শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ: হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৪-জুন, ২০২১

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৪ঠা জুন, ২০২১ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)’র স্মৃতিচারণ করেন এবং বিগত খুতবার মত আজও দোয়ার গুরুত্বের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করেন।

তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, বিগত খুতবাগুলোতে হযরত উমর (রা.)’র স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল এবং তিনি যেসব গাযওয়া ও সারিয়্যাতে অংশগ্রহণ করেন সেগুলোর বর্ণনা চলছিল। ‘হামরাউল আসাদ’ এর যুদ্ধাভিযান সম্পর্কে বর্ণিত আছে, মহানবী (সা.) উহুদের যুদ্ধ শেষে যখন মদীনায় ফিরে আসেন আর কাফিররা মক্কাভিমুখে যাত্রা করে তখন তিনি (সা.) রাতের বেলা মদীনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার নির্দেশ দেন, কারণ তিনি আশংকা করছিলেন যে, কুরাইশদের ফিরে যাওয়াটা একটি ছল হতে পারে এবং তারা পুনরায় আক্রমণ করে বসতে পারে। পরদিন জানা গেল, এই সন্দেহ নিতান্ত অমূলক ছিল না; কুরাইশরা কিছুদূর গিয়েই অবস্থান নেয় এবং তাদের নেতারা উহুদের জয়ের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মদীনায় আক্রমণ করে মুসলমানদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। তাদের মধ্যে কতক বলছিল, যেহেতু তারা মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যাও করতে পারে নি বা কোন মুসলমান নারীকে দাসীও বানাতে পারে নি, তাই অবশ্যই মদীনা আক্রমণ করে বিজয়কে পূর্ণতা দেয়া আবশ্যক। অবশ্য কতক নেতা বলছিল, যেটুকু জয় অর্জন করা গিয়েছে সেটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত ও মক্কায় ফিরে যাওয়া উচিত; কিন্তু অবশেষে মদীনা আক্রমণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। অতএব, মহানবী (সা.) সাহাবীদেরকে শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য যাত্রা করতে বলেন; কিন্তু এ-ও বলে দেন, উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা ছাড়া অন্য কেউ যেন তাদের সাথে না যায়। এক বর্ণনানুসারে মহানবী (সা.) কুরাইশদের দুরভিসন্ধি জানার পর হযরত আবু বকর ও উমর (রা.)’র সাথে পরামর্শ করলে তারা মহানবী (সা.)-কে এই পরামর্শ প্রদান করেন। যাহোক, মুসলমানগণ মদীনা থেকে আট মাইল দূরে ‘হামরাউল আসাদ’ নামক স্থানে পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। রাতে মহানবী (সা.) সবাইকে তাঁবুর সামনে আগুন জ্বালিয়ে রাখতে বলেন, এর ফলে দূর থেকে দেখে মুসলিম শিবিরকে অনেক বড় একটি দল মনে হচ্ছিল। এখানে মা’বাদ নামক বনু খুযাআহ্’ গোত্রের একজন মুশরিক নেতা মহানবী (সা.)-এর সাথে এসে দেখা করে এবং উহুদের যুদ্ধে নিহত সাহাবীদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করে। সেই মুশরিক নেতা আরও কিছুদূর অগ্রসর হয়ে ‘রওহা’ নামক স্থানে পৌঁছে কুরাইশদের সৈন্য-শিবির দেখতে পায়, যারা মদীনায় আক্রমণের পাঁয়তারা করছিল। মা’বাদ সাথে সাথে তাদের নেতা আবু সুফিয়ানকে গিয়ে বলে, তোমরা করছটা কী? আমি মাত্রই ‘হামরাউল আসাদ’-এ মুহাম্মদ (সা.)-এর বাহিনী দেখে এসেছি; উহুদের যুদ্ধের পরাজয়ে তারা এতটা ক্ষীপ্ত হয়ে আছে যে, তোমাদেরকে বাগে পেলে পুড়িয়ে ভষ্ম করে ফেলবে। একথা শুনে আবু সুফিয়ানসহ কুরাইশ নেতারা ভয়ে তাদের দুরভিসন্ধি ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং মক্কাভিমুখে পলায়ন করে। মহানবী (সা.) যখন এই সংবাদ পান তখন সাহাবীদের বলেন, এটি আল্লাহ্ তা’লার প্রতাপ যা কাফিরদের হৃদয়ে ত্রাসের সঞ্চার করেছে।

