শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ: হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৩-এপ্রিল, ২০২১

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৩শে এপ্রিল, ২০২১ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)’র স্মৃতিচারণের ধারা আরম্ভ করেন।

তাশাহহুদ, তা’ঊয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, আজ আমি হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.)’র স্মৃতিচারণ করব। হযরত উমর (রা.) কুরাইশদের বনু আদী বিন কা’ব বিন লুঈ গোত্রের সদস্য ছিলেন। তার পিতার নাম ছিল, খাত্তাব বিন নুফায়েল এবং মায়ের নাম ছিল হানতামা বিনতে হাশেম; তার মা আবু জাহলের চাচাতো বোন ছিলেন। অপর এক বর্ণনামতে তার মায়ের নাম ছিল হানতামা বিনতে হিশাম, অর্থাৎ তিনি আবু জাহলের আপন বোন ছিলেন; অবশ্য এই বর্ণনাটি নির্ভরযোগ্য নয়। হযরত উমর (রা.) কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে সম্পর্কে একাধিক অভিমত রয়েছে। একটি বর্ণনামতে হযরত উমর (রা.) বড় ফুজ্জারের যুদ্ধের চার বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন, আরেক বর্ণনামতে তিনি সেই যুদ্ধের চার বছর পরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর (আই.) যুদ্ধের নাম ‘ফুজ্জার’ হওয়ার কারণও তুলে ধরেন; এই যুদ্ধটি যুদ্ধের জন্য নিষিদ্ধ মাসে সংঘটিত হয়েছিল, যা এক জঘন্য পাপ বলে গণ্য হতো; এ কারণে যুদ্ধটির এরূপ নাম দেওয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধটি কুরাইশ ও বনু কিনানা এবং বনু হাওয়াযিন গোত্রের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। অপর এক বর্ণনামতে হযরত উমর (রা.) হস্তি-বাহিনীর আক্রমণের ঘটনার ১৩ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন; এই বর্ণনানুসারে তিনি ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তৃতীয় আরেকটি অভিমত হল, তিনি নবুওয়তের ৬ষ্ঠ বছরে ইসলামগ্রহণ করেন, যখন তাঁর বয়স ছিল ২৬ বছর; এই হিসেবে তার জন্ম ৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে হওয়ার কথা। চতুর্থ অভিমত হল, মহানবী (সা.)-এর বয়স যখন ২১ বছর, তখন হযরত উমর (রা.) জন্মগ্রহণ করেন।

হযরত উমর (রা.)’র ডাকনাম ছিল আবু হাফস; এই নাম স্বয়ং মহানবী (সা.) তাকে প্রদান করেছিলেন। বদরের যুদ্ধের দিন যখন মহানবী (সা.) জানতে পারেন, বনু হাশেম এবং আরও কতিপয় ব্যক্তি কুরাইশদের চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে যুদ্ধে এসেছে, অথচ তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে সম্মত ছিল না- তখন তিনি (সা.) তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করতে বারণ করেন। বস্তুত মহানবী (সা.) বনু হাশেমের সদস্যদের, আবুল বাখতারী এবং তাঁর চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবকে হত্যা করতে নিষেধ করেন। কিন্তু একজন সাহাবী আবু হুযায়ফাহ্ বিন উতবাহ্ (রা.) মন্তব্য করেন, ‘আমরা নিজেদের বাবা, ভাইসহ নিকটাত্মীয়দের হত্যা করব আর আব্বাসকে ছেড়ে দেব! আল্লাহ্‌র কসম, যদি যুদ্ধক্ষেত্রে আব্বাসের সাথে আমার দেখা হয়, তাহলে আমি অবশ্যই তাকে তরবারি দিয়ে হত্যা করব!’ একথা মহানবী (সা.)-এর কর্ণগোচর হলে তিনি হযরত উমর (রা.)-কে বলেন, ‘হে আবু হাফস! আল্লাহ্‌র রসূলের চাচার মুখে তরবারি দিয়ে আঘাত করা হবে?’ হযরত উমর বলেন, এই ‘আবু হাফস’ নামটি সেদিনই তিনি সর্বপ্রথম রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মুখে শোনেন; তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে নিবেদন করেন, যে এরূপ ধৃষ্ট মন্তব্য করেছে, অনুমতি পেলেই তিনি তাকে হত্যা করবেন। হযরত আবু হুযায়ফাহ্ (রা.) তার এই মন্তব্যের জন্য খুবই অনুতপ্ত ছিলেন এবং মনেপ্রাণে শাহাদতের আকাঙক্ষা করতেন, যেন তা তার এই কথার প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ হয়। অতঃপর ইয়ামামার যুদ্ধের দিন তিনি শাহাদত বরণ করেন।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) হযরত উমর (রা.)-কে ‘ফারুক’ উপাধি প্রদান করেছিলেন। এর প্রেক্ষাপট হযরত উমর (রা.)’র ইসলাম গ্রহণের সাথে সম্পৃক্ত। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হযরত উমর (রা.)’র কাছে তাঁর এই উপাধি প্রাপ্তির কারণ জানতে চাইলে তিনি (রা.) সেই ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, হযরত হামযাহ্ (রা.) তার চেয়ে তিন দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, আর হযরত হামযাহ্ (রা.)’র ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটিও বলেন। এর তিনদিন পর হযরত উমর (রা.) রাস্তায় বের হলে বনু মখযুম গোত্রের একজন নবদীক্ষিত মুসলমানের সাথে তাঁর দেখা হয়। উমর (রা.) তাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য ভর্ৎসনা করলে সেই ব্যক্তি উমর (রা.)-কে তাঁর বোন ও ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের কথা বলেন। উমর (রা.) সাথে সাথে বোনের বাড়িতে যান, গিয়ে দেখেন, ঘরের দরজা বন্ধ এবং ভেতরে ফিসফিসিয়ে কিছু পড়া হচ্ছে। উমর (রা.)’র সাড়া পেয়ে যখন তারা দরজা খোলেন তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন এবং তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায়; এক পর্যায়ে তিনি ভগ্নিপতিকে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলেন। এ সংক্রান্ত অন্যান্য বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি নিজের বোনকেও আঘাত করে রক্তাক্ত করে ফেলেছিলেন। যাহোক, রক্ত দেখে হযরত উমর (রা.) কিছুটা লজ্জিত ও অনুতপ্ত হন এবং অনুতাপ থেকেই তিনি তাদের কাছে সেই গ্রন্থ দেখতে চান। তাঁর বোন তাঁকে পবিত্র হয়ে আসতে বলেন, উমর (রা.) তখন গোসল করে আসেন। অতঃপর যখন তাঁকে কুরআনের বাণী পড়তে দেয়া হয়, যা ছিল সূরা ত্বাহার প্রথম নয়টি আয়াত, তখন তা হযরত উমর (রা.)’র হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং তিনি মনে মনে ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেন। তিনি জানতে চান, মহানবী (সা.) কোথায় আছেন। যখন তাকে জানানো হয়, তিনি (সা.) দ্বারে আরকামে আছেন, তখন তিনি সাথে সাথে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। উমরকে দেখে উপস্থিত সাহাবীরা দরজা খুলতে দ্বিধা করছিলেন, কিন্তু হযরত হামযাহ্ (রা.) বলেন দরজা খুলে দাও, যদি উমর অসদুদ্দেশ্যে এসে থাকে, তবে আমরাও উমরকে হত্যা করতে সক্ষম। হৈচৈ শুনে মহানবী (সা.)-ও বাইরে আসেন, তখন হযরত উমর (রা.) কলেমা শাহাদত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন, আর সেখানে উপস্থিত সব সাহাবী উচ্চস্বরে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চকিত করেন। হযরত উমর (রা.)’র আবেদনের প্রেক্ষিতে মহানবী (সা.) সবাইকে নিয়ে কা’বার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সাহাবীরা দুই সারিতে ভাগ হয়ে কা’বা চত্বরে প্রবেশ করেন, একটি সারির সামনে ছিলেন হযরত উমর (রা.) এবং অপরটির সামনে ছিলেন হযরত হামযাহ্ (রা.)