শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ: হযরত আবু বকর (রা.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১১-নভেম্বর, ২০২২

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১১ই নভেম্বর, ২০২২ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সাম্প্রতিক ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত আবু বকর (রা.)’র ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের ধারা অব্যাহত রাখেন রাখেন।
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র স্মৃতিচারণ হচ্ছিল। তাঁর সম্পর্কে এ-ও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি আরবদের বংশবৃক্ষের ইতিহাস সংক্রান্ত বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন এবং কাব্যচর্চার প্রতিও গভীর আগ্রহ রাখতেন। বর্ণিত আছে, সব মানুষের মধ্যে তিনি আরবদের বংশীয় ইতিহাস সবচেয়ে বেশি জানতেন। এই বিদ্যার একজন সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ছিলেন জুবায়ের বিন মুত’ইম; তিনি স্বয়ং বলেন, এই বিদ্যা তিনি হযরত আবু বকর (রা.)’র কাছ থেকে শিখেছেন; কুরাইশদের বংশীয় ইতিহাস এবং বৈশিষ্ট্যের ভালো ও মন্দ দিকগুলো সম্বন্ধে হযরত আবু বকর (রা.) বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তবে, হযরত আবু বকর (রা.)’র একটি অসাধারণ গুণ ছিল; তিনি কখনো কারো বংশের নেতিবাচক বিষয়ের উল্লেখ করতেন না। এজন্য কুরাইশদের কাছে হযরত আকীল বিন আবু তালেবের চেয়ে আবু বকর (রা.) বেশি গ্রহণযোগ্য ছিলেন। এই বিদ্যায় পারদর্শীতার ক্ষেত্রে হযরত আবু বকর (রা.)’র পরেই অবস্থান ছিল আকীলের; তিনি মসজিদে নববীতে আবু বকর (রা.)’র কাছ থেকে পাঠ নিতেন। কুরাইশরা যখন কাব্যের মাধ্যমে নবীজী (সা.)-এর কুৎসা রটনা করে তখন তিনি (সা.) হযরত হাসসান বিন সাবেতকে এর পাল্টা উত্তর দিতে নির্দেশ দেন এবং আবু বকর (রা.)’র কাছ থেকে তাকে সহায়তা নিতে বলেন। বস্তুত যখন হাসসান (রা.) রচিত পঙক্তি মক্কায় পৌঁছতো তখন তারা বলতো, নিশ্চয়ই এতে আবু বকর (রা.)’র সহায়তা রয়েছে।
হযরত আবু বকর (রা.) যদিও নিয়মিত কবিতা রচনা করতেন না, কিন্তু অত্যন্ত কাব্যানুরাগী ছিলেন। জীবনীকারকদের মাঝে তাঁর কাব্যচর্চা বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে; কারো কারো মতে তিনি পঙক্তি রচনা করেন নি, আবার কারো মতে তিনি কিছু পঙক্তি রচনা করেছেন। তুরস্কে হযরত আবু বকর (রা.) রচিত ২৫টি কাসীদা সম্বলিত একটি বই পাওয়া গিয়েছে; জনৈক লেখক সাক্ষ্যও প্রদান করেছেন যে, তাকে ইলহামের মাধ্যমে জানানো হয়েছে- এটি হযরত আবু বকর (রা.) কর্তৃক রচিত। তাবাকাত ইবনে সা’দ এবং সীরাত ইবনে হিশাম অনুসারে হযরত আবু বকর (রা.) কিছু পঙক্তি রচনা করেছিলেন। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুতে হযরত আবু বকর (রা.) যেসব পঙক্তি রচনা করেছিলেন সেই মর্মস্পর্শী পঙক্তিগুলোর অনুবাদ হুযূর (আই.) খুতবায় তুলে ধরেন।
হযরত আবু বকর (রা.) গভীর প্রজ্ঞা ও ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন। মহানবী (সা.) একবার সাহাবীদের বলেন, আল্লাহ্ তা’লা তাঁর জনৈক বান্দাকে পৃথিবী অথবা আল্লাহ্‌র কাছে যা আছে- এই দু’টোর মধ্য থেকে একটি বেছে নেয়ার সুযোগ দেন; সেই বান্দা আল্লাহ্‌র কাছে যা আছে সেটি বেছে নেন। একথা শুনে হযরত আবু বকর (রা.) ডুকরে কেঁদে ওঠেন। সাহাবীরা আশ্চর্য হন, আল্লাহ্‌র এক বান্দা আল্লাহ্‌র কাছে যাওয়াকে বেছে নিয়েছে- এতে কাঁদার কী আছে? কিন্তু মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর সবাই বুঝতে পারেন, সেই বান্দা ছিলেন স্বয়ং মহানবী (সা.); হযরত আবু বকর (রা.) সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন বিধায় তিনি তখনই এটি বুঝতে পেরেছিলেন। মহানবী (সা.) তখন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, কেঁদো না, আবু বকর! নিশ্চয়ই মানুষের মাঝে আমার সাথে সবচেয়ে বেশি সদাচরণকারী এবং নিজ সাহচর্য ও সম্পদ দিয়ে সাহায্যকারী হলো আবু বকর। যদি আমি উম্মতের মাঝে কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম তবে সে হতো আবু বকর; আবু বকরের দরজা ছাড়া মসজিদের সবগুলো দরজা বন্ধ করে দেয়া হোক।