প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ ও ইমাম মাহদী (আ.)-এর দৃষ্টিতে পবিত্র কুরআনের অতুলনীয় মর্যাদা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৩-মার্চ, ২০২৩

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৩রা মার্চ, ২০২৩ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় বিগত খুতবার ধারাবাহিকতায় প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ ও ইমাম মাহদী (আ.)-এর রচনাসমগ্র থেকে পবিত্র কুরআনের অনিন্দ্য সুন্দর গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য দোয়ার তাহরীক করেন।
হুযূর (আই.) বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদেরকে পবিত্র কুরআনের যে মা’রেফত বা তত্বজ্ঞান দান করেছেন অথবা আমাদেরকে বুঝানোর জন্য তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থাবলীতে এসব মারেফত যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা আমি সম্প্রতি দু’টি খুতবায় বর্ণনা করেছি। পবিত্র কুরআন আমাদেরকে তত্ত্বজ্ঞানের যে ভাণ্ডার প্রদান করে সত্যিকার অর্থে এগুলোই বান্দাকে খোদার সাথে নিবিড় সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ করে থাকে। কুরআন ছাড়া খোদাকে লাভ করার বা তাঁর নৈকট্য পাবার আর কোনো পথই খোলা নেই। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর একটি পঙক্তিতে বলেন, “কুরআন খোদা নুমাঁ হ্যায়, খোদা কা কালাম হ্যায়। বে ইসকে মা’রেফত কা চমন না তামাম হ্যায়।” (অর্থাৎ, কুরআন হলো খোদা দর্শনের দর্পণ ও খোদার বাণী। আর এটি ছাড়া তত্ত্বজ্ঞানের বাগান অসম্পূর্ণ।)
হুযূর (আই.) বলেন, এটি হচ্ছে মূল বিষয় যা আমাদেরকে সর্বদা দৃষ্টিপটে রাখতে হবে। আমরা যদি খোদার নৈকট্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করতে চাই, আমরা যদি নিজেদের ইহ ও পরকালকে সুন্দর ও নিরাপদ করতে চাই তাহলে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, পবিত্র কুরআনই হচ্ছে এর একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু এটিও মনে রাখতে হবে, এই তত্ত্বজ্ঞান বুঝার জন্য বা অনুধাবন করার জন্য খোদার কোনো মহাপুরুষের আবির্ভাব আবশ্যক ছিল। আর এ যুগে সেই প্রতিশ্রুত মহাপুরুষ হচ্ছেন মহানবী (সা.)-এর নিষ্ঠাবানদাস হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)। তিনি (আ.) পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি যেরূপ গভীরে গিয়ে আলোকপাত করেছেন এবং এর সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করেছেন এবং তাঁর বর্ণিত এসব জ্ঞান ও তত্ত্বের যে ভান্ডার রয়েছে তা আমাদের অনুধাবনের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।
এরপর হুযূর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনাসমগ্রের আলোকে পবিত্র কুরআনের অনন্য বৈশিষ্ট্য, মোকাম ও মর্যাদা এবং এর গুরুত্ব বর্ণনা করেন। কোনো ঐশীগ্রন্থের কি কি বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত এবং পবিত্র কুরআন কীরূপ কামেল শরীয়ত ও শিক্ষামালা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে তা হুযূর (আই.) বিশদভাবে বর্ণনা করেন।
হুযূর (আই.) বলেন, একবার পণ্ডিত লেখরাম হযরত মসীহ মওউদ (আ.)-কে বলেছিলেন, পবিত্র কুরআন নয়, বরং বেদ ঈশ্বরের বাণী। প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) বলেন, এটি কখনো সত্য হতে পারে না, কারণ বেদে খোদা তা’লার সাথে শির্‌ক এর শিক্ষা বিদ্যমান, কিন্তু পবিত্র কুরআন শির্‌ক এর ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে আর পবিত্র কুরআন অনুসরণের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সত্যিকারের খোদাকে দেখতে এবং চিনতে পারে। অতএব, খোদা তা’লার বাণী হবার জন্য অপরিহার্য শর্ত হলো, তা শির্‌ক এর সমস্ত শিক্ষা থেকে মুক্ত হবে।
পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের ওপর অসাধারণ প্রভাব ফেলেছিল। প্রাথমিক যুগে তৎকালীন আরবরা এমনভাবে চরম অধঃপতিত ছিল যে, তারা পাপপুণ্যের ভেদাভেদ সম্পর্কে একেবারে অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছিল। মহানবী (সা.) এবং কুরআনের শিক্ষার প্রভাবে তারা রুহুল কুদুস বা ফিরিশ্তাদের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মন্দকর্ম সম্পর্কে ভালাভাবে অবগত হন এবং তা থেকে বিরত থাকার শক্তি অর্জনের মাধ্যমে পুণ্যের উচ্চমার্গে উন্নীত হয়েছেন।
পবিত্র কুরআন তাঁর পাঠককে খোদার গুণাবলী নিজের মাঝে ধারণে সাহায্য করে। পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে খোদার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআনকে সত্যিকার অর্থে অনুসরণ করলেই আল্লাহ্ তা’লার গুণাবলীর বিকাশস্থল হওয়া যায়। এটি এমন একটি গুণ যা পূর্ববর্তী অন্য কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না। এত্থেকে প্রমাণিত হয়, পবিত্র কুরআনের কল্যাণ চিরস্থায়ী আর পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের কল্যাণকর প্রভাব এখন আর নেই।
পবিত্র কুরআনের চারটি স্বতন্ত্র গুণ সম্পর্কে হযরত মসীহ মওউদ (আ.) বলেন, পবিত্র কুরআনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর দক্ষতা এবং বাগ্মীতা। আরেকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো, এতে উল্লিখিত সকল ঘটনা ভবিষ্যদ্বাণী স্বরূপ। তৃতীয় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো, এটি মানব প্রকৃতিকে তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। চতুর্থ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো, যে ব্যক্তি প্রকৃত অর্থেই এর শিক্ষার অনুসরণ করে এটি তাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যাতে সে আল্লাহ্‌র সাথে কথোপকথন করতে সক্ষম হয় এবং হাক্কুল একীন বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান সৃষ্টি হয়।
পবিত্র কুরআনকে সত্যিকার অর্থে অনুসরণ করার আরেকটি ফলাফল হলো, দোয়া গৃহীত হওয়া। প্রকৃতপক্ষে খোদা তাদের দোয়া গৃহীত হওয়ার কথা জানিয়ে দেন এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করেন।
হুযুর (আই.) বলেন, আমরা যদি এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে কুরআন পাঠ করি এবং এর ওপর আমল করি তাহলে আমাদের সংশোধন হবে, নতুবা আমাদের সংশোধন হবে না। পবিত্র কুরআন শির্‌ক থেকে মুক্তি দান করে আর বিশ্ববাসীকে শির্‌ক এর শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছে। কিন্তু আমরা যদি এর ওপর আমল না করি তাহলে আমরা সেদিকেই ধাবিত হবো।
তিনি আরো বলেন, পবিত্র কুরআন অতি উন্নত মানের শিক্ষা আর কিয়ামত পর্যন্ত এটি উন্নত শিক্ষা হিসেবেই বলবৎ থাকবে। অথচ সহস্র বছর পূর্বে অজ্ঞতার যুগে এটি অবতীর্ণ হয়েছে আর এটি কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছে। এ আধুনিক যুগে এসে কুরআন সবার জন্য এমন শিক্ষা প্রদান করে যা থেকে বুঝা যায় এটি পৃথিবীর সমস্ত জাতিকে একত্রিত করবে।
