পরিপূর্ণ ও সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ আল্‌-কুরআন: প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ ও ইমাম মাহদী (আ.)-এর লেখনির আলোকে

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৭-এপ্রিল, ২০২৩

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম ও আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল খামেস (আই.) গত ৭ই এপ্রিল, ২০২৩ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী, প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী (আ.)-এর বিভিন্ন লেখনির আলোকে পবিত্র কুরআনের পরিপূর্ণ ঐশী গ্রন্থ এবং কামেল শরীয়ত হওয়ার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) ফিলিস্তিনের মুসলমানদের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করার আবেদন করেন।
তাশাহ্‌হুদ তাআউয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযুর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে ধর্ম ও শরীয়তকে পরিপূর্ণতা দান করেছেন। এটি মুসলমানদের প্রতি আল্লাহ্ তা’লার অনেক বড় কৃপা আর এ দাবি কেবলমাত্র ইসলামেরই রয়েছে। অতএব এখন আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাইলে ইসলাম তথা কুরআনী শিক্ষার ওপর আমল করার কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ্ তা’লা বলেন, মানুষের সকল চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার পূর্ণতা এবং উন্নতি এখন কেবলমাত্র পবিত্র কুরআনের মাধ্যমেই সম্ভব তা পার্থিব হোক বা আধ্যাত্মিক। কেননা কুরআনই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ঐশী গ্রন্থ এবং কামেল শরীয়ত।
প্রতিশ্রুত হযরত মসীহ্ (আ.) বলেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) সেই শ্রেষ্ঠ ও পরিপূর্ণ নবী যার প্রতি পূর্ণাঙ্গ শরীয়ত অবতীর্ণ হয়েছে আর এটিই আমাদের দাবি ও বিশ্বাস। আপত্তিকারীরা প্রশ্ন করে, আপনারা যেহেতু মুহাম্মদ (সা.)-কে শেষ ও পরিপূর্ণ নবী এবং কুরআনকে সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ ঐশী কিতাব বলে বিশ্বাস করেন তাহলে ইমাম মাহদী (আ.)-এর আগমনের কি প্রয়োজন ছিল? এর উত্তরে তিনি (আ.) বলেন, যদি তোমরা সত্যিকার অর্থেই ইসলামের শিক্ষার ওপর আমল করতে তাহলে আমার আগমনের কোনো প্রয়োজন ছিল না।
কিন্তু যুগের অবস্থা এটিই দাবি করছিল যে, এমন একজনের আগমন আবশ্যক। মুহাম্মদ (সা.)ও এ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, শেষ যুগে প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) এসে পৃথিবীতে ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তা প্রচার করবেন। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) প্রতিশ্রুত মসীহ্ হিসেবে আগমন করেছেন এবং আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব প্রত্যেক আহমদীর এ বিষয়ে চিন্তা করা উচিত যে, এ উদ্দেশ্য সাধনে আমরা ব্যক্তিগতভাবে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কি করছি?
