তাকওয়ার গুরুত্ব এবং রমযানের পর আমাদের করণীয়

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২১-এপ্রিল, ২০২৩

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম ও আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২১শে এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় তাকওয়ার গুরুত্ব এবং রমযানের পর আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করেন। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) পাকিস্তান, বুরকিনা ফাঁসো, বাংলাদেশ, আলজেরিয়া এবং অন্যান্য দেশের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করার আবেদন করেন।
তাশাহ্‌হুদ, তাআউয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, আজ রমযানের শেষ জুমুআ। রমযান শেষ হয়ে যাচ্ছে আর অনেক মানুষ হয়তো এ মাসে বিশেষ ইবাদত এবং নিজের অভ্যন্তরে পবিত্র পরিবর্তন সৃষ্টি করার ব্যপারে দৃঢ় সংকল্পও করে ছিলেন, কিন্তু সংকল্প অনুযায়ী হয়তো কার্যত তেমনটি করতে পারেন নি। জুমুআর দিনে এমন এক মুহূর্ত আসে যখন যে দোয়াই করা হয় তা খোদার দরবারে গৃহীত হয়। কাজেই, যদি আমাদের রমযানের দিনগুলো আশানুরূপ নাও কাটে তবুও বিচলিত হওয়ার কিছু নেই বরং এখন আমাদের এই দোয়া এবং অঙ্গীকার করা উচিত, আল্লাহ্ তা’লা যেন কৃপাবশত আমাদেরকে সেভাবে জীবনযাপনের তৌফিক দেন যেভাবে প্রকৃতপক্ষে চলা উচিত এবং যেমনটি আল্লাহ্ তা’লা আমাদের কাছে প্রত্যাশা রাখেন। মহানবী (সা.) কোথাও একথা বলেন নি যে, কেবল রমযানের শেষ জুমুআতেই দোয়া গৃহীত হয়, বরং সাধারণভাবে প্রত্যেক জুমুআতেই দোয়া গৃহীত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। অতএব, আমরা যদি স্থায়ীভাবে ইবাদতের এই মান ধরে রাখি এবং প্রত্যেক জুমুআকে পুণ্যকাজের মাধ্যমে অতিবাহিত করার চেষ্টা করি এবং ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দেই এবং পরবর্তী রমযান পর্যন্ত নিজেদের মাঝে পবিত্র পরিবর্তনের জন্য এ অভ্যাস সৃষ্টি হয়েছে তা ধরে রাখতে পারি তাহলে আগামীতেও পরম দয়ালু আল্লাহ্ আমাদেরকে সেসব কল্যাণে ভূষিত করতে থাকবেন যা এই রমযান মাসের জন্য নির্ধারিত ছিল।
কাজেই, প্রকৃত বিষয় হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি। প্রকৃত বিষয় হলো, খোদা তা’লার নির্দেশ মেনে চলা, তাঁকে ভয় করা, তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা, স্থায়ীভাবে পুণ্যার্জনের চেষ্টা করতে থাকা এবং ধর্মকে পার্থিবতার ওপর প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করা, এ বিষয়টি আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে। আমরা যখন নিজেদের জীবনকে তাকওয়ার আলোকে পরিচালিত করব তখন এটি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্তরূপে উপস্থাপিত হবে।
হুযূর (আই.) বলেন, আমরা খোদা তা’লার কৃপায় এ যুগের ইমামের হাতে বয়আত করেছি। যেসব শর্তে বয়আত করেছি তার সারাংশ হলো, সর্বদা তাকওয়ার আলোকে জীবনযাপন করবো, যেন আমাদের জীবনে সেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয় যা কেবলমাত্র রমযানের এক মাসের বিপ্লবই নয়, বরং প্রতি বছর এ রমযানকে কেন্দ্র করে তাকওয়ার মানে উত্তরোত্তর উন্নতির বিপ্লব সৃষ্টি করতে থাকবে। প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) আমাদের তাকওয়ার মানকে উন্নত করতে এবং আমাদের সংশোধনের জন্য প্রেরিত হয়েছেন আর তাই তিনি বারংবার এই বিষয়ে উপদেশই প্রদান করেছেন। এক স্থানে তিনি (আ.) বলেন, আমি প্রেরিত হয়েছি যেন সত্য এবং ঈমানের যুগ পুনরায় ফিরে আসে এবং হৃদয়ে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। অতএব, ঈমানের মান উন্নত করতে আমাদের বিশেষভাবে চেষ্টা-প্রচেষ্টা