শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ: হযরত হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব (রা.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

৩০-ডিসেম্বর, ২০২২

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৩০শে ডিসেম্বর, ২০২২ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব (রা.)’র জীবনীর সেই অংশ উপস্থাপন করেন যা মূল স্মৃতিচারণের পরে হস্তগত হয়েছে। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) আসন্ন নববর্ষ উপলক্ষ্যে সবাইকে দোয়ার আহ্বান জানান এবং দোয়া করেন।
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র স্মৃতিচারণ শেষে আমি বলেছিলাম, বদরী সাহাবীদের স্মৃতিচারণ যদিও এখানে শেষ হচ্ছে, কিন্তু কতিপয় সাহাবী যাদের বিষয়ে পূর্বে স্মৃতিচারণ করেছি তাদের সম্পর্কে কিছু তথ্য বা বিস্তারিত বিবরণ পরে হস্তগত হয়েছে; সুযোগ পেলে তা পরবর্তী খুতবায় বর্ণনা করা হবে, নতুবা তাঁদের জীবনী ছাপার সময় তাতে এসব তথ্য-উপাত্ত অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কেউ কেউ হুযূরকে পত্রে অনুরোধ করেছেন, এসব ইতিহাস শুনে তারা অনেক উপকৃত হয়েছেন; তাই এই অংশগুলোও যেন খুতবায় বর্ণনা করা হয়। অনুরোধের প্রেক্ষিতে হুযূর (আই.) এসব বিষয়ও খুতবায় বর্ণনা করা সমীচীন মনে করেন যেন বেশি বেশি মানুষ এগুলো শুনতে পারে, জানতে পারে। এই প্রেক্ষিতে হুযূর আজ হযরত হামযা (রা.)’র স্মৃতিচারণ করেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর চাচা ছিলেন এবং তাঁর (সা.) অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন যা মহানবী (সা.)-এর বিভিন্ন কথায় এবং হযরত হামযা (রা.)’র শাহাদতের পর মহানবী (সা.)-এর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। হাদীস থেকে জানা যায়, হামযা নামটি মহানবী (সা.)-এর খুবই প্রিয় ছিল। মদীনায় জনৈক সাহাবীর বাড়িতে পুত্রসন্তান জন্ম নিলে তারা মহানবী (সা.)-কে তার নাম রাখতে অনুরোধ করেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তার নাম হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিবের নামের সাথে মিলিয়ে রাখ যা আমার সবচেয়ে প্রিয় নাম।’
হযরত হামযা (রা.)’র স্ত্রী-সন্তানদের বিষয়ে তাবাকাতে কুবরায় বর্ণিত হয়েছে, অওস গোত্রের জনৈক ব্যক্তি মিল্লা বিন মালেকের মেয়েকে হযরত হামযা (রা.)’র বিয়ে করেছিলেন যার গর্ভে ইয়া’লা ও আমের নামক দুই পুত্রের জন্ম হয়; ইয়া’লার কারণে তাকে ‘আবু ইয়া’লা’ ডাকনামেও ডাকা হতো। তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী হযরত খওলা বিনতে কায়েস, যার গর্ভে তার কন্যা হযরত আম্মারা জন্মগ্রহণ করেন; এই মেয়ের পিতা হিসেবে তাকে ‘আবু আম্মারা’ নামেও ডাকা হতো। তার আরেক স্ত্রী ছিলেন হযরত আসমা বিনতে উমায়েসের বোন হযরত সালমা বিনতে উমায়েস, যার গর্ভে তার এক কন্যা হযরত উমামার জন্ম হয়। হুদাইবিয়ার সন্ধির পরের বছর মহানবী (সা.) যখন সন্ধিচুক্তির শর্ত অনুযায়ী মক্কায় উমরা পালন শেষে ফিরে আসছিলেন তখন উমামা পেছন থেকে ‘চাচা, চাচা’ বলে ডাকতে ডাকতে আসতে থাকেন। হযরত আলী (রা.) এগিয়ে গিয়ে তাকে তুলে নেন এবং হযরত ফাতেমার হাতে তাকে তুলে দেন। কিন্তু তার লালনপালনের বিষয়ে হযরত আলী, জা’ফর এবং হযরত যায়েদ বিন হারেসা রাযিয়াল্লাহু আনহুমের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়; তারা প্রত্যেকেই হযরত হামযা (রা.)’র এই কন্যাকে পালতে চাইছিলেন। মহানবী (সা.) তাদের মধ্যে মীমাংসা করেন; তিনি বলেন, খালা মায়ের সমতুল্য। যেহেতু উমামার খালা হযরত আসমা হযরত জা’ফর (রা.)’র স্ত্রী, সেজন্য মহানবী (সা.) উমামাকে লালনপালনের দায়িত্ব তাদের হাতে অর্পণ করেন। উল্লেখ্য, হযরত হামযা (রা.) যদিও সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর চাচা ছিলেন, কিন্তু একই মায়ের দুধ পান করার কারণে তিনি মহানবী (সা.)-এর দুধভাইও ছিলেন। হযরত হামযা (রা.)’র পুত্র ইয়া’লার বেশ কয়েকজন সন্তান ছিল, যেমন উম্মারা, ফযল, যুবায়ের, আকীল ও মুহাম্মদ; কিন্তু তারা সবাই মৃত্যুবরণ করায় হযরত হামযা (রা.)’র বংশ আর বিস্তার লাভ করে নি।