এরপর হুযূর (আই.) প্রতিশ্রুত হযরত মসীহ্ (আ.)-এর বিভিন্ন উদ্ধৃতির আলোকে পবিত্র কুরআনের পরিপূর্ণ ঐশী কিতাব হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন। প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) এ প্রসঙ্গে বলেন, এটি প্রমাণসিদ্ধ বিষয় যে, পবিত্র কুরআন ধর্মকে পরিপূর্ণ করেছে যেভাবে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا (সূরা আল্ মায়েদা: ৪) অর্থ: আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য আমার নিয়ামতরাজিকে পূর্ণতা দান করেছি এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছি। অতএব পবিত্র কুরআনে সমস্ত শিক্ষা অবতীর্ণ হয়েছে, এখন কেবল খোদার সাথে বাক্যালাপের সুযোগ রয়েছে। তা-ও আবার পবিত্র কুরআন ও মুহাম্মদ (সা.)-এর সত্যিকার অনুসরণের মাধ্যমেই এ সৌভাগ্য লাভ হতে পারে, অন্যথায় নয়। প্রতিশ্রুত হযরত মসীহ্ (আ.) বলেন, আমিও এতদুভয়ের অনুসরণের মাধ্যমেই এ সৌভাগ্য লাভ করেছি।
প্রতিশ্রুত হযরত মসীহ্ (আ.) অন্যত্র বলেন, পবিত্র কুরআন আদেশ-নিষেধের ব্যাপারে পরিপূর্ণ শিক্ষা দেয়। কি করতে হবে, কি করা যাবে না তা-ও স্পষ্টভাবে স্থানকালপাত্রভেদে উল্লেখ করে। অধিকন্তু এটি সমস্ত যুগের নিরিখে চিরন্তন শিক্ষা প্রদান করে এবং সেই শিক্ষাগুলো কখন এবং কীভাবে প্রযোজ্য হবে তা-ও উল্লেখ করে। মানবীয় যোগ্যতায় এমন কিতাব লিখা সম্ভব নয় তা সে যত বড় জ্ঞানী ও দক্ষই হোক না কেন। মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ এবং খোদার জ্ঞান অপরিসীম। অতএব, সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে মানুষ এর সমকক্ষ কিছু তৈরি করতে পারবে না। এ কারণে সবাই এর সমকক্ষ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে আর ভবিষ্যতেও ব্যর্থ হবে।
পবিত্র কুরআন জ্ঞানের দিক থেকে যেভাবে মানুষকে পরম উৎকর্ষতায় পৌছে দেয় তেমনই ব্যবহারিকভাবেও পূর্ণতার শিখরে উপনীত করে। অতএব, পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মানুষ নিদর্শন দেখতে পাবে এবং তার দোয়াও কবুল হবে, কিন্তু শর্ত হলো এজন্য কুরআনের শিক্ষার পূর্ণ অনুসরণ করতে হবে। অতএব, পবিত্র কুরআনের শিক্ষার ওপর পরিপূর্ণরূপে আমল করলে মানুষ অসাধারণ কল্যাণ লাভ করতে পারে।
পবিত্র কুরআনের আরেকটি শ্রেষ্ঠত্ব হলো, এর এমন কোনো বাক্য নেই যা অপ্রয়োজনে লেখা হয়েছে আর এমন কোনো কথা নেই যা অকারণে বর্ণনা করা হয়েছে আর এমন কোনো শব্দ নেই যা অনর্থক লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এমন ক্ষুদ্রাকৃতির একটি গ্রন্থ যা এক কিশোরও মুখস্থ করে ফেলতে পারে তাতে সকল যুগের জন্য সবধরনের শিক্ষা বিদ্যমান। যখন যে ধরনের ব্যাধি দেখা যায় তদ্রুপ চিকিৎসা প্রদান করে এই কুরআন, যে ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় সে অনুযায়ী তার প্রতিকার বিধান করে।
পবিত্র কুরআনের সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ হওয়া সম্পর্কে প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) বলেন, পবিত্র কুরআন এমন সময় অবতীর্ণ হয়েছিল যখন সবধরনের নৈরাজ্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই পবিত্র কুরআনের শিক্ষাও চূড়ান্ত পর্যায়ের। এ দৃষ্টিকোণ থেকেও পবিত্র কুরআন পরিপূর্ণ আর পূর্ববর্তী সকল গ্রন্থ ও সহিফা ত্রুটিপূর্ণ আখ্যা পেয়েছে। কিন্তু পবিত্র কুরআনের পর আর কোনো ঐশী কিতাবের প্রয়োজন নেই, কেননা কুরআন শরীফের পর জ্ঞানের আর কোনো স্তর অবশিষ্ট নেই।
