শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ: হযরত আবু বকর (রা.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৯-ডিসেম্বর, ২০২২

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৯ই ডিসেম্বর, ২০২২ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় বিগত কয়েক বছর যাবৎ বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের যে ধারাবাহিক স্মৃতিচারণ করে আসছেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র স্মৃতিচারণ শেষ করার মাধ্যমে তার ইতি টানেন।
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, গত শুক্রবার খুতবার শেষদিকে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কিছু উদ্ধৃতি উপস্থাপন করা হয়েছিল, সেই ধারাবাহিকতায় হুযূর আরো কিছু উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেন। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এক স্থানে লেখেন, নিঃসন্দেহে আবু বকর সিদ্দীক ও উমর ফারুক (রা.) সেই কাফেলার নেতৃত্ব দিয়েছেন যা আল্লাহ্র খাতিরে সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছেন। তাঁরা সভ্য-অসভ্য নির্বিশেষে মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন এবং তা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের উভয়ের খিলাফতকালে ইসলামরূপী বৃক্ষ ফুলে-ফলে সুশোভিত ও সুরভিত হয়েছে। হযরত সিদ্দীকে আকবরের যুগে ইসলাম বিভিন্ন প্রকার নৈরাজ্য ও বিপদাপদে জর্জরিত ছিল; চতুর্দিক থেকে শত্রুদের ঝাঁপিয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে আল্লাহ্ তা’লা হযরত আবু বকর (রা.)’র সিদ্ক তথা সততার কারণে ইসলামের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন এবং গভীর কূপ থেকে নিজের প্রিয় ধর্ম ইসলামকে উদ্ধার করেছেন। এজন্য ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর এই মহান সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আমাদের জন্য আবশ্যক। হযরত আবু বকর (রা.) চরম পর্যায়ের জগদ্বিমুখ ও খোদাপ্রেমী মানুষ ছিলেন, আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি কখনো নিজ সন্তানদের প্রতি শুভাকাঙ্খাকে প্রতিবন্ধক হতে দেন নি। তাহলে একথা কীভাবে কল্পনা করা যায় যে, তিনি (রা.) মহানবী (সা.)-এর বংশধরদের প্রতি অন্যায়-অবিচার করেছেন? তিনি (আ.) বলেন, পবিত্র কুরআনে সাহাবী হিসেবে অকাট্য ও সুনির্দিষ্টভাবে একমাত্র তাঁর (রা.) মাহাত্ম্যের উল্লেখই রয়েছে, অন্য কোন সাহাবীর উল্লেখ এরূপ সুস্পষ্ট নয়। নবুয়্যতের গুণাবলীর বিকাশ ঘটানোর এবং মহানবী (সা.)-এর খলীফা হবার জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি তিনিই ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর সাথে তাঁর সম্পর্ক এত নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য ছিল যে, পৃথিবীর কোন শক্তিরই তাঁদেরকে পৃথক করার সাধ্য ছিল না। তাঁর আত্মা ও প্রকৃতিতে বিশ্বস্ততা, দৃঢ়চিত্ততা ও তাকওয়া অন্তর্নিহিত ছিল। সারা পৃথিবীও যদি মুরতাদ হয়ে যেত তবুও তিনি অগ্রসরই হতেন, পিছু হটতেন না। একারণেই আল্লাহ্ তা’লা সূরা নিসার ৭০নং আয়াতে নবীদের পরই সিদ্দীকদের উল্লেখ করেছেন। বস্তুতঃ এই আয়াতটি অন্য সাহাবীদের ওপর হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। কারণ মহানবী (সা.) কেবল তাঁকেই সিদ্দীক উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) হযরত আবু বকর (রা.)’র শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে ইবনে খলদূনের কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন যা হুযূর (আই.) খুতবায় তুলে ধরেন। হযরত আবু বকর (রা.)’র অসাধারণ বিভিন্ন সেবা, ঈমানের ক্ষেত্রে এবং শত্রুর মোকাবিলায় পরম অবিচলতার কথাও তুলে ধরেন।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, হযরত আবু বকর হারামাইন অর্থাৎ দুই পবিত্র শহরে এবং দুটি কবরেও মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন। প্রথম কবর বলতে তিনি সওর গুহাকে বুঝিয়েছেন যা প্রকারান্তরে মৃত্যুকে বরণ করার এবং কবরে প্রবেশ করারই নামান্তর ছিল, আর মদীনাতেও তিনি মৃত্যুর পর মহানবী (সা.)-এর কবরের ঠিক পাশ ঘেঁষেই সমাহিত হন। তিনি (আ.) বলেন, প্রকৃত ও পরিপূর্ণ ঈমানের পরিচয় বিপদের সময়ই পাওয়া যায়। হযরত মসীহ্ নাসেরী (আ.)-এর হাওয়ারীগণ চরম বিপদের সময়ই তাঁকে পরিত্যাগ করেছিল। কিন্তু হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) মক্কা থেকে হিজরতের চরম কঠিন মুহূর্তে মহানবী (সা.)-এর সাথী ছিলেন যা তাঁর (রা.) সবচেয়ে নিষ্ঠাবান ও সাহসী হবার প্রমাণ। মক্কার কাফিররা মহানবী (সা.)-কে হত্যা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই কঠিন সময়ে মক্কায় ৭০/৮০জন সাহাবী ছিলেন যাদের মধ্যে হযরত আলী (রা.)ও অন্যতম; কিন্তু মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)-কেই বেছে নেন। এর ভেতর রহস্য হলো, নবী যেহেতু আল্লাহ্‌র চোখ দিয়ে দেখে থাকেন এবং তাঁকে বিচক্ষণতাও আল্লাহ্ তা’লাই দেন, সেজন্য আল্লাহ্ তা’লাই তাঁকে এলহাম ও কাশফের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিলেন, আবু বকর (রা.)ই এই কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। আর শত্রু যখন ঠিক গুহার মুখে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছিল এবং আবু বকর (রা.) মহানবী (সা.)-এর নিরাপত্তার শঙ্কায় ক্রন্দনরত, তখন মহানবী (সা.) তাঁকেই এই সুসংবাদ শোনান- ‘লা তাহযান, ইন্নাল্লাহা মা’আনা’- দুঃখ কোরো না, আল্লাহ্ আমাদের দুজনের সাথেই আছেন। মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর যখন সাহাবীদের মধ্যে সে বিষয়ে সন্দেহ-সংশয় দেখা দেয় এবং হযরত উমর (রা.)’র মতো ব্যক্তিও তরবারি ধারণ করে ঘোষণা করেন, মহানবী (সা.) মারা যেতে পারেন না; যে বলবে তিনি মারা গিয়েছেন, আমি তার শিরোচ্ছেদ করব- সেই কঠিন মুহূর্তে আবু বকর (রা.)ই সবার আগে ধাক্কা সামলে ওঠেন এবং সবার সামনে সূরা আলে ইমরানের ১৪৫নং আয়াত পাঠ করে প্রকৃত সত্য উপস্থাপন করেন। এই সংবাদে বিপুল সংখ্যক বেদুঈন মুসলমান ধর্মত্যাগী হয়ে যায়, আর সেই কঠিন মুহূর্তেই হযরত আবু বকর (রা.)-কে খিলাফতের কঠিন জোয়াল নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যু, মুরতাদ হবার হিড়িক, নবী হবার মিথ্যা দাবিদারদের উত্থান, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ইত্যাদি চরম বিপদ দেখা দেয়। হযরত আয়েশা (রা.) সেই চিত্র তুলে ধরে বলেন, আমার বাবার ওপর তখন এত কঠিন সব দুঃখ আপতিত হয়েছিল, যদি পাহাড়ের ওপরও তা আপতিত হতো তবে তা গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যেত। হযরত আবু বকর (রা.) বর্ষার মতো অঝোর ধারায় আল্লাহ্ তা’লার দরবারে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন এবং দোয়া করেছেন, সেইসাথে পাহাড়ের মতো অটল হয়ে অন্যায়ের সাথে বিন্দুমাত্র আপোস না করে শক্তহাতে ইসলামের সুরক্ষা করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। বস্তুত তিনি ইসলামের জন্য দ্বিতীয় আদম সদৃশ ছিলেন, যাঁর মাধ্যমে ইসলামের পুনর্জন্ম হয়েছে।