হযরত হামযা (রা.)’র ইসলাম গ্রহণের ঘটনা খুবই সুবিদিত; তাঁকে যখন বাড়ির একজন দাসী মহানবী (সা.)-এর সাথে আবু জাহলের দুর্ব্যবহারের কথা জানান তখন তিনি নিজেও ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন এবং আবু জাহলকে কঠোরভাবে শাসান। ইবনে ইসহাক ও কয়েকজন ইতিহাসবিদ খোদ হামযা (রা.)’র বরাতে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন; তিনি বলেন, সেই মুহূর্তের উত্তেজনায় মুসলমান হবার ঘোষণা দিলেও পরে তার অনুতাপ হয় যে, ‘আমি বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে দিলাম?!’ এই দুঃখে তিনি সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন নি। দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি কা’বাগৃহে আল্লাহ্‌র দরবারে কাকুতিমিনতি করে দোয়া করেন যেন আল্লাহ্ প্রকৃত সত্য তাঁর সামনে উদ্ভাসিত করেন এবং তা মানার জন্য তাঁর হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দেন। বস্তুত এই দোয়া শেষ হবার পূর্বেই তাঁর হৃদয় দৃঢ় বিশ্বাসে পরিপূর্ণ ও প্রশান্ত হয়ে যায়। সকালে গিয়ে তিনি মহানবী (সা.)-কে সব জ্ঞাত করেন আর তিনি (সা.)ও তার ঈমানের দৃঢ়তা এবং অবিচলতার জন্য দোয়া করেন।
একদা হযরত হামযা (রা.) মহানবী (সা.)-এর কাছে জিব্রাঈল (আ.)-কে স্বরূপে দেখার আবদার করেন; জিব্রাঈল (আ.) তখন কা’বাগৃহের একাংশে অবতরণ করেন। যখন হামযা (রা.) সেদিকে তাকান তখন তাঁর (আ.) পা সবুজ চুনি বা জেড পাথরের মতো দেখতে পান এবং মূর্ছা যান।
হযরত হামযা (রা.) মহানবী (সা.)-এর সাথে একাধিক যুদ্ধাভিযানে যাবার সৌভাগ্যও অর্জন করেন। যুদ্ধের অনুমতি অবতীর্ণ হবার পর প্রথম যে যুদ্ধাভিযানে স্বয়ং মহানবী (সা.) অংশ নেন তা ছিল ২য় হিজরীর সফর মাসে আবওয়া অভিমুখে অভিযান। এই অভিযানে হযরত হামযা (রা.) মহানবী (সা.)-এর পতাকাবাহক হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এটি ওয়াদ্দানের অভিযান নামেও সুপরিচিত। এতে কোনো যুদ্ধ হয় নি, তবে মহানবী (সা.) বনু কিনানা গোত্রের একটি শাখা বনু যামরার সাথে দ্বিপাক্ষিক সন্ধিচুক্তি করে ফেরত আসেন যে, তাদের সাথে মুসলমানদের মিত্রতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে এবং বিপদের সময় তারা একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন। একই বছর জমাদিউল উলা মাসে কুরাইশদের সম্ভাব্য গতিবিধি প্রতিরোধের জন্য তিনি (সা.) উশায়রা অভিমুখে অগ্রসর হন; এ সময়ও মহানবী (সা.)-এর সাদা রঙের পতাকা হযরত হামযা (রা.)ই বহন করেন। এই অভিযানেও কোনো যুদ্ধ হয় নি; মহানবী (সা.) বনু মুদলিজ গোত্রের সাথেও বনু যামরার অনুরূপ চুক্তি করে ফিরে আসেন।
বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের একক দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বানের প্রেক্ষিতে মহানবী (সা.) হযরত হামযা, আলী ও উবায়দা (রা.)-কে পাঠিয়েছিলেন। এই বিষয়টির অবতারণা করতে গিয়ে হুযূর (আই.) বদরের যুদ্ধের কিছু ঘটনা তুলে ধরেন। ঐশী প্রজ্ঞার অধীনে উভয় বাহিনীর অবস্থানগত কারণে কাফিররা মুসলমানদের সংখ্যা দ্বিগুণ অনুমান করছিল এবং মুসলমানরা কাফিরদের প্রকৃত সংখ্যার অর্ধেক মনে করছিলেন। কুরাইশরা উমায়রা বিন ওয়াহাব নামক এক ব্যক্তিকে মুসলমানদের সংখ্যা জরিপ করতে পাঠায়; সে ফিরে এসে আশার বাণী শোনানোর পরিবর্তে বলে, ভালো চাইলে রণে ভঙ্গ দাও; আমি যেন উটগুলোর ওপর জীবন্ত লাশ বসে থাকতে দেখেছি! অর্থাৎ মুসলমানরা যুদ্ধে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছে; এমন