খিলাফত ও আমাদের দায়িত্ব
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)
২৮-মে, ২০২১
মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন
ডাউনলোড
জুমুআর খুতবার সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৮শে মে, ২০২১ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মহান খিলাফত দিবসের প্রেক্ষাপট – এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং আমাদের কর্তব্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেন।
তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) সূরা নূরের ৫৬ ও ৫৭নং আয়াত পাঠ করেন,
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ * وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ*
এই আয়াতদ্বয়ের বঙ্গানুবাদ হল: “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, তাদের সাথে আল্লাহ্ তা’লা অঙ্গীকার করেছেন যে, অবশ্যই তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে খলীফা নিযুক্ত করবেন, যেভাবে তিনি তাদের পূর্ববর্তীদের খলীফা নিযুক্ত করেছিলেন। আর অবশ্যই তিনি তাদের জন্য তাদের ধর্মকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিবেন, যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন; এবং তাদের ভয়-ভীতির অবস্থার পর সেটিকে তাদের জন্য নিরাপত্তায় বদলে দিবেন। তারা আমার ইবাদত করবে, আমার সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করবে না। আর এরপর যারা অস্বীকার করবে, তারাই হবে দুষ্কৃতকারী। আর তোমরা নামায কায়েম কর এবং যাকাত দাও এবং এই রসূলের আনুগত্য কর, যেন তোমাদের প্রতি কৃপা করা যায়।”
হুযূর (আই.) বলেন, গতকাল ২৭ মে ছিল, যা আমরা খিলাফত দিবস হিসেবে স্মরণ করে থাকি। খিলাফত দিবসের প্রেক্ষাপটে জামাতে জলসাও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, যেন জামাতের ইতিহাস ও খিলাফতের সুবাদে আমাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্বাবলী সম্পর্কে আমরা সচেতন থাকি; একইসাথে খলীফার হাতে বয়আত করার পর সেসব দায়িত্ব পালনকারীও হই এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’লার করুণারাজির উত্তরাধিকারী হই। আমাদের প্রতি আল্লাহ্ তা’লার মহা অনুগ্রহ হল, তিনি আমাদেরকে তাঁর প্রেরিতপুরুষকে মানার সৌভাগ্য দান করেছেন, যাঁকে তিনি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা উপস্থাপন করার জন্য প্রেরণ করেছেন; আর এরপর খিলাফতের হাতে বয়আত করারও সৌভাগ্য দান করেছেন যেন সেই শিক্ষা আমরা নিজেরাও মান্য করি এবং পৃথিবীময় তা ছড়িয়ে দিতে পারি। কাজেই, আহমদীয়া খিলাফতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া প্রত্যেক আহমদীর ওপর এক গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে। যদি আমরা সেই দায়িত্ব পালন করি, তবেই আমরা আল্লাহ্ তা’লার সেই অনুগ্রহের উপযুক্ত বলে গণ্য হতে পারি। পাঠকৃত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ্ তা’লা একদিকে যেমন ধর্মকে সুদৃঢ় করার, ভয়-ভীতির অবস্থাকে শান্তি ও নিরাপত্তায় পরিবর্তন করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তেমনিভাবে সেই প্রতিশ্রুতিকে দৃঢ় ঈমান, পুণ্যকর্ম সাধন, ইবাদতের দায়িত্ব পালন ও আল্লাহ্র একত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে শর্তযুক্ত করেছেন; আর এই বিষয়গুলো অর্জনের জন্য নামায, আল্লাহ্র পথে ব্যয় করা এবং মহানবী (সা.)-এর আনুগত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমরা এ বিষয়গুলো স্মরণ রাখব এবং সেই অনুসারে নিজেদের জীবন গড়ার চেষ্টা করব, ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দেয়ার অঙ্গীকার স্মরণ রেখে প্রকৃত স্পৃহার সাথে তা পালনকারী হব- তখনই আমরা আল্লাহ্ তা’লার সেসব পুরস্কার অর্জন করতে পারব, যেগুলো প্রদানের তিনি অঙ্গীকার করেছেন; আর খিলাফতের পুরস্কার দ্বারাও প্রকৃত অর্থে কল্যাণমণ্ডিত হতে পারব। অতএব, এই আয়াতটি মু’মিনদের জন্য একদিকে যেমন মহা সুসংবাদস্বরূপ, সেইসাথে আমাদের জন্য চিন্তারও বিষয়; কারণ যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলো যদি আমরা পূর্ণ না করি, তবে আমরা এই পুরস্কার দ্বারা প্রকৃত অর্থে কল্যাণমণ্ডিত হতে পারব না। সুতরাং কেবল এই ইতিহাস জেনে নেয়া এবং খিলাফত দিবস পালন করাই যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ না আমরা প্রকৃত অর্থে আবদ বা আল্লাহ্র দাসে পরিণত না হই, নিজেদের নামায আদায়ে সচেতন না হই, আল্লাহ্ তা’লা ও তাঁর সৃষ্ট জীবের প্রাপ্য প্রদানকারী না হই। কাজেই, আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করা প্রয়োজন যে, আমাদের ঈমানের অবস্থা আসলে কেমন, আমাদের মধ্যে কি খোদাভীতি রয়েছে, আমরা কি তাক্বওয়ার সূক্ষ্ম পথে বিচরণকারী, আমরা কি আল্লাহ্ তা’লাকে সবকিছুর চাইতে বেশি ভালোবাসি, আমাদের প্রতিটি কর্ম কি ইসলামী শিক্ষাসম্মত, আমাদের কোন কর্ম লোক-দেখানোর উদ্দেশ্যে নয় তো? হৃদয়ের প্রশান্তি তো তখন অর্জন করা সম্ভব যখন আমাদের প্রতিটি কর্ম কেবল এবং কেবলমাত্র আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হবে। আর কেবলমাত্র তখনই খিলাফতের ছায়াতলে সেই সুন্দর সমাজ গঠিত হবে, যখন আমাদের প্রতিটি কর্ম হুকুকুল্লাহ্ ও হুকুকুল ইবাদের দায়িত্ব পালনকারী হবে। অতএব, কেবল মুখের কথায় এটি অর্জিত হবে না, বরং আমাদেরকে আল্লাহ্ তা’লার এই বাণী সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, ঐশী খিলাফত দ্বারা কল্যাণমণ্ডিত হবে কেবল সেসব মু’মিন, যাদের কর্ম ‘আমলে সালেহ্’ হবে।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) ‘আমলে সালেহ্’র পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমলে সালেহ্’ সেই পুণ্যকর্মকে বলে যার মাঝে অণু পরিমাণও ত্রুটি না থাকে। তিনি (আ.) বলেন, মানুষের প্রত্যেক কর্মের পেছনে চোর ওঁৎ পেতে থাকে; সেই চোর কারা? লৌকিকতা, অহংকার, আত্মতুষ্টি বা আত্মম্ভরিতা, বিভিন্ন প্রকার অপকর্ম ও পাপ, যা কখনও কখনও মানুষ টেরও পায় না- এরা হল সেসব চোর যেগুলোর কারণে আমাদের কর্ম বিনষ্ট হয়ে যায়। আমলে সালেহ হল, সেই পুণ্য যার মধ্যে এসব বিষয় তো দূরে থাক, কোন মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার চিন্তাও থাকে না। আমলে সালেহ্ যেভাবে পরকালে মানুষকে রক্ষা করে, তেমনি এই পৃথিবীতেও তা মানুষকে রক্ষা করে। তিনি (আ.) বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সৎকর্ম সম্পাদিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেবল মান্য করা ও বিশ্বাস স্থাপন কোন কাজে আসে না। সেটি আমলে সালেহ্ নয়, যেটিকে আমরা আমলে সালেহ্ আখ্যা দেই। আল্লাহ্র নির্দেশ তাঁর রসূলের (সা.) প্রদর্শিত উপায়ে অক্ষরে অক্ষরে যদি পালন করা হয় এবং এর মাঝে কোন প্রকার ত্রুটি না থাকে- তবেই সেটি আমলে সালেহ্ গণ্য হবে। যারা নিজেদের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে আমলে সালেহ্’র মনগড়া ব্যাখ্যা করতে আরম্ভ করে দেয়, ‘ন্যায়সঙ্গত মীমাংসা’র নিজস্ব ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে- এমন লোকদের খিলাফতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার দাবী অন্তঃসারশূন্য। যারা বিশুদ্ধচিত্তে, নিষ্ঠার সাথে খিলাফতের আনুগত্যকারী, তারাই প্রকৃত অর্থে খিলাফতের সাথে সম্পৃক্ত ও খিলাফতের সুরক্ষাকারী; আর খিলাফতও তাদের সুরক্ষাকারী, যুগ-খলীফার দোয়াও তারা লাভ করে। খিলাফতের সাথে তাদের সম্পর্ক এবং তাদের সাথে খিলাফতের সম্পর্ক কেবলমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। অন্য মুসলমানগণ জাগতিক আন্দোলন ও পরিকল্পনার মাধ্যমে খিলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে; কিন্তু তারা যতই চেষ্টা করুক, সফল হতে পারবে না। খিলাফতের সেই ধারাই অব্যাহত থাকবে যা আল্লাহ্ চেয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই আমাদের একদিকে যেমন আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞ ও প্রণত হওয়া উচিত যে, তিনি আমাদের খিলাফত দান করেছেন, সেই সাথে সর্বদা এই ভীতির সাথে আত্মবিশ্লেষণও করা দরকার যে, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি কি-না?