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এক স্থানে বলেন, হযরত আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) প্রত্যেকেই প্রকৃত অর্থে ধর্মের আমীন ছিলেন। যদি তাঁরা সেরূপ না হতেন, তবে আজ পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের বিষয়েও জোরালোভাবে বলা সম্ভব হতো না যে, তা সরাসরি আল্লাহ্‌র বাণী। তিনি (আ.) আরো বলেন, কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন মুসলমান হতে পারে না, যতক্ষণ না এঁদের মত বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্যে ধারণ করে।
হযরত আবু বকর (রা.)’র খিলাফত নিয়ে শিয়াদের বক্রোক্তি এবং বিভিন্ন প্রশ্নের দাঁতভাঙা জবাব মসীহ্ মওউদ (আ.) দিয়েছেন। একস্থানে এরূপ কিছু প্রমাণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, পবিত্র কুরআনে যে খিলাফতের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্ তা’লা মু’মিনদেরকে প্রদান করেছেন, তার যাবতীয় লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য একমাত্র হযরত আবু বকর (রা.)’র খিলাফতেই পরিলক্ষিত হয়। হযরত আবু বকর (রা.)’র মাধ্যমে কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ যখন সমতল-সুমসৃণ পথে পরিণত হয়েছে, তার পরে হযরত উমর (রা.) ও পরবর্তী খলীফাদের যুগে ইসলামের অভূতপূর্ব উন্নতি সম্ভব হয়েছে। হযরত আবু বকর (রা.) ইসলামকে এমন এক পতনোন্মুখ দেয়ালের অবস্থায় পেয়েছেন, আর এরপর তিনি একে লোহার মতো সুদৃঢ় দেয়ালে পরিণত করেছেন।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও সৃষ্টিকূল শিরোমণি মহানবী (সা.)-এর সাথে হযরত আবু বকর (রা.)’র এক আদি সাদৃশ্য ছিল, যার কারণে তিনি তাঁর (সা.) কল্যাণধারা থেকে অতি অল্প সময়ে এমন কিছু লাভ করেছিলেন যা অন্যরা এক সুদীর্ঘকাল এবং সুদূর পথ অতিক্রম করেও লাভ করতে পারে নি। বস্তুত হযরত আবু বকর (রা.) মহানবী (সা.)-এর প্রতিবিম্ব ও ছায়া সদৃশ ছিলেন; মহানবী (সা.)-এর সমস্ত নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী তিনি নিজের মধ্যে ধারণ করতেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে এমন এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল যে, তরবারি এবং বর্শার আক্রমণেও তাঁদের মাঝে কেউ ফাঁটল সৃষ্টি করতে পারে নি।
হুযূর (আই.) খুতবার শেষদিকে এই ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের ইতি টেনে বলেন, ইনি হলেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) যিনি আল্লাহ্ এবং মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসায় নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন। এরই মাধ্যমে বদরী সাহাবীদের স্মৃতিচারণের ধারা শেষ হলো। এরপর হুযূর (আই.) বলেন, প্রথমদিকে কতক সাহাবীর যে স্মৃতিচারণ করা হয়েছিল, তাঁদের সম্পর্কে কিছু বিবরণ পরে এসেছে; সুযোগ পেলে আগামীতে কখনো তা বর্ণনা করা হবে, অথবা যখন বদরী সাহাবীদের জীবনী প্রকাশ করা হবে তখন সেসব বিবরণ যুক্ত করে দেয়া হবে। হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এসব সাহাবীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে জীবন যাপনের তৌফিক দান করুন; জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁরা আমাদের পথপ্রদর্শক হোন, আর যে মানদণ্ড তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করেছেন আমরাও যেন সেই মানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হই। (আমীন)