শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ: হযরত আবু বকর (রা.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৬-সেপ্টেম্বর, ২০২২

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সাম্প্রতিক ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত আবু বকর (রা.)’র ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের ধারা অব্যাহত রাখেন রাখেন।
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র যুগে যিম্মিদের অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করেন। ইসলামের পরিভাষায় যিম্মি তাদেরকে বলা হয়, যারা ইসলামী রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করে এর অধীনে স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং ইসলামী রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়। যেহেতু মুসলমানদের মত তাদেরকে যুদ্ধেও যেতে হতো না বা যাকাতও দিতে হতো না, এজন্য একটি নামমাত্র ট্যাক্স তাদের দিতে হতো যাকে জিযিয়া বা কর বলা হয়। মাথাপিছু বার্ষিক ৪ দিরহাম ছিল এর পরিমাণ, আর তা-ও প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ এবং কর্মক্ষমদের প্রতি আরোপ হতো; বৃদ্ধ, শিশু, প্রতিবন্ধী ও অক্ষমরা এর আওতামুক্ত ছিল, উল্টো তাদেরকে বায়তুল মাল থেকে সাহায্য প্রদান করা হতো। ইরাক এবং সিরিয়া বিজয়কালে অনেক গোত্র জিযিয়া বা কর প্রদানের শর্তে মুসলমানদের সাথে সন্ধিচুক্তি করে, তাদের সাথে কৃত চুক্তিপত্রে এতটা ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয় যে, তাদের গির্জা ইত্যাদি অক্ষত রাখা, গির্জার ঘন্টা বাজানো, এমনকি বিশেষ উৎসবের সময় ক্রুশ নিয়ে মিছিল করার অনুমতিও প্রদান করা হয়। হীরাবাসীদের সাথে খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা.)’র কৃত চুক্তিতে এই শর্তও অন্তর্ভুক্ত ছিল যে, বার্ধক্যে উপনীত বা বিপদগ্রস্ত হয়ে কেউ যদি আর উপার্জনক্ষম না থাকে, তবে তার এবং তার পরিবারের ভরণ-পোষণও ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকবে। এসব বিষয় থেকে ইসলামের উদারপন্থা, মানবতা এবং মাহাত্ম্য সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।
ইসলামের সেবায় হযরত আবু বকর (রা.)’র আরেকটি অসামান্য অবদান ছিল কুরআন সংকলন করে একক গ্রন্থাকারে সুরক্ষিত করা। ইয়ামামার যুদ্ধে যখন ১২শ’ মুসলমান নিহত হন যাদের মধ্যে অনেক সাহাবী এবং কুরআনের হাফেযও ছিলেন, এক বর্ণনামতে ৭শ’ কুরআনের হাফেয উক্ত যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন, তখন হযরত উমর (রা.) গিয়ে হযরত আবু বকর (রা.)-কে পুরো কুরআন একটি গ্রন্থাকারে সংকলন করার সুপরামর্শ প্রদান করেন। আবু বকর (রা.) প্রথমে উমর (রা.)-কে বলেন, মহানবী (সা.) যে কাজ করেন নি, সেটি করা কি ঠিক হবে? উমর (রা.) আল্লাহ্‌র নামে শপথ করে বলেন, এই কাজে মঙ্গল নিহিত আছে। অতঃপর আল্লাহ্ তা’লা আবু বকর (রা.)’র হৃদয়েও বিষয়টির গুরুত্ব প্রোথিত করে দেন; তিনি একমত হন এবং হযরত যায়েদ বিন সাবেত (রা.)’র স্কন্ধে এই গুরু-দায়িত্ব অর্পণ করেন। যায়েদ (রা.) বলেন, তিনি যদি আমাকে পাহাড় উঠিয়ে অন্যস্থানে নিয়ে রাখার নির্দেশ দিতেন, তবে সেটিও এই দায়িত্বের চেয়ে আমার জন্য সহজ হতো। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা তাকে এই অসাধ্য সাধনের সাহস এবং সামর্থ্য দান করেন। অতঃপর তিনি সন্ধান করতে আরম্ভ করেন এবং খেজুরপাতা, পাথর ও মানুষের মুখস্ত করা থেকে কুরআন সংকলন করে তা একটি গ্রন্থাকারে সংকলন করতে থাকেন। উল্লেখ্য, জিব্রাইল (আ.) যখনই কুরআনের কোন অংশ নিয়ে অবতীর্ণ হতেন, তখনই বলে দিতেন- এটি অমুক সূরার অমুক আয়াতের পর বসবে; মহানবী (সা.)-ও সাহাবীদের তা জানিয়ে দিতেন এবং সেই ক্রমবিন্যাসেই কুরআন বিন্যস্ত ছিল এবং আজও হুবহু সেভাবেই রয়েছে। বস্তুতঃ মহানবী (সা.) স্বয়ং পুরো কুরআন লিপিবদ্ধ করিয়ে গিয়েছিলেন; আবু বকর (রা.) সেটিকে গ্রন্থের আকৃতি দান করেন। গ্রন্থাকারে সংকলিত এই কুরআন প্রথমে হযরত আবু বকর (রা.)’