শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ: হযরত উসমান বিন আফ্‌ফান (রা.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৯-জানুয়ারি, ২০২১

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৯শে জানুয়ারী, ২০২১ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবাতে হযরত উসমান বিন আফ্‌ফান (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করেন।
তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, হযরত উসমান (রা.) যেসব যুদ্ধাভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন আমি আজ তা বর্ণনা করছি। বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে যেভাবে পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে, হযরত উসমান (রা.) তাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি, কারণ তার স্ত্রী নবী-তনয়া হযরত রুকাইয়া (রা.) সেসময় গুরুতর অসুস্থ ছিলেন, এজন্য মহানবী (সা.) তাকে স্ত্রীর সেবা-শুশ্রূষার জন্য মদীনাতেই অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অবশ্য মহানবী (সা.) যুদ্ধলদ্ধ সম্পদে সমান অংশ প্রদানের মাধ্যমে তাকে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যেই গণ্য করেছেন। ৩য় হিজরীর সফর মাসে সংঘটিত গাতফানের যুদ্ধাভিযানেও হযরত উসমান (রা.) অংশগ্রহণ করতে পারেন নি, কারণ তখন মহানবী (সা.) তাকে মদীনার আমীর নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন। হুযূর (আই.) এই অভিযানের সংক্ষিপ্ত বিবরণও তুলে ধরেন। বনু গাতফানের কোন কোন গোত্র বনু সা’লাবাহ্ ও বনু মোহারিবের লোকেরা একজন নামকরা যোদ্ধা দ’সুর বিন হারেসের নেতৃত্বে মদীনায় আকস্মিক আক্রমণের অভিপ্রায়ে নজদের যি-আমর নামক স্থানে সমবেত হচ্ছিল। কিন্তু যেহেতু মহানবী (সা.) নিয়মিত শত্রুদের গতিবিধির খোঁজ-খবর রাখতেন, তাই তিনি বিচক্ষণ সেনানায়কের মত তাদের ষড়যন্ত্র বানচাল করতে আগাম পদক্ষেপ হিসেবে ৪৫০ সাহাবীকে সাথে নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হন। তাঁর (সা.) পৌঁছনোর খবর পাওয়ামাত্রই শত্রুরা আশপাশের পাহাড়গুলোতে আত্মগোপন করে। জব্বার নামক তাদের এক বেদুইন মুসলমানদের হাতে আটক হয়; তাকে মহানবী (সা.)-এর সামনে উপস্থিত করা হলে সে জানায়, বনু সা’লাবাহ্ ও বনু মোহারিবের লোকেরা কোন অবস্থাতেই উন্মুক্ত প্রান্তরে মুসলমানদের মুখোমুখি হবে না। অগত্যা নিরূপায় হয়ে মহানবী (সা.) সাহাবীদের নিয়ে যুদ্ধ ছাড়াই ফিরে আসেন, তবে তখনকার মত তাদের পক্ষ থেকে আক্রমণের আশংকা দূর হয়ে যায়।
৩য় হিজরীর শওয়াল মাসে উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এই যুদ্ধে হযরত উসমান (রা.) অংশগ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি গিরিপথের প্রহরায় নিয়োজিত তীরন্দাজ সাহাবীদের অনেকেই তাদের অবস্থান ত্যাগ করলে খালিদ বিন ওয়ালিদ, যিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেন নি এবং এই যুদ্ধে কাফিরদের অন্যতম সেনাপতি ছিলেন, তিনি কাফিরদের নিয়ে সেই গিরিপথ দিয়ে ঘুরে এসে মুসলমানদের ওপর পুনরায় আক্রমণ করেন এবং যুদ্ধের পরিণতি সাময়িকভাবে ঘুরে যায়। মুসলমানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন, এমনকি মহানবী (সা.)-এর পাশে কেবলমাত্র বারজন সাহাবী অবশিষ্ট থাকেন। কাফিরদের অন্যতম দক্ষ যোদ্ধা ইবনে কামিয়া মুসলিম-বাহিনীর পতাকাবাহক হযরত মুসআব বিন উমায়ের (রা.)-কে হত্যা করে এবং যেহেতু তার চেহারার সাথে মহানবী (সা.)-এর চেহারায় অনেক মিল ছিল, তাই সে হৈচৈ শুরু করে দেয় যে, সে মহানবী (সা.)-কে হত্যা করে ফেলেছে। এটি তার দুরভিসন্ধিও হতে পারে। এরূপ বিভ্রান্তিকর সংবাদে সাহাবীরা মানসিকভাবে প্রচণ্ড ধাক্কা খান; একদল সাহাবী হতোদ্যম হয়ে রণে ভঙ্গ দেন এবং মদীনা অভিমুখে ফিরে যান, আরেকদল ভগ্ন-হৃদয়ে যুদ্ধক্ষেত্রেই বসে ক্রন্দন শুরু করেন বা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকেন, আরেকদল রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর শাহাদতের খবর শুনে নিজেরাও নবীর পদাংক অনুসরণ করার বাসনায় প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন, যেন তারাও শাহাদত বরণ করতে পারেন এবং অনেকে শহীদও হন। ঘটনাচক্রে হযরত উসমান (রা.) প্রথমোক্ত দলে ছিলেন। উক্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং এই সাহাবীদের হৃদয়ের ঈমান ও নিষ্ঠা বিবেচনা করে আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনে তাদেরকে মার্জনা করে দেয়ার ঘোষণা প্রদান করেন। আল্লাহ্ তা’লা সূরা আলে ইমরানের ১৫৬ নং আয়াতে বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ تَوَلَّوْا مِنْكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوا وَلَقَدْ عَفَا اللَّهُ عَنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ

