আহমদী বিরোধীদের জন্য দোয়া করার গুরুত্ব

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৪-মে, ২০২১

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৪ই মে, ২০২১ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় আহমদী বিরোধীদের জন্য দোয়া করার গুরুত্ব তুলে ধরে তাদের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করার প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন।

তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, সম্প্রতি একজন মৌলভী সাহেব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলছিলেন, পৃথিবীর যেখানেই বিশৃঙ্খলা ও যুদ্ধ চলছে, কাদিয়ানীরাই এর মূল কারণ। এমনকি ফিলিস্তিনে সংঘটিত বিশৃঙ্খলার দায়ও সে কাদিয়ানী অর্থাৎ আহমদীদের ওপর চাপাচ্ছিল; আর সাধারণত তারা যেমনটি করে থাকে- আহমদীদের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করা, তাদেরকে হত্যা করার বিষয়ে উস্কানি দিচ্ছিল। যাহোক, এটি তো তাদের পুরনো রীতি; যখন থেকে আহমদীয়াতের সূচনা হয়েছে তখন থেকেই এমন মৌলভী, যাদেরকে ‘আইম্মাতুল কুফর’ অভিহিত করা যায়, এমনটি করে আসছে। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লার দরবারে লাখো শুকরিয়া, আমরা সেই প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদীর অনুসারী, যিনি আমাদের শিখিয়েছেন; আমরা যেন তাদের এসব মর্মযাতনাদায়ক কথাবার্তা শুনে এবং কার্যত সাধারণ মুসলমানদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার অপচেষ্টা দেখেও ধৈর্য ও দোয়ার আশ্রয় নিই। এই ‘আইম্মাতুল কুফর’ লোকেরাই আহমদীয়া জামাতের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে নিষ্পাপ ও সাধারণ মুসলমানদেরকে আহমদীয়াতের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে। সাধারণ মুসলমানরা প্রকৃত বিষয় না জানার ফলে হয়তো ভাবে যে, মৌলভীদের কথাই সত্য, ‘আসলেই আহমদীরা মহানবী (সা.)-এর (নাউযুবিল্লাহ্) অবমাননা করছে, তাই তাদের সাথে এমনটিই হওয়া উচিত’। কিন্তু যেসব মৌলভী প্রকৃত সত্য সম্বন্ধে অবগত, তারা খুব ভালোভাবেই জানে যে, তাদের কথার কোন ভিত্তি নেই; তারা শুধু নিজেদের অবস্থান ও মিথ্যা সম্মানের মোহে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব মিথ্যাচার করে। আল্লাহ্ তা’লাই ভালো জানেন যে, তিনি তাদের সাথে কী করবেন! আমাদের কাজ হল, শুধুমাত্র দোয়া করা।

হুযূর (আই.) বলেন, যেমনটি আমি ঈদের খুতবাতেও বলেছি, মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর শিক্ষা হল- শত্রুদের জন্যও দোয়া কর। আমরা শুধু দোয়াই করি এবং করতে থাকবো, ইনশাআল্লাহ্। এই বিরোধিতা কোন নতুন বিষয় নয়, এসব মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যুগ থেকেই আরম্ভ হয়েছিল; তাঁর ওপরও আক্রমণ করা হতো। যারা তাঁর কথা শুনতে আসতো, তাদের ওপরও আক্রমণ করা হতো; এমনকি অ-আহমদী হলেও কখনও কখনও আক্রমণের শিকার হতে হতো। কিন্তু হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এতদসত্ত্বেও এসব বাধাদানকারী, আক্রমণকারীদের জন্য দোয়া করতেন, আর সেই দোয়ার ফলেই তাদের মধ্যে কেউ কেউ চরম বিরোধিতা পরিহার করে আহমদী হয়েছেন এবং এখনও হচ্ছেন। অতএব, আমরা এই মৌলভীর এরূপ অপলাপ সত্ত্বেও অনুরূপ পাল্টা কথা বলব না, তার মত ভাষা ব্যবহার করব না; আমরা এসব কিছুর পরও তাদের জন্য শুধু দোয়াই করতে থাকবো।