৫ম হিজরীর শাবান মাসে সংঘটিত বনু মুস্তালিকের যুদ্ধেও হযরত উমর (রা.) উপস্থিত ছিলেন। এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা যায়, মক্কার কুরাইশদের শত্রুতা ও ষড়যেন্ত্রের দরুন হিজায অঞ্চলে অবস্থিত অমুসলিম গোত্রগুলোও মুসলমানদের প্রতি শত্রু-ভাবাপন্ন হয়ে ওঠে, যারা ইতোপূর্বে এতটা বিরোধী ছিল না। সেগুলোর মধ্যেই অন্যতম গোত্র ছিল বনু মুস্তালিক যারা মদীনায় অতর্কিত আক্রমণের ষরযন্ত্র করে। তাদের নেতা হারেস বিন আবি যিরার আশেপাশের কোন কোন গোত্রকেও নিজেদের দলে ভেড়ায়। মহানবী (সা.) যখন এ বিষয়ে সংবাদ পান তখন বুরীদা নামক একজন সাহাবীকে ভালোভাবে খোঁজ নেয়ার জন্য পাঠান। হযরত বুরীদা (রা.) খোঁজ নিয়ে দেখেন, ঘটনা সত্য এবং দ্রুত মহানবী (সা.)-এর কাছে সেই সংবাদ পৌঁছে দেন। মহানবী (সা.) সাহাবীদের নিয়ে বনু মুস্তালিক অভিমুখে যাত্রা করেন এবং হযরত আবু যার গিফ্‌ফারী (রা.) মতান্তরে যায়েদ বিন হারসা (রা.)-কে মদীনার আমীর নিযুক্ত করে যান। এই অভিযানে মুসলমানদের সাথে অনেক মুনাফিকও শামিল হয়। পথিমধ্যে শত্রুদের একজন গুপ্তচর মুসলমানদের হাতে আটক হয়; তার কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হলেও সে সঠিক উত্তর না দিয়ে কথা ঘোরাতে থাকে। তাই সে যুগের প্রচলিত রীতি অনুসারে হযরত উমর (রা.) তাকে হত্যা করেন। এদিকে মুসলমানদের আগমনের সংবাদ শুনে শত্রুদের অনেকেই ঘাবড়ে যায়। কারণ তারা মদীনায় অতর্কিত আক্রমণ করার ষড়যন্ত্র করেছিল, মুসলিম বাহিনীর সাথে লড়াইয়ের কোন অভিপ্রায় তাদের ছিল না; এজন্য অন্যান্য গোত্র সেখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু বনু মুস্তালিক গোত্র লড়াইয়ের ব্যাপারে গোঁ ধরে থাকে। মহানবী (সা.) যুদ্ধ এড়ানোর ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন, কিন্তু শত্রুদের একগুঁয়েমির কারণে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। এমনকি যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তেও মহানবী (সা.) হযরত উমর (রা.)’র মাধ্যমে ঘোষণা করান যে, তারা যদি এখনও শত্রুতা পরিহার করে তবে তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হবে ও মুসলমানগণ ফিরে যাবেন। কিন্তু শত্রুরা সেই সুযোগ কাজে লাগানো তো দূরে থাক, উল্টো তাদের পক্ষ থেকেই তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে যুদ্ধের সূচনা করা হয়। কিছুক্ষণ তীর বিনিময়ের পর মহানবী (সা.) সাহাবীদেরকে হঠাৎ একযোগে আক্রমণ করতে বলেন। মহানবী (সা.)-এর এই সুনিপুণ রণকৌশলের ফলে স্বল্পতম রক্তপাতের মাধ্যমেই যুদ্ধের সমাপ্তি হয়; মাত্র দশজন কাফির নিহত হয় ও একজন মুসলমান শহীদ হন, অবশিষ্ট কাফিররা আটক হয়। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর (আই.) এই আপত্তিরও খণ্ডন করেন যে, মুসলমানরা নাকি বনু মুস্তালিকের ওপর অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রমণ করেছিল; বস্তুত তারা আগেই পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল এবং মুসলমানদের আগমনের সংবাদ পাওয়ামাত্র তারা যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।

