প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.)-এর রচনার আলোকে: দোয়ার গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং দোয়া কবুল হওয়ার শর্ত ও পদ্ধতি

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৬-এপ্রিল, ২০২১

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৬ই এপ্রিল, ২০২১ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় রমযানের আগমন উপলক্ষ্যে প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.)-এর রচনার আলোকে: দোয়ার গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং দোয়া কবুল হওয়ার শর্ত ও পদ্ধতি নিয়ে খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহহুদ, তা’ঊয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) সূরা বাকারার ১৮৪-১৮৭ নং আয়াত পাঠ করেন,


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ * أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ * شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ * وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ

এর বঙ্গানুবাদ হল: ‘হে যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের ওপর রোযা সেভাবেই বিধিবদ্ধ করা হল যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর তা বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করতে পার। হাতেগোণা কয়েকটি দিন! আর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ বা ভ্রমণরত থাকে, সে যেন সমসংখ্যক রোযা অন্য সময়ে পূর্ণ করে। আর যারা সামর্থ্য রাখে তাদের জন্য ফিদিয়া হল, একজন মিসকিনকে আহার্য দান করা; আর যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত পুণ্যকর্ম করে তা তারই জন্য কল্যাণকর। আর যদি তোমরা জানতে (তাহলে বুঝতে পারতে,) রোযা রাখাই তোমাদের জন্য উত্তম। রমযান সেই মাস, যে মাসে কুরআনকে মানুষের জন্য এক মহান হিদায়াত (পথনির্দেশ) হিসেবে অবতীর্ণ করা হয়েছে, আর এমন প্রকাশ্য নিদর্শনরূপে (অবতীর্ণ করা হয়েছে) যার মধ্যে হিদায়াতের বিস্তারিত এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণকারী বিষয়াবলী রয়েছে। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে-ই এই মাস পায়, সে যেন তাতে রোযা রাখে। আর যে অসুস্থ বা ভ্রমণরত থাকে, তাকে সমসংখ্যক রোযা অন্য সময়ে পূর্ণ করতে হবে। আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সাচ্ছন্দ্য চান এবং তোমাদের জন্য কাঠিন্য চান না; আর তিনি চান যেন তোমরা স্বচ্ছন্দ্যে গণনা পূর্ণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে পথনির্দেশ দিয়েছেন- তার জন্য আল্লাহ্‌র মাহাত্ম্য ঘোষণা কর, আর যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আর আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে, তখন (বল) নিশ্চয় আমি তাদের নিকটেই থাকি; আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনার উত্তর দেই, যখন সে আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই, তাদের উচিত তারাও যেন আমার আহ্বানে সাড়া দেয় আর আমার প্রতি ঈমান আনে, যেন তারা হিদায়াত লাভ করে।’

হুযূর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় এবছর আবারও আমরা রমযান মাস অতিক্রম করার সৌভাগ্য লাভ করছি; আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত, কেবল রমযান মাস পাওয়া এবং তা অতিবাহিত করাই যথেষ্ট নয়, কিংবা কেবল ভোরবেলা সেহেরী খেয়ে রোযা রাখা ও সন্ধ্যায় ইফতারী করাই রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য পূর্ণ করে না। বরং আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এই রোযার সাথে এবং এই রোযার ফলে নিজেদের মাঝে এক পবিত্র পরিবর্তন সৃষ্টিরও নির্দেশ দিয়েছেন। রোযার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে কিছু নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর ফলশ্রুতিতে আমাদেরকে তাঁর নৈকট্য লাভ ও দোয়া গৃহীত হওয়ার সুসংবাদ দান করেছেন।