। এটি দেখে কাফিররা যারপরনাই আশ্চর্য্য হয়। এই ঘটনার পর মহানবী (সা.) তাঁকে ‘ফারুক’ উপাধি প্রদান করেন, কারণ তাঁর মাধ্যমে ইসলাম শক্তি লাভ করে এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে যায়। আইয়ূব বিন মূসা বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.) বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা’লা সত্যকে উমরের কথায় ও তাঁর হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন; আর সে ফারুক, কারণ আল্লাহ্ তা’লা তাঁর মাধ্যমে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে দিয়েছেন।’

হযরত উমর (রা.) দীর্ঘকায় ও সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন, তাঁর মাথার সামনের দিকে টাক ছিল, গায়ের রং ছিল লালচে ফর্সা। অজ্ঞতার যুগে হযরত উমর (রা.)’র শখ ছিল অশ্বারোহণ ও কুস্তি লড়া; প্রতিবছর উক্কাযের যে মেলা হতো, তাতে অধিকাংশ সময় তিনিই কুস্তিতে জয়ী হতেন। যুবক বয়সে আরবের প্রচলিত রীতি অনুসারে তিনি তাঁর পিতার উষ্ট্রপালও চরাতেন। ইসলামপূর্ব যুগে আরবে লেখাপড়ার প্রচলন ছিল না বললেই চলে; সেই যুগে কুরাইশদের মধ্যে কেবল ১৭ ব্যক্তি লিখতে পারতো। হযরত উমর (রা.) তাদের একজন ছিলেন। তিনি কুরাইশদের সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য হতেন; ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কুরাইশরা বিভিন্ন যুদ্ধ, বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্য এবং অন্য গোত্রের সাথে সংলাপের জন্য হযরত উমর (রা.)-কে নিজেদের দূত হিসেবে প্রেরণ করতো।

হযরত উমর (রা.) যদিও অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ এবং ইসলাম-বিদ্বেষী ছিলেন, কিন্তু সেই সময়েও এমন ঘটনা ঘটেছে যা থেকে তাঁর হৃদয়ের নম্রতা ও কোমলতা সম্পর্কে জানা যায়। কুরাইশদের অত্যাচারের কারণে মক্কার মুসলমানরা মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে আবিসিনিয়ায় হিজরত করছিলেন। এমনই এক দম্পতি ছিলেন হযরত উম্মে আব্দুল্লাহ্ ও আমের বিন রবীআ (রা.)। তাদের বাড়ির উঠোনে হিজরতের সাজসরঞ্জাম স্তুপিকৃত ছিল এবং হযরত আমের (রা.) কোন কারণে বাইরে গিয়েছিলেন; এমন সময় সেখানে হযরত উমর (রা.) এসে উপস্থিত হন এবং উম্মে আব্দুল্লাহ্‌কে প্রশ্ন করেন, তারা কোথাও চলে যাচ্ছেন কি-না? উম্মে আব্দুল্লাহ্ প্রত্যুত্তরে বলেন, যেহেতু উমরসহ কুরাইশরা তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য অনেক কষ্ট দিয়েছে, অত্যাচার করেছে এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্মকর্ম করতে দিচ্ছে না- তাই তারা মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তার এরূপ অভিমানপূর্ণ উত্তর শুনে উমর (রা.) আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন; তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং বলেন, ‘আল্লাহ্ তোমাদের সহায় হোন।’ যখন আমের বিন রবীআ (রা.) ফিরে আসেন, তখন উম্মে আব্দুল্লাহ্ (রা.) তাকে এই বৃত্তান্ত শোনান। আমের মন্তব্য করেন, এটা দেখে ভাবার কোন অবকাশ নেই যে, উমর কোনদিন ইসলাম গ্রহণ করবে; বরং তাঁর গাধাও ইসলাম গ্রহণ করতে পারে, সে নয়। আসলে হযরত উমরের কঠোরতা ও ইসলাম-বিদ্বেষের কারণে হতাশ হয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু যেমনটি উম্মে আব্দুল্লাহ্ (রা.)’র বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, হযরত উমর (রা.)’র কঠোর আবরণের ভেতরে একটি সুপ্ত কোমল হৃদয়ও ছিল।