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, হযরত আবু বকর (রা.) কুরআনের গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। যখন সূরা মায়েদার ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِى আয়াতটি অবতীর্ণ হয়, তখন আবু বকর (রা.) কেঁদে ফেলেন। কেউ একজন জিজ্ঞেস করে, এই বৃদ্ধ কাঁদছে কেন? তখন তিনি বলেন, এই আয়াতের মাঝে আমি মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছি! তিনি (আ.) বলেন, নবীগণ আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে প্রেরিত শাসকস্বরূপ হয়ে থাকেন; যেভাবে কোনস্থানে নিযুক্ত শাসক সেখানে তার দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে যায়, তেমনিভাবে নবীগণও যখন পৃথিবীতে তাঁদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব সম্পাদন করেন তখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। এজন্যই যখন ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করলাম’ বাণী অবতীর্ণ হয়, সাথে সাথে আবু বকর (রা.) বুঝে ফেলেন- এখন মহানবী (সা.)-এর বিদায়ক্ষণ সন্নিকট। এটি প্রমাণ করে যে, হযরত আবু বকর (রা.)’র জ্ঞান ও ধীশক্তি অনেক বেশি ছিল। তিনি (আ.) ‘মসজিদে আবু বকরের জানালা কেবল খোলা থাকবে’ সংক্রান্ত হাদীসের ব্যাখ্যা প্রদান করে বলেন, মসজিদ যেহেতু ঐশী রহস্যাবলীর বিকাশস্থল হয়ে থাকে, তাই তা কুরআনের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস; আবু বকর (রা.)’র দিকের মসজিদের জানালা খোলা থাকার অর্থ হলো- আল্লাহ্ তা’লা ঐশী রহস্যাবলী তাঁর কাছে প্রকাশ করতে থাকবেন, সেইসাথে আবু বকর (রা.)’র হৃদয়ের জানালা যেহেতু এদিকে, তাই এর জানালাও তাঁর জন্য খোলা থাকবে। অন্যান্য সাহাবীদেরও এই জ্ঞান ছিল, তবে আবু বকর (রা.)’র জ্ঞান ছিল সবচেয়ে বেশি। এ প্রসঙ্গে মসীহ্ মওউদ (আ.) মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আবু বকর (রা.) কর্তৃক সূরা আলে ইমরানের ১৪৫নং আয়াত- নবীজী (সা.)-এর মৃত্যুর প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপনের বিষয়টিও তুলে ধরেন এবং বলেন, এই আয়াত সম্পূর্ণ পড়ার উদ্দেশ্য এটিই ছিল যেন মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর একটি সুস্পষ্ট এবং অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়; এরপরও ঈসা (আ.) জীবিত আছেন- একথা বলা নিতান্তই মূর্খতা বৈ আর কিছু নয়।
হযরত আবু বকর (রা.) স্বপ্নের তা’বীর বা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সুদক্ষ ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর (সা.) উপস্থিতিতেও তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান করতেন। ইমাম মুহাম্মদ বিন সীরীন বলেন, মহানবী (সা.)-এর পর স্বপ্নের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন। মহানবী (সা.) একবার আবু বকর (রা.)-কে বলেন, আমি স্বপ্নে দেখি, আমি ও তুমি যেন একই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছি, এরপর আমি তোমার চেয়ে আড়াই সিঁড়ি এগিয়ে গেলাম। এটি শুনে আবু বকর (রা.) বলেন, খুবই ভালো স্বপ্ন, হে আল্লাহ্‌র রসূল (সা.)! আল্লাহ্ আপনাকে ততদিন জীবিত রাখবেন যেন আপনি স্বচক্ষে তা দেখে নেন যা আপনাকে আনন্দিত করে এবং আপনার চোখের স্নিগ্ধতার কারণ হয়। আর আল্লাহ্ আপনাকে নিজ সন্নিধানে নিয়ে যাবার পর আমি আরো আড়াই বছর বেঁচে থাকব। বস্তুতঃ এরূপই হয়েছিল। মহানবী (সা.)