হুযূর (আই.) এরপর খুতবার শুরুতে পঠিত আয়াতগুলোর বিষয়বস্তু সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেন; যাতে আল্লাহ্ তা’লা রোযা আবশ্যকতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আর একইসাথে বলেছেন, অসুস্থতা বা অন্য কোন বৈধ কারণ থাকলে পরবর্তীতে সেই রোযাগুলো পূর্ণ করতে হবে, কিংবা অসুস্থতা যদি এমন দীর্ঘ হয় যে, বছরের অন্য দিনেও ভাঙ্গা রোযা রাখা সম্ভব নয়- তবে ফিদিয়া দিতে হবে। কিন্তু এ-ও মনে রাখা দরকার, পরবর্তীতে যদি রোযা রাখার সামর্থ্য সৃষ্টি হয়, তবুও ফিদিয়া দেয়া মঙ্গলজনক, যদি তা দেয়ার সাধ্য থাকে। এরপর পবিত্র কুরআনের গুরুত্ব ও এর অবতরণের উল্লেখ করে বলেছেন, কুরআন পড়া ও এর নির্দেশাবলী পালন করা আমাদের জন্য ঈমানে দৃঢ়তা লাভের, আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ও তাঁর প্রেরিত শিক্ষামালা বোঝার মাধ্যম। আর এরপর আমাদেরকে এই সুসংবাদও দিয়েছেন যে, তিনি আমাদের নিকটেই আছেন, তিনি আমাদের দোয়া শোনেন ও কবুল করেন; কিন্তু একইসাথে এটিও বলে দিয়েছেন যে, আমরা যদি চাই তিনি আমাদের দোয়া কবুল করেন, তাহলে আমাদেরকেও তাঁর কথা মানতে হবে, তাঁর নির্দেশাবলী পালন করতে হবে। আর কেবল রমযান মাসেই নয়, বরং এই পুণ্যগুলোকে নিজেদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করতে হবে, আর ঈমানকে সুদৃঢ় করতে হবে। যখন আমরা এই শর্তগুলো পালন করে নিজেদের দোয়ায় সৌন্দর্য সৃষ্টি করব, তখন আল্লাহ্ তা’লাকেও আমাদের নিকটে এবং দোয়া শ্রবণকারী রূপে দেখতে পাব।

হুযূর (আই.) বলেন, আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে যারা ভাসাভাসাভাবে একটু দোয়া করেই বলে বসে, ‘আল্লাহ্ তা’লা আমার দোয়া কবুল করেন নি।’ ভাবটা এমন যেন ‘আল্লাহ্ তা’লাকে আমরা একটা কাজ করতে বলেছিলাম যা তাঁর করা উচিত ছিল, আর তিনি তা করেন নি’! যেন আল্লাহ্ তাদের হুকুমের গোলাম; যেভাবে তারা বলবে তাঁকে তাই করতে হবে, (নাঊযুবিল্লাহ্)। আল্লাহ্ তা’লা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন- সেটা হবে না! প্রথমে আল্লাহ্‌র কথা মানতে হবে, নিজেদের কর্মকে কুরআনের অনুশাসনের অধীন করতে হবে, নিজেদের ঈমানকে সুদৃঢ় করতে হবে, তাঁর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে হবে। এভাবে বান্দা যখন নিজের কর্মের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে, তখন আল্লাহ্‌র দয়া ও কৃপা উদ্বেলিত হয়। তাই এই বিষয়টি অনুধাবন করা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরপর হুযূর (আই.) দোয়ার গুরুত্ব, আমাদের ব্যবহারিক অবস্থায় পরিবর্তন সৃষ্টির সাথে দোয়া গৃহীত হওয়ার সম্পর্ক, দোয়া কবুল হওয়ার শর্তাবলী, এর দর্শন ও এর গভীরতা সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনাসমগ্র হতে বিভিন্ন উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) প্রসঙ্গক্রমে মন্তব্য করেন, দোয়া ইসলামের অহংকার এবং মুসলমানদের গর্ব; কিন্তু একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, দোয়া কেবলমাত্র কিছু বুলি আওড়ানোর নাম নয়। দোয়া সেই জিনিস যার দ্বারা হৃদয় আল্লাহ্‌র ভয়ে পূর্ণ হয়ে যায় এবং দোয়াকারীর আত্মা পানির মতো বিগলিত হয়ে আল্লাহ্‌র দরবারে গিয়ে উপস্থিত হয়, আর নিজের দুর্বলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে সর্বশক্তিমান খোদার কাছে শক্তি, সামর্থ্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করে। এটি সেই অবস্থা যাকে অন্য কথায় এক প্রকার মৃত্যু বলা যেতে পারে। মানুষের ভেতর যখন এরূপ অবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন নিশ্চিতভাবে আশা করা যায়, তার জন্য কবুলিয়্যতের দ্বার উন্মুক্ত করা হবে। হুযূর (আই.) বলেন, এটি হল, দোয়া করার, আল্লাহ্ তা’লাকে পাবার, দোয়া কবুল করানোর এবং পাপ থেকে রক্ষা পাবার পদ্ধতি। আজকাল এই প্রশ্ন খুব বেশি করা হয় যে, ‘আমরা কীভাবে বুঝব, আমাদের পাপ ক্ষমা করা হয়েছে আর আল্লাহ্ তা’লা আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট?’ এস্থলে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) উক্ত প্রশ্নের উত্তরে একটি মৌলিক বিষয় বলে দিয়েছেন যে, যদি আল্লাহ্ তা’লার সাথে প্রকৃত ও স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়, তবে আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে এমন কৃপা হয় যে, মানুষ পাপ থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা পাবার সামর্থ্য লাভ করে; উপরন্তু স্থায়ী পুণ্যকর্ম করার শক্তি অর্জন করে। যদি এমন অবস্থা সৃষ্টি না হয়, তবে আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের দাবি ভ্রান্ত। তাই এই রমযানে এটি অর্জন করার জন্য আমাদের অনেক চেষ্টা করা উচিত।