বনু মুস্তালিকের যুদ্ধ থেকে ফেরার পথেই আরও একটি ঘটনা ঘটে; একজন আনসার ও একজন মুহাজিরের মধ্যে তুচ্ছ কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাধে, যার ফলে তারা দু’জনই অন্য আনসার ও মুহাজিরদের ডাকাডাকি শুরু করেন এবং নিজেদের মধ্যেই একটি উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অবশেষে মহানবী (সা.)-এর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়, কিন্তু মুনাফিক-নেতা আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুল সুযোগ পেয়ে আনসারদেরকে বলে বসে, এবার মদীনা ফিরে গিয়ে মদীনার সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি সেখান থেকে সবচেয়ে লাঞ্ছিত ব্যক্তিকে বের করে দেবে। তার কথার মর্ম ছিল, সে নিজে সবচেয়ে সম্মানিত এবং মহানবী (সা.) সবচেয়ে লাঞ্চিত ব্যক্তি (নাউযুবিল্লাহ্)। যখন তার এই মন্তব্যের বিষয়ে জানাজানি হয় তখন হযরত উমর (রা.) ক্ষুদ্ধ হয়ে মহানবী (সা.)-এর কাছে তাকে হত্যা করার অনুমতি প্রার্থনা করেন, কিন্তু মহানবী (সা.) তাকে অনুমতি দেন নি। আব্দুল্লাহ্ বিন উবাইয়ের জীবনের শেষের দিকে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, একসময় যারা তার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, তারাই তার ওপর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে পড়ে। তখন মহানবী (সা.) হযরত উমর (রা.)-কে স্মরণ করান যে, যদি বনু মুস্তালিকের যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় তিনি (সা.) তাকে হত্যা করার অনুমতি দিতেন, তবে এই লোকগুলো আব্দুল্লাহ্‌র পক্ষ নিতো। কিন্তু আজ এমন অবস্থা হয়েছে যে, মহানবী (সা.) তাকে হত্যার নির্দেশ দিলে এই লোকগুলোই সানন্দে তাকে হত্যা করবে। হযরত উমর (রা.) স্বীকার করেন, নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.)-এর সিদ্ধান্ত অধিক কল্যাণময় ও দূরদর্শী। মহানবী (সা.) আব্দুল্লাহ্ বিন উবাইয়ের প্রতি এতদূর পর্যন্ত কৃপা করেন যে, হযরত উমর (রা.)’র বাধা দেয়া সত্ত্বেও তিনি (সা.) তার জানাযা পড়ান। কিন্তু এরপর আল্লাহ্ তা’লা তাকে ওহীর মাধ্যমে কোন মুনাফিকের জানাযা পড়াতে বারণ করেন; এরপর আর তিনি (সা.) কোন মুনাফিকের জানাযা পড়ান নি।

পরিখার যুদ্ধেও হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.)’র অংশগ্রহণ সম্পর্কে ইতিহাস থেকে জানা যায়; খন্দকের যুদ্ধের দিন হযরত উমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে জানান, কাফিরদের উপর্যুপরি আক্রমণের কারণে তিনি আসরের নামায পড়তে পারেন নি, ইতোমধ্যেই সূর্য অস্তমিত হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, তিনি নিজেও আসরের নামায পড়তে পারেন নি; অতঃপর বুতহান নামক উপত্যকায় গিয়ে মহানবী (সা.) সাহাবীদের নিয়ে সূর্যাস্তের পর আসর ও মাগরিবের নামায পড়েন। এটি নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে যে, খন্দকের যুদ্ধের দিন কত ওয়াক্ত নামায নির্ধারিত সময়ের পর পড়া হয়েছিল; কিন্তু হুযূর (আই.) বিভিন্ন হাদীস ও হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বরাতে তুলে ধরেন যে, কেবলমাত্র আসরের নামায নির্ধারিত সময়ের কিছু পরে পড়া হয়েছিল। মসীহ্ মওউদ (আ.) পাদ্রী ফতেহ্ মসীহ্‌র আপত্তির উত্তরে এ বিষয়টির অবতারণা করেছিলেন।

হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়ও হযরত উমর (রা.)’র বিশেষ ভূমিকা ছিল। মহানবী (সা.) হযরত উমর (রা.)-কে মক্কাবাসীদের কাছে দূতস্বরূপ পাঠানোর কথা ভেবেছিলেন; তখন হযরত উমর (রা.) মহানবী (সা.)-কে বলেন, আপনি (সা.) নির্দেশ দিলে তিনি যেতে প্রস্তুত, তবে এই মুহূর্তে মক্কাবাসীরা তার প্রতি চরম শত্রুভাবাপন্ন এবং তাকে পাওয়ামাত্র হত্যা করবে। হযরত উমর (রা.) নিজের চেয়ে আরও উত্তম দূত হিসেবে হযরত উসমান (রা.)’র নাম প্রস্তাব করেন; মহানবী (সা.)-এর এই প্রস্তাব মনঃপুত হয় এবং হযরত উসমান (রা.)-কেই তাঁর (সা.) দূত হিসেবে পাঠানো হয়। যখন মহানবী (সা.) ও কুরাইশ-নেতা সুহায়েল বিন আমরের মধ্যে হুদাইবিয়ার সন্ধির চুক্তিসমূহ নির্ধারিত হচ্ছিল এবং কুরাইশদের পক্ষ থেকে এই শর্তও আরোপ করা হয় যে, মক্কা থেকে কোন মুসলমান মদীনায় গেলে মুসলমানরা তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেবে, ঠিক সে সময়ই সুহায়েলের পুত্র আবু জান্দল শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় সেখানে উপস্থিত হন। তিনি মুসলমান হওয়ায় তার পিতা ও পরিবারের লোকেরা তাকে শিকলাবদ্ধ করে নির্যাতন করতো; মুসলমানদের আগমনের সংবাদ পেয়ে তিনি কোনমতে পালিয়ে হুদাইবিয়া আসেন এবং মুসলমানদের সাহায্য কামনা করেন। যদিও তখনও সন্ধির শর্তাবলী চূড়ান্ত হয় নি, কিন্তু সুহায়ল বলে ওঠে যে, সন্ধি মোতাবেক এখনই তার ছেলেকে তার হাতে তুলে দিতে হবে। মহানবী (সা.) বারবার তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু সুহায়েল গোঁ ধরে বসে, যদি তার ছেলেকে এখন তার হাতে তুলে না দেয়া হয় তবে সন্ধিচুক্তি আর হবে না। আবু জান্দল অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় মুসলমানদের অনুরোধ করে যে, তাদের এক ভাইকে যেন শত্রুদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া না হয়, কিন্তু অবশেষে শান্তি ও সন্ধির খাতিরে মহানবী (সা.) বুকে পাথর বেঁধে অত্যন্ত বেদনার্ত কণ্ঠে তাকে বলেন, হে আবু জান্দল, ধৈর্য ধর এবং আল্লাহ্‌র প্রতি ভরসা রাখ; তিনি অবশ্যই তোমার ও তোমার মত নিপীড়িত মুসলমানদের জন্য কোন না কোন পথ উন্মুক্ত করে দেবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা অপারগ, কারণ মক্কাবাসীদের সাথে সন্ধির আলাপ হয়ে গিয়েছে। সাধারণ মুসলমানদের জন্য এটি অত্যন্ত কঠিন এক মুহূর্ত ছিল; তারা কোনভাবেই আবু জান্দলকে ফেরত দিতে প্রস্তুত ছিলেন না, বরং কুরাইশদের সাথে লড়াই করতেও প্রস্তুত ছিলেন। অবশেষে হযরত উমর (রা.) অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে নিবেদন করেই বসেন, ‘আপনি কি আল্লাহ্‌র সত্য রসূল নন? আমরা কি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নই এবং শত্রুরা কি মিথ্যার ওপর নয়? তাহলে আমরা কেন আমাদের সত্য ধর্মের সাথে এরূপ অপমান সহ্য করব? মহানবী (সা.) তাকে সংক্ষেপে কেবল বলেন, হে উমর, আমি আল্লাহ্‌র রসূল এবং ভালো জানি আল্লাহ্ তা’লার অভিপ্রায় কী; আমি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারি না। কিন্তু হযরত উমর (রা.)’র ভেতর আবেগের ঝড় তখনও স্তিমিত হয় নি; তিনি জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি বলেন নি যে, আমরা বায়তুল্লাহ্ প্রদক্ষিণ করব? মহানবী (সা.) বলেন, অবশ্যই বলেছি, কিন্তু আমি তো বলি নি যে, সেটি এই বছরই হবে। হযরত উমর (রা.)’র উত্তেজনা তাতেও প্রশমিত হয় নি; মহানবী (সা.)-এর সামনে তো তার মুখে আর কথা যোগায় নি, কিন্তু তিনি গিয়ে হযরত আবু বকর (রা.)’র কাছে এসব কথাই বলতে শুরু করেন। হযরত আবু বকর (রা.)ও মহানবী (সা.)