প্রতিশ্রুত হযরত মসীহ্ (আ.) বলেন, আমার মতে, তার প্রতি খোদার অভিসম্পাত বর্ষিত হবে যে কুরআনের নিয়ামতরাজিকে অস্বীকার করে এবং নিজেকে অনেক বড় মনে করে। খোদার কসম! আমরা কুরআনের জ্ঞানরাশির ঝরনা থেকে সিঞ্চিত হই এবং এর সৌন্দর্যে সুসজ্জিত হই। আমার প্রতি কুরআন ব্যতিরেকে আর কোনো কিছুর অনুগ্রহ নেই। এটি আমাকে সেভাবে লালিতপালিত করেছে যেভাবে পিতামাতা সন্তানকে প্রতিপালন করে থাকে। যদি আমার সাথে কোনো নিদর্শন না থাকত এবং আমার সাথে খোদার সাহায্য ও সমর্থন না থাকত আর আমি কুরআনকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো পথ বের করে নিতাম অথবা কুরআনী নির্দেশাবলী বা শরীয়তে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করতাম অথবা মনগড়া কোনোকিছু আরোপ করতাম অথবা মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষার বাইরে কিছু করতাম বা বলতাম তাহলে মানুষের আপত্তি গ্রহণযোগ্য হতো যে, প্রকৃতঅর্থেই এ ব্যক্তি খোদা ও তাঁর রসূলের শত্রু এবং পবিত্র কুরআন ও এর শিক্ষাকে অস্বীকারকারী। কিন্তু আমি তো কুরআনের সেবক এবং যে ব্যক্তি কুরআনে হস্তক্ষেপ করে এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসরণকে পরিত্যাগ করে আমি তাকে কাফির ও মুরতাদ মনে করি। খোদা তা’লা পৃথিবী ও আকাশ থেকে আমার অনুকূলে সহস্র সহস্র নিদর্শন দেখিয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এরপরও অনেকে খোদার এ প্রত্যাদিষ্টের বিরোধিতা করে, তার প্রতি অপবাদ আরোপ করে। তাদের কিছুটা চিন্তা করা উচিত, বিবেক খাটানো উচিত এবং এত্থেকে বিরত হওয়া উচিত। যদি বিরত না হয় তাহলে আল্লাহ্ তাদেরকে কীভাবে পাকড়াও করবেন তা তিনিই ভালো জানেন।
পবিত্র কুরআনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উন্নত শিক্ষা বিদ্যমান রয়েছে। অজ্ঞতার যুগেও পবিত্র কুরআন সর্বনিকৃষ্ট লোকদের সাথে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে। অতএব ন্যায়পরায়ণতার এই নীতিই পৃথিবীতে শান্তি বয়ে আনতে পারে। বর্তমানেও পৃথিবীর নেতারা যদি এটা বুঝে তাহলে বিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহের পরিবর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) এক স্থানে বলেন, খোদা তা’লা সাক্ষী আছেন, কেউ যদি কুরআনের শিক্ষার মাঝে এক অণু পরিমাণও ত্রুটি দেখাতে পারে অথবা অন্য কোনো কিতাবে কুরআনের শিক্ষা বহির্ভূত এক অণু পরিমাণও অধিক উন্নত কোনো শিক্ষা দেখাতে পারে তাহলে আমি মৃতুকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এ তত্ত্বজ্ঞান অনুধাবনের তৌফিক দিন।
খুতবার শেষের দিকে হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে প্রকৃত অর্থে কুরআন অনুধাবন ও আমল করার তৌফিক দিন। রমযানে যেভাবে আপনারা কুরআন পাঠ ও এর শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রতি মনোযোগী হয়েছেন রমযানের পরও এত্থেকে কল্যাণ লাভের চেষ্টা জারি রাখুন। রমযানে বিরোধীদের দুস্কৃতি থেকে বাঁচার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করুন। আল্লাহ্ তা’লা তাদের ষড়যন্ত্র ও সবধরনের দুস্কৃতি থেকে আমাদের সুরক্ষা করুন। বিশ্ববাসী যেন সকল প্রকার ফিতনা ও ফাসাদ ও নৈরাজ্য থেকে সুরক্ষিত থাকে সেজন্য অনেক বেশি দোয়া করুন। অনুরূপভাবে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের জন্যও দোয়া করুন যেন তারা অত্যাচারীদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পায়। সামগ্রীকভাবে মুসলিম উম্মাহ্‌র জন্য দোয়া করুন, আল্লাহ্ তা’লা যেন তাদেরকে সত্য বুঝার ও গ্রহণের তৌফিক দান করেন আর তারা যেন খোদার ক্রোধ থেকে রক্ষা পায়। আল্লাহ্ তা’লা এই রমযানে আমাদের জন্য পূর্বের চেয়ে আরো বেশি কৃপার দরজা উন্মোচন করুন, আমীন।