দোয়া কবুলিয়্যতের বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে মসীহ্ মওউদ (আ.) একস্থানে বলেন, দোয়া কবুল হওয়ার বিষয়টি আসলে দোয়া বিষয়টির-ই একটি শাখা; যে ব্যক্তি মূলকেই বুঝতে সক্ষম হয় নি, সে শাখা কীভাবে বুঝবে? দোয়ার বৈশিষ্ট্যই হল, একজন পুণ্যবান বান্দা ও তার প্রভু-প্রতিপালকের মধ্যে একপ্রকার আকর্ষণ থাকে; প্রথমে খোদা তা’লার রহমানিয়্যত বান্দাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে, এরপর বান্দার নিষ্ঠার আকর্ষণে আল্লাহ্ তা’লাও তার নিকটে চলে আসেন। বান্দা যখন চরম বিপদে নিপতিত হয়ে পরিপূর্ণ বিশ্বাস, আশা, ভালোবাসা ও নিষ্ঠার সাথে খোদা তা’লার প্রতি বিনত হয় এবং সব উদাসীনতা ছিন্ন করে ‘ফানা’ বা আত্মনিবেদনের পথে অগ্রসর হয়, তখন সহসাই সে দেখতে পায়, সে খোদা তা’লার দরবারে উপস্থিত, আর সেখানে কেবল সে একাই রয়েছে। তখন একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর সবকিছু তার দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়, পৃথিবী বা এর কোন কিছুই তার কাছে আর বিন্দুমাত্র মূল্য রাখে না। আর তখন বান্দার মধ্যে আল্লাহ্ তা’লা প্রকৃতিগতভাবেই যে আকর্ষণশক্তি নিহিত রেখেছেন, সেটি আল্লাহ্ তা’লার কৃপারাজিকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। তখন আল্লাহ্ তা’লা বান্দার সেই প্রয়োজন পূরণ করার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং সেই কার্য সাধিত হওয়ার জন্য যেসব বাহ্যিক উপকরণ প্রয়োজন, সেগুলো ঐশী প্রভাবে প্রভাবিত হয় এবং সেই কার্য সাধিত হয়। নবী-রসূলগণ এবং ওলী-আউলিয়াদের মাধ্যমে যে হাজার হাজার মু’জিযা বা অলৌকিক নিদর্শন প্রদর্শিত হয়েছে, আসলে দোয়া-ই সেগুলোর প্রকৃত উৎস। হুযূর (আই.) বলেন, কুরআন শরীফে যে অজস্র ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে বা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ্ রয়েছে, কিংবা অনেক মানুষ যারা সত্যস্বপ্ন দেখেছেন- এগুলো সবই তখন সংঘটিত হয়, যখন বান্দা নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্‌র প্রতি বিনত হয়।

অপর একস্থানে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) কুরআন শরীফের আয়াত

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا

অর্থাৎ ‘যারা আমাদের পথে চেষ্টা-সাধনা করবে, আমরা তাদেরকে আমাদের পথ দেখিয়ে দেব’ (সূরা আন্‌কাবূত: ৭০)