হুযূর (আ.) বলেন, নামসর্বস্ব আলেম-ওলামারা পবিত্র কুরআন বুঝতে অক্ষম কেননা, আল্লাহ্ বলেছেন, “লা ইয়া মাসসুহু ইল্লাল মুতহ্‌হারুন”। অর্থাৎ পবিত্র ব্যক্তিরা ছাড়া কেউ কুরআন স্পর্শ করতে পারে না। আর কুরআন অবতীর্ণ করার মূল উদ্দেশ্য হলো মুত্তাকীদের হিদায়াত প্রদান। মুত্তাকী হওয়ার ও সত্যিকার হিদায়াত লাভের শিক্ষা মূলত কুরআন থেকেই পাওয়া যায়। এছাড়া কুরআনের শুরুর দিকেই আল্লাহ্ বলে দিয়েছেন, “আনাল্লাহু আ’লামু” অর্থাৎ আমি আল্লাহ্ সর্বজ্ঞানী। তাই সর্বজ্ঞানী খোদা তাঁর সর্বময় জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষের কল্যাণের জন্য সবকিছ্ইু এতে বর্ণনা করেছেন। আর এও বলে দিয়েছেন যে, “লা রাইবা ফিহে” অর্থাৎ, এটি এমন জ্ঞান ভাণ্ডার যাতে সন্দেহ বা সংশয়ের কোনো অবকাশ নাই।
হুযূর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে যুগ-ইমামকে মানার তৌফিক দিয়েছেন আর তিনি আমাদেরকে কুরআনের জ্ঞান ও মূল তত্ত্ব শিখিয়েছেন। আমাদের উচিত কুরআনের প্রতি গভীরভাবে অভিনিবেশ করা এবং এর আলোয় আলোকিত হয়ে পবিত্র জীবন যাপনের মাধ্যমে বিশ্বের সামনে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। এছাড়াও পবিত্র কুরআন এমন আরো বহু কল্যাণের ধারক ও বাহক। তাই আমাদের উচিত, আমরা যেন নিজেদের আমলের মাধ্যমে এসব কল্যাণের ফলাফল প্রমাণ করে দেখাই। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে তাকওয়ায় ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে এর ওপর আমল করার তৌফিক দান করুন।
খুতবার শেষদিকে হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, এখন আমি দোয়ার তাহরীকও করতে চাই। বাংলাদেশে আজকাল সালানা জলসা হচ্ছে। আজই তাদের প্রথম দিন ছিল। কিন্তু সেখানে বিরোধীরা আক্রমণ করেছে, জলসাগাহেও আক্রমণ করেছে। অনেক মানুষ সেখানে আহতও হয়েছেন। আমার ধারণা হলো বাহির থেকে, তারা এমনভাবে আক্রমণ করেছে যার ফলে (মানুষ) আহত হয়েছে, (তাদের) কেউ কেউ গুরুতর আহতও রয়েছে। এছাড়া সেই এলাকায় যেসব আহমদী ছিল তাদের ঘরবাড়িও পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যে সংবাদ এসেছে সে অনুযায়ী কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। আল্লাহ্ তা’লা আহমদীদেরকে তাদের (অর্থাৎ বিরোধীদের) অনিষ্ট থেকে সুরক্ষিত রাখুন আর তাদের পাকড়াও করার উপকরণ সৃষ্টি করুন। তাদের জন্য হিদায়েতের কোনো দোয়া তো হতে পারে না। আল্লাহুম্মা মায্যেকহুম কুল্লা মুমায্যাকিন ওয়া সাহ্‌হিকহুম তাসহীকা-(অর্থাৎ, হে আমার আল্লাহ্! এই শত্রুদের টুকরো টুকরো করে দাও এবং তাদেরকে মাটিতে মিশিয়ে দাও। তাদেরকে পিষ্ট করো আর তাদেরকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দাও) এই দোয়াই আমাদের জন্য মুখ ও হৃদয় থেকে বের হয়।
হুযূর (আই.) আরো বলেন, একইভাবে পাকিস্তানের পরিস্থিতির জন্যও দোয়া করুন। আল্লাহ্ তা’লা সেখানেও আহমদীদের অবস্থার উন্নতি ঘটান। বুরকিনা ফাঁসোতেও এখন পর্যন্ত বিপদ মাথার ওপর ঘূর্ণায়মান। সেখানকার জন্যও দোয়া করুন। অনুরূপভাবে আলজেরিয়াতেও আহমদীদের বিরুদ্ধে কতিপয় মামলা রয়েছে। তাদের জন্যও দোয়া করুন। আল্লাহ্ তা’লা সকল স্থানে আহমদীদের সুরক্ষিত রাখুন।
হুযূর (আই.) পুনরায় বলেন, যেমনটি আমি বলেছি, বাংলাদেশে প্রশাসন আমাদেরকে বলেছিল যে, চিন্তা করবেন না। জলসা করুন, আমরা পূর্ণ নিরাপত্তা দেবো। কিন্তু যখন দাঙ্গাবাজ ও সন্ত্রাসী আর উগ্রপন্থী মোল্লারা তাদের মিছিল নিয়ে আসে তখন পুলিশ সেখানে দর্শক হয়ে বসেছিল এবং কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যাহোক, আমাদেরকে আল্লাহ্ তা’লার প্রতি বিনত হতে হবে, আল্লাহ্ তা’লার কাছে দোয়া করতে হবে। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের এই ভাইদের বিপদ দ্রুত দূর করুন। (আমীন)