মসজিদ নির্মাণে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৭-অক্টোবর, ২০২২

বায়তুল ইকরাম মসজিদ, অ্যালেন, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৭ই অক্টোবর, ২০২২ইং আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অ্যালেন শহরে অবস্থিত বায়তুল ইকরাম মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি আমাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) সূরা আ’রাফের ৩০-৩২ নাম্বার আয়াত পাঠ করেন,

قُلْ أَمَرَ رَبِّي بِالْقِسْطِ وَأَقِيمُوا وُجُوهَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ كَمَا بَدَأَكُمْ تَعُودُونَ * فَرِيقًا هَدَى وَفَرِيقًا حَقَّ عَلَيْهِمُ الضَّلَالَةُ إِنَّهُمُ اتَّخَذُوا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ مُهْتَدُونَ * يَا بَنِي آَدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ

যার অনুবাদ হলো, “তুমি বলো, ‘আমার প্রভু-প্রতিপালক ন্যায়বিচারের আদেশ দিয়েছেন, এবং এই আদেশও দিয়েছেন যে, তোমরা প্রত্যেক মসজিদে নিজেদের মনোযোগ আল্লাহ্‌র প্রতি নিবদ্ধ রাখো এবং ধর্মকে তাঁর জন্য বিশুদ্ধ করে কেবল তাঁকেই ডাক। যেভাবে তিনি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন সেভাবেই তোমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। একদলকে তিনি হিদায়াত দিয়েছেন, কিন্তু আরেকদলের জন্য পথভ্রষ্টতা অবধারিত হয়ে গিয়েছে; নিশ্চয় তারা আল্লাহ্‌কে বাদ দিয়ে শয়তানদের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে এবং তারা মনে করে, তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত। হে আদম সন্তানগণ! তোমরা প্রত্যেক মসজিদে উপস্থিতির সময় নিজেদের সৌন্দর্য অবলম্বন করো (অর্থাৎ, তাকওয়ার পোশাক সাথে নিয়ে যেও) এবং পানাহার করো, কিন্তু বাড়াবাড়ি করো না; নিশ্চয় তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।”

এরপর হুযূর (আই.) বলেন, আজ আল্লাহ্ তা’লা আপনাদেরকে নিজেদের মসজিদ উদ্বোধন করার তৌফিক দান করছেন; যদিও এর নির্মাণকাজ কিছুদিন পূর্বেই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আজ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হচ্ছে। প্রথমে এখানে মসজিদ হিসেবে একটি হলরুম বানানো হয়েছিল, এখন যথারীতি মসজিদ নির্মিত হয়েছে এবং খুব সুন্দর মসজিদ নির্মিত হয়েছে যা ধারণক্ষমতার দিক দিয়েও বেশ প্রশস্ত। হুযূর (আই.) দোয়া করেন, যারা এই মসজিদ নির্মাণে অংশগ্রহণ করেছেন, আল্লাহ্ তা’লা তাদের সবাইকে মসজিদের যে প্রাপ্য অধিকার রয়েছে তা প্রদানের তৌফিক দান করুন আর এই মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্য যেন শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনই হয়। কারণ মহানবী (সা.) বলেছেন, যে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহ্ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ গৃহ নির্মাণ করেন। আর আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্মিত মসজিদের দায়িত্ব তা নির্মাণের সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় না, বরং আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি মানুষ তখনই অর্জন করতে পারে যখন তাঁর নির্দেশাবলী পালন করে, তাঁর ইবাদতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, হুকুকুল ইবাদ তথা সৃষ্টজীবের প্রাপ্য অধিকার যথাযথভাবে প্রদান করে, নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে ধর্মকে জাগতিকতার ওপর অগ্রাধিকার প্রদান করে আর নিজের বয়’আতের অঙ্গীকার যথাযথভাবে পালন করে।