-এর প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করেন, প্রথমে চেষ্টা বান্দাকে করতে হয়; একইসাথে আল্লাহ্ তা’লা اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ দোয়াও শিখিয়েছেন; মানুষের উচিত এই দু’টো বিষয়কে দৃষ্টিপটে রেখে যেন নামাযে ক্রন্দন-আহাজারি করে দোয়া করে এবং আশা রাখে যে, সে-ও উন্নতি লাভকারী ও দৃষ্টিশক্তিপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। দৃষ্টিশক্তি বলতে সেই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিশক্তি বোঝানো হয়েছে, যা মানুষকে পরকালে দৃষ্টিশক্তি দান করবে। কেননা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা’লা এই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে,

مَنْ كَانَ فِي هَذِهِ أَعْمَى فَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ أَعْمَى

অর্থাৎ যে এই পৃথিবীতে অন্ধ, সে পরকালেও অন্ধই থাকবে; (সূরা বনী ইসরাঈল: ৭৩)

এই অন্ধত্ব অবশ্যই আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব। কাজেই, পরকালের প্রস্তুতি এই পৃথিবী থেকেই শুরু হওয়া উচিত, পরবর্তী জগতের জন্য প্রয়োজনীয় ইন্দ্রিয়রাজি এই জগৎ থেকেই ঠিক করে নিয়ে যেতে হয়। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন; মানুষ মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়ে ধর্মের অন্ধ অনুসরণ করেই ভাবে- সে প্রকৃত মুসলমান হয়ে গিয়েছে! কার্যত তার মাঝে ধর্মের প্রকৃত ভালোবাসা অনুপস্থিত। মোটকথা, আল্লাহ্ তা’লা শেখাচ্ছেন- তিনি দেয়ার জন্য বসে আছেন, বান্দা নেয়ার জন্য প্রস্তুত কি-না; নিজের মধ্যে সেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের জন্য আকাঙক্ষী কি-না? হুযূর (আই.) বলেন, এই দিনগুলোতে অনেক বেশি اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ দোয়া করা প্রয়োজন; যেন আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন, আমাদের হৃদয়গুলোকে পবিত্র করে তাঁর খাঁটি বান্দায় পরিণত করেন, আর তাঁর বান্দাদের প্রাপ্য অধিকার প্রদানকারী বানিয়ে দেন। (আমীন)

কিছু মানুষ আছে যারা বলে, ‘আমরা এতই পাপী যে, আল্লাহ্ আমাদেরকে ক্ষমা করবেন না।’ আসলে শয়তান তাদের মনে এই কুমন্ত্রণা সঞ্চার করেছে, আর এটি তাদের আরও পাপে ধৃষ্ট হওয়ার কারণ হয়ে থাকে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, কোন পাপী যেন তার পাপের আধিক্যের কারণে দোয়া করা থেকে বিরত না হয়, কারণ দোয়া নিজেই হল প্রতিষেধক; দোয়া করলে মানুষ দেখতে পাবে, এক পর্যায়ে গিয়ে যে পাপ করে সে আনন্দ পেত, যে পাপের প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করতো- সেই পাপ করতে তার কেমন খারাপ লাগে!! শয়তান তার কাছ থেকে দৌড়ে পালাবে!