হযরত উমর (রা.)’র ইসলাম গ্রহণের জন্য মহানবী (সা.) দোয়াও করেছিলেন। এ সংক্রান্ত একাধিক বর্ণনা হুযূর (আই.) তুলে ধরেন। হযরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) দোয়া করেছিলেন- ‘হে আল্লাহ্! তুমি উমর বিন খাত্তাব ও আবু জাহল-এই দু’জনের মধ্যে যে তোমার অধিক প্রিয়, তার মাধ্যমে ইসলামকে সম্মান দান কর।’ হযরত উমর (রা.)’র ইসলাম গ্রহণের একদিন পূর্বেও মহানবী (সা.) এই দোয়া করেছিলেন বলে জানা যায়। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ্, তুমি বিশেষভাবে উমর বিন খাত্তাবের মাধ্যমে ইসলামকে সম্মান দান কর।’ তাবাকাতুল কুবরায় বর্ণিত হয়েছে, হযরত উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার পর হযরত জীব্রাঈল অবতীর্ণ হন এবং বলেন, ‘উমরের ইসলাম গ্রহণের ফলে আকাশের অধিবাসীরাও আনন্দিত হয়েছেন।’

হযরত উমর (রা.) নবুয়্যতের ষষ্ঠ বছরের যিলহজ্জ মাসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস ও ইতিহাসগ্রন্থে পৃথক পৃথক বর্ণনা পাওয়া যায়। এরূপ সাতটি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা হুযূর (আই.) খুতবায় উপস্থাপন করেন। সীরাতুল হালবিয়াতে বর্ণিত হয়েছে, একবার আবু জাহল কুরাইশদের মাঝে ঘোষণা দেয়- যে ব্যক্তি মুহাম্মদকে (সা.) হত্যা করবে, তাকে সে একশ’ লাল উট ও এক হাজার রূপার অওকিয়া বা মোহর, কস্তুরি, মূল্যবান পোশাক ইত্যাদি পুরস্কার দেবে। এই ঘোষণা শুনে উমর (রা.) বলেন, তিনি এই কাজ সমাধা করে পুরস্কার গ্রহণ করবেন। এই লক্ষ্যে তিনি উন্মুক্ত তারবারি নিয়ে রওয়ানা হলে পথিমধ্যে একস্থানে একটি জবাই করা গরুর বাছুরের ভেতর থেকে আল্লাহ্‌র একত্ববাদ ও মুহাম্মদ (সা.)-এর আল্লাহ্‌র রসূল হওয়ার অশরীরি ঘোষণা শুনতে পান; এর ফলে হযরত উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। হুযূর (আই.) মন্তব্য করেন, যদি এই বর্ণনা সঠিক হয়ে থাকে, তবে এই বাছুরের ঘটনাটি সম্ভবত হযরত উমর (রা.)’র একটি দিব্যদর্শন ছিল। আরেকটি বর্ণনামতে একদিন হযরত উমর (রা.) কা’বা প্রদক্ষিণ করার জন্য কা’বা চত্বরে গেলে সেখানে মহানবী (সা.)-কে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে দেখেন। উমর মহানবী (সা.)-এর কুরআন তিলাওয়াত শোনার জন্য কান পাতেন এবং কুরআনের বাণী শুনে তাঁর হৃদয় বিগলিত হয়; তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে ইসলামের সত্যতা বুঝতে পারেন। নামায শেষে মহানবী (সা.)-এর ফেরার সময় উমর (রা.)-ও তাঁর পেছন পেছন যান এবং মহানবী (সা.)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। প্রায় একই রকম আরেকটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, পার্থক্য হল, হযরত উমর (রা.) একদিন রাতে তাঁর বোনের প্রসব-বেদনার কষ্ট লাঘবের জন্য কা’বাগৃহে গিয়ে দোয়া করছিলেন, তখন মহানবী (সা.) সেখানে উপস্থিত হন; অবশিষ্ট ঘটনা প্রায় পূর্বের ঘটনার অনুরূপ। পঞ্চম বর্ণনাটি সবচেয়ে প্রসিদ্ধ; হযরত উমর (রা.) মহানবী (সা.)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন, পথে আরেকজন মুসলমানের সাথে তাঁর দেখা হলে তিনি উমরকে নিজের বাড়ির খোঁজ নিতে বলেন এবং তাঁর বোন ও ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে অবগত করেন। হযরত উমর (রা.) বোনের বাড়িতে গিয়ে বোন ও ভগ্নিপতিকে মারধর করে রক্তাক্ত করেন, অতঃপর রক্ত দেখে অনুতপ্ত হয়ে তাদের কাছে কুরআন দেখতে চান। অতঃপর সূরা ত্বাহার আয়াতগুলো শুনে তাঁর মন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অতঃপর হযরত উমর (রা.) দ্বারে আরকামে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এই ঘটনাটি হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) বর্ণনা করেছেন এবং হুযূর (আই.) হযরত খাব্বাব (রা.)’