-এর পবিত্র সহধর্মিনী হযরত আয়েশা (রা.) স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, তাঁর কামরায় তিনটি চাঁদ খসে পড়েছে। মহানবী (সা.) মৃত্যুর পর তার কামরায় সমাহিত হলে হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর কন্যাকে বলেন, এটি সেই প্রথম চাঁদ যা তুমি স্বপ্নে দেখেছিলে। নবীজী (সা.) একবার স্বপ্নে দেখেন, একপাল কালো ছাগল তাঁকে অনুসরণ করছে, সেগুলোর পেছনে ছাই রংয়ের ছাগলের পালও রয়েছে। এটি শুনে আবু বকর (রা.) বলেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল (সা.)! আরবরা আপনাকে অনুসরণ করবে, আর অনারব জাতিগুলো তাদেরকে অনুসরণ করবে। মহানবী (সা.) তখন বলেন, ফিরিশ্তারাও এই স্বপ্নের এরূপ ব্যাখ্যাই করেছে।
ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ কে ছিলেন- তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারো কারো মতে হযরত আবু বকর (রা.) প্রথম ছিলেন, কারো মতে হযরত আলী আবার কারো মতে হযরত যায়েদ বিন হারসা (রা.) ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ ছিলেন। কামরুল আম্বিয়া হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.) এ বিতর্কের খুব সুন্দর সমাধান দিয়েছেন। তিনি বলেন, এটি একটি অযথা বিতর্ক; হযরত আলী ও যায়েদ (রা.) মহানবী (সা.)-এর বাড়ির সদস্য ছিলেন এবং তাঁর (সা.) সন্তানতুল্য ছিলেন। তাঁর (সা.) দাবি করার সাথে সাথেই তারা মেনে নেবেন- এটাই স্বাভাবিক; তাদের কোন মৌখিক স্বীকারোক্তিরও প্রয়োজন পড়ে না। বাকি পুরুষদের মধ্যে হযরত আবু বকর (রা.)ই প্রথম মুসলমান ছিলেন- এটি সর্বজনস্বীকৃত। একবার হযরত আবু বকর ও উমর (রা.)’র মধ্যে কোন একটি বিষয়ে বিতর্ক হলে বিষয়টি জানার পর মহানবী (সা.) যে মন্তব্য করেন, তাত্থেকেও প্রমাণ হয় যে, আবু বকর (রা.)ই প্রথম মুসলমান পুরুষ ছিলেন।
হযরত আবু বকর (রা.) দাসমুক্তির ক্ষেত্রেও অত্যন্ত অগ্রগামী ছিলেন। হযরত উমর (রা.) বলতেন, আবু বকর (রা.) আমাদের নেতা, আর তিনি আমাদের নেতা বেলালকে মুক্ত করেছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.) ইসলামের প্রাথমিক যুগেই ৭জন মুসলমানকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন, যাদের ওপর কাফিররা চরম নির্যাতন-নিপীড়ন চালাত; তারা হলেন হযরত বেলাল, আমের বিন ফুহায়রা, যিন্নিরা, নাহদিয়া এবং তার মেয়ে, বনু মুয়াম্মালের একজন ক্রীতদাসী ও উম্মে উমায়েস (রা.)।
হযরত আবু বকর (রা.)’র একটি বিশেষ সৌভাগ্য হলো, তিনি মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় মসজিদে নববীতে ইমামতি করেছেন, বিশেষত মহানবী (সা.)-এর অন্তিম অসুস্থতার সময় তাঁকেই মহানবী (সা.) ইমামতি করার দায়িত্ব প্রদান করেন এবং প্রস্তাবিত অন্যান্য নাম প্রত্যাখ্যান করেন। হযরত আবু বকর (রা.) নিজের সন্তানদেরও অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাঁর বড় ছেলে হযরত আব্দুর রহমান পৃথক বাড়িতে থাকলেও তার সংসারের খরচ আবু বকর (রা.)ই বহন করতেন। বড় মেয়ে হযরত আসমা (রা.) হযরত যুবায়ের বিন আওয়ামের স্ত্রী ছিলেন; প্রথমদিকে তারা অস্বচ্ছল ছিলেন বিধায় তাদের বাড়িতে কোন দাস-দাসী ছিল না। মেয়েকে বাড়ির সব কাজ করতে হয় দেখে আবু বকর (রা.) তাদের জন্য একজন দাসের ব্যবস্থা করেন। স্ত্রীর কারণে আব্দুল্লাহ্ বিন আবু বকর জিহাদে না যাওয়ায় তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে ছেলেকে নির্দেশ দেন, স্ত্রীকে তালাক দাও। ছেলে পিতার আদেশ পালন করলেও স্ত্রীর বিরহে করুণ পঙক্তি আওড়াতেন; এটি জেনে আবু বকর (রা.) তাকে- স্ত্রী ফিরিয়ে নেয়ার অনুমতি দেন। একবার হযরত আয়েশা (রা.)’র জ্বরের সময় আবু বকর (রা.) তাকে দেখতে যান এবং পরম স্নেহে তার কপালে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘মা আমার! কেমন আছ?’ হুযূর (আই.) বলেন, এই স্মৃতিচারণের ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ্।