মানুষদের সাথে যুদ্ধ করা খুবই বিপজ্জনক। কুরাইশরা বিচলিত হয়ে পড়ে; হাকীম বিন হিদম, উতবা প্রমুখ যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আবু জাহলের ভয়ংকর উস্কানিতে সবাই আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং উতবা তার ভাই শায়বা ও পুত্র ওয়ালীদকে নিয়ে একক দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য অগ্রসর হয়। মদীনার আনসার তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে যেতে চাইলে মহানবী (সা.) তাদের থামিয়ে দিয়ে নিজের সবচেয়ে নিকটাত্মীয় হযরত হামযা, আলী ও উবায়দা (রা.)-কে সামনে যেতে বলেন। হামযা ও আলী (রা.) নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহজেই পরাজিত ও হত্যা করেন, কিন্তু উবায়দা (রা.) ও ওয়ালীদের মাঝে তুমুল লড়াই হয় আর দু’জনই গুরুতর আহত হয়; তখন হামযা ও আলী (রা.) গিয়ে ওয়ালীদকে হত্যা করে আর উবায়দা (রা.)-কে নিয়ে মুসলিম শিবিরে ফিরে আসেন। আহত হযরত উবায়দা (রা.) আঘাতের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে মদীনায় ফেরার পথে শাহাদত বরণ করেন। বদরের যুদ্ধে হযরত হামযা (রা.) কুরাইশ নেতা তোয়াইমা বিন আদীকেও হত্যা করেছিলেন।
মদ্যপান হারাম ঘোষণা হবার পূর্বে একবার হযরত হামযা (রা.) নেশার ঘোরে হযরত আলী (রা.)’র উট মেরে ফেলেছিলেন এবং মহানবী (সা.)-কেও অসৌজন্যমূলক উত্তর দিয়েছিলেন; হামযা (রা.)’র চৈতন্য নেই বুঝতে পেরে মহানবী (সা.) কথা না বাড়িয়ে তখন ফিরে এসেছিলেন। হযরত হামযা (রা.) পরে খুবই লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়েছিলেন বলে অনুমান করা যায়, যার ফলে তিনি পুণ্যের ক্ষেত্রে অগ্রসর হন। ইসলামের উন্নতিতে মদীনার ইহুদীদের গাত্রদাহ, মুসলমানদের মাঝে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা এবং শত্রুতা, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকার কারণে মহানবী (সা.) যখন বনু কায়নুকা’ গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন। এই যুদ্ধেও হযরত হামযা (রা.) মহানবী (সা.)-এর পতাকাবাহক ছিলেন।
হযরত হামযা (রা.) উহুদের যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেছিলেন। মক্কার কাফিররা অত্যন্ত জঘন্যভাবে অঙ্গচ্ছেদের মাধ্যমে তাঁর লাশকে বিকৃত করে, তাঁর বুক চিরে কলিজা বের করে নেওয়া হয়; যা সহ্য করাও অত্যন্ত দুস্কর ছিল। কিন্তু মহানবী (সা.)-এর দৃঢ় নির্দেশের কারণে কেউ কোনরকম বিলাপ করে নি, এমনকি মহানবী (সা.)-এর ফুফু সাফিয়াও বিলাপ এবং আহাজারি না করার শর্তেই ভাইয়ের লাশ দেখার অনুমতি পেয়েছিলেন। অবশ্য তাঁরা অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন যা বৈধ। এ প্রসঙ্গে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)’র একটি উদ্ধৃতি হুযূর উল্লেখ করেন যে, মহানবী (সা.) কীভাবে মদীনার নারীদের মাঝ থেকে আপনজনদের মৃত্যুতে বিলাপ ও আহাজারির কুপ্রথা দূর করার জন্য হযরত হামযা (রা.)-কে উপলক্ষ্য বানান এবং নিজের অতুলনীয় আদর্শ উপস্থাপনের মাধ্যমে অন্যদের শেখান এবং তরবীয়ত করেন।
খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) আসন্ন নববর্ষ উপলক্ষ্যে সবাইকে দোয়ার আহ্বান জানান এবং দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা যেন নতুন বছরের যাবতীয় কল্যাণে আমাদের ভূষিত করেন, জামা’তের জন্য এই বছর সবদিক থেকে কল্যাণময় ও উন্নতির কারণ হয়, শত্রুদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়, শত্রুদের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে আহমদীরা নিরাপদ থাকে; সার্বিকভাবে পৃথিবীর জন্যও হুযূর দোয়া করেন যেন আল্লাহ্ তা’লা যুদ্ধের বিভীষিকা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে জগদ্বাসীকে রক্ষা করেন। (আমীন)