অর্থাৎ, ‘যেদিন দু’দল পরস্পর মুখোমুখি হয়েছিল, সেদিন তোমাদের মধ্যে যারা পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করেছিল, নিশ্চয় শয়তান তাদের কোন কোন কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে পদস্খলিত করার চেষ্টা করেছিল। এবং অবশ্যই আল্লাহ্ তাদেরকে মার্জনা করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ্ অতীব ক্ষমাশীল, পরম সহিষ্ণু।’

হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়েও হযরত উসমান (রা.)’র বিশেষ সেবা ও ভূমিকা ছিল এবং তাকে কেন্দ্র করেই বয়আতে রিযওয়ানের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। হুযূর (আই.) এই ঘটনাগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করেন। ৬ষ্ঠ হিজরীতে মহানবী (সা.) স্বপ্নে দেখেন, ‘তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ কা’বা শরীফ প্রদক্ষিণ করছেন এবং তাদের মাথার চুল মুড়ানো বা চুল ছোট করে ছাঁটা, যা উমরার সময়ে করা হয়ে থাকে’। মহানবী (সা.) এটিকে উমরা পালনের জন্য এক ঐশী ইঙ্গিত মনে করেন এবং যুল-কা’দা মাসে ১৪০০ সাহাবীসহ উমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা-অভিমুখে যাত্রা করেন। যেহেতু তখনও মক্কাবাসীদের সাথে মুসলমানদের কোন সন্ধিচুক্তি হয় নি, বরং এর পূর্বে যুদ্ধই হয়েছিল এবং তাদের পক্ষ থেকে বাধার সম্মুখীন হওয়ারই সমূহ্ সম্ভাবনা ছিল, তাই মহানবী (সা.) আরবের ঐতিহ্য অনুসারে যুদ্ধের জন্য নিষিদ্ধ মাসগুলোতেই যাত্রা করেন এবং কেবল খাপবদ্ধ তরবারি ছাড়া সাহাবীদের কোন যুদ্ধাস্ত্র বহন করতেও নিষেধ করেন। মহানবী (সা.) যে কোন মূল্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত রাখতে চাইতেন। যুল-হুলাইফা নামক স্থানে গিয়ে মহানবী (সা.) কুরবানীর জন্য আনা ৭০টি উটকে মালা পরানোর এবং সাহাবীদেরকে ইহরাম বাঁধার নির্দেশ দেন, যেন যে কেউ সহজেই বুঝতে পারে, তারা উমরা পালনের উদ্দেশ্যে এসেছেন। মহানবী (সা.) সাহাবীদের একটি দলকে গোপনে মক্কাবাসীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠান, পাছে তারা আবার কোন অনর্থ না ঘটিয়ে বসে এবং মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ না শুরু করে দেয়। এদিকে মহানবী (সা.) আরও কিছুটা অগ্রসর হবার পর জানতে পারেন, মক্কাবাসীরা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে রয়েছে এবং তারা কোন অবস্থাতেই মুসলমানদের মক্কায় প্রবেশ করতে না দিতে বদ্ধপরিকর; এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ চিতাবাঘের খোলস পরে নিয়েছে, যা চরম যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ ছিল। ইতোমধ্যে হুদাইবিয়া পৌঁছে মহানবী (সা.)-এর উট কাসওয়া বসে পড়েছিল। সাহাবীরা মন্তব্য করেন, উটটি সম্ভবত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে; কিন্তু মহানবী (সা.) বলেন, ‘না, না! এটা ক্লান্তও হয় নি, আর এভাবে বসে পড়াটা এর স্বভাবও না! বরং আসল বিষয় হল- সেই মহান সত্ত্বা, যিনি হস্তী-বাহিনীর হাতিদের মক্কাভিমুখে অগ্রসর হতে বাধা দিয়েছিলেন, তিনিই এই উটকেও বাধা দিয়েছেন।’ তিনি (সা.) আরও বলেন, ‘আল্লাহ্‌র কসম! মক্কার কুরাইশরা পবিত্র মাস ও শহরের পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য আমার কাছে যে দাবীই জানাবে, আমি তা মেনে নেব।’ তিনি (সা.) হুদাইবিয়াতেই শিবির স্থাপন করেন। খুযা’আ গোত্রের একজন খ্যাতনামা নেতা বুদায়ল বিন ওয়ারকা সেখানে মহানবী (সা.)-এর সাথে দেখা করতে আসে এবং জানায়, কুরাইশরা তো চরম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। মহানবী (সা.) তখন খুবই শান্তভাবে তাকে বুঝান যে, তিনি যুদ্ধ করতে আসেন নি, বরং শান্তিপূর্ণভাবে উমরা পালনের উদ্দেশ্যে এসেছেন এবং শান্তির খাতিরে কুরাইশদের সাথে যেকোন চুক্তি করতে প্রস্তুত; কিন্তু যদি তারা হঠকারিতা প্রদর্শন করে তাদেরকে কা’বা শরীফে যেতে বাধা দেয় এবং যুদ্ধ বাধাতে চায়, তবে তিনি (সা.)