হুযূর (আই.) বলেন, সাধারণ মুসলমানদের পক্ষ থেকে কটুবাক্য শুনেও আমরা তাদের জন্য দোয়া করি, তাদের কষ্টে আমরাও কষ্ট পাই। আর এর কারণ হল, মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর শিক্ষা, আর এটিই তাঁর প্রতি আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশ ছিল। আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে (আ.) বলে দিয়েছিলেন, তাদের এই অত্যাচার শুধুমাত্র ভুল বুঝার কারণেই হয়ে থাকে এবং রসূলপ্রেমের কারণেই তারা এমনটি করে; কার্যত তাদের মাঝে রসূলপ্রেম না থাকলেও রসূলপ্রেমের দাবী কিন্তু রয়েছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করা যাবে না। এ সংক্রান্ত একটি ঘটনা হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি যখন কিশোর ছিলেন, তখন একবার লাহোরে মসীহ্ মওউদ (আ.) কোন একটি অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলেন, সম্ভবত কোন সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল এবং মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে চলে আসতে হয়েছিল; যখন তিনি বাজারের মাঝখান দিয়ে অতিক্রম করছিলেন তখন মানুষজন ছাদে দাঁড়িয়ে তাঁকে গালি দিচ্ছিল এবং বলছিল, ‘মির্যা পালাচ্ছে, মির্যা পালাচ্ছে!’ একজন বৃদ্ধ যার একটি হাত কাটা ছিল এবং ক্ষত দেখে বোঝা যাচ্ছিল, তার হাত কয়েকদিন পূর্বেই কাটা পড়েছে, সে-ও অত্যন্ত উৎসাহের সাথে চেঁচিয়ে এসব বলছিল। মুসলেহ্ মওউদ (রা.) যেহেতু বয়সে খুব ছোট ছিলেন, তাই তিনি বুঝতে পারছিলেন না, ঘটনা আসলে কী, তাদের এত হৈচৈয়ের কারণই বা কী? আসলে মোল্লারা এভাবেই মানুষকে উস্কাতে থাকতো। আরেকবার তিনি (আ.) লাহোর শহরে যাচ্ছিলেন, তখন কেউ একজন পেছন থেকে তাঁকে আক্রমণ করে, ফলে তিনি পড়ে যান বা হোঁচট খান। কখনও কখনও মুসলেহ্ মওউদ (রা.) মানুষজনকে ইট-পাটকেল ছুঁড়তেও দেখেছেন। এসব কার্যকলাপের ফলে মাঝে মাঝে জামাতের সদস্যরাও রেগে যেতেন যে ‘এরা অকারণে কেন এমন করছে?’ তখন হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রতি ইলহাম হয়েছিল- ‘এ্যায় দিল তু নিয খাতেরে ইনা নিগাহদার- কাখর কুনান্দ দাওয়ায়ে হুব্বে পয়াম্বারাম’ অর্থাৎ তুমি এই মুসলমানদেরকে তাদের গালিগালাজ সত্ত্বেও কিছু বলো না, কারণ তারা যে তোমাকে গালি দিচ্ছে বা মারতে উদ্যত হচ্ছে, তা মুহাম্মদ (সা.)-কে ভালোবাসার কারণেই করছে। যেহেতু তারা ভুল করছে এবং ভুল বুঝার কারণেই এমনটি করছে, তাই তুমি তাদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করো না।

হুযূর (আই.) বলেন, তাই আমাদের যত বিরোধিতাই হোক- আমাদেরকে দেখতে হবে এর পেছনে আসল কারণ কী! হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, যদি তারা একবার একথা বুঝতে পারে যে, আমার হৃদয়ে মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ভালোবাসার যে শিখা জ্বলছে, তা তাদের লক্ষজনের ভেতরেও নেই- তাহলে তারা তৎক্ষণাৎ আহমদীদের কাছে মাথানত করবে। তারা বিরোধিতা এজন্য করে যে, তারা ভাবে, আমরা মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে, যা নিতান্তই এক ভুল ধারণা। তিনি (রা.) আরও বলেন, তারা যদি বিরোধিতা করে এবং আমাকে বা মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে বা তোমাদেরকে গালিগালাজ করে তবে জামাতের মনে রাখতে হবে- তারা আমাদের ভাই, তারা এক ভ্রান্তিতে নিপতিত; তাদের প্রতি রাগান্বিত হওয়ার পরিবর্তে তাদের জন্য দোয়া কর এবং ভদ্রভাবে তাদেরকে প্রকৃত সত্য সম্বন্ধে অবগত কর। তোমরা যখন তাদেরকে প্রকৃত সত্য অনুধাবন করাবে, তখন তারা বুঝতে পারবে, আমরা মহানবী (সা.)-এর শত্রু নই, বরং তাঁর (সা.) সত্যিকার প্রেমিক; আর সেই মানুষগুলোই, যারা আজ আমাদেরকে মারতে উদ্যত, তারা আমাদের জন্য প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবে না। হুযূর (আই.) বলেন, তাই আমাদেরকে বিরুদ্ধবাদীদের জন্য দোয়া করতে হবে।