র স্মৃতিচারণের সময়ও এটি উল্লেখ করেছিলেন। এর অনুরূপ আরেকটি বর্ণনাও রয়েছে, পার্থক্য হল, তাতে সূরা ত্বাহার পরিবর্তে সূরা হাদীদের উল্লেখ রয়েছে। ষষ্ঠ একটি বর্ণনাও রয়েছে, যেখানে কা’বা চত্বরে মহানবী (সা.)-এর সূরা হাক্কার আয়াতসমূহ পাঠের উল্লেখ রয়েছে এবং একের পর এক সূরা হাক্কার আয়াতগুলোর মাধ্যমে হযরত উমর (রা.)’র মনে সৃষ্ট বিভিন্ন কুধারণা অপনোদন হওয়ার ফলে ইসলামের সত্যতা তাঁর সামনে সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার এবং তাঁর ইসলাম গ্রহণের উল্লেখ রয়েছে। হযরত উমর (রা.)’র ইসলাম গ্রহণের সপ্তম একটি বর্ণনাও হুযূর (আই.) সহীহ বুখারী থেকে উদ্ধৃত করেন। হুযূর (আই.) মন্তব্য করেন, ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে তো এরূপ বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি বর্ণিত, যৌক্তিক ও অধিক গ্রহণযোগ্য বর্ণনা হল, হযরত উমর (রা.)’র মহানবী (সা.)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে বের হয়ে ঘটনাচক্রে নিজ বোন ও ভগ্নিপতির বাড়িতে যাওয়া এবং অবশেষে ইসলাম গ্রহণ করা। হুযূর (আই.) আরও বলেন, হতে পারে, সম্ভবত হযরত উমর (রা.)’র ইসলাম গ্রহণ সংক্রান্ত এই সবগুলো ঘটনাই সঠিক; বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত এসব ঘটনার ফলে হযরত উমর (রা.)’র হৃদয়ে ইসলামের সত্যতা বদ্ধমূল হতে থাকে আর চূড়ান্ত পর্যায়ে, তিনি দ্বারে আরকামে গিয়ে ইসলাম গ্রহণের প্রকাশ্য ঘোষণা প্রদান করেন। ইসলাম গ্রহণের সময় হযরত উমর (রা.)’র বয়স ৩৩ বছর, মতান্তরে ২৬ বছর ছিল। হযরত উমর (রা.)’র ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানরা অনেকটা শক্তি ও সাহস অর্জন করে, তারা প্রকাশ্যে কা’বা চত্বরে গিয়ে নামায পড়ে এবং প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার-প্রচারণা আরম্ভ হয়; দ্বারে আরকামে ইসলাম গ্রহণকারী শেষ ব্যক্তি ছিলেন হযরত উমর (রা.)। তাঁর স্মৃতিচারণ আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে হুযূর (আই.) জানান।

খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) সম্প্রতি প্রয়াত কয়েকজন নিষ্ঠাবান আহমদীর গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন এবং তাদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন। প্রয়াতরা হলেন, ইয়েমেনের প্রথমদিকের আহমদী ও আদন জামাতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোকাররম আহমদ মুহাম্মদ উসমান শুবুতি সাহেব, জলসা সালানা দপ্তরের একাউন্টেন্ট মোকাররম কুরাইশী যাকাউল্লাহ্ সাহেব, কানাডা-প্রবাসী পাকিস্তানের মোকাররম মালেক খালেদ দাদ সাহেব, নাযারত উমুরে আম্মা বিভাগের কর্মচারী মোকাররম মোহাম্মদ সেলিম সাবের সাহেব, সাহেবযাদা আব্দুল লতীফ শহীদ সাহেবের পৌত্র সাহেবযাদা মাহদী লতীফ সাহেবের সহধর্মিণী যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী মোকাররমা নাঈমা লতীফ সাহেবা এবং মুহাম্মদ শরীফ সাহেবের সহধর্মিণী কানাডা-প্রবাসী মোকাররমা সাফিয়া বেগম সাহেবা। হুযূর (আই.) প্রয়াতদের রূহের মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করেন এবং তাদের পদমর্যাদার উন্নতির জন্য দোয়া করেন। (আমীন)