-ও সাহাবীদের নিয়ে প্রাণপণ লড়াই করে হলেও মক্কায় প্রবেশ করবেন এবং উমরা পালন করবেন। তাঁর (সা.) এই আবেগ ও নিষ্ঠাপূর্ণ বক্তব্যে বুদায়ল খুবই প্রভাবান্বিত হয় এবং বলে, সে গিয়ে মক্কাবাসীদের বুঝানোর চেষ্টা করবে। বুদায়ল মক্কায় গিয়ে মহানবী (সা.)-এর প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে, এসব শুনে মক্কাবাসীরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল মুসলমানদের উমরা পালনের সুযোগ দেয়ার পক্ষপাতি ছিল, অপর দল এর সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। তখন উরওয়া বিন মাসঊদ নামক এক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি তাদের পক্ষ থেকে মহানবী (সা.)-এর সাথে আলোচনা করতে আসে; সে-ও মহানবী (সা.)-এর কথা শুনে প্রভাবিত হয় এবং কুরাইশদেরকে উমরার সুযোগ দিতে বলে। একে একে হুলায়স বিন আলকামা, সুহায়ল বিন আমর, মিকরায বিন হাফস প্রমুখ নেতৃবৃন্দও আলোচনার জন্য আসে; হুলায়স তো মুসলমানদের উমরা করতে দেয়ার পক্ষে কুরাইশদের সামনে জোরালো বক্তব্যও রাখে। যেহেতু কুরাইশদের পক্ষ থেকে একের পর এক দূত আসছিল, তাই মহানবী (সা.)-ও তার পক্ষ থেকে খিরাশ বিন উমাইয়া (রা.)-কে দূত হিসেবে কুরাইশদের বুঝানোর জন্য মক্কায় পাঠান। কিন্তু ইকরামা বিন আবু জাহল ও আরও কিছু চরম বিদ্বেষী কুরাইশ খিরাশের উটের ওপর আক্রমণ করে বসে। তাদের এরূপ নৃশংস আচরণ সত্ত্বেও মহানবী (সা.) শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে এবং কুরাইশদের উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য ও তাদেরকে সুপথে আনার উদ্দেশ্যে এমন কোন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে মক্কায় প্রেরণ করতে মনস্থ করেন, যিনি মক্কারই বাসিন্দা এবং কুরাইশদের কোন সম্ভ্রান্ত গোত্রের সদস্য। মহানবী (সা.) হযরত উমর (রা.)-কে একাজের জন্য যেতে বললে তিনি হযরত উসমান (রা.)-কে পাঠানোর পরামর্শ দেন, কারণ মক্কাবাসীরা উমর (রা.)’র চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছিল এবং তখন মক্কায় তার গোত্রের কোন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তিও ছিল না; অন্যদিকে হযরত উসমান (রা.)’র গোত্র বনু উমাইয়া তখন মক্কার কর্তৃত্বে ছিল এবং মক্কাবাসীরা উসমান (রা.)-কে কিছু করার মত দুঃসাহসও রাখতো না। এই পরামর্শ মহানবী (সা.)-এর মনঃপুত হয় এবং তাঁর নির্দেশে উসমান (রা.) মক্কায় দূত হিসেবে যান। কুরাইশরা তার সাথে সৌজন্য প্রদর্শন করে এবং তাকে ব্যক্তিগতভাবে উমরা করার প্রস্তাব দিলেও মহানবী (সা.) ও সাহাবীদের সেই বছর উমরা পালন করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়। কিন্তু হযরত উসমান (রা.) ফিরে যেতে নিলে কতিপয় তরুণ ও বিদ্বেষী কুরাইশ তাকে আটকে রাখে ও তাকে হত্যা করার গুজব রটিয়ে দেয়, যেন মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বাস্তবিক অর্থেই যখন মুসলমানদের কাছে এই খবর পৌঁছে, তখন মহানবী (সা.) একটি বাবলাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন, যদি কুরাইশরা এই পবিত্র ও নিষিদ্ধ মাসে, পবিত্র শহর মক্কায় একজন দূতকে হত্যা করার মত জঘন্য কাণ্ড ঘটিয়ে থাকে, যা পৃথিবীজুড়ে চরম অসৌজন্যমূলক কর্ম বলে বিবেচিত, তাহলে মুসলমানরা তাঁর (সা.) হাতে এসে বয়আত গ্রহণ করে প্রতিজ্ঞা করুক যে তারা প্রাণের বিনিময়ে হলেও এই জঘন্য কাণ্ডের প্রতিশোধ নেবে এবং আমৃত্যু লড়াই করে হলেও মক্কা জয় করবে। মহানবী (সা.)-এর আহ্বানে সাহাবীরা পাগলপারা হয়ে একে অপরকে ডিঙিয়ে বয়আতে অংশ নেন; মহানবী (সা.) তাঁর বা হাতটি নিজের ডান হাতের ওপর রেখে হযরত উসমান (রা.)-কে প্রতীকীরূপে সেই বয়আতে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে বয়আতে রিযওয়ান নামে পরিচিত, যাকে সাহাবীরা অত্যন্ত সম্মান ও গর্বের ব্যাপার মনে করতেন, যেখানে সমগ্র মুসলিম শক্তি এক বিন্দুতে সমবেত হয়েছিল। এমনকি পবিত্র কুরআনের সূরা ফাতাহ্’র ১৯ নং আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা এই ঘটনার উল্লেখ করে বলেন,

لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا

অর্থাৎ, ‘নিশ্চয় আল্লাহ্ মু’মিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা একটি গাছের নীচে তোমার বয়আত করছিল, এবং তিনি তাদের হৃদয়ে যা ছিল তা অবগত ছিলেন, অতএব তিনি তাদের হৃদয়ে প্রশান্তি অবতীর্ণ করলেন আর তাদেরকে নিকটবর্তী বিজয় দান করলেন।’

কুরাইশরা যখন এই ঘটনা জানতে পারে, তখন তারা অত্যন্ত ভীত হয় এবং তৎক্ষণাৎ হযরত উসমান (রা.) ও তার সঙ্গীদের মুক্ত করে দেয়, এমনকি সাথে সাথে তাদের প্রতিনিধিদলও পাঠায় যেন কোনমতে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হয়ে যায়। অতঃপর হযরত আলী (রা.) লিখিত হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়; মুসলমানদের মধ্য থেকে হযরত আবু বকর, উমর, উসমান, আব্দুর রহমান বিন অওফ, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস ও আবু উবায়দা (রা.) এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন।
সন্ধির শর্তাবলী ছিল নিম্নরূপ:

“এ বছর পবিত্র কাবায় উমরা পালন না করেই মুসলমানগণ মদীনায় ফিরে যাবে। মুসলমানরা পরের বছর উমরা করতে পারবে। কিন্তু তিনদিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই তারা পরবর্তী বছর পবিত্র নগরীতে আসবে। এ সময় কেবলমাত্র কোষবদ্ধ তরবারী সঙ্গে আনা যাবে। মক্কায় বসবাসরত কোনো মুসলমানকে তারা সাথে করে মদীনায় নিয়ে যেতে পারবে না, আবার কোনো মুসলমান যদি মদীনা থেকে মক্কায় যেতে চায় তাকেও তারা বাধা দিতে পারবে না। যদি মক্কাবাসী কোনো মুসলমানও মদীনায় চলে যায় তবে তাকে হস্তান্তর করতে হবে, আর যদি কোনো মুসলমান মদীনা ছেড়ে মক্কায় আসে তবে মক্কাবাসীরা তাকে হস্তান্তর করবে না। আরবের অন্যান্য গোত্র স্বাধীনভাবে যে কোনো পক্ষের মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে। আর এই চুক্তির মেয়াদ হবে দশ বছর।”

হুযূর (আই.) বলেন, হযরত উসমান (রা.)’র স্মৃতিচারণ আগামীতেও অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ্।
খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) পুনরায় পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য দোয়ার প্রতি জামাতের মনোযোগ আকর্ষণ করেন এবং বিশেষভাবে দোয়া অব্যাহত রাখতে বলেন। হুযূর বলেন, এই দোয়া যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ইনশাআল্লাহ্ শীঘ্রই আমরা বিরুদ্ধবাদীদের দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি দেখতে পারব। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের দোয়া করার তৌফিক দান করুন এবং তা নিজ সন্নিধানে কবুল করুন। (আমীন)