হযরত মৌলভী আব্দুল করীম সাহেব শিয়ালকোটি (রা.) মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বাড়ির চিলেকোঠায় থাকতেন। একরাতে তিনি শুনতে পান, কেউ এমনভাবে কাঁদছে যেভাবে প্রসববেদনায় জর্জরিত এক নারী কাঁদে। তিনি আশ্চর্য হয়ে কান পেতে শোনেন। তিনি শুনতে পান, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) কেঁদে কেঁদে দোয়া করছেন, ‘হে খোদা, প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে আর মানুষ এতে মারা যাচ্ছে। হে খোদা, যদি সব মানুষ এভাবে মারা যায়, তবে তোমার প্রতি কে ঈমান আনবে?’ প্লেগ সেই নিদর্শন, যার ভবিষ্যদ্বাণী স্বয়ং মহানবী (সা.) করেছিলেন এবং মসীহ্ মওউদ (আ.) নিজেও এর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন; কিন্তু নিজের সত্যতার নিদর্শন হওয়া সত্ত্বেও তিনি মানুষের মঙ্গলার্থে এটি দূর করার জন্য এভাবে কেঁদে কেঁদে দোয়া করতেন! এত্থেকে বুঝা যায়, মু’মিন জনসাধারণের বিরুদ্ধে দোয়া করে না, কারণ সে তো তাদের রক্ষা করার জন্যই দাঁড়ায়। সে যদি তাদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করে, তবে সে রক্ষা করবে কাকে? আহমদীয়াত প্রতিষ্ঠিতই হয়েছে মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য; যাদেরকে রক্ষার জন্য আমাদেরকে দাঁড় করানো হয়েছে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে কীভাবে দোয়া করতে পারি?

হুযূর (আই.) বলেন, আমরা জানি আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে একদল এমন রয়েছে যারা জেনে-বুঝে আমাদের বিরোধিতা করে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই না জেনে-না বুঝে বিরোধিতা করে; পাকিস্তান এবং অন্যান্য স্থানে অধিকাংশ মানুষের অবস্থা এমনই। কিন্তু তাদের এই বিরোধিতা আমাদের নেতা ও মনীব মুহাম্মদ (সা.)-কে ভালোবাসার কারণেই। যখন তারা বুঝতে পারবে, আমরা মহানবী (সা.)-এর প্রেমিক, তখন তারা উল্টো আমাদের সাহায্যার্থে ছুটে আসবে। এমন দিন অবশ্যই আসবে, ইনশাআল্লাহ্। কারণ ভুল আর কতদিন টিকে থাকবে? হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) একজন ইংরেজ লেখকের কথা একস্থানে বর্ণনা করেন। সে লিখেছিল, তুমি সারা পৃথিবীকে কিছুদিনের জন্য বোকা বানাতে পার, কিছু মানুষকে সবসময়ের জন্য বোকা বানাতে পার, কিন্তু সব মানুষকে সবসময়ের জন্য বোকা বানাতে পারবে না। সত্য একদিন প্রকাশ পাবেই পাবে। আর আমরা বাস্তবে এমনটিই দেখতে পাই। আহমদীয়া জামাত যে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা কীভাবে পাচ্ছে? তাদের মধ্য থেকেই মানুষ আহমদী হচ্ছে যারা একসময় আহমদীয়াতের চরম বিরোধিতায় লিপ্ত ছিল। এমন অনেক মানুষ হুযূর (আই.)-কে চিঠি লিখে জানিয়েও থাকেন যে, তারা একদা বিরোধী ছিলেন, পরবর্তীতে যখন দোয়া করেন এবং জামাতের বই-পুস্তক অধ্যয়ন করেন, তখন সত্য তাদের সমানে সুস্পষ্ট হয়ে যায়। এমনটি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যুগেও ঘটেছে, পরবর্তী খলীফাদের যুগেও ঘটেছে, এখনও ঘটছে। কাজেই, মৌলভীরা আমাদের বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যা বক্তব্য দেয়, এর মাধ্যমে আহমদীয়াতের আরও প্রচার ও প্রসার ঘটে থাকে, বিশেষভাবে সেই শ্রেণীতে যেখানে আমরা নিজেরা আহমদীয়াত প্রচার করতে পারি না। আমরা তো তাদের জন্যও দোয়া করি যেন আল্লাহ্ তাদেরকে সুবুদ্ধি ও বিবেক দান করেন; কিন্তু সাধারণ মুসলমানদের জন্যও আমাদের অনেক বেশি দোয়া করা উচিত, যেন তারা মৌলভীদের খপ্পর থেকে, তাদের প্রতারণা থেকে মুক্তি পায়। তাই আমাদের কাজ হল, দোয়া করতে থাকা এবং ধৈর্য ধারণ করা, আর এটিই সেই সর্বোত্তম পন্থা, যার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সাফল্যমণ্ডিত করবেন, ইনশাআল্লাহ্। আমাদের দায়িত্ব হল, আমরা যেন মুসলমানদের জন্য নিজেদের আবেগ-অনুভূতি পরিষ্কার রাখি, তাদের জন্য দোয়া করি- যেন আল্লাহ্ তা’লা দ্রুত তাদের দৃষ্টি উন্মোচন করেন আর তারা যুগের ইমামকে চিনতে ও মানতে সক্ষম হয়। (আমীন)