মসীহ্ মওউদ (আ.) একস্থানে বলেন, আমার দয়ালু প্রভু আমাকে এই প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন যে, ‘উজিবু কুল্লা দুআইকা’ অর্থাৎ ‘আমি তোমার প্রতিটি দোয়া কবুল করব’; কিন্তু হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) স্বয়ং এর ব্যাখ্যা করে বলেন, এর অর্থ মোটেও এটি নয় যে, যা দোয়া করা হবে, তার সবগুলোই আল্লাহ্ কবুল করবেন; বরং যে দোয়া অমঙ্গলজনক, সেটি কবুল না করাই দোয়া কবুল হওয়া! মানুষ যেহেতু ক্ষীণদৃষ্টি রাখে ও অপরিণামদর্শী, তাই সে কখনো কখনো এমন বিষয় আল্লাহ্‌র কাছে চেয়ে বসে যা তার জন্য ক্ষতিকর। যেমন একটি অবুঝ শিশু মায়ের কাছে জ¦লন্ত অঙ্গার বা ধারালো ছুরি নিয়ে খেলা করার বায়না ধরে; কিন্তু সন্তানের প্রতি গভীর ভালোবাসা সত্ত্বেও মা তাকে এমন বিপজ্জনক বস্তু নিয়ে খেলতে দেয় না, বাচ্চা কেঁদে মরে গেলেও না! অনুরূপভাবে আল্লাহ্ও যখন দেখেন বান্দা এমন কোন বিষয়ে দোয়া করছে যা পরিণামে তার জন্য ক্ষতিকর, তখন তিনি তাকে তা দেন না; বরং যেটি তার জন্য কল্যাণকার- সেটি দান করেন। হুযূর (আই.) বলেন, কেউ কেউ তো এমনভাবেও দোয়া করে, ‘হে আল্লাহ্, এটি আমার জন্য মঙ্গলজনক না হলেও তুমি কবুল করে নাও!’ আর আল্লাহ্ তাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য কখনো কখনো কবুলও করেন; বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে এমন ঘটনাও ঘটেছে! পরিণাম এ-ই হয় যে, পরে গিয়ে মানুষ বুঝতে পারে, ঠেকে তারপর শেখে! হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) সেই ইলহামের বিষয়ে বলেন, যেহেতু কুরআনের শিক্ষা হল, مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ, আর দোয়ার এই কবুলিয়্যতও আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এক মহান রিয্‌ক- তাই জামাতের সদস্যরা দোয়ার আবেদন করুক বা না-ই করুক, তিনি (আ.) সবসময় তাদের জন্য দোয়া করেন। কিন্তু দোয়ার জন্য আবেদনকারীর জন্য আবশ্যক, তার হৃদয়ে যেন সর্বদা আল্লাহ্‌র ভয় বিরাজমান থাকে, সে যেন সন্ধি-স্থাপনকারী ও বিবাদ মিটিয়ে ফেলার মানসিকতা রাখে। যদি তার কর্ম এরূপ না হয়, সে আল্লাহ্‌র নির্দেশমত না চলে- তবে তার এরূপ কর্ম দোয়া কবুল হওয়ার পথে এক পাথর বা প্রতিবন্ধক হয়ে আটকে থাকে; তার নিজের দোয়াও কবুল হয় না আর অন্য কাউকে দিয়ে দোয়া করালেও তা কবুল হয় না। তিনি (আ.) জামাতকে সতর্ক করে বলেন, কেউ যেন এভাবে নিজের কর্ম দিয়ে তাঁর (আ.) করা মূল্যবান দোয়া ও সময়কে নষ্ট না করে! কুরআনে এসেছে, إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ (সূরা আল্ মায়েদা: ২৮) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’লা কেবল মুত্তাকীদের কাছ থেকেই তাদের দোয়া কবুল করেন। তাহলে এক ব্যক্তি পাপে লিপ্ত হয়েও এবং তওবা বা প্রত্যাবর্তন করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তওবা না করে কীভাবে আশা করে যে, তার দোয়া কবুল হবে? সে কি নিতান্তই মূর্খ নয় যে কুরআনের স্পষ্ট ভাষ্যের বিপরীতে গিয়েও আশা করে- তার দোয়া কবুল হবে?