র কাছে, তাঁর মৃত্যুর পর হযরত উমর (রা.)’র কাছে এবং তাঁর মৃত্যু হলে উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা (রা.)’র কাছে সংরক্ষিত থাকে। হযরত আলী (রা.) হযরত আবু বকর (রা.)’র জন্য আন্তরিক দোয়া করে বলতেন, তিনিই সর্বপ্রথম কুরআনকে গ্রন্থাকারে সংকলিত করেছিলেন। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর (আই.) কুরআনের অটুট-অবিকৃত থাকার পক্ষে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) কর্তৃক উত্থাপিত অকাট্য যুক্তি-প্রমাণও উদ্ধৃত করেন। সেই সাথে হযরত উসমান (রা.)’র খিলাফতকালে কীভাবে পবিত্র কুরআনের অভিন্ন ক্বিরাআত বা পঠনের প্রচলন করা হয়, সেই ইতিহাসও হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)’র বরাতে হুযূর তুলে ধরেন। পূর্বে আরবের একেক গোত্র একেক ক্বিরাআতে কুরআন পাঠ করত; অর্থাৎ একই শব্দ কেউ যবর, কেউ যের আবার কেউ পেশ দিয়ে পড়তো। ফলে অনারব এবং অমুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশংকা ছিল যে, কুরআনের মাঝে ভিন্নতা রয়েছে। প্রথম যুগে এটি অনুমোদিত ছিল, কিন্তু হযরত উসমান (রা.)’র যুগ পর্যন্ত সমগ্র আরব মক্কার ভাষার সাথে পরিচিত এবং অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল বিধায় তিনি মক্কায় প্রচলিত আরবীতে লিপিবদ্ধ কুরআনের মূল কপি থেকে বেশ কিছু কপি করিয়ে প্রত্যেক প্রদেশে প্রেরণ করেন এবং অন্যান্য গোত্রীয় উপভাষায় কুরআন পাঠ নিষিদ্ধ করেন। ইউরোপীয়ান লেখকদের এই আপত্তি যে, ‘উসমান নতুন এক কুরআন প্রবর্তন করেছেন’- এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটি কথা এবং প্রকৃত ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)ও কুরআনের সুনিশ্চিত এবং অবিকৃত থাকার বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। হযরত আবু বকর (রা.) কর্তৃক সংকলিত কুরআনের প্রথম কপিটি হযরত হাফসা (রা.)’র মৃত্যুর পর মদীনার তৎকালীন গভর্নর মারওয়ান ছিনিয়ে নেয় এবং নষ্ট করে ফেলে।
হযরত আবু বকর (রা.) কোন্ কোন্ বিষয়ে সর্বপ্রথম বা অগ্রগামী ছিলেন- এরূপ একটি তালিকা হুযূর (আই.) তুলে ধরেন। তিনি (রা.) ইসলামগ্রহণ, মক্কায় নিজ বাড়িতে মসজিদ স্থাপন, মহানবী (সা.)-এর পক্ষে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করা, মুসলিম ক্রীতদাস-দাসীদের কিনে নিয়ে মুক্ত করা, পবিত্র কুরআনকে গ্রন্থ হিসেবে রূপ দেয়া, কুরআনকে মাসহাফ নামে অভিহিত করা, খলীফায়ে রাশেদ হিসেবে অভিহিত হওয়া, মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় হজ্জের আমীর নিযুক্ত হওয়া এবং নামাযের ইমাম নিযুক্ত হওয়া, বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা, মুসলমানদের দ্বারা খলীফার জন্য ভাতা নির্ধারিত হওয়া, পরবর্তী খলীফা মনোনীত করা, এমন খলীফা যাঁর অন্যদের বয়’আত নেয়ার সময় তাঁর পিতা জীবিত ছিলেন, নবীজী (সা.) কর্তৃক ইসলামী উপাধিপাপ্তি, একই ব্যক্তি যার চার পুরুষ সাহাবী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন- এই ১৫টি বিষয়ে তিনি (রা.) সর্বপ্রথম ছিলেন। হযরত আয়েশা (রা.)’র বর্ণনা থেকে হযরত আবু বকর (রা.)’র চেহারা সম্পর্কে জানা যায়, তিনি ফর্সা এবং হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ ছিলেন। তাঁর কটিদেশ কিছুটা ঝুঁকে থাকতো; গালে তেমন মাংস ছিল না, চোখ কিছুটা কোটরে বসা ছিল।
হযরত আবু বকর (রা.)’র তাকওয়া এবং জগদ্বিমুখতা সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। একবার তিনি গাছে বসা একটি পাখিকে দেখে বলেছিলেন, হায়, “আমিও যদি তোমার মতো হতাম! তুমি গাছে বসো, ফল খাও এবং উড়ে চলে যাও; তোমাকে কোন হিসাব দিতে হবে না বা শাস্তিও পেতে হবে না। আল্লাহ্‌র শপথ! আমার মন চায়- আমি (যদি) পথের পাশের এক গাছ হতাম, যার পাতা উট চিবিয়ে খেয়ে হজম করে গোবর হিসেবে পথে ফেলে যেতো; তবুও আমি মানুষ না হতাম”!