-এর মতই উত্তর দেন, সেই সাথে সতর্কও করেন যে, আল্লাহ্‌র সত্য রসূলের হাতে বয়আত করার পর তার সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কোন কিছু করা বা ভাবা মোটেই সমীচীন না। তখন হযরত উমর (রা.) সম্বিত ফিরে পান যে, তিনি মহানবী (সা.)-এর সাথে এরূপ তর্ক করে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছেন। তিনি তার এই কর্মের প্রায়শ্চিত্তের জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অনেক নফল ইবাদত, তওবা-ইস্তেগফার, দান-খয়রাত ইত্যাদি করেছেন। হুদাইবিয়ার সন্ধির চুক্তিপত্রের দু’টি কপি করা হয়; মুসলমানদের পক্ষ থেকে এতে হযরত আবু বকর, উমর, উসমান, আব্দুর রহমান বিন অওফ, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস ও আবু উবায়দাহ্ (রা.) স্বাক্ষর করেন।

হুদাইবিয়া থেকে ফেরার সময় পথিমধ্যে মহানবী (সা.)-এর প্রতি সূরা ফাতাহ্ অবতীর্ণ হয়; মহানবী (সা.) সাহাবীদের ডেকে বলেন, আজ আমার প্রতি এমন এক সূরা অবতীর্ণ হয়েছে যা পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে আমার অধিক প্রিয়। অতঃপর তিনি (সা.) তাদেরকে সূরা ফাতাহ্ পাঠ করে শোনান। এতে আল্লাহ্ তা’লা হুদাইবিয়ার সন্ধিকে মহানবী (সা.)-এর জন্য এক মহান বিজয় আখ্যায়িত করেন এবং তাঁর (সা.) পূর্বাপর সকল ভুল-ত্রুটি মার্জনা করার ঘোষণা দেন; আর এ-ও বলেন, মুসলমানরা শীঘ্রই অতি-অবশ্যই শান্তিপূর্ণভাবে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে। গুটিকতক সাহাবী আপত্তির রঙে মন্তব্য করেন, কা’বা তাওয়াফ না করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়াটাই কি বিজয়? মহানবী (সা.) একথা জানতে পেরে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং এক সংক্ষিপ্ত কিন্তু তেজোদীপ্ত বক্তৃতা দিয়ে বুঝিয়ে দেন, প্রকৃতই এই সন্ধি মুসলমানদের জন্য এক মহান বিজয়। যদি মুসলমানরা এখন জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করতেন, তবে তা শান্তিপূর্ণ প্রবেশ হতো না; কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা শীঘ্রই তাদেরকে শান্তির সাথে মক্কায় প্রবেশের সুসংবাদ দিচ্ছেন। কুরাইশরা যেখানে মুসলমানদের প্রাণের শত্রু, তারা স্বেচ্ছায় সন্ধি করেছে- এটি বিজয় নয় তো আর কী? এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.) বিশেষভাবে হযরত উমর (রা.)-কে ডেকে এই সূরা অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলেছিলেন, যেহেতু উমর (রা.) হুদাইবিয়ার সন্ধিকে একপ্রকার অপমান মনে করেছিলেন। সাহাবীরা সবাই তখন বুঝতে পারেন এবং একবাক্যে স্বীকার করেন, এই সন্ধি আসলেই এক মহান বিজয়। হুযূর (আই.) বলেন, হযরত উমর (রা.)’র স্মৃতিচারণ আগামীতেও অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ্।

খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) সম্প্রতি প্রয়াত কতিপয় নিষ্ঠাবান আহমদী সদস্যের গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন এবং তাদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন; তারা হলেন যথাক্রমে পাকিস্তানের মোকাররম মালেক মোহাম্মদ ইউসুফ সেলিম সাহেব, কাদিয়ানের ওয়াকেফে যিন্দেগী মোকাররম শুয়াইব আহমদ সাহেব, কাদিয়ানের মুবাল্লিগ সিলসিলা মোকাররম মাকসুদ আহমদ ভাট্টি সাহেব, ফয়সালাবাদের মোকাররম জাভেদ ইকবাল সাহেব, ঘানার মুরব্বী সিলসিলা নওয়ায আহমদ সাহেবের সহধর্মিণী মোকাররমা মাদীহা নওয়ায সাহেবা। হুযূর (আই.) তাদের সবার রূহের মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করে দোয়াও করেন। (আমীন)