হুযূর (আই.) বলেন, আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে; আমরা যুগের ইমাম এবং মহানবী (সা.)-এর নিষ্ঠাবান দাস হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মেনেছি; কিন্তু শুধু মেনেছি বলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় নি, বরং অনেক বড় দায়িত্ব আমাদের স্কন্ধে অর্পিত হয়েছে। মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে প্রদত্ত আল্লাহ্ তা’লার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পুরস্কাররাজি লাভের যোগ্য আমরা তখনই হতে পারব যখন আমরা বয়’আত পরবর্তী দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো সুচারূরুপে পালন করবো। মসজিদ আবাদ রাখা তথা নামাযী দিয়ে পূর্ণ রাখা আমাদের দায়িত্ব, পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতর সাথে বসবাস করা, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণীকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া, ইসলামের অনিন্দ্য-সুন্দর শিক্ষা জগতের সামনে উপস্থাপন করা, অবিরত দোয়ার মাধ্যমে নিজেদের এবং সন্তানদের সংশোধনের প্রতি মনোযোগী হওয়া- এ সবই আমাদের দায়িত্ব।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেছেন, ‘কোথাও ইসলামকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলে সেখানে মসজিদ বানিয়ে দাও’; এখানে যেহেতু মসজিদ নির্মিত হয়েছে তাই ইসলামের পরিচয় সবাই জানবে এবং তবলীগের পথও উন্মুক্ত হবে। কিন্তু ইসলামের শিক্ষার ব্যবহারিক আদর্শ তুলে ধরা, বিশেষত প্রতিবেশিদের অধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে যেন তারা তাদের এবং আহমদীদের মাঝে এক সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখতে পায় যে; এরূপ জাগতিক চাকচিক্যের মাঝে থেকেও আহমদীরা ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দেয়, আপন স্রষ্টার সাথে নিবিড় সম্পর্ক রাখে এবং সৃষ্টজীবের প্রতিও তারা সহমর্মী। এমনটি হতে দেখলে আমাদের বিষয়ে মানুষের মাঝে কৌতূহল সৃষ্টি হবে যা আমাদের জন্য তবলীগের পথ আরও সুগম করবে।
হুযূর আনোয়ার (আই.) খুতবার শুরুতে পঠিত আয়াতগুলোর আলোকে মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব-কর্তব্য তুলে ধরেন। এতে বর্ণিত প্রথম নির্দেশ হুকুকুল ইবাদ বা সৃষ্টজীবের প্রাপ্য অধিকার প্রদান, যার প্রথম পদক্ষেপ হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা; পবিত্র কুরআনে অন্যত্র আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন, শত্রুর প্রতিও ন্যায়বিচার করতে হবে। যারা এই শিক্ষা পালন করে, তারা অন্যের কোন ক্ষতি করা তো দূরে থাক, কারো বিষয়ে কুধারণাও করতে পারে না। জানা কথা, যদি শত্রুর সাথেও আল্লাহ্ এতটা সদাচরণ করার নির্দেশ দেন, তবে আপন লোকদের প্রতি কতটা সদয় ও নম্র হওয়া প্রয়োজন! কেউ যদি নিজ বাড়িতে স্ত্রীর সাথে সদ্ব্যবহার না করে, সবসময় তাকে খোঁটা দিতে থাকে, সন্তানরাও সবসময় তার ভয়ে তটস্থ থাকে আর কার্যত তার কারণেই সন্তানরা ধর্ম থেকে দূরে সরে যায়, তবে এমন দ্বিমুখী আচরণসম্পন্ন মানুষের মাধ্যমে জামাতের কোন কাজ হওয়াও সম্ভব না বা তার ইবাদত কবুল হওয়াও অসম্ভব। প্রকৃত মু’মিন কথা ও কাজে এবং ভেতর ও বাইরে অভিন্ন হয়ে থাকে। নিছক মসজিদ নির্মাণ এবং দায়সারাভাবে নামায আদায় করা খোদার দৃষ্টিতে কোন মূল্যই রাখে না। কারো এই গর্ব করা উচিত না যে, ‘আমি খুব নামায পড়ি, পাঁচবেলা মসজিদে আসি, জামাতের কাজ করি’ ইত্যাদি ইত্যাদি; যে বান্দার প্রাপ্য অধিকার প্রদান করে না সে কখনো খোদার প্রাপ্যও প্রদান করতে না।
হুযূর (আই.) বলেন, বর্তমান যুগের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তওবা এবং এস্তেগফারের প্রতি অনেক বেশি মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে, কেবল তবেই সাফল্য লাভ করা সম্ভব। মুসলমানরা যখন লোকদেখানো ন্যায়বিচার এবং ইবাদত করতে শুরু করে তখন থেকেই তাদের পতন আরম্ভ হয়। পাকিস্তানে তো আহমদীদের মসজিদ ভাঙাকেই তারা মহাপুণ্য মনে করে। বর্তমান যুগের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে মহানবী (সা.) পূর্বেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন; যেমনটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, এমন এক যুগ আসবে যখন ইসলামের শুধু নাম অবশিষ্ট থাকবে, কুরআনের শুধুমাত্র অক্ষর থাকবে, তাদের