সূরা নাবার ৪১নং আয়াত যেখানে বলা হয়েছে- ‘কাফির বলবে- হায়, আমি যদি ধূলো হতাম!’- এর ব্যাখ্যায় হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.), হযরত আবু বকর (রা.)’র বিরুদ্ধে আরোপিত জঘন্য অপবাদের অপনোদন করেছেন। কোন কোন মুসলমান ফির্কার দাবি হলো, আবু বকর (রা.) মৃত্যুর পূর্বে উক্ত বাক্যটি বলতেন, তাই সাব্যস্ত হয় যে (নাউযুবিল্লাহ্) তিনি কাফির! কতটা জঘন্য মূর্খ হলে এরূপ আপত্তি করা যায়। এই আয়াতে যদি আবু বকর (রা.)’র প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েও থাকে, তবে তাঁর ঈমানের অবস্থা বিবেচনাপূর্বক এর অর্থ দাঁড়াবে- কাফিরদের কথার অস্বীকারকারী আবু বকর (রা.) বলবে, ‘হায়, আমার সাথে যদি আল্লাহ্ এই ব্যবহার করতেন যে, আমার পুণ্যেরও কোন প্রতিদান দিবেন না এবং আমার ভুলের জন্য কোন শাস্তিও দিবেন না!’ একজন পরিপূর্ণ মু’মিনের হৃদয়ের ব্যাকুলতা এরূপই হয়ে থাকে। খলীফা হবার পর তাঁর জন্য বায়তুল মাল থেকে ভাতা নির্ধারণের ঘটনাটিও তাঁর সারল্য ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। তাঁর হাত থেকে কখনও উটের লাগাম ছুটে গেলে তিনি কাউকে উঠিয়ে দিতে না বলে নিজেই উট থামিয়ে তা তুলে নিতেন। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘মহানবী (সা.) আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন কারও কাছে কিছু না চাই।’ তিনি এতটাই সতর্ক ছিলেন! একবার মসজিদে কিছু লোক বলাবলি করছিল, আমাদের চেয়ে আবু বকর (রা.)কোন দিক দিয়ে শ্রেয়? তিনি যেসব পুণ্য করেন সেগুলো তো আমরাও করি! একথা শুনতে পেয়ে মহানবী (সা.) এগিয়ে গিয়ে উত্তর দেন, ‘আবু বকরের শ্রেষ্ঠত্ব তার নামায এবং রোযার কারণে হয় নি, বরং সেটির ফলে হয়েছে যা তার মনে রয়েছে।’ অর্থাৎ তাঁর হৃদয়ের তাকওয়া এবং মহানবী (সা.)-এর প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসার কারণে হয়েছে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) সূরা হিজরের ১০০ নাম্বার আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সূফীদের পরিভাষায় ‘বাকা’ বলতে যা বোঝায় তা তুলে ধরেন এবং হযরত আবু বকর (রা.)’র উদাহরণ টেনে বলেন, মহানবী (সা.) বলতেন, ‘কেউ মৃত লাশকে পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াতে দেখতে চাইলে আবু বকরকে দেখে নিক।’ হযরত আবু বকর (রা.) কখনও এমন কোন খাবার খেতেন না যার সাথে প্রতারণা বা শির্‌কের দূরতম এবং বিন্দুমাত্রও সম্পৃক্ততা থাকতো, এমনটি জানতে পারলে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে তা বের করে দিতেন।
মহানবী (সা.)-এর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অত্যন্ত গভীর ছিল। একদিন হযরত আয়েশা (রা.) নবীজী (সা.)-এর সাথে উঁচু স্বরে কথা বললে হযরত আবু বকর (রা.) সহ্য করতে না পেরে মেয়েকে মারতে উদ্যত হন; মহানবী (সা.) বাধা দিলে তিনি ক্ষান্ত হন। ইমাম হাসানকে শৈশবে একদিন কোলে নিয়ে তিনি পরম স্নেহে বলেছিলেন, “আল্লাহ্‌র শপথ! এর চেহারা তো মহানবী (সা.)-এর মতো হয়েছে, আলীর মতোর”! একথা শুনে হযরত আলী (রা.) হাসছিলেন। হযরত হাফসা (রা.) বিধবা হলে উমর (রা.) প্রথমে হযরত উসমান এবং এরপর হযরত আবু বকর (রা.)-কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। উসমান (রা.) প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও আবু বকর (রা.) কোন উত্তরই দেন নি, এতে হযরত উমর (রা.) খুবই কষ্ট পান। মহানবী (সা.) হযরত হাফসাকে বিয়ে করার পর আবু বকর (রা.), হযরত উমরকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন যে, তিনি মহানবী (সা.)-এর অভিপ্রায় জানতেন, কিন্তু তাঁর (সা.) গোপনীয়তা রক্ষার্থে কিছু বলেন নি। খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) বলেন, হযরত আবু বকর (রা.)’র স্মৃতিচারণ আগামীতেও অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ্।