আল্লাহ্ তা’লা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে এই প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন যে, তাঁর জামাতে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তা স্থায়ী হবে, তিনি (আ.) আল্ ওসীয়্যত পুস্তিকায় এ বিষয়ে সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন। তিনি (আ.) লিখেছেন, আল্লাহ্ তা’লার অমোঘ বিধান হল, তিনি ও তাঁর রসূলগণ সর্বদা জয়যুক্ত হন; কিন্তু এই বিজয়ের পূর্ণতা আল্লাহ্ তা’লা নবীদের হাতে দেন না, বরং নবীর মৃত্যু এর পূর্বেই হয় এবং এভাবে আল্লাহ্ বিরুদ্ধবাদীদেরকে সাময়িক উল্লাস ও হাসি-ঠাট্টা করার সুযোগ দেন। এরপর আল্লাহ্ তা’লা পুনরায় স্বীয় কুদরত প্রদর্শন করেন এবং খিলাফতের মাধ্যমে পতনোন্মুখ জামাতকে রক্ষা করেন ও বিজয়কে পূর্ণতা দান করেন।
হুযূর (আই.) ইতিহাস তুলে ধরেন যে, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) যেমনটি বলেছেন, তাঁর মৃত্যুর পর সেই দৃশ্যই দেখা গিয়েছে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রয়াণে আহমদীরা যতটা শোকে মুহ্যমান ছিল, বিরুদ্ধবাদীরা ততটাই উল্লসিত হয়; এতটা জঘন্য মিথ্যাচার তারা করেছে যা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে এরা কেমন মুসলমান? উদাহরণস্বরূপ হুযূর (আই.) উল্লেখ করেন, পীর জামাত আলী শাহের মুরীদরা এই গুজব ছড়িয়ে দেয় যে, আহমদীরা নাকি মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মৃত্যুর পর তওবা করে তাদের পীরের কাছে বয়আত করছে। খাজা হাসান নিযামী যিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তিনি আহমদীদের পরামর্শ দেন, তারা যেন হুযুর (আ.)-কে মসীহ্ ও মাহদী মান্য করা থেকে সরে আসে, নতুবা তাদেরকে অন্যদের কাছে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে হবে। আসলে তারা জানতো না যে, আল্লাহ্ তা’লা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাথে অঙ্গীকার করে রেখেছেন- ‘আমি তোমার ও তোমার প্রিয়দের সাথে আছি।’ হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) আল্লাহ্ তা’লার কাছ থেকে সংবাদ পেয়েই দ্বিতীয় কুদরত তথা খিলাফতের ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন এবং এ-ও বলেছিলেন, আদিকাল থেকেই খোদা তা’লার যে চিরন্তর রীতি- তা এখন পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। আর দ্বিতীয় কুদরতের আগমন আহমদীদের জন্য শ্রেয়, কারণ তা কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হবে। বস্তুতঃ এরূপই হয়েছে এবং আমরা বিগত ১১৩ বছর যাবৎ হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কথা এবং তাঁকে প্রদত্ত আল্লাহ্ তা’লার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হতে দেখে আসছি। অতঃপর হুযূর (আই.) খলীফাতুল মসীহ্দের প্রত্যেকের খিলাফতের পূর্বে সৃষ্ট ভয়-ভীতিপূর্ণ অবস্থা এবং খিলাফতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’লা কীভাবে সেই অবস্থাকে শান্তি ও নিরাপত্তায় পরিবর্তন করে দিয়েছেন এবং জামাতকে ক্রমাগত উন্নতির পথে ধাবিত করেছেন- তা সংক্ষেপে তুলে ধরেন।
খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল হযরত মৌলভী হেকীম নূরুদ্দীন (রা.)’র খিলাফতের পূর্বের অবস্থা তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যখন তিনি খিলাফতের আসনে সমাসীন হন, তখনও একটি পত্রিকায় লেখা হয়- ‘এখন তাদের ইমাম যে ব্যক্তি হয়েছেন, তিনি কেবল মসজিদে কুরআন পড়াতে পারবে।’ অথচ এই নির্বোধরা জানেই না, এই কাজের জন্যই হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহ্ তা’লার কাছে দোয়া করেছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে মহানবী (সা.)-এর ধরাপৃষ্ঠে আগমন ঘটে! কিন্তু খলীফা আউয়াল (রা.) শুধু এই কাজই করেন নি, বরং জামাতকে সুসংহত করা এবং খিলাফতের অধীনে জামাতকে সুদৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ করার কঠিন দায়িত্বও তিনি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন, এবং যেসব মুনাফিকরা পেছন থেকে খিলাফতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অপচেষ্টা করছিল, তাদের ষড়যন্ত্রও তিনি কঠোর হাতে নস্যাৎ করে দেন। ১৯১৪ সনের মার্চ মাসে তার তিরোধানের পর দ্বিতীয় খিলাফতের সময় জামাতের ভেতর থেকে বয়োজ্যেষ্ঠদের একটি দল, যারা সদর আঞ্জুমানের হর্তাকর্তা ছিলেন, খিলাফতের তীব্র বিরোধিতা করে এবং একে বিঘ্নিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা স্বীয় প্রতিশ্রুতি অনুসারে খিলাফত পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন এবং হযরত মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.)-কে খলীফা নিযুক্ত করেন। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)’র ৫২ বছরব্যাপী খিলাফত একথার সাক্ষী যে, আঞ্জুমানের সেই কর্তা-ব্যক্তিদের ভাষ্যমতে যিনি নিতান্তই এক বালক ছিলেন, তারই নেতৃত্বে আহমদীয়াত পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৬৫ সনের নভেম্বরে যখন তার তিরোধান হয় তখন দ্বিতীয় কুদরতের তৃতীয় বিকাশস্থল হন, হযরত মির্যা নাসের আহমদ (রাহে.); তার খিলাফতের পূর্বেও অশান্তি ও বিরোধিতা হয়, কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা দেখিয়ে দেন যে, তিনি-ই এই ব্যক্তিকে খলীফা নিযুক্ত করেছেন। আফ্রিকায় জামাতের ব্যাপক জনকল্যাণমূলক কর্মকা- ও বিস্তার তার খিলাফতের যুগের এক বিশেষ অধ্যায়। ১৯৭৪ সালে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানে জামাতকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়; কিন্তু জামাত খিলাফতের ঢালের পেছনে থাকায় শত্রুদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। ১৯৮২ সালের জুন মাসে তৃতীয় খলীফা আমাদের ছেড়ে চলে গেলে আল্লাহ্ তা’লা পুনরায় হযরত মির্যা তাহের আহমদ (রাহে.)’র মাধ্যমে ভয়ভীতির অবস্থাকে শান্তি ও নিরাপত্তায় বদলে দেন। খলীফাতু মসীহ্ রাবে (রাহে.)’র হিজরত এবং তারপর আহমদীয়াতের উন্নতি ও প্রচারের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়; স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আহমদীয়াত এবার আহমদীদের সাথে সাথে অ-আহমদীদের বাড়িতেও পৌঁছতে আরম্ভ করে। ২০০৩ সনের এপ্রিলে খলীফাতু মসীহ্ রাবে (রাহে.)’র তিরোধান জামাতের জন্য অনেক বড় একটি ধাক্কা ছিল এবং শত্রুদের ধারণামতে আহমদীয়াতকে ধ্বংস করার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা তখনও এমনভাবে জামাতকে রক্ষা করেন যে, কতিপয় মৌলভী তাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও একথা বলতে বাধ্য হয়- সত্যি সত্যিই এই জামাতের সাথে খোদা তা’লার সাহায্য ও সমর্থন রয়েছে। খিলাফতে খামেসার যুগে অন্যান্য উন্নতির সাথে সাথে বিশ্বের পরাশক্তি বলে বিবেচিত রাষ্ট্রগুলোর কর্ণধারদের কাছেও আহমদীয়াত ও ইসলামের খাঁটি শিক্ষা পৌঁছে গিয়েছে; একটি চ্যানেল থেকে এখন এমটিএ আটটি চ্যানেলে উন্নীত হয়েছে, দেশে দেশে এর স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমেও আহমদীয়াতের ব্যাপক প্রচার হচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হল, করোনা মহামারীতে গোটা বিশ্ব যেখানে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের শিকার, সেখানে আহমদীয়া খিলাফতের ছায়াতলে তা জামাতের আরও বিশাল উন্নতির কারণ হয়েছে। এখন ভার্চুয়াল সাক্ষাতের মাধ্যমে পৃথিবীর দূর-দূরান্তে অবস্থিত আহমদীরাও সরাসরি যুগ-খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করে দিক-নির্দেশনা লাভ করতে পারছে, আর খলীফা হুযূরও নিজ দপ্তরে বসেই দূর-দূরান্তের আহমদীদের প্রকৃত অবস্থা সরাসরি তাদের মুখ থেকে জেনে নিতে পারছেন। হুযূর (আই.) বলেন, আমি তো অত্যন্ত দুর্বল এক মানুষ, আমার কোন যোগ্যতার কারণে এসব হচ্ছে না; বরং এগুলো সবই আল্লাহ্ তা’লার কৃপা, সাহায্য ও সমর্থন, যেমনটি তিনি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন; আর এগুলো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর দোয়ার কল্যাণেই হচ্ছে। অতএব, আল্লাহ্ তা’লা তো স্বীয় প্রতিশ্রুতি অনুসারে জামাতকে অবশ্যই উন্নতি দান করবেন, কিন্তু খিলাফত দ্বারা কল্যাণমণ্ডিত হওয়ার জন্য আমাদেরকেও নিজেদের ভূমিকা পালন করতে হবে; আল্লাহ্ তা’লার কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে তাঁর প্রতি বিনত হতে হবে। খিলাফতরূপী নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা আমাদের প্রতিটি কথা ও কাজের মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া উচিত, খিলাফতের আনুগত্যের স্বার্থে সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকারে নিজেদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে; তবেই আমরা কিয়ামত পর্যন্ত নিজেদের বংশধরদের খিলাফতের প্রতি অনুগত ও অনুরক্ত রাখার দায়িত্ব পালন করতে পারব।
আল্ ওসীয়্যত পুস্তিকায় হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এই জামাতের উন্নতির বিষয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন হুযূর (আই.) তা উদ্ধৃত করেন এবং দোয়া করেন- আল্লাহ্ তা’লা করুন, এই জামাতের পরিপূর্ণ উন্নতির দৃশ্য যেন আমরা স্বচক্ষে দেখতে পারি; আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে নিজেদের অঙ্গীকার পালনকারী বানান, আমাদের ইবাদত, নামায, কাজকর্ম- সবই যেন আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জনকারী হয়, আমরা যেন খিলাফতের প্রকৃত মর্ম অনুধাবনকারী হই এবং নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকেও এর কথা বলতে পারি, যেন কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের বংশধররা এর দ্বারা কল্যাণমণ্ডিত হতে পারে।
খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) পুনরায় দোয়ার প্রতি জামাতের মনোযোগ আকর্ষণ করেন; পাকিস্তানসহ বিশ্বের যেকোন প্রান্তে নির্যাতিত ও বিপদগ্রস্ত আহমদীদের জন্য ও ফিলিস্তিনসহ বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য হুযূর দোয়ার আহ্বান করেন। হুযূর (আই.) এই দোয়ারও আহ্বান জানান যে আহমদীরা যেন প্রকৃত অর্থে ইসলাম ও আহমদীয়াতের শিক্ষা পালনকারী খাঁটি আহমদী হয়, আর সাধারণ মুসলমানরাও যেন মহানবী (সা.)-এর নিষ্ঠাবান প্রেমিক ও দাস হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে চিনতে ও মান্য করতে সক্ষম হয়; আর যত দ্রুত সম্ভব পৃথিবীতে আল্লাহ্ তা’লার খাঁটি তৌহিদ বা একত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মহানবী (সা.)-এর পতাকা সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে উঁচুতে উড্ডীন হয়। (আমীন)