মসজিদগুলো সুদৃশ্য হলেও তা হিদায়াতশূন্য হবে আর তাদের আলেমগণ আকাশের নিচে নিকৃষ্টতম জীব হবে, আজ আমরা হুবহু এই চিত্রই দেখতে পাচ্ছি। তবে মহানবী (সা.) অন্ধকারের পর আলোর সুসংবাদও দিয়ে গিয়েছেন যা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আগমনের মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে, যাঁর হাতে আমরা বয়’আত করেছি এবং ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দেবার অঙ্গীকার করেছি। তাই আমাদের অ-আহমদীদের মত হলে চলবে না, বরং ইসলামের হৃত সম্মান এবং মর্যাদা আমাদেরকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর যুগের মুসলমানদের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘মুখলিসীনা লাহুদ্দীন’ আয়াতে উল্লিখিত নিষ্ঠা জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়েছে, আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বস্ততা, ভালোবাসা ও আস্থা শূন্যপ্রায়; এখন আল্লাহ্ এসব গুণ পুনর্জীবিত করতে চান। তাঁর (আ.) হাতে বয়’আত করার ফলে আজ আমাদের স্কন্ধে এই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে (আ.) যেসব দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা অবশ্যই পূর্ণ হবে; কিন্তু আমরা এগিয়ে না এলে অন্য কেউ এসে তা করবে আর আমরা থেকে যাব বঞ্চিত। তাই আমাদেরকে নিজেদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে এবং যেখানে ত্রুটি ও দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। পুণ্য করার সামর্থ্যও মূলত আল্লাহ্ই দান করেন; তাই আমরা যদি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র কৃপালাভের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা না করি, তবে আমাদের চেষ্টা বৃথা, কিংবা এসব বিষয় অর্জনের আকাঙ্ক্ষা নিরর্থক। আল্লাহ্ তো এত দয়ালু যে, আমাদের অজস্র ভুল সত্ত্বেও কৃপা করে যান। তাই যারা সামান্য দোয়া করেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে আর বলে বসে, ‘আল্লাহ্ আমাদের দোয়া শোনেন না’- তাদের চিন্তা করা উচিত, তারা কতটা আল্লাহ্‌র প্রাপ্য অধিকার প্রদান করে? দিনে কতটা সময় একান্তই আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে তাঁর ইবাদত করে? মানুষের সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য তথা আল্লাহ্‌র ইবাদত কি মাত্র কয়েক মিনিটে নামায পড়ে, অনেক সময় কিছু না বুঝে মন্ত্র আওড়ানোর মত নামায পড়ে নেয়ার মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে? কখনোই না!
সূরা আ’রাফের আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তা’লা তাকওয়ার পোশাকের প্রতি ইঙ্গিত করার মাধ্যমে নামাযে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন, আর বাহ্যিকতার প্রভাব যেহেতু হৃদয়ের ওপরও পড়ে, সেজন্য বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতার প্রতিও নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর আল্লাহ্ তা’লা পানাহারের ক্ষেত্রে অপব্যয় বা সীমালঙ্ঘন করতে বারণ করেছেন। একথার একটি আত্মিক তাৎপর্যও রয়েছে; তা হলো- কেবল পানাহার, শয়ন ইত্যাদিকেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য মনে করো না। একজন খাঁটি বান্দা জাগতিক কাজকর্ম করলেও তাতে নিমগ্ন হয়ে আল্লাহ্‌কে ভুলে যায় না, বরং সর্বদা আল্লাহ্‌র স্মরণ তার হৃদয়ে জাগরুক থাকে। মহানবী (সা.) যেমনটি বলেছেন, মু’মিন এক নামায শেষে পরবর্তী নামাযের অপেক্ষায় থাকে- এই মানে আমাদের উপনীত হতে হবে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, মসজিদের আসল সৌন্দর্য এর অট্টালিকার মধ্যে নয়, বরং এর প্রকৃত সৌন্দর্য সেসব মুসল্লীর মাধ্যমে হয় যারা নিষ্ঠার সাথে নামায পড়েন। হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা সবাইকে তৌফিক দান করুন তারা যেন নিষ্ঠার সাথে নামায আদায়কারী হন এবং এই মসজিদ আবাদকারী হন; আল্লাহ্ তা’লা আমাদের দোয়া এবং সকল ইবাদত কবুল করুন। (আমীন)