করা উচিত। এমনটি হলে আমরা সেসব মানুষের অন্তর্ভুক্ত হবো যারা প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর সাথে বিশেষ সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছেন, যারা বয়আতের উদ্দেশ্যকে অনুধাবনকারী এবং এর প্রাপ্য অধিকার যথাযথভাবে প্রদানকারী আর এরাই তারা যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’লা বলেছেন, আমি তোমার এবং তোমার প্রিয়ভাজনদের সাথে আছি। কারো প্রিয়ভাজন হতে হলে মৌলিক শর্ত হলো, তাঁর কথা শোনা এবং তাঁর কথা মেনে চলা। অতএব, যখন কারো সাথে আল্লাহ্ তা’লার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে যায় তখন তার আর কি প্রয়োজন? অতএব, আমাদের মধ্যে তারাই সৌভাগ্যবান যারা ঈমানের এই মানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
প্রকৃত তাকওয়া কি এবং এর ওপর প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির সাথে আল্লাহ্ তা’লা কীরূপ আচরণ করেন এ সম্পর্কে প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) বলেন, মুত্তাকী অজ্ঞ হতে পারে না। প্রকৃত মুত্তাকী খোদার ইবাদতকারী এবং বান্দার প্রাপ্য অধিকার প্রদানকারী হয়। অতএব, এটি সেই মৌলিক বিষয় যা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। প্রকৃত তাকওয়ার মাঝে ঐশী নূর থাকে। পবিত্র কুরআনে আছে, যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো তাহলে তোমাদের এবং অন্যদের মাঝে এক বিশেষ পার্থক্য সৃষ্টি হবে আর তা হলো তোমাদেরকে ঐশী নূর দেয়া হবে। তোমাদের সবকিছুতে নূর থাকবে এবং যে পথে তোমরা চলবে তা নূরান্বিত হয়ে যাবে। এটি হলো সেই পদমর্যাদা যা একজন মুত্তাকী ও মু’মিনের লাভ করার চেষ্টা করা উচিত। আমাদের সকল কাজ ও কথা আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হলে আমরা সেই নূর লাভ করতে পারব।
হুযূর (আই.) এরপর বলেন, এখন শয়তানী থাবা সর্বত্র বিস্তৃত এবং সবদিক থেকে শয়তান আমাদের ওপর আক্রমন করতে উদ্যত। এমতাবস্থায় বিশেষভাবে খোদা তা’লার পানে ধাবিত হওয়া উচিত। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার কারণ হলো, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কীভাবে শয়তানের খপ্পর থেকে রক্ষা করা যায়। এজন্য প্রত্যেক আহমদী অভিভাবক এবং জামা’তী ব্যবস্থাপনার সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত। তাই প্রত্যেক আহমদীর খোদা তা’লার কাছে আকুতিমিনতি ভরে দোয়া করা উচিত যেন আমরা এসব শয়তানী কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারি। সকল নবীর সময় শয়তান পরাজিত হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে এবং চূড়ান্ত অর্থে শয়তান পরাজিত হবে প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর যুগে। এ সম্পর্কে প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) বলেন, এটি সত্য যে, তিনি (আল্লাহ্) আমার অনুসারীদেরকে অস্বীকারকারীদের ওপর প্রাধান্য দিবেন। কিন্তু কেবল বুলিসর্বস্ব বয়আত করেই সত্যিকার অনুসারী হওয়া যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার মাঝে আনুগত্যের পরিপূর্ণ স্পৃহা সৃষ্টি না হবে। এথেকে বুঝা যায়, খোদা তা’লা এমন এক জামা’ত সৃষ্টি করতে চান যারা সম্পূর্ণরূপে তাঁর সত্তায় বিলীন বা বিভোর থাকবে।
হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা অবশ্যই এমন জামা’ত সৃষ্টি করবেন কিন্তু আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত যে, আমরা কি সেই মানে উপনীত হতে পেরেছি? প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর অনুসারীদের সাথে যে প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্ তা’লা দিয়েছেন আমরা কি সেই মানের তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত যা তিনি তাঁর জামা’তের সদস্যদের মাঝে দেখার প্রত্যাশা রেখেছেন? কেবল রমযানের কয়েক দিনের ইবাদত আমাদেরকে সেই কল্যাণ বা আধ্যাত্মিক উন্নত মান প্রদান করবে না। তিনি (আ.) বলেন, কেবল মৌখিক বয়আত করায় কোনো স্বার্থকতা নেই যতক্ষণ পর্যন্ত অবিচলতার সাথে এর ওপর পরিপূর্ণরূপে আমল না করবে। যারা এমনটি করবে তারা আমার চার দেয়ালের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’লা বলেন, ইন্নি উহাফিযু কুল্লা মান ফিদ্দার। আমি তাদেরকে সুরক্ষা করব যারা তোমার চার দেয়ালের অন্তর্ভুক্ত।
তিনি (আ.) বলেন, কেবলমাত্র মৌখিকভাবে এ কথা বলা যে, শয়তান মারা গেছে এটি ফলপ্রসূ নয় বরং ব্যবহারিকভাবে দেখাতে হবে যে, শয়তান মারা গেছে। তোমাদের সকল কর্ম এবং অবস্থার মাধ্যমে যেন এটি প্রকাশ পায় যে, আমরা আমাদের শয়তানকে মেরে ফেলছি। প্রত্যেকের সাথে শয়তান থাকে, কিন্তু আমাদের নবী (সা.)-এর শয়তান মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। এটি আমাদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। অনুরূপভাবে তোমাদের শয়তানেরও মুসলমান হয়ে যাওয়া উচিত। হাদীসে আছে, লা হাওলা পড় তাহলে শয়তান পালিয়ে যাবে। কিন্তু কেবল মৌখিকভাবে লা হাওলা পড়লেই শয়তান পালাবে না, বরং যে ব্যক্তি এই দোয়া পড়ার পাশাপাশি খোদা তা’লার আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং নিজের আমলের মাধ্যমে শয়তান থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে মূলত তার শয়তানই পালিয়ে যায়।
খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর উদ্ধৃতির বরাতে আমাদের নামায কীরূপ হওয়া উচিত এবং কীভাবে খোদা তা’লার প্রাপ্য অধিকার প্রদান করা উচিত তা উল্লেখ করেন। তিনি (আ.) বলেছেন, হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নামায ইবাদতের মগজ বা সার। আমরা যখন এই মগজ অর্জন করতে পারবো তখন আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্য অর্জনকারী হবো। কাজেই, প্রকৃতঅর্থে নামায পড়তে হবে, নতুবা বাহ্যিক নামায পড়া আমাদের কোনো উপকারে আসবে না। আমাদের দোয়া ও আমাদের সকল ইবাদত কেবলমাত্র আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হতে হবে। নামাযের সুরক্ষা এ কারণে করা হয় না যে, খোদা তা’লার এর প্রয়োজন রয়েছে। খোদা তা’লার তাঁর বান্দার নামাযের কোনো প্রয়োজন নেই, বরং এটি মানুষের প্রয়োজন। মানুষ নিজের ভালো চায়, তাই সে খোদা তা’লার কাছে সাহায্য চায় আর সাহায্য চাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হলো নামায। এরপর যদি সমগ্র জগৎ এমন নামাযী ও খোদা তা’লার প্রেমে বিভোর ব্যক্তির বিপক্ষে যায় তথাপি তার কোনোই ক্ষতি করতে পারে না। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে নামাযের প্রাপ্য অধিকার প্রদানের তৌফিক দিন এবং আমরা যেন এমন নামাযী না হই যা আল্লাহ্ তা’লার অসন্তুষ্টির কারণ হয় বরং আমরা যেন আল্লাহ্ তা’লার কৃপারাজির উত্তরাধিকারী হতে পারি।
হুযূর আনোয়ার (আই.) পরিশেষে বলেন, পাকিস্তানের আহমদীদের জন্য দোয়া করুন। পাকিস্তানের আহমদীরাও নিজেদের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করুন। বুরকিনা ফাঁসো, বাংলাদেশ, আলজেরিয়া এবং অন্যান্য দেশের আহমদীদের জন্যও বিশেষভাবে দোয়া করুন যেন আল্লাহ্ তা’লা প্রত্যেক আহমদীকে শত্রুর দুস্কৃতি ও অনিষ্ট থেকে নিরাপদ রাখেন এবং তাদের ঈমানকে সুদৃঢ় করেন। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে নিজেদের মাঝে পবিত্র পরিবর্তন সৃষ্টি করার এবং অধিকহারে দোয়া করার তৌফিক দিন, তদুপরি সেসব দোয়া নিজ সন্নিধানে কবুল করুন, আমীন।