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লার রহমত বা কৃপা দু’প্রকার- একটি হল রহমানিয়্যত, যা আমাদের অস্তিত্ব লাভের পূর্বেই আল্লাহ্ যেসব কৃপারাজি আমাদের জন্য সৃষ্টি করে রেখেছেন, সেটিকে বুঝায়, আর সব মানুষই এই গুণ থেকে উপকৃত হয়। আর দ্বিতীয় রহমত আল্লাহ্ তা’লার রহিমিয়্যতের সাথে সম্পৃক্ত, যখন বান্দা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করে এবং এরফলে তাঁর কৃপা লাভ করে। আল্লাহ্ তা’লার রহমানিয়্যত বান্দার মধ্যে সেই যোগ্যতা সৃষ্টি করে, যা তাকে তাঁর রহিমিয়্যত থেকে উপকৃত হবার যোগ্য করে তোলে। অতএব, এটি প্রকৃতির নিয়ম- যদি আমরা আল্লাহ্‌র প্রথমে দেয়া কৃপারাজির মূল্যায়ন না করি, সেগুলোকে কাজে না লাগাই, তবে আমরা কখনোই তাঁর পরবর্তী কৃপারাজি লাভ করতে সক্ষম হব না। সূরা ফাতিহার إِيَّاكَ نَعْبُدُ দোয়াটিও এদিকেই ইঙ্গিত করে যে, প্রথমে আল্লাহ্‌র দেয়া শক্তি-সামর্থ্যকে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করতে হয়, এরপর উৎকৃষ্ট ফলাফল লাভের জন্য আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করতে হয়। কাজেই, বাহ্যিক উপকরণাদি কাজে লাগানো আবশ্যক; এটি ভাবা মোটেও ঠিক নয় যে, দোয়া করলে উপায়-উপকরণ বা মাধ্যম ব্যবহার করা অপ্রয়োজনীয়। উপকরণ বা মাধ্যম খোঁজার কাজটি নিজেই এক দোয়া, আর দোয়া স্বয়ং এক মহান উপকরণ বা মাধ্যম। আল্লাহ্ তা’লার পবিত্র নবী-রসূলগণ তো আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকেই মিশন নিয়ে আসেন, আর তারা এ ব্যাপারেও নিশ্চিত থাকেন যে, চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই হবে; কিন্তু এক পর্যায়ে গিয়ে তারাও তো مَنْ أَنْصَارِي إِلَى اللَّهِ (সূরা আলে ইমরান: ৫৩) উচ্চারণে বাধ্য হন এবং আল্লাহ্‌র পথে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার আহ্বান জানান! অতএব, বাহ্যিক চেষ্টা-প্রচেষ্টা বা উপকরণ ব্যবহার আল্লাহ্ তা’লার নির্ধারিত প্রকৃতির নিয়মেরই অন্তর্ভুক্ত, তাই সেটি অবলম্বন করা উচিত এবং দোয়ার পাশাপাশি নিজের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত।

হুযূর (আই.) বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর এই মহান ধনভাণ্ডার থেকে আমি অল্প কয়েকটি কথা উপস্থাপন করলাম মাত্র, যাত্থেকে দোয়ার গুরুত্ব, তাৎপর্য, দোয়া করার পদ্ধতি, দোয়ার দর্শন- এসব বিষয়ের ওপর কিছু না কিছু আলোকপাত হয়; যদি আমরা এগুলো বুঝতে সমর্থ হই, তবে আমরা নিজেদের জীবনে এক বিপ্লব সাধন করতে সক্ষম হব, আল্লাহ্ তা’লার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে এক বিশেষ অবস্থা সৃষ্টি করতে পারব, আল্লাহ্ তা’লার কৃপারাজিকে আকর্ষণ করতে পারব। তাই আমাদের এই রমযানে চেষ্টা করা উচিত, আমরা যেন আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর নির্দেশাবলী পালনকারী হই, নিজেদের ঈমানকে দৃঢ়তর করতে থাকি, দোয়ার তাৎপর্য ও দর্শন অনুধাবন করি, নিজেদের কর্ম সংশোধনকারী হই এবং সেই মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হই- যাদের দোয়া আল্লাহ্ তা’লার দরবারে গৃহীত হয়। এই রমযান আল্লাহ্ তা’লার সাথে আমাদের সম্পর্ক সৃষ্টি ও আধ্যাত্মিকতায় এক বিপ্লব সাধনকারী হোক। (আমীন)।

হুযূর (আই.) পাকিস্তান ও আলজেরিয়াসহ পৃথিবীর যেখানেই কোন আহমদী আহমদীয়াতের কারণে বিপদ কবলিত, এমন ভাইদের জন্য দোয়ার আহ্বান জানান এবং বলেন, অন্যদের জন্য দোয়া করলে নিজেদের দোয়াও কবুল হয়; বরং অন্যের জন্য দোয়া করলে ফিরিশ্তারা সেই ব্যক্তির জন্য দোয়া করে এবং ফিরিশ্তাদের দোয়া অবশ্যই কবুল হয়। তাই আমাদের কেবল নিজেদের জন্য দোয়া না করে বিশেষভাবে অন্যদের জন্যও অনেক দোয়া করা উচিত; আল্লাহ্ তা’লা এই রমযানে আমাদেরকে এটিরও তৌফিক দান করুন। (আমীন)