না, তার বক্তব্য তার নিজের হয় না বরং খোদা তা’লা তাকে দিয়ে কথা বলান। যারা আমাদের মিথ্যাবাদী বলে তাদের জন্য আবশ্যক না যে, তারা আমাদের সাথে ভদ্র আচরণ করবে বা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর নাম সম্মানের সাথে বলবে। স্বয়ং মহানবী (সা.)-এর জীবনেও আমরা এরূপ দেখতে পাই যে, শত্রুরা চরম অসৌজন্য দেখিয়েছে কিন্তু তিনি (সা.) ধৈর্য প্রদর্শন করেছেন। বরং প্রকৃত বিষয় হলো, মহানবী (সা.) আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশে ধৈর্যের যে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন তার সাথে কেউই পাল্লা দিতে পারে না। আহমদী হবার পর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন এমনকি কখনো কখনো বাবা-মা, ভাই-বোনও শত্রু হয়ে যায়। আমাদের কর্তব্য হলো, তাদের সাথে ঝগড়াবিবাদ না করে তাদের জন্য নিভৃতে দোয়া করা যেন আল্লাহ্ তা’লা তাদেরকেও সত্য বুঝার ও গ্রহণ করার সৌভাগ্য দান করেন। ধৈর্য ধরার ফলে একসময় শত্রুও লজ্জিত হয় এবং অত্যাচার থেকে বিরত হয়। হুযূর (আই.) সম্প্রতি বাংলাদেশে জলসায় আক্রমণের সময়কার একটি ঘটনা আবারো উল্লেখ করেন যে, কীভাবে আক্রমণকারী একটি ছেলে লজ্জিত হয়ে হাতের পাথর ফেলে দিয়েছিল। প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.) বলেন, ধৈর্যকে কক্ষনো হাতছাড়া হতে দেবে না; ধৈর্য এমন এক অস্ত্র, কামান দিয়ে যে কাজ সমাধা না হয় তা ধৈর্যের দ্বারা হয়। ধৈর্যই মানুষের হৃদয় জয় করে। প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.)-কে গালি দিলে স্বভাবতই একজন আহমদীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, কিন্তু তিনি আমাদেরকে উত্তেজনা না দেখিয়ে বিষয়টি আল্লাহ্ তা’লার ওপর ছেড়ে দিতে বলেছেন। কারণ তাদের গালাগালি, কুফরি ফতওয়া তো কোনোভাবেই সত্যের জয়যাত্রার পথরোধ করতে পারে নি, জামা’ত ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একদা জনৈক আহমদী এক বিরুদ্ধবাদী মৌলভীর বিরোধিতার উল্লেখ করে তাঁর (আ.) কাছে দোয়ার আবেদন করে যেন, সেই মৌলভীর অন্যত্র বদলি হয়ে যায়। তিনি (আ.) মৃদু হেসে তাকে বুঝান যে, আহমদী হবার পর জামা’তের কি পালন করা উচিত; যদি কষ্ট না হয় তাহলে পুণ্য কীভাবে লাভ হবে? মহানবী (সা.) সাহাবীদের চরম কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য ধরার শিক্ষাই দিয়েছেন, এক সময় গিয়ে শত্রুরা সব শেষ হয়ে গিয়েছে। ধৈর্য ধারণ করা একটি ইবাদত এবং আল্লাহ্ তা’লা ধৈর্য ধারণকারীদের অগণিত প্রতিদান দেয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন। ধৈর্য এক অতুলনীয় জিনিস। তিনি (আ.) বলেন, আমাদের বিজয়ের অস্ত্র হচ্ছে তওবা, এস্তেগফার, ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন, আল্লাহ্ তা’লার মাহাত্ম্য দৃষ্টিপটে রাখা ও পাঁচ বেলার নামায যথাযথভাবে আদায় করা। নামায হলো দোয়া কবুল হওয়ার চাবিকাঠি। সেইসাথে সবরকম পাপ বর্জন করতে হবে।
খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে ধৈর্যধারণের শক্তি দিন এবং দোয়া করার তৌফিক দান করুন, আর তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এসব বিষয়ের ওপর আমল করার